অন্তঃপুরে দহন পর্ব ৫

0
487

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-5)

#আরশিয়া_জান্নাত

বিকেলের মিটিং শেষ করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছিল ওমর। অন্যসময় বসের গাড়িতেই ফেরা হলেও আজ বস অন্য এক মিটিং এটেন্ড করতে যাচ্ছেন বলে পার্সোনালী যেতে হচ্ছে তাকে। মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করার উপায় নেই। পড়ন্ত বিকেলের এই সময়টাতে রাস্তায় বেশ জ্যাম থাকে। খালি সিএনজিও পাওয়া যাচ্ছেনা তাই কিছুটা হেঁটেই সামনে এগুচ্ছিল তখনই দেখা হলো তাইয়্যেবার সাথে! তাইয়্যেবা তার বিখ্যাত অমায়িক হাসি দিয়ে বললো, কথায় বলে বহুবছর পর যদি একবার দেখা হয় তবে সেটা কয়েকদফায় চলতে থাকে। তোমার সাথে ফের দেখা হয়ে গেল!
ওমর অপ্রস্তুত গলায় বলল, হ্যাঁ তাই তো দেখছি! অবশ্য ঢাকা শহর এতোটাও বড় না যে আবার দেখা হবে না,,

এতো বড় না কিন্তু কই পাঁচ বছর তো দেখা হয় নি! যেই মুখোমুখি সাক্ষাত হলো ফের দেখা হচ্ছে,, হিহি

ওমরের কান লাল হয়ে গেল। মেয়েটা কথায় কথায় এমন হাসে বলেই প্রতিটা হাসিতে তার হার্টবিট মিস হয়ে যেত। এখনো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এই যে একটু আগে অফিস ফেরার তাড়া, রাস্তার জ্যাম দেখে অস্থিরতা সব যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল তাইয়্যেবার মুখ দর্শনে!

তা কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?

অফিসে,, তুমি?

জ্যাম দেখতে বেরিয়েছি।

মানে?

মানে আর কি! আমি স্পেসিফিক সময়ে জ্যাম দেখতে বের হই। ফুট ওভার ব্রীজে দাঁড়িয়ে নীচের ব্যস্ত নগরী দেখি। হালকা আলো হালকা রাতের আঁধার অর্থাৎ সন্ধ্যা নামার ক্ষণে রাস্তা দেখতে আমার বেশ লাগে!

কি বলে! যানজট দেখতেও কারো ভালো লাগে?

যাদের তাড়া থাকে তাদের ভালো লাগে না। আর গাড়িতে বসে যানজট অসহ্য লাগলেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে অতোটা বিদঘুটে লাগেনা। ইনফ্যাক্ট মজাই লাগে। একদিন সময় বের করে এসো আমার সঙ্গে। বুঝবে কত ভালো লাগে! সবসময় ধরাবাধা নিয়মে আটকে না থেকে এলোমেলো অপ্রয়োজনীয় কাজ করবে। দেখবে বেঁচে থাকাটা মন্দ নয়! যাই হোক তোমাকে আটকে সময় বরবাদ করছি। যান মহাব্যস্ত মানুষ আপনার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ওমর হাতঘড়িটা দেখে বললো, আসলেই দেরী হয়ে যাচ্ছে। ফের দেখা হবে আল্লাহ হাফেজ।

তাইয়্যেবা কানে ইয়ারফোন গুজে ফের চলতে লাগলো তার গন্তব্যে। ওমরের খুব ইচ্ছে হলো তাইয়্যেবার সঙ্গ ধরার। কিন্তু কেন যেন পারলো না। এমন না এখন অফিস না গেলে বিশেষ ক্ষতি হবে। কিন্তু বর্ণচোরা ছেলেটা চাইলেই নিজের মর্জিমতো চলতে পারে না,,,,

তাইয়্যেবা তার কলেজ জীবনের এক অধরা অপ্সরা। শ্যাম বর্ণের হরিণী চোখের মেয়েটার মায়ায় পড়তে বেশি সময় লাগে নি তার। তাইয়্যেবার গলার স্বর এতোটাই স্পষ্ট আর সুন্দর যে কেউই তার কথা শুনে প্রেমে পড়বে নিশ্চিত। ওমর তাকে প্রথম দেখেছিল কলেজের বসন্তজয়ন্তীতে। মঞ্চে বসে যখন “হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ পাখিটি ছাড়িলো কে,,,,,” গানটি গাইলো ওমর মুগ্ধ হয়ে গেল। এই গানটার সুর সবার গলায় সুন্দর করে ফোটে না। ওমরের ব্যক্তিগত মতামত অন্তত এটাই বলে। অথচ তাইয়্যেবার গলায় কি সুন্দর করেই না ফুটে ওঠেছিল। সেই ভরা মজলিশে ওমর প্রথমবার কোনো মেয়ের জন্য বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা অনুভব করেছিল। সেই থেকেই তাইয়্যেবা তার স্বপ্নের রাজকুমারী। দুজনেই কলেজের ভলেন্টিয়ারের সদস্য হবার সুবাদে কথোপকথন হতে বেগ পায় নি। টুকটাক আড্ডা কিংবা কাজের সুবাদে কথাবার্তা এভাবেই বেশ ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ইন্টার শেষে ভার্সিটি বদলায় তবুও বহুদিন অবধি যোগাযোগ থাকলেও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই একই শহরে থেকেও দেখা করা হয়ে উঠেনা।সেদিন কফিশপে বহুদিন পর দেখা হওয়াটা যতোটা আনন্দ দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছিল বিল দিতে গিয়ে যখন দেখলো ওয়ালেট খালি! মেয়েটা কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছিল ব্যাপারটা। নিজেই বিল পে করে হেসে বলেছিল, বহুবছর পর দেখা হলো তাই ট্রিট দিলাম। অন্তত খরচার ভয়ে দেখা করতে যেন পিছপা না হও সেই বন্দোবস্ত করলাম!

ওমরের বুকটা এখনো ধুকপুক করছে। চারদিকের হর্ন কোলাহল কিছুই যেন তার কানে যাচ্ছেনা। মনের গহীনে কেবল একজনের অস্তিত্ব সর্বস্ব জুড়ে প্রতীয়মান। আরকিছুই তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছেনা আপাতত।


শামীমা সতর্কতার সাথে অনীলের প্লেটে ভাত তরকারি পরিবেশন করছে। গ্লাসে পানি ঢেলে সালাদের প্লেটটা সামনে রেখেই চেয়ার টেনে বসেছে।
অনীল প্রথমে ভাজা টাইপ আইটেম দিয়ে খাওয়া শুরু করে। তারপর মরিচে কামড় দিতেই হিচকি তুলতে তুলতে পানি খায়। এটা তার রোজকার ঘটনা। শামীমা বুঝেনা ঝাল যেহেতু খেতেই পারে না অযথা মরিচ নেয় কেন? পেয়াজ মরিচ সামনে না দিলে আবার রক্ষে নেই। তাই পানির গ্লাস পরিপূর্ণ করেই সামনে রাখে।
অনীল বেশ আয়েশী ভঙ্গিতেই খাবার খাচ্ছে। তারপর খেতে খেতেই বললো, খুব ভালো ছেলের সন্ধান পেয়েছি। পুরান ঢাকার স্থানীয়। ছেলে কদিন পর বিদেশ চলে যাবে তাই যাওয়ার আগে বিয়ে করিয়ে বৌসহ পাঠাতে চাইছে মা-বাবা। ভালো ইঞ্জিনিয়াররা কি আর বাংলাদেশে পড়ে থাকে? ওরা বিদেশ গিয়ে সেটেল্ড হয়ে যায় দেশে আর ফিরে না। ছেলের বাবার বুদ্ধি আছে বলতে হয়। দেশী মেয়ে বিয়ে করানো মানে দেশে একবার হলেও ফেরার একটা চান্স হাতে রাখা। অন্তরার ছবি ওরা দেখেছে। আমার মেয়েকে পছন্দ করবে না এমন কেউ আছে নাকি? তবুও বলেছি শুধু ওদের পছন্দ হলে হবেনা। আমার মেয়েরও পছন্দ অপছন্দ আছে। তাই সামনের শুক্রবার ওদের আসতে বলেছি। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তবে এই মাসের মধ্যেই বিয়ের বন্দোবস্ত করে ফেলবো!

বলছি কি এতো দূরে মেয়েকে পাঠিয়ে আপনি থাকতে পারবেন? মেয়েকে তো একটা রাতও একা ছাড়েন নি কারো বাসায়। এমনকি ওর ফুফুর বাড়িও যেতে দেননা!!

অনীল কিছুটা দমে গিয়ে বললো, এই কথা সত্যি অন্তরাকে না দেখে আমি থাকতে পারিনা। কিন্তু দেশে থেকেও করবে কি? ঐখানে শ্বশুরবাড়ির প্যারা থাকবে না। স্বামী স্ত্রী একা থাকবে। উন্নত দেশে কোনোকিছুরই অশান্তি নাই। মেয়ের সুখের জন্য এইটুকু স্যাক্রিফাইজ আমি করতেই পারি। আর এখনের যুগে এসব বলে লাভ আছে? ইচ্ছে হলেই ভিডিও কল করা যায়, দেখা যায়। মন বেশি খারাপ লাগলে চলে যাবো মেয়েকে দেখতে, সমস্যা কি?

আপনি যা ভালো মনে করেন,

তা তো অবশ্যই আমার মেয়ের খারাপ তো আমি চাইবো না। তবুও তুমি ওরে জিজ্ঞাসা করিও পছন্দের কেউ আছে কি না। যদি থাকেও কিছু বলবা না। এখনকার ছেলেমেয়েকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে লাভ নেই বরং হিতের বিপরীত ঘটে। তুমি শুধু নরম হয়ে কৌশলে ভেতরের খবর বের করবা। বাকিটা আমি সামলাবো। কি বলেছি বুঝেছো? পারবা তো নাকি এটাও আমাকেই করতে হবে?

শামীমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সে ভালো করেই জানে মেয়ের পছন্দ থাকুক বা না থাকুক বিয়ে সেখানেই হবে যেখানে অনীল চায়। বাকি সবার মতামত কেবল নামমাত্র ফর্মালিটিস!!
শামীমা জিজ্ঞাসা করারো জো নেই ছেলের চরিত্র কেমন? ধার্মিক কি না? পরিবারের কোনো খারাপ রেকর্ড আছে কি না। কিংবা ছেলের কোনো বদঅভ্যাস আছে কি না! সে জিজ্ঞাসা করতে পারে না ছেলেটা মেয়েদের সম্মান করে তো? নাকি অনীলের মতোই ভোগ্যপণ্য ভাবে? সে এমন অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারেনা যা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগে প্রতিটা মায়ের জানা উচিত।
তবুও এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকে, অনীল নিজে বদ হলেও মেয়ের বেলা অনেক সচেতন। সে নিশ্চয়ই দশদিক বিবেচনা করেই এগোচ্ছে। নিজে খারাপ হলেই অন্যের খারাপ সহজেই চোখে পড়ে। আশা রাখি তারও পড়বে!
তবুও নিজের মনের খচখচানিটা রয়েই যায়। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিজের অবস্থানের অসহায়ত্ব ভেবে। আহারে সে নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ের ব্যাপার মতামত রাখার ও সাহস পেলো না,,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here