#অনুরাগে_অনুরক্তি
||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
রাত নেমেছে আকাশের বুকে। স্ট্রিট লাইটের সোনালি আলোয় আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে এক দম্পতির মধুময় মুহূর্ত। প্রিয় পুরুষটির বাহুবন্ধনে অচেনা নারীটি হৃদয়ে দহন জাগাচ্ছে অনুরক্তির। তবুও কিছু করার নেই।
মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। ধীর পদচারণায় রওনা হয় নিজ গন্তব্যের দিকে। বিল্ডিংয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়া রঙ-বেরঙের আলো কিংবা রাস্তার স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলোর মাঝেও টরেন্টো শহরটি ঘোলাটে, অন্ধকারচ্ছন্ন। সরব হয়েও কীভাবে যেন নীরব। কোলাহল আছে, তবে তা শুধুই যানবাহনের। মানুষ সময়ে সময়ে পথে থাকলেও যন্ত্রমানবের মতোই।
বর্তমানে প্রায় কানাডার স্থায়ী বাসিন্দাই অনুরম্যি। বসবাস ও কাজ করার অনুমতি পেয়েছে প্রায় দুই-আড়াই মাস হবে। এখানের নিয়মকানুন, সংস্কৃতির সাথে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে।
মাহমুদ মোস্তফার ল-ফার্মে বেশ ভালো স্থানেই আছে সে। ব্যক্তিগত ভাবে প্র্যাকটিস এখনও শুরু করেনি, করতেও বহু দেরী। তবে সব কাজেই তাকে রাখা হয়। শুধু পরিবার ছাড়াই নয়, ঝামেলা ছাড়াও জীবন তার।
অনুরক্তি আনমনেই ভাবে,
– এই পদে, এই জীবনে আসাটা কি আদৌ সহজ ছিল?
মনে পড়ে তার কয়েক মাস আগের করা যুদ্ধের কথা। এক প্রতারকের থেকে নিজের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার কথা। নীরব বেদনায় গ্রাস হয় তার হৃদয়।
–
অতীত,
মাহমুদ মোস্তফার কথা শুনে গোটা তিনটি রাত তা নিয়ে ভাবে অনুরক্তি। এতো বিচার-বিবেচনার পর তার বোধগম্য হয় তার তো ভাবার এখানে কিছুই নেই।
ভাবনা, দ্বিধা, সিদ্ধান্তহীনতা তখন আসে যখন পথ একাধিক হয়। যেখানে পথই খোলা শুধুমাত্র একটা সেখানে ভাবনার তো স্থানই থাকে না।
তার নিকট তো কোনো উপায়ই নেই। বাংলাদেশে ফিরলে আত্মহত্যা ব্যতীত পাড়া-পরশি তো দূরে থাক, নিজ আত্মীয়-স্বজনই তাকে আঘাত করা বন্ধ করবে না। শুধুমাত্র তাকে নয়, তার মা-বাবাও শেষ হয়ে যাবে তিক্ত বাণীর আঘাতে।
এর চেয়ে নিজে স্বার্থ বুঝে নেওয়াটাই উত্তম। আর এটা তো প্রতারকটার সাহায্য নয়, বরং নিজের অধিকার বুঝে নেওয়া।
সকাল হতেই অনুরক্তির ঘরে করাঘাত করেন আমিরা শাহিন ও আমের। সকাল সকালই হোটেল যেয়ে অনুরক্তির জিনিসপত্র বুঝে এনেছে আমের। মেয়েটা তিন দিন ধরে আমিরা শাহিনের যৌবন কালের পুরোনো পোশাকে দিবারাত্রি কাটাচ্ছে। অবশ্য সে চলে যেতে চেয়েছিল হোটেলে কিন্তু আমিরা শাহিন তাকে কিছুতেই যেতে দেননি।
এই তিনদিনে তিন মিনিটের জন্যও কথা হয়নি আমের ও অনুরক্তি। খুব বেশি বেরই হয়নি অনুরক্তি নিজের জন্য নির্ধারিত ঘরটি থেকে।
আমেরের করাঘাতেও ঘুম ভাঙে না অনুরক্তির। খাণিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজা খুলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমিরা শাহিন। অনুরক্তির মাথায় ওড়না, গায়ে ভালোভাবে কাঁথা জড়িয়ে আলতো চুমু খায় তার হাতের পিঠে। মেয়েটাকে কেন যেন বেশ আপন মনে হয় তার।
“Masha Allah! May Allah give all the happiness of the world to my child!”
আমেরকে লাগেজগুলো নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে ডাকেন তিনি। আমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই তার হ্যাজেল বর্ণের চোখ দু’টো স্থির মেয়েটির অতি সাধারণ চেহারায়। ক্যানো যেন এক অন্যরকম ভালো লাগা অনুভব করে। ভালো লাগে তার, জানতে ইচ্ছে করে এই নারীটিকে। হয়তো তার প্রতিদিন দেখা, জানা নারীদের থেকে অনেকটাই অন্যরকম হওয়ায়ই অনুরক্তির প্রতি তার এই কৌতূহল। সহাস্যমুখে তাকিয়েই থাকে সে, যদিও এখানে মুগ্ধতা বা মুগ্ধতার কোনো কারণ নেই।
আমিরা শাহিন ততক্ষণে অনুরক্তির জিনিসপত্র আলমারিতে তুলে রেখে ফেলেছেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে শুধান,
“আমি কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে আসি অনুর জন্য। তুমি একটু এই লাগেজ দু’টো আলমারির উপরে রেখে দেও।”
লাগেজ রাখবে আর কি আমের? তার হ্যাজেল মণি তো এই মেয়েটি থেকে সরছেই না। কী এক গভীর ঘুমে ডুবে আছে মেয়েটা! যুবকের সহ্য হচ্ছে না তা, মনে হচ্ছে কিছু একটা করে ভ্রষ্ট করে দিতে নারীটির শান্তির ঘুম, চমকে দিতে নারীটিকে।
কিন্তু তার ভাবনা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই নড়ে উঠলো অনুরক্তি। মিটমিট করে চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। আমেরও নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে নিল।
ঘুম থেকে উঠে আমেরকে দেখে অবাকই হয়ে যায় রমণী। ওড়না মাথায় দিয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে বসে।
“আপনি এখানে মিস্টার হ্যাজেল আইজ?” বলেই জিভে কামড় দেয় সে।
আমেরও অবাক হয়ে অনুরক্তির দিকে তাকায়। কিঞ্চিৎ হাসির আগমন হয় তার মুখে। মনে মনে আওড়ায়, “Mr. Hazel Eyes!”
“Sorry! I wanted to say Mr. Amer!” তড়িঘড়ি করে শুধায় অনুরক্তি।
“তুমি আমাকে মিস্টার হ্যাজেল আইজ বলেই ডেকো। It sounds nice! And I was helping to keep your luggage.”
এর মধ্যেই আমিরা শাহিন চা নিয়ে হাজির হন। চা পান করার মাঝেই অনুরক্তি নিজের সিদ্ধান্ত জানায় তাকে।
“Cool Anu! তুমি আমাকে এড্রেসটা বা ফোন নাম্বারটা দাও তার। আমি আজকেই যাবো তার সাথে কথা বলতে।”
অনুরক্তি নিজের কাছা থাক সায়ানের সকল তথ্য আমেরকে জানায়।
–
একটা কফিশপে বসে আছে আমের ও সায়ান দু’জনেই। আমের কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই নিজের প্রস্তাব খুলে বলে।
আমেরের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় সায়ান। এমা জানে না তার প্রথম বিবাহ এবং বিশ্বাসঘাতকতার কথা। এ কাজে সায় দেওয়া মানে তাকে জানানো অনুরক্তি তার আইনত স্ত্রী।
কিছুটা আমতা আমতা করে সে জানায়,
“Sorry, I can’t help in this.”
“One woman has wasted her 7 years only for you. Now you are being such an a******!” চাপা ক্ষিপ্ত কণ্ঠ তার। ক্রোধে শক্ত হয়ে উঠেছে আমেরের মুখশ্রী ইতিমধ্যে।
“You are not understanding. My wife and kid doesn’t know anything about that marriage. Doing this would be letting them know about Anurokti.”
বাঁকা হেসে নিজের কার্ডটি সামনে বসা পুরুষটির দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলে,
“Okay. Then you have handle the case we will throw on you about mental harassment, not providing for your partner, cheating! My father is one of the well-known lawyer in Toronto. You are surely going to lose at least one third of your assets or maybe everything you own.”
কথাটা হাস্যকরই শুনায় সায়ানের কাছে। যে নারী নিজের জীবনের সাত বছর তার জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে নষ্ট করেছে সে আর যাই হোক তার ক্ষতি অবশ্যই করবো না।
“How will you do it? Anurokti loves me more than anything in this world? She is not going to stand against me.”
“We will see that. Remember to take my card. Because soon you will need me.” কালো রোদচশমায় হ্যাজেল বর্ণের চোখ দুটো আড়াল করে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে আমের।
এর দু’দিন বাদেই সায়ানের বাড়িতে ও অফিসে অফিশিয়াল কাগজ চলে যায়। এমাও সব জানতে পেরে ভীষণ ভড়কে যায় স্বামীর উপর। সায়ানের মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ে, সে বিশ্বাসই করতে পারে না অনুরক্তি এমনটা করতে পারে। বোধ করে হয়তো তার মতো ঐ নিখাঁদ ভাবে ভালোবাসা নারীটিও নিজ স্বার্থ বুঝে নিতে শিখেছে। ভয়ও পায় ভীষণ। এমনটা হলে যে চাকরিটাও যাবে।
দ্রুতো আমেরের দেওয়া কার্ডটি খুঁজে বের করে। তার নম্বরে কল করে জানায় সে রাজি।
অতঃপর অনেক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অনুরক্তি থাকার ও কাজ করার অনুমতি পায় কানাডায়।
বর্তমানে,
বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছিয়েছে অনুরক্তি। বেল বাজাতেই আমিরা শাহিন এসে দরজা খুলে দেন।
“Welcome home, darling!”
“Thank you anne.”
ইদানীং অনুরক্তি আমিরা শাহিনকে ‘আন্নে’ বলেই সম্বোধন করে। মাকে তুর্কিরা সাধারণত ‘আন্নে’ বলেই থাকে। আমের তো কখনও বলেনি, তাই এই অচেনা কন্যাটিকে দিয়েই সখ পূরণ করছেন আমিরা শাহিন। অবশ্য বিশেষ এক কারণ আছে এর, যা প্রকাশে তিনি অনিচ্ছুক।
এই ভিনদেশে অনুরক্তি বনবাসিনী হলেও শান্তিপূর্ণ একটি জীবন আছে তার। নেই কারো খোঁটা, নেই প্রিয় মানুষদের মলিন মুখ, নেই অর্থের অভাব, নেই চিন্তা বিয়ের।
একদম বিরস জীবনও না তার। সকাল কাটে তার নিজের আন্নেকে কাজে সাহায্য করতে করতে, রাত অবধি কাজে ব্যস্ততা, বাড়ি ফিরে মাহমুদ মোস্তফার যৌবনের স্মৃতিচারণ শুনে।
আর ছুটির দিন শুরু হয় দুপুর থেকে আন্নের সাথে mercimek kofte, İskender kebap, baklava, Yaprak dolma সাথে আবশ্যক ভাবে তুর্কিশ রাইস রান্না করতে করতে। এরপর মাহমুদ মোস্তফা, আমিরা শাহিন, আমেরের সাথে টেবিল টেনিস বিকাল থেকে রাত হয়ে যায়। তখন হয় নাশিদ গানের সাথে বার্বিকিউ পার্টি ব্যাকয়ার্ডে।
এছাড়া মিস্টার হ্যাজেল আইজের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী তো আছেই। অভাব শুধু একান্তই আপন কারোর বা নামযুক্ত সম্পর্কের মানুষের।
আমিরা শাহিন অনুরক্তির হাসির আড়ালে উদাসীন মুখ সহজেই ধরে ফেলে। কফি হাতে দিয়ে খুব সাধারণ কিন্তু কঠিন এক প্রশ্ন করে অনুরক্তিকে।
তা হলো,
“তুমি সত্যিই ভালো আছো তো এখানে অনু?”
“ভালো আছি কি না জানা নাই। তবে আপন শান্তিতে আছি।
ভালো থাকা থেকে শান্তিতে থাকা প্রয়োজনীয়, মানুষ যেদিন এই সত্য অনুধাবন করবে সকল সেদিনই জীবনটা স্বচ্ছ পানির মতো সহজ বোধ হবে।”
চলবে…