অনুরাগে অনুরক্তি পর্ব ২

0
1604

#অনুরাগে_অনুরক্তি
||২য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ছেলেটা তো ঠিকই দেশে বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে! আর তুই! প্রায় ত্রিশের ঘরে বয়স এমন বুড়ি মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আমাদের বুকে বসেই থাকবি সারাজীবন।”

মমতাময়ী মায়ের তিক্ত বাণী শুনে অসহ্য যন্ত্রণায় বুদ্ধিহত লাগছে অনুরক্তির।

“আপা, ঐ ছেলে নাহয় শয়তান ছিল। ধোঁকাবাজি করেছেই না হয়, তোর মেয়েকে কে বলেছিল গাঁধার মতোন অপেক্ষা করতে? আজকাল তো চার-পাঁচ বছরের প্রেমিক কিংবা স্বামীর জন্যও মানুষ অপেক্ষা করে না। আর তিনি সাতটা বছর নষ্ট করে বসে আছেন। হুহ!” ভেঙচি কাটলেন অনুরক্তির ছোটো খালা।

অনুরক্তি চোখ দু’টো এবার শুধু বাবার দিকে স্থির। তিনি ক্লান্ত, বিরস মুখে সোফায় বসে আছে শুধু, তার মুখে একটু শব্দও নেই।

“কী হলো ভাইজান? কিছু বলছেন না ক্যানো? এতোদিন তো আপনাকে কম বলিনি জোর করেই বিয়েটা করিয়ে দেন মেয়ের! এখন রাখেন মেয়েকে আইবুড়ো করে!”

মেঝো বোনের ঝাঁঝালো গলা শুনে অনুরক্তির বাবা কিছু একটা বলতে নিয়েও বলতে পারে না। বুকে হাত দিয়ে হাসফাস করতে শুরু করেন। ভদ্রলোকের এমনিতেও উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সমস্যা আছে, মেয়ের এই করুণ জীবনদশা বোধহয় সহ্য করতে পারেননি।

সকলে ছোটোছুটি করে তাঁকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের দিকে। তবে অনুরক্তির হাজারও আহাজারির পরও তার মা সাথে নিলেন না। সবার কাছেই বাবার এমতাবস্থার জন্য দোষী সে, যা সত্য বৈকি মিথ্যা নয়।

অনুরক্তি একা পড়ে রইলো শূন্য বাড়িতে। এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। কাফনের শুভ্র কাপড় পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিল নিমিষেই। লাল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল তার গোটা হাত। খাণিক বাদেই চোখের সম্মুখে অন্ধকার। আবছা দৃষ্টি, জড়ানো কণ্ঠে চেতনা না হারানোর আগে শুধু একটি কথাই উচ্চারণ করে সে, “তোমায় শুধু ভালোবাসিনি, নিবিড়ভাবে আপনও করেছিলাম সায়ান।”

ইশ! কঠোর অপেক্ষা, নিখাঁদ প্রেম, বিশ্বস্ততার জন্যে জীবনের কী কুৎসিক এক রূপই না দেখতে হলো অনুরক্তিকে। তবুও অনুরাগে অনুরক্তি তার খাণিকটাও কমলো না।

নিদ্রা ভঙ্গ হয় অনুরক্তির। সারা গা থেকে ঝরছে শীতল ঘাম। কী এক ভয়ংকরী স্বপ্নই না দেখলো!

নিজেকে সামলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। বিছানার ঠিক বা পাশেই বিশালাকার স্বচ্ছ কাচে ঘেরা জানালা, রাত নেমেছে কানাডার আকাশে। জীবনের এ ধাপে নিজেকে ছন্নছাড়া, দিকভ্রান্ত এক পথিকের মতো বোধ হচ্ছে। যার জানা নেই কোন পথে যাবে।

দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে সচকিত হয়ে চোখের নীরব অশ্রু মুছে ফেলে।

“আসলাম ঘরে!” বলতে বলতেই দ্বার খুলে প্রবেশ করেন আমিরা শাহিন। ছটফটে ভদ্রমহিলার সর্বপ্রথমই চোখে পড়ে অনুরক্তির ঘোলাটে চোখ, মলিন নত মুখশ্রী।

চিবুকে ধরে নত মুখ উঁচু করেন তিনি।

“কী গো মেয়ে? এমন মাথা নিচু করে আছো কেন? তোমার তো সামনে বিশাল এক যুদ্ধ, যোদ্ধাদের মাথা নোয়ানোর সুযোগ নেই। মনে থাকবে তো?”

মাথায় ঝাঁকায় অনুরক্তি। মরুভূমির তীব্র রোদে মাঝে সামান্য জলও অসামান্য তৃপ্তি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে মাতৃতুল্যা নারীটির সিক্ত স্পর্শও সামান্য জলের মতোই।

“চলো তোমাকে আমের আর তার বাবা ডাকছেন।”

বাড়ির পিছনে বেশ বড়ো ব্যাকয়ার্ড। একপাশে বার্বিকিউ স্ট্যান্ড রাখা ও ছোটো একটা ছাউনি ঘেরা কিচেন কাউন্টার। অপরপাশে বেশ কিছু চেয়ার এবং মাঝে টিটেবিল, সেখানেই বসে আছে আমের। পাশে বসে আছেন একজন অতি সুদর্শন ভদ্রলোক, তাঁর চোখ দুটোও অবিকল আমেরের মতোন হ্যাজেল রঙের।

হয়তো বাবার থেকেই এই সুন্দর বৈশিষ্ট্যটি পেয়েছে আমের। অবশ্য অনুরক্তি কোথায় যেন পড়েছিল হ্যাজেল চোখ সবচেয়ে অধিক পাওয়া যায় মিডেল ইস্ট, নর্থ আফ্রিকা, ব্রাজিল আর স্পেইনে। আর আমেরও বলেছিল তার বাবা মিডেল ইস্টের।

এসব ভাবতে ভাবতেই সকালের কথা মনে পড়ে যায় তার। বস্তুত আমেরের কথার অর্থ ভুল ভাবেই বুঝেছিল সে। আমের তার জন্য বলতে তার বাবার ল’ফার্মের জন্য থাকার আবেদন করেছিল। কারণ তার বাবার ল’ফার্মেও একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন। যেহেতু আমের ডাক্তার সামলায়, সেও সাহায্য করতে পারে না।

“Dad, here is my friend. I was talking about you to Dad.”

অনুরক্তির পাশে এসে দাঁড়ায় আমের। হাসি-খুশি ছেলেটা তার মুখেও মৃদু হাসি ফুটায় নিমিষেই।

“Oh! She is the girl for whom your ommi was crying! Such a crybaby your ommi is!” মাহমুদ মোস্তফা মুখ টিপে হাসতে শুরু করলেন।

“Böyle bir kaba! Onunla evlendikten sonra hayatım sona erdi! Babam onu ​​nasıl seçti? (তুর্কিশ- কেমন অসভ্য! তাকে বিয়ে করার পর আমার জীবনটা শেষ! আমার বাবা কিভাবে তাকে বেছে নিলেন?)”

“আপনার মা কোন ভাষায় কথা বলছেন একা একা?” অনুরক্তি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে আমেরকে।

“টার্কিশ ভাষায়। মাম বলছে ড্যাডকে বিয়ে করে তার জীবন শেষ। আসলে ড্যাড টার্কিশ বুজে না।”

“এই টুমি কী বলছো টার্কিশ ভাষায় আমার নামে আমিরা?”

“না, বলছিলাম মিস্টার মাহমুদ মোস্তফার মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই।”

“Can you guys stop now please! ড্যাড বলো না অনুকে তুমি হেল্প করতে পারবে কি না?”

“Child, look there is a way for you to stay here. You are legally that guy’s first wife, so with his little support and some procedures you can get the permission from government. If you wyour to do this, then I can help you. You are a law student, so you can work at my farm and pay me back.”

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে অনুরক্তির মাহমুদ মোস্তফার কথায়। যেই মানুষটি এতো জঘন্য প্রতারণা করেছে তার সাহায্য নিবে? তার আহত দৃষ্টি, দ্বিধা কীভাবে যেন বুঝে যায় আমের।

“Dad, is there any other way?”

“No, I don’t think so. ডিয়ার আমি জানি টুমি এখন অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছো। বাট প্র‍্যাকটিক্যালি ভাবো। But take your decision first, you have only 6 months time to stay here.”

মোস্তফা মাহমুদ কথাগুলো বলার মাঝেই তাঁর ফোনে কলরিংটোন বেজে উঠে। জরুরি কল হওয়ায় তিনি ফোন নিয়ে উঠে চলে যান।

“শোনো মা, আমার মনে হয় মিস্টার মাহমুদ মোস্তফার কথাই তোমার শোনা উচিত। যে মানুষটা এতো জঘন্য প্রতারণা করেছে তোমার সাথে, তার তো এটুকু প্রতিদান দেওয়া আবশ্যক। আর যদি না করে তুমি ওর নাম ধোঁকাবাজির মামলা করবে, আমরা পাশে থাকবো।” শেষের বাক্যটা বেশ ক্ষিপ্ত সুরেই উচ্চারণ করেন আমেরের মা।

অনুরক্তি নিজেকে সামলাতে পারে না। চোখের পানি লুকাতে সে বড়োই অপটু। মুখে হাত দিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় সে।

“আমি কীভাবে আবার ঐ বেইমানের মুখোমুখি হবো আন্টি? কীভাবে? আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। সত্যি পারবো না।”

“You don’t have to stand infront of him. I will talk to him on behalf of you.”

“তবুও ঐ বেইমানের সাহায্য নেওয়া!”

“Look Anu you are not taking any kind of help from him. এটা তোমার অধিকার স্ত্রী হিসেবে তোমার স্বামীর সাথে থাকার। তোমাকে ও বিয়ে করেছে, তালাক দেয়নি এখনও। তবুও একটি হকও তোমাকে দেয়নি। এবার তোমার খুশির জন্য তোমাকে তোমার হক বুঝে নিতে হবে। আর যদি রাজি না হয়, তাহলে আরও একটা কেস তো তৈরিই আছে তার নামে! Think practically please!”

আমেরের হ্যাজেল রঙের চোখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনুরক্তি। এ জীবন কোন প্রান্তে এনে দাঁড় করালো তাকে?

অনুরক্তির কি করা উচিত? ঠিক হবে ঐ বেইমানটার কোনো রূপ সাহায্য কিংবা অধিকারই নেওয়া? আর সে রাজি হলেও কি সায়ান রাজি হবে এ কাজে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here