“বিয়েটা তবে করেছেনই সায়ান?” নোনাজলে টইটম্বুর চোখ দুটো অনুরক্তির। দীর্ঘ সাতটি বছর যার অপেক্ষায় কাটিয়েছে সেই স্বামী নামক পুরুষটি যদি প্রতারণা ও বিরহ নিয়ে হাজির হয়, তবে যে কোনো নারী বা পুরুষই ভাঙবে।
“অনু, তুমি…”
সায়ানের সোনালি ফ্রেমের চশমা এঁটে থাকা চোখ জোড়ায় বিস্ময়। চাপা বিরহবেদনা কিংবা পুরোনো প্রেমের ঝাঁঝ কি আছে তাতে? কে জানে?
শেষবার অনুরক্তিকে দেখেছিল প্রাণবন্ত এক সদ্য যুবতী রূপে। কিন্তু আজকের অনুরক্তি পূর্ণাঙ্গ নারী, মুখে নেই প্রাণোচ্ছল হাসির ছিটেফোঁটাও, বরং স্পষ্ট পরিপূর্ণতা।
“অবাক হলেন বুঝি? বলেন তো কী সাত বছর আগের প্রণয়টা আপনি ভুলে গিয়ে ঠিকই নিজের দুনিয়া সাজিয়ে নিয়েছেন। আমি পারিনি। আপনার অপেক্ষা করে গিয়েছি, রোজ সকাল-সন্ধ্যায় আপনার প্রেমের আরাধনায় মশগুল থেকেছি এবং ভেবেছি আপনিয়ও… সবাই কতো বলেছে, শুনিনি। মা, বাবা, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ফিরিয়েছি আপনাকে বিশ্বাস করে। বুঝতে পারিনি অতীতের স্মৃতি কেউ মনে রাখে এতো কাল? অধ্যায় বদলানোর সাথে সাথে তাও মুছে যায়। আপনাকে পাগলের মতো সাতটা বছর ধরে অবিরাম খুঁজে গিয়েছি। কি বোকাই না আমি! কি বোকাই না! বুঝতে পারিনি আমার অনুরাগে আপনি হলেও, আপনার অনুরক্তিতেও আমি কখনও থাকতে পারিনি।”
অনুরক্তি ঘোলা ঘোলা চোখে বের হয়ে গেল, এলোমেলো পদচারণায়। পরনের শুভ্র মেঘ তুল্য রঙের শাড়িটার আঁচলটাও কানাডার বরফে ঢাকা জমিনে গড়াগড়ি খেতে খেতে ছুটে চললো পিছন পিছন।
সায়ানের চোখে এতো বছর হৃদয়ে বদ্ধ থাকা ঘোলাটে সব স্মৃতিগুলো একে একে চোখের সম্মুখে ভাসতে শুরু করে। তাঁর নয়ন যুগলেও স্থির হয় সূক্ষ্ম এক বিরহ যন্ত্রণার ছাপ, কোনো আক্ষেপ কিংবা গাঢ় অনুশোচনা।
কী বলে সান্ত্বনা দিবে সে অনুকে? কীভাবেই বা সে নিজের পক্ষে কোনো যুক্তি দিবে? কী বলবে? অপরিণত বয়সের আবেগ বা প্রেম ছিল বোধ হতেই তাই আকাশে ভাসমান মেঘের মতো অধরাই চলে গিয়েছে? তা তো ছিল না। তাদের পরিণত বয়সের শক্ত-পোক্ত প্রণয়, বোঝাপড়া ছিল৷ হয়তো পরিণয়ও ছিল বলার ক্ষেত্রে, কাজী অফিসে দুই সাইনের পরিণয়। যাকে সে এখন থেকে ঠিক দু’মিনিট আগেও মূল্যায়ন করেনি।
প্রণয়টা হয়েছিল স্কটল্যান্ড থেকে মাস খাণেকের জন্য বাংলাদেশে থাকা নিজের বংশের শেষ ভিটেমাটি বিক্রির কাজে যেয়ে। পরিচয় ফেসবুকের একটি গ্রুপে। তারপর একদম দেখে, শুনে, চিনে, বুঝে, ধীরে ধীরে। একদম পারফেক্ট ম্যাচ চয়ন যাকে বলে। অনুরক্তি ছিল বাবা-মায়ের না শুধু, গোটা বংশের একমাত্র কন্যা। তাই কন্যার মোহে হার মেনে পরিবারও মেনে নেয়, অবশ্য যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলেই সায়ান। কিন্তু বাংলাদেশে যার পরিবার বা কিছুই নেই সেখানে বাবা-মার ভয় থাকাটা স্বাভাবিকই ছিল, আর ভয়টা সত্যও হলো।
এই নাম মাত্র বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হলেও সংসার তাদের এক মুহূর্তেরও হয়নি। কথা ছিল স্কটল্যান্ডে ফিরে বাবা-মাকে জানাবে অনুরক্তির বিষয়ে। কিন্তু এয়ারপোর্টে থেকে বাড়ির দিকে যাত্রাপথে রোড এক্সিডেন্টে বাবা-মায়ের মৃত্যু। দুই মাস টানা কোমায়, জাগার পর তীব্র ডিপ্রেশনে ডুবে যাওয়া, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। একাকী থাকতে নিষেধ থাকায় খালার সাথে পাড়ি জমায় তাঁর আবাসস্থলে কানাডায়। তখনও ডিপ্রেশনে ডুবে।
এমার সাথে পরিচয় একজন সাইকাইট্রিস্টের কার্যক্ষেত্রেই। সেচ্ছাসেবী ছিল সে। অবশেষে ধীরে ধীরে সেড়ে উঠছিল ডিপ্রেশন, ভুলে যাচ্ছিল সব অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের পাতা, সাথে অনুরক্তির সব স্মৃতিও।
স্বার্থপরের মতো সব ভুলে বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে নেয় নিজের। একবার জানায়ও না অনুরক্তিকে। একটা বার অনুতাপও বোধ হয়নি তাঁর নিজের কাজে। বরং, মনে হয়েছিল অনুরক্তির থেকে হাজার গুণ ভালো এমা তার জন্য, একই সংস্কৃতির, আদুরে ও এক্সটোভার্ট প্রকৃতির। ভেবেছিল অনুরক্তিও নিশ্চয়ই এগিয়েছে জীবনে। তবে আজ যেন বিবেক হৃদয় নিংড়ে বের করে নিচ্ছে সকল অনুতাপ বোধ। তাঁর মনে হচ্ছে ছুটে যেতে অনুরক্তির পিছনে, ক্ষমা চাইতে নিজের জঘন্য পাপের।
তার ভাবনার মাঝেই এমা এসে কোমড় জড়িয়ে ঘাড়ে চুমু খায়। “Sweetheart, dinner’s ready. Shawn’s waiting for you.”
সায়ান নিবিড়ভাবে নিজেকে সামলে নেয়। একপলক রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঘরে ফিরে যায়। হ্যাঁ, সে স্বার্থপর, অনেকটাই স্বার্থপর। আগেও ছিল, এখনও আছে নিজ স্বার্থরক্ষায়। প্রকৃতপক্ষে হয়তো তার অনুরক্তিতে ঐ শুভ্র আচ্ছাদনে আবৃত নারীটি কখনওই ছিল না। শুধু সে-ই ছিল নারীটির অনুরাগে।
—-
অপরিচিত দেশের অপরিচিত রাস্তায় দিকভ্রান্তের মতো হাঁটছে অনুরক্তি। চোখ জোড়া হতে নেমে চলেছে নিরব অশ্ররা। গভীর, নিখাদ ভালোবাসার বিনিময়ে এমন পরিণতি কে-ই বা সামলে নিতে পারে?
তার মনের সাথে তাল মিলিয়ে গোটা পরিবেশটাই যেন বিধ্বস্ত হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা যেন নেমে গিয়েছে হঠাৎ করে। অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া আকাশে রাশি রাশি কালো বিশালাকার মেঘেরা ছোটাছুটি করছে বেসামাল হয়ে। বাতাসের গতিপথে পরিবর্তন হয়ে গতিবেগ বেড়ে গিয়েছে তিনগুণ হারে। এ যেন ঝড় কিংবা বজ্রঝড় আসার চিহ্ন।
কানাডার এই ভাগে এমন ঝড় আসা একদম নতুন কিছু না। রাস্তাঘাটে পূর্ব থেকেই লোক সরগম কম ছিল, এখন যারা ছিল তারাও দ্রুততার সাথে সরে যাচ্ছে।
কিন্তু অনুরক্তি যেন জানতে পারলো না কিছুই। সে তার মতোই হেঁটে চলেলো, শীতল বাতাসের তীব্রতায় শালটা গায়ে আরও ভালো ভাবে জড়িয়ে নিল শুধু। হৃদয়ে তৈরি শোক তার বোধগম্যতা, দৃষ্টিশক্তি ও অনুধাবন শক্তিকেও হয়তো অকার্যকর করে দিয়েছে।
বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। বাতাসের সাথে আসছে গাছের ছোটো বাকল-পাতা, ক্ষুদ্র নানা জিনিস। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকাও প্রায় অসম্ভব বর্তমানে। সদ্য হৃদয় ভাঙা নারীটির এবার যেন হুশ ফিরে। আশেপাশে কাকপক্ষীর আনাগোনাও নেই তখন।
আতঙ্কে তার গোটা দেহে শীতল ঢেউ বয়ে যায়। তবে কি আজ সব বিপদেরা এক সাথে আক্রমণ করেছে আজ? মানসিক চাপ, ভয়, দুশ্চিন্তায় মূর্তিমান সে।
“Hey miss! Hey! What are doing on the street now? Storm will be coming any time now!”
হঠাৎ এক ভিনদেশী পুরুষের চিৎকারে স্তম্ভিত হয়ে পিছনে ফিরে সে। তার ঠিক পিছনে একটি কালো মার্সিডিজ এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
এতোটাই শোক পেয়েছে আজ মুখ দিয়ে একটা শব্দও হয় না। কিছু আলোড়ন হয় শুধু।
“Ma’am are you dumb or what? Sit in the car, if you want to be safe.”
বলতে বলতে যুবকটি নেমে আসে গাড়ি থেকে। এমন সময় বাতাসের তেজে পাশের গাছের বড়ো এক ডাল পড়তে নেয় অনুরক্তির উপর৷ ছেলেটি হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে আনে তাকে। ঝড়ের প্রকোপ আরও বাড়ছে তখন। ধমকের সুরে তাকে বসতে বলে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে।
এবার কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে পায় অনুরক্তি। তবুও চুপচাপ বসে থাকে। পরিবেশের এমন অবস্থায় গাড়ি চালানো ক্রমান্বয়ে কঠিন থেকে কঠিন হয়ে উঠছে।
একটি কটেজ দেখতে পেয়ে গাড়ি থামায় যুবকটি। বর্তমানে নিকটস্থ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া জরুরি, বাড়ি বা গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো নয়।
“Hey! Let’s go to that cabin for now!”
মাথা নাড়ায় অনুরক্তি। গাড়িটা লক করে দু’জনে কটেজটির দিকে ছুটে যায়।
কটেজে কয়েকবার নক করেও কোনো সাড়া-শব্দ না পেলে। অনুমতি ব্যতীত একপ্রকার ডাকাতের মতোই প্রবেশ করে তারা। তাপমাত্রা আরও হ্রাস পেয়েছে। সামান্য শালে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া নিঃসন্দেহে অসাধ্য সাধারণের জন্য। আরও জড়োসড়ো হয়ে বসে সে শুভ্র কাউচে।
বুঝতে পারে পুরুষটি। কটেজের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালায় সে।
অনুরক্তি কৃতজ্ঞচিত্তে তাকায় পুরুষটির দিকে। শ্বেতাঙ্গ দেহে কালচে বাদামী মৃদু ঢেউ খেলানো চুল, লম্বাটে মুখের গড়ন, তবে হ্যাজেল রঙের চোখের মণি একবারের জন্য হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। চেহারাও খাণিকটা বুদ্ধিদীপ্ত ধরনের।
ছেলেটি নিজের মোবাইল ফোন দেখতে দেখতে আপন মনেই বলে উঠে,
“If you had listened to me on the first call, I would have reached home by now. And I could give you some warm clothes. Mum and dad will be so worried for me! Phone’s dead too.”
এ উক্তি শুনে অনুরক্তি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। এমন কেন সে? যারা তার সাহায্য করে কিংবা তার জন্য ভালো কামনা করে তাদের কখনওই বিনিময়ে ভালো কিছু দিতে পারে না? সাতাশ বছরের ভালোবাসার বিনিময়ে পরিবারকে বাজে আচারণ দিয়েছে মিথ্যে মরীচিকার পিছন ঘুরে, ছোটোবেলার বন্ধুদেরও দিয়েছে অপমান শুধু তার প্রণয়ের সত্যটা বলায়। আর এখন এই অচেনা যুবকটিও তার কারণেই বিপদে।
ঢুকরে কেঁদে উঠে সে। ছেলেটা হচকচিয়ে উঠে তাঁর কান্নার মৃদু শব্দে।
“What happened? Why are you crying? Hey!”
দুঃখের জোয়ারে ভেসে ছেলেটা যে কানাডিয়ান তাও ভুলে বসে সে।
“I am really really sorry. আমি সত্যিই ইচ্ছে করে করিনি কিছু। আপনি আমার সাহায্য করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন! আপনার মা-বাবাও আমার জন্য টেনশনে। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, তাদের কাছেও হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবো। ঝড় কাটলে সবার কাছেই ক্ষমা চাবো। সবার কাছে!”
“What!” ছেলেটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অনুরক্তি আরেক দফা হতাশ হয় নিজের কাজে।
“আপনি তো বাংলা বোঝেন না। সবাই ঠিকই বলে জীবনে কোনো কাজটাই ঠিক মতো করতে পারলাম না। ক্ষম চাওয়াটাও! I am saying I am sorry for what I did. And I’ll ask forgiveness from your parents too.”
“এই যে ম্যাম কে বলল আমি বাংলা বুজি না? হ্যাঁ কঠিন শব্দ হলে একঠু কম বুজি বা অতিরিক্ত ফাস্ট বললে বুজতে বা প্রোনানসিয়েশনে প্রবলেম হয়। But I can understand well!”
অনুরক্তি আশ্চর্য হয়ে তাকায় ছেলেটির দিকে। বাবা কিংবা মা বাঙালি হলেও চেহারায় একটু তার ধাঁচ থাকে সাধারণত, কিন্তু এই ছেলের মাঝে বাঙালিয়ানা চেহারার বিন্দুমাত্র নেই।
” I know what you are thinking. My dad’s ex was Bengali. Her father rejected him for being failed in learning Bengali. He is Turkish. So being insulted, he had promised himself to learn Bengali himself. Without that our whole family love Rabindra Sangeet. So here I am….”
“আপনার মা জানে তার এক্সের কথা? সে এলাও করেছে?’ ঝটপট প্রশ্ন অনুরক্তির।
“Yeah, she was my dad’s family friend and also a friend of his ex. Even my mum taught him bengali. Actually my granny’s from Bangladesh but grandpa’s a Middle Eastern and mum is a Canadian by born. She speaks in Bangla most of the time. Interesting story right! ”
অনুরক্তি আনমনেই ভাবে,
‘বাবা গো বাবা পুরাই সংকর জাতি থুক্কু সন্তান!’
“Are you saying something? By the way your name…?”
“অনুরক্তি।”
“অনুরতি, অনুতি। Forget it! আমি আপনাকে অনু বলেই ডাকি। I am Aamer Ryan Bin Mahmood Mustafa. In short Amer Ryan! Nice to meet you.”
“জী।”
অনুরক্তির ছোটো উত্তরে আর কথা আগাতে পারে না আমের। তাই এখানেই সমাপ্ত হয় কথোপকথন।
—
আজানের মধুর সুর কর্ণগোচর হয় অনুরক্তির। খাণিক অবাক হয়, আসার পথে আশেপাশে কোনো মসজিদ তো দেখেনি। বোধগম্য হয় ভিনদেশী পুরুষের মুঠোফোন থেকে আগত এ মধুর সুর।
“আমার উদুহ্ (ওজু) আছে। আমি সালাহ্ পড়ে নিচ্ছি।”
কোনোরকম মাথা ঝাঁকায় অনুরক্তি। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার অপরিচিত ভিনদেশী এক পুরুষের সাথে এক ছোট্ট কটেজে একাকী থাকায়। আবার শরীরটাও কেমন যেন লাগছে। তার উপর নিরব কান্নারা বারবার বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু খাণিক একাকীত্বও পাচ্ছে না মন ভরে কাঁদার জন্য।
ঘরের এক কোণে নামাজ পড়ে ফেলে সে। সালাম ফিরিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পায় কাউচে গা এলিয়ে দিয়েছে অনুরক্তি। কিন্তু অস্বাভাবিক ভাবে গা কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর, মৃদু গোঙাচ্ছেও যেন।
আমের কিছু একটা অনুধাবন করতে পেরেই দ্রুতো এগিয়ে গিয়ে কাউচের সামনে দাঁড়ায় নিজের হাত মোজা খুলে হাতটি রাখে রমণীর জ্বরের তেজে জ্বলন্ত প্রায় ললাটে। অনুরক্তি এবার আরও জোরালো ভাবে কেঁপে উঠে, হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়াতেই। পরমুহূর্তেই হাতের উষ্ণতা পেয়ে আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে হাতটি সহ মানুষটিকে।
বিড়বিড়ায়,
“বেইমান আপনি। বেইমান! এতো ভালোবাসার বিনিময়ে কী করে এমন ছলনা দিলেন?”
আমের একটু আহতই হয় নারীটির করুণ আকুতি শুনে। মানুষ কি নিদারুণ উপহারই না দেয় নিখাঁদ ভালোবাসার বিনিময়ে! জ্বরের ঘোরেও কাঁদছে অনুরক্তি। ধীর স্পর্শে তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আমের। এই প্রথম বার বাঙালি রমণীটিকে ভালো ভাবে খেয়াল করে সে।
সোনালি গায়ের রঙ, না শ্বেতাঙ্গ নয়, মৃদু হলদেটে শুভ্রতা থাকলেও লালচে একটা ভাব। যাকে বিদেশীয়রা ট্যানিং বলে এবং যেই ট্যানিং পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কড়া রোদ্রে দেহ পুড়ায়। কালো চুল, যাতে চুল পড়ার চিহ্নও স্পষ্ট। মাঝারি আকারের চোখ জোড়ায় এক বিন্দু কাজল এবং পাপড়িতে মাস্কারার দুই আবারণ বেশ ভালোই মানিয়েছে। নাকটা দাঁড়ানো হলেও কেমন বোঁচা বোঁচা। যদিও নিজেকে অযত্নে রাখার ছাপ স্পষ্ট। একজন ডার্মাটোলজিস্ট হিসেবে মেয়েটার চেহারা অসাধারণ কিছু না হলেও সাধারণের মাঝে বেশ মিষ্টিই লাগছে।
তবে অধরজোড়াকে অনেকাংশ “পারফেক্ট লিপস্” বলা চলে। এই তো কয়েকদিন আগেই এক নারী এসেছিল এমন ঠোঁট পাওয়ার জন্য। শেষে লিপ ফিলিং করিয়ে গিয়েছে।
তার অহেতুক এলোমেলো ভাবনার মাঝেই মনে পড়ে মায়ের বলা একটি কথা, “নবি করিম (স.) বলে গেছেন, “কোনো পুরুষ একজন মহিলার সাথে নির্জনের মিলিত হলে তাদের তৃতীয় সঙ্গী হয় শয়তান”। সুতরাং সাবধান থাকবে বাবা।”
কিছুটা বিচলিত হয় আমের। তাড়াতাড়ি সরে যায় অনুরক্তির কাছ থেকে। বিছানায় বিছানো পাতলা চাদরটা সহ নিজের গায়ের জ্যাকেট, মাফলার খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দেয়। গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড বক্স এনে ঔষধ খায়িয়ে ভিজা কাপড় দিয়ে রাখে মাথায়। তবে জ্বর কমার নাম নিচ্ছে না।
এদিকে ঝড় থামলেও রাস্তা আটকে গিয়েছে বিশাল দু’টো গাছের পতনে। সকালের আগে মনে হয় না বের হতে পারবে। এসব ভাবতে কাউচের হাতলে মাথা রেখে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
—
অনুরক্তির চেতনা ফিরতেই চোখের সামনে দেখতে পায় ভিনদেশী যুবকটিকে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“Mr. Hazel Eyes!”
কৃতজ্ঞতার সাথে অনুশোচনাও বোধ হয়। তার সেবা করতে করতেই ক্লান্তিতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা তাতে তার সন্দেহ নেই। এমন কী এই ঠাণ্ডার মাঝে শুধু সাধারণ একটা ফুল হাতা টিশার্ট পরে থাকতে হয়েছে।
কাউচ থেকে উঠে দরজার দিকে অগ্রসর হয় সে। দ্বার খুলতেই এক ঝাঁক সোনালি আলোর প্রবেশ হয় কেবিন জুড়ে। বাহিরে শীতল বাতাসের শোঁশোঁ আওয়াজ আর শুভ্র এক পরিবেশ।
এক পলক আমেরের দিকে তাকিয়ে চুপিসারে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসে। রাস্তায় পা রাখতেই আশেপাশে তাকিয়ে অনুরক্তির যে কথাটা মনে হলো, তা হলো- জায়গাটা ভীষণ সুন্দর।
উৎফুল্ল হয় তার হৃদয়। হবে নাই বা কেন! নায়াগ্রা ফলস্! কানাডা! তাঁর স্বপ্নের দেশ, যে বছর সায়ানের সাথে দেখা হয় সে বছরই কানাডার ভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়েছিল সে। কিন্তু প্রিয় পুরুষটির হুটহাট যোগাযোগ বন্ধ করা, ডিপ্রেশন, অসুস্থতা সবমিলিয়ে স্বপ্নময় সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে যায়।
কথাটা মাথায় আসতেই মুখ খানা পুনরায় মলিন হয়ে যায়। হাজারো দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভর করে তার। মা-বাবাকে কি জবাব দিবে? আর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যাদের সাথে একটা বেইমানের জন্য রূঢ় আচারণ করেছিল! এই বিশ্বাসের যুদ্ধে পরাজিত মুখটা নিয়ে দাঁড়াবেই বা কীভাবে কারো সম্মুখে! তালাকের তকমা লাগবে তার ললাটে!
নানান রকম চিন্তা, আকাশসম যন্ত্রণায় চিৎকার করে কান্না শুরু করে সে। মাথায় শুধু একটিই ভাবনা, এর চেয়ে বোধহয় মৃত্যুই শ্রেয় হতো! প্রকৃতির নিস্তব্ধতা গ্রাস হয় তার গগনবিদারী কান্নায়।
আমেরের নিদ্রাও ভঙ্গ হয়েছে ততক্ষণে। ঘুম থেকে উঠে অনুরক্তিকে না দেখে ও দরজা খোলা দেখে চিন্তিত হয়ে বের হয়।
খাণিকটা দূরে শূন্য রাস্তায় সদ্য পরিচিত হওয়া বাঙালি নারীটির এমন বিধ্বস্ত রূপে কিছু মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়ই হয়ে পড়ে সে। দ্রুতো যেয়ে মাটিতে লুটিয়ে থাকা অনুরক্তিকে আগলে নেয় সে।
“Hey! Why are you crying?”
“সায়ান ক্যানো আমাদের বিয়ের, প্রণয়ের সামান্য টুকু মূল্য রাখলো না! এতোটা ঠুনকো ছিল তার নিকট সবকিছু! এখন কোন মুখে বাংলাদেশ যাবো! কোন মুখে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সামনে দাঁড়াবো! তাদের কথাই তো সত্য হলো, আমার…”
অতিরিক্ত কাঁদায় মুখ দিয়ে আর বেরোচ্ছে না, সাপের ন্যায় ফোঁপানোর শব্দ ও অবিরাম অশ্রুই তার ভাষা। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ারই দশা রমণীর। স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আমেরের হাত ডুবে যায় অনুরক্তির এলোচুলে। হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়।
“Hush! It’s okay! Stop crying please! আমাকে বলুন ক্যানো কাঁদছেন?”
অনুরক্তি মাথা এলিয়ে দেয় তার বক্ষে। ছটফটাতে থাকা দেহটি এখন ততোটাই শান্ত যতোটা শান্ত ঝড়ের পর গোটা পরিবেশ।
—
একহাতে গাড়ি চালাচ্ছে আমের, অন্য হাতে অনুরক্তির নির্ভরহীন মাথা সামাল দিচ্ছে। চেতনাহীন হয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে পড়ে থাকা মেয়েটি কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও ক্লান্ত করে তুলেছে তাকে। একবার ঝড়ের মাঝে আটকে পড়া তো একবার জ্বর বা চেতনা হারানো। তবুও সামান্যতম বিরক্তবোধ বা ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে না তার, বরং তীব্র এক স্বাভাবিকতা বোধ হচ্ছে। কী জন্য জানা নেই।
হাসপাতালে যাবে ভেবেও বাড়ির দিকেই যাচ্ছে সে। কারণ মুঠোফোন চার্জের অভাবে চেতনাহীন, তাই বাবা-মাকে খবর দিতে পারছে না। তাছাড়া, ডাক্তার হিসেবে অনুরক্তি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে, তেমন গম্ভীর কিছু নয় তাও জ্ঞাত।
গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে অনুরক্তিকে কোলে তুলে কলিংবেলে বাজায়। সাদা ফ্লোরাল প্রিন্টের লং ঢোলা গাউন পরা ও মাথায় ওড়না দিয়ে হিজাব বাঁধা অতী সুশ্রী একজন নারী বেরিয়ে আসে।
“আস্তাগফিরুল্লাহ! আমের এই মেয়ে কে? তুমি বিয়ে করে ফেলেছো! এ কী সর্বনাশ হলো আমার! আসুক মিস্টার মোস্তফা মাহমুদ! দেখুক কী করেছে তাঁর ছেলে!”
আমের একটুও বিচলিত হলো না। ছোটোবেলা থেকেই সে দেখে তার মা এবং নানী প্রায় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত ওভাররিয়েক্ট করে এবং খাণিকটা নাটকীয় প্রকৃতিরও। তাই সে চুপচাপ অনুরক্তিকে নিয়ে গেস্টরুমের বিছানায় রাখতে যায়।
ছেলের খাপছাড়া ভাবে আহত হন আমেরের মা আমিরা শাহিন। সঙ্গে সঙ্গে কল লাগান স্বামী মাহমুদ মোস্তফাকে। আমের এসে দেখে তার মা মুঠোফোনে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। অতঃপর দু’জনকেই গতকাল থেকে আজ অবধি ঘটা সকল ঘটনা খুলে বলে।
আমিরা শাহিন সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল কণ্ঠে শুধান,
“আমি জানতাম আমার ছেলে এমন কিছু করতেই পারে না। আমার সোনা ছেলে! আজ তোমার জন্য তোমার প্রিয় পায়েস রান্না করবো আমি।”
খোলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান তিনি। আমেরও ক্লান্ত ভঙ্গিমায় গোসলের জন্য চলে যায়।
—
অনুরক্তি নিদ্রা ভঙ্গ হতেই নিজেকে অপরিচিত এক কামরায় আবিষ্কার করে। তবে সেসব নিয়ে তার চিন্তা নেই, তার শরীর ঘামছে বাড়ির লোকদের বিশেষ করে মা-বাবাকে কী জবাব দিবে সে চিন্তায়। আগে তো কটুক্তির বিপরীতে নিজের বিশ্বাসের জোরে গলাবাজির দ্বারা সামাল দিত। এখন তো সে বিশ্বাসও ভেঙ্গে চুরমার। এবার সকলের কটুক্তি, খোঁচা, আঘাত কীভাবে সহ্য করবে?
এলোমেলো ভাবনার মাঝেই চোখ যেয়ে পড়ে বিছানার পাশে রাখা ফলের ঝুড়িতে থাকা ফ্রুট নাইফে। বাজে এক ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। চাকুটা হাতে নিয়ে যেই হাতের রগে চালান করতে নিবে তখনই আমের এসে চাকুটা ছিনিয়ে নেয়।
“Are you mad or what girl? এমন কী হয়েছে যার জন্য মরতে চাও? Breakups happen, it’s nothing.”
ঢুকরে কেঁদে উঠে একে একে সকল কিছু খুলে বলে অনুরক্তি।
“বুঝলেন? এটা শুধুই সামান্য ব্রেকআপ না। আমি কীভাবে সামলাবো নিজেকে আপন মানুষদের কটুক্তি থেকে? বাংলাদেশে যেয়ে কী জবাব দিব সবাইকে? মা-বাবাকে? সবার সম্মুখে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর থেকে এই ভিনদেশে মৃত্যুই শ্রেয় নয় কি?”
মেয়েটির হৃদয়-মস্তিষ্ক পোড়নের উষ্ণতা হয়তো যুবকটিও কিছুটা বোধ করে। আহত হয় এমন করুণ বেইমানির গল্প শুনে। এই দেশে সাধারণত এমন বিশ্বাস ও অপেক্ষার চিত্র খুব একটা দেখা যায় না। সবাই যার যার জীবন সামলাতে ব্যস্ত, অপেক্ষার সময় কোথায়? সেটাই বোধহয় ভালো প্রতারণা তো আর জুটে না কঠোর আরাধনার পর।
“তবে যাবে না ঐ দেশে। এখানেই থেকে যাও। মরার চেয়ে সহজ হবে।”
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অনুরক্তির বুক চিড়ে।
“যার জন্য এসেছিলাম সে তো কবেই আমার অজান্তেই আমাকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলেছিল? কার জন্যই বা কোথায় থেকে যাব?”
“আমার কাছে থেকে যাও।” কোনো এক ঘোরেই হঠাৎ উত্তর দেয় আমের।
সিক্ত চোখজোড়ায় মুহূর্তেই অবাক চাহনি স্থির হয়। অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে আমেরের মুখ পানে।
একদিনে তো অনুভূতির সঞ্চার হয় না। পুরুষটি কি তবে খেলতে চাচ্ছে অনুরক্তির অনুভূতি, অনুরাগ নিয়ে? না কি আবেগে মুখ ফসকে বের হওয়া কোনো করুণার বাণী মাত্র? সম্মুখে হয়তো ভাগ্যের আরও এক রূপ অপেক্ষা করছে অনুরক্তির জন্য, যা পুনরায় এলোমেলো করে দিবে তাকে।
#অনুরাগে_অনুরক্তি
– ঈপ্সিতা শিকদার