অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৪৯
অনি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে সামনের দিকে তাকায়। ঘুমের রেশ এখনো বিদ্যমান।হঠাৎ এভাবে ঘুম থেকে ওঠায় মাথায় কেমন চিন চিন করছে। চোখমুখ কুঁচকে গেছে।
এমতাবস্থায় রিশা এসে হুট করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এমন কান্ডে অনি থ বনে যায়।
–ভাবী!ভাবী!ভাবী!আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে চান্স হয়ে গেছে। বেশ উচ্চস্বরে আনন্দের সহিত কথাগুলো বলে রিশা।
এবার পুরো বিষয়টা বোধগম্য হয় অনির কাছে।
–আলহামদুলিল্লাহ। এটা তো খুব ভালো খবর। আর মিথিলার কি খবর?
–মিথিলারও হয়ে গেছে ভাবী।
–আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের দুজনকেই কংগ্রাচুলেশনস। বলেই অনি মুচকি হাসে।
–ভাবী তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো।আমি ভাইয়াকেও জানিয়ে দিয়েছি ভাইয়াও আসছে। তুমি জলদি এসো। বলেই অনির উত্তরের আশা না করে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে যায়।
অনি বড় করে নিঃশ্বাস নেয়।মিথিলা এমনভাবে ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। অনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ৪টা পার হয়ে গেছে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অজু করে বেরিয়ে আসে। আসরের নামাজ পড়ে অনি নিচে নামে।
পুরো পরিবারের সদস্যরা ড্রইংরুমে বসে আছে। তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু আজ মিথিলা আর রিশার বিশেষ দিন। তাদের এত দিনের পরিশ্রমে আজ বড় সফলতার প্রথম সিলমোহর লেগেছে। তাদের হাস্যজ্জ্বল মুখটা যেন সব সময় এমনই থাকে এটাই অনির কামনা।
রিশা মিথিলার আনন্দে তাদের সাথে পুরো পরিবারটাও যেন আত্মহারা হয়ে গেছে।সবার সাথে অনিও এসে শামিল হয়। মিথিলাকে কংগ্রাচুলেশনস জানায়।
এরই মাঝে রিশাদ হাজির হয় মিষ্টি নিয়ে। সবার আগে সে মিথিলা আর রিশাকে নিজ হাতে মিষ্টিমুখ করায়।সাথে রিশা আর মিথিলার জন্য একটা করে বিশেষ উপহার। রিশার অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল একটা আইফোন কেনার।কিছুদিন আগেই সে রিশাদকে একবার বলেছিল আইফোনের কথা তবে সময় রিশাদ পাত্তা দেয়নি আর পরবর্তীতে রিশাও এ ব্যাপারে ভুলে গিয়েছিল।তাই আজ এই বিশেষ একটা দিনে সে তার আদরের ছোট বোনটার ছোট্ট এই আবদার পূরণ করে দেয়। রিশার সাথে সাথে মিথিলার জন্যও একটা আইফোন নিয়ে আসে। যদিও সে জানে মিথিলা কখনোই মুখ ফুটে বলবে না।
রিশা আইফোন পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। আনন্দে বাচ্চাদের মতো লাফালাফি শুরু করে দেয়। দেরি না করে র্যাপিং পেপারটা খুলে সে আইফোনটা বের করে দেখতে থাকে। খুশিতে সে তার ভাইকে জড়িয়ে ধিরে ধন্যবাদ জানায়। মিথিলাও রিশাদকে ধন্যবাদ জানায় না চাইতেই এত সুন্দর একটা উপহার দেয়ার জন্য।
আজ রিশাদদের বাড়িতে যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ। বাড়ির দুই মেয়ের সফলতায় আজ তাদের জন্য বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। শায়লা বেগম ও সাবরিনা নিজ হাতে সব কিছুর ব্যবস্থা করে তাদের মেয়েদের পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেন। মিথিলা আর রিশাও যেন আজ নিশ্চিন্তে তৃপ্তি করে খেতে পেয়েছে।
সুখকর সময়গুলো কত দ্রুত পেরিয়ে যায়।একসাথে কাটানো মূহুর্তগুলো শুধুই স্মৃতির পাতায় রয়ে যায়। কিছু ভালো স্মৃতি কিছু তিক্ত বিষাদময় স্মৃতি। তবে কিছু বিশেষ আনন্দের স্মৃতি তিক্ত স্মৃতিগুলোকে প্রশমিত করে দেয়। একসময় তা অতলে হারিয়ে যায়। সেই সুখস্মৃতির রেশটা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় জটিল জীবনটা কিছুটা সহজ, সাবলীল হয়ে যায়।
আর দুদিন পরেই অনির ফ্লাইট।সব কিছু ছেড়ে তাকে ফের পুরনো ঠিকানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হবে।ভাবলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। শূন্যতায় ভরে যায় হৃদয় ও মস্তিষ্ক।
আচ্ছা রিশাদের সাথে তো বেশ সুখেই আছে এখানে। শুধুমাত্র নিজের ক্যারিয়ার,স্বপ্নের জন্য তাকে দূরে থাকতে হচ্ছে। সে কি ভুল কিছু করছে?সেও কি অদ্রির মতো রিশাদকে কোনভাবে প্রত্যাখ্যান করছে?অদ্রির মনে অজানা ভয় ঢুকে যায়।
আজকের ঘটনার পর থেকে যেন তার মনে ভয়টা বেড়েই গেছে। নিজের অজান্তেই কত বড় একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে ।
এইতো আজ বিকেলের কথা। জাহানারা বেগম রিশাদের পুরো পরিবারকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দেয়। সাথে দাওয়াত দেন হিমাদ্রীর পরিবারকে।
জাহানারা বেগম আর অনামিকা শেখ সব ব্যবস্তগা করেন। অনামিকা আজ বেশ খুশি দেখাচ্ছে। তবে তার খুশির কারণটা অজানা। সে যাইহোক বিকেল বেলা এসে উপস্থিত হয় রিশাদ,অনি ও তাদের পুরো পরিবার। অনামিকা তাদের আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে যায়। এরই মাঝে উপস্থিত হয় হিমাদ্রী ও তাদের পরিবারের কিছু সদস্য। গুনগুন,নিরা,কাব্য,রাফি আর হিমাদ্রী। রাফি আসতে চাইছিল না হিমাদ্রী তাকে জোর করে টেনে নিয়ে আসে। সে চাইছিল আজকের বিশেষ দিনে তার ভাই সমতুল্য বন্ধু তার পাশে থাকুক। তবে কি সেই বিশেষ দিন?
অনি ও জাহানারা বেগম তাদের আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসায়। তাদের জন্য হালকা স্ন্যাকসের এরেঞ্জমেন্ট করা হয়। গুনগুনের কথা অল্পবিস্তর অনির দুই পরিবারের সবাই জানতো তাই তাদের আর চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি।
তবে এই সবকিছুর মাঝে চঞ্চল রিশা যেন একেবারে চুপ হয়ে যায়। এইতো একটু আগেও সে হাসিমাখা মুখে কথা বলছিল।নিমিষেই যেন সে চুপসে যায়। মিথিলা বিষয়টা খেয়াল করেছে তবে সে কিছু বুঝতে পারছে না।
একজোড়া চোখ রিশার উপর স্থির। রিশা সেদিকে তাকাতেই চোখ দূটোতে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠছে। রিশার বুকটা ধক করে ওঠে। আজ এতদিন পর সে পুনরায় তার মুখোমুখি। রিশা চুপিচুপি উঠে চলে যায়। মিথিলা হা হয়ে যায়। সে কিছু বুঝতে পারছে না। সেও রিশার পেছন পেছন চলে যায়।
হিমাদ্রী রিশাদের পাশে বসে পড়ে। রিশাদ হিমাদ্রী একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করে আর রিশাদের সাথে রাফিকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা তিনজনই বেশ ফ্রি হয়ে যায় একে অপরের সাথে। আড্ডায় মেতে ওঠে তারা।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে তিন পরিবার গল্পগুজবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রিশাদ আর হিমাদ্রী পাশাপাশি বসেছে। তাদের বিপরীত দিকে রেহানা বেগমের পাশে বসে আছে অনি। রেহানা বেগম জোর করে অনিকে তার পাশে বসান। অনিকে একটু বেশিই খাতির দেখাচ্ছেন তিনি। এদিকে হিমাদ্রীর দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় হিমাদ্রী আড়চোখে অনির দিকে তাকিয়ে আছে।অনির সেদিকে খেয়ালই নেই। হিমাদ্রীর উপর আগে থেকেই রিশাদের রাগ জমে আছে। সেদিন পার্টিতেও সে দেখেছিল বার বার অনির দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে হিমাদ্রীর নাক বরাবর ঘুষি মেরে দেবে। কিন্তু না সে খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সে।
এদিকে রেহানা বেগমের কার্যক্রম অনির মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তিও বোধ করছে। তবে গুরুজন ভেবেই সে হাসিমুখে কথা বলছে।
এর মাঝেই জাহানারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে রেহানা বেগম বলেন;
–“যদি কিছু আপত্তি না করেন তবে আপনার কাছে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ ছিল।”
–এভাবে লজ্জায় ফেলোনা মা আমাকে বলোনা কি বলবে?
–আপনাদের যদি সম্মতি থাকে তো আপনাদের বাড়ির মেয়েকে আমি আমার বাড়ির ছোট বউ হিসেবে নিয়ে যেতে চাই। আপনারা চাইলে আমার ছেলের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারেন।
রেহানা বেগমের কথা শুনে রিশাদ ও অনির পরিবার অবাক হয়ে যায়। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তাদের বাড়িতে বিবাহযোগ্য তো একটাই মেয়ে। সে তো অদ্রি আর অদ্রি তো এখন দেশে নেই। তাহলে কার কথা বলছে রিশা বা মিথিলার কথা বলছে কি?
–জি বুঝলাম না।কার কথা বলছো তুমি মা?(জাহানারা)
রেহানা অনির গালে হাত রেখে হাসি মুখে তার নাম নিতেই দুই পরিবারের লোকজন চূড়ান্ত আকারে অবাক হয়।
রিশাদের সন্দেহটাই যেন ঠিক হলো। রেহানা বেগমের কথায় তার মেজাজ বিগড়ে যায়। তবে গুরুজনকে সম্মান করে বলে সে তাকে অসম্মানজনক কথা বলেনা সে।
–আন্টি আপনি এটা কি বলছেন? অনন্যময়ীকে কিভাবে আপনি আপনার ছেলের বউ বানাবেন?শি ইজ মাই ওয়াইফ। (রিশাদ)
হিমাদ্রী সহ তাদের পুরো পরিবার যেন আকাশ থেকে পড়েছে। হিমাদ্রীর কানে বার বার রিশাদের শেষ কথাটা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি দেরি করে ফেলেছে?হয়তো তার আগমনের পূর্বেই তার মায়াবতীর পৃথিবীতে অন্যকারো আগমন ঘটেছে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে।নিয়তি তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
ভালোভাবে না জেনেশুনে এতবড় একটা কথা বলে হিমাদ্রী সহ তার পুরো পরিবার যেন অপরাধবোধ করে। এদিকে অনি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছে। রিশাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে রিশাদ কি পরিমাণ রেগে গেছে। জাহানারা বেগম কোনমতে পরিস্থিতি সামাল দেন। হিমাদ্রীরা ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেয়। কি একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেত হলো।হিমাদ্রীদের জন্যও খারাপ লাগছে তার। কি আর করার!যা হবার হয়েই গেছে।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বিকেলের ঘটনাটাই বার বার মনে পড়ছিল অনির। রিশাদ রেগে কোথায় যেন গেছে এখনো বাড়ি ফেরার নাম নেই। অনির ভয়টা বেড়েই চলেছে। রিশাদকে হারিয়ে ফেলার সুপ্ত ভয়টা আজ বিশাল আকারে জাগ্রত হয়েছে। তার তো কোন দোষ নেই। কে বার বার না চাইতেও এত জটিলতার সৃষ্টি হয় তার জীবনে? কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অনি দুচোখ বুজে নেয়। রাতের একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে তার মুখে আছড়ে পড়ে।
ঠিক সেই মূহুর্তেই কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে।পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় তার কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা। অনি কোন কথা না বলে রিশাদকে জড়িয়ে ধরে।চোখ বুজতেই অশ্রুগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একাধারে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। রিশাদ তার প্রেয়সীকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। গায়ের জামাটা ভেজা অনুভব হতেই সে অনিকে ছেড়ে দিয়ে তার আর্দ্র নেত্রপল্লব হয়ে সবটুকু জল শুষে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। অভিমানী অনি চুপ করে থাকে। রিশাদকে ছেড়ে দিয়ে সে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে যায়।
রিশাদ তার প্রেয়সীর অভিমান অনুধাবন করতে পারে। সেও আর কালক্ষেপণ না করে রুমে চলে যায়। অনি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রিশাদ তার সামনে গিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে তার হাত দুটো ধরতেই অনি উঠে যেতে নেয়। রিশাদ তাকে শক্ত করে ধরে। উঠতে চাইলে বাধা দেয়। অনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আপনা আপনিই অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ছে।
রিশাদ উঁচু হয়ে অনিকে তার দিকে ফিরিয়ে নেয়। অশ্রুসিক্ত অনিকে দেখে তার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বিনা কারণে সে আজ তার প্রিয়তমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।
–সরি অনন্যময়ী। অযথা তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
অনি কোন উত্তর দেয় না। রিশাদ অনির চোখ মুছে দেয়। নিশ্চুপ অনি ফ্যালফ্যাল করে রিশাদেফ দিকে থাকে।
সে রাতে বেশ কসরত করেই রিশাদকে তার প্রিয়তমার অভিমান ভাঙাতে হয়েছিল। অনির মান ভাঙাতে পেরে তবেই রিশাদের অস্থিরতা দূর হয়। রাগের মাথায় সে অযথা অন্যের ভুলের জন্য তার ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিচ্ছিল।
দুদিন পর আজ বিচ্ছেদের ঘন্টা বেজে গেছে। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে অনি। সাথে পুরো পরিবার। এদেশে এসেছিল সে খালি হাতে।তবে ফিরে যাচ্ছে অনেকগুলো ভালো সম্পর্ক আর কিছু নতুন অনুভূতি নিয়ে। একেবারে ফিরে আসার জন্যই সে ফিরে যাচ্ছে। যদিও বা সে জানে না কবে নাগাদ ফিরতে পারবে। তবে তার স্থায়ী গন্তব্য যে এখানেই রয়ে গেল। সাময়িক ভাবে সে সীমিত সময়ের মধ্যেই আপন হওয়া মানুষগুলোকে রেখে চলে যাচ্ছে অচেনা মানুষগুলোর মাঝে নিজের স্বপ্ন বুননের জন্য। বিচ্ছেদটা বরাবরই কষ্টকর তা চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ হলেও কষ্টকর সীমিত সময়ের জন্য হলেও কষ্টকর।
মাঝে মাঝে মনে হয় এত কিছু না পেলেই হয়তো ভালো হতো।না থাকতো কোন পিছুটান আর না থাকতো কিছু হারানোর ভয়।এয়ারপোর্টে একে একে সবার থেকে বিদায় নেয় অনি। এই বিদায় বেলায় এসেও তার সাথে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। জীবনে প্রথম বার তার জন্মদাত্রী তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে আগলে নেয়। এই ঘটনায় অনি একেবারে অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়ে। প্রথমবারের নতো মাতৃঘ্রাণ তার নাসিকায় পৌঁছায়। কি এক বিরল অনুভূতির আবিষ্কার করে সে। বিদায় বেলায় এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিপর্যস্ত অনির হৃদয় ও মস্তিষ্ক।
অনির অবস্থাটা বুঝতে পেরে রিশাদ সবাইকে বাহানা দিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে প্রিয়তমাকে। বিচলিত অনি কিছুটা শান্ত হয়। অশ্রুগুলো বেরিয়ে আসতে চাইলে রিশাদ তার আগেই নেত্রপল্লবে তার ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয়। মহিলা কণ্ঠে লাস্ট এনাউন্সমেন্ট হতেই রিশাদ অনিকে ছেড়ে দেয়। সম্ভব সে নিজেই অনিকে রেখে আসতো। কপাল খারাপ তাই যেতে পারলো না।
অনিকে শেষবারের মতো বিদায় জানায় রিশাদ ও তাদের পুরো পরিবার। রিশাদ এক ধ্যানে অনির গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনি বার বার পিছনে ফেরে। রিশাদ ততবারই হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। দূরে দাঁড়িয়ে অনি রিশাদের হাসির পেছনের চাপা কষ্টটা দেখতে পারেনা। সে শুধু মনে মনে ভাবতে থাকে তার যত কষ্ট হচ্ছে রিশাদেরও কি ততটাই কষ্ট হচ্ছে????
অনি দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেলে রিশাদের হাসি ম্লান হয়ে যায়। কষ্টগুলো সব দলা পেকে যাচ্ছে। কেমন ব্যথা অনুভব হচ্ছে তবে কোথায় তা অনুধাবন করতে পারছে না। খুব ফাঁকাফাঁকা লাগছে তার। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি তার সামনে দিয়েই দূরে অজানায় চলে গেল। একটু আগেও তার প্রিয় মানুষটার হাত তার মুঠোয় আবদ্ধ ছিল। আস্তে আস্তে মুঠো আলগা হয়ে হাতটা বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর মানুষটাও চোখের বাহিরে চলে গেল। কি দারুণ কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার। দুফোঁটা জল তার চোখের কোণায় চিক চিক করে।
শায়লা বেগম তার ছেলের কাঁধে হাত রাখেন। রিশাদ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। কিছুটা শান্তি অনুভব করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার পরিবারকে নিয়ে চলে যায়।
এয়ারপোর্ট রোড এখনো পার হয়নি। রিশাদদের চলমান গাড়ির উপর দিয়ে জোরে শব্দ করে উড়ে যায় এরোপ্লেন। রিশাদ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে আওড়ায়;
–“বেলা থাকতেই ফিরে এসো আমার নীড়ে। ভালোবাসি।বড্ড বেশি ভালোবাসি”?
চলবে……
আসসালামু আলাইকুম?