অনন্যময়ী পর্ব_০১

0
17604

অনন্যময়ী পর্ব_০১
#সানজিতা_তুল _জান্নাত

বধূ বেশে হাসপাতালের করিডোরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনি।কান্নার আহাজারি তার উপর যেন কোন প্রতিক্রিয়াই ফেলছে না। আবেগ অনুভূতি অনেক আগেই অনির ভেতর থেকে বিলীন হয়ে গেছে আজ নতুন করে সে আবার অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে।চোখের পলক পড়ছে না।এই মূহুর্তে তার এখানে দাঁড়িয়ে কান্না করা উচিত। আশ্চর্যজনক ভাবে তার বিন্দু মাত্র কান্না পাচ্ছে না।তবে কোথাও যেন খারাপ লাগা কাজ করছে। আর পাঁচটা মেয়ের মত সাধারণ জীবনযাপন অনি কখনোই পায়নি।তবে এতে তার কোন আফসোস নেই জটিলতা তার জীবনে অন্তহীন।এরই মধ্যে একজন বয়স্ক লোক তার হাত ধরে অনুরোধ করে বলে,
মা রে আমার ছেলেটা কে বাঁচা। তুই পারিস আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে।এই বৃদ্ধ বাবাকে তুই ফিরিয়ে দিসনা।

অনি আস্তে করে তার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে আইসিইউ রুমের দিকে পা বাড়ায়।
আইসিইউ রুমের দরজার সামনের কাচের ভিতর দিয়ে অনি রুমের ভিতর চোখ বুলায়।সাদা চাদর বিছানো বিছানায় শুয়ে আছে একজন সুপুরুষ যার সাথে অনির ২/১ বারের বেশি অনির দেখা হয়নি তবে ঘটনাচক্রে সেই মানুষটাই আজ অনির স্বামী। মাত্র ৫ ঘন্টা আগে তারা শরিয়ত মোতাবেক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।যে মানুষটা আজ সকাল অবধি তার বিয়ে নিয়ে হাসি খুশি ছিল সেই মানুষটাই আজ হাসপাতালের বিছানায় জিবীত লাশের মত শুয়ে আছে।বিয়ে নিয়ে অনির নিজের ও আনন্দের শেষ ছিল না। কারণ বিয়েটা ছিল তার একমাত্র বড় বোন অদ্রির। অদ্রি আর অনি দুই বোন।আজ যেখানে অদ্রি বধূ বেশে থাকার কথা সেখানে অনি দাঁড়িয়ে আছে।অনি মনে মনে ভাবতে থাকে সকালের কথা কতই না খুশি ছিল সবাই।বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ের উপলক্ষে সবাই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।অনি নিজেও তো বিয়ে উপলক্ষে বড় বোনের জোরাজুরি তে বাধ্য হয়ে বাবা মার সাথে মান অভিমান এর পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে আসে।দেশে এসে যে এভাবে তার জীবন উলট পালট হয়ে যাবে তা অনির কল্পনাতীত ছিল।না চাইতেও অনেকগুলো জীবনের সাথে অনির জীবন জড়িয়ে যায়। সে কি করবে কিছু ভেবে পায় না ধুপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে।

অদ্রির সাথে রিশাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক যা অনিরও অজানা নয়।অনি সহ বাড়ির সবাই এ সম্পর্কের কথা বেশ ভালোভাবেই জানত।তারা একসাথে ঢাকা সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর অদ্রি চান্স পায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে অন্য দিকে রিশাদ বুয়েটে। একই কলেজে দুই বছর যাবত পড়াশোনা করলেও বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া কখনোই একে অপরের সাথে সেভাবে কথা বলার সুযোগ পায়নি তারা।তাদের পরিচয় টা হয় ভার্সিটি লাইফে এসে।

ঢামেকে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যায় অদ্রি। ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি গুলোর মধ্যে একটি হলো তার স্বপ্নের মেডিকেলে চান্স পাওয়া। অদ্রি বরাবরই ঘরকুনো স্বভাবের মেয়ে। মেয়েটির মধ্যে আধুনিকতার পরশ না থাকলেও কেউ কখনোই তাকে বলতে পারবে না সে ব্যাক ডেটেট। কেননা তার পোষাক পরিচ্ছদ আচার ব্যবহারে তাকে যেন মনে হত এ যুগের একজন আদর্শ মেয়ে যা সকলের জন্য অনুসরণযোগ্য। দেখতে যেমন সুন্দর ব্যবহার যেন তার থেকেও বেশি সুন্দর। প্রথম পরিচয়ে সবাই তার অমায়িক আচরণে মুগ্ধ হতে বাধ্য।তার অসাধারণ রেজাল্ট এর পাশাপাশি মার্জিত ও সুন্দর ব্যবহারের জন্য স্যার দের প্রিয় শিক্ষার্থীদের তালিকায় তার নাম শীর্ষে থাকে।মেডিকেল লাইফে এসেও এর অন্যথা হয় নি। এখানেও সে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্যারদের মন জয় করে নিয়েছে।

-অদ্রি প্লিয চল না আজ একটু বই মেলায় যাই। কয়েক দিন পরেই তো ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাবে দোস্ত তারপর তো আমরা বাসায় ফিরে যাব তখন আর একসাথে বই মেলায় যাওয়া হবে না।প্লিয চল না বাবুসোনা??।(অদ্রির বান্ধবি রাইসা)

-উফফ রাইসা দেখতেই পাচ্ছিস আমি পড়ছি তাও কেন আমাকে বার বার ডিস্টার্ব করছিস।তোর মেলায় যেতে হলে তুই যা। আমি যাব না (কিছুটা রেগে অদ্রি)

-সোনা মোনা কলিজা প্লিয রাগ করিস না এই লাস্ট বার আমি আর কখনো যেতে বলবোনা প্লিয প্লিয।(রাইসা)
-এই তুই যা তো একদম কানের কাছে বক বক করবি না।(অদ্রি)

মুখে হাত চেপে ন্যাকা কান্না করে রাইসা অদ্রিকে বলল;
হায় আল্লাহ এই দিন দেখার জন্যে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখছো??। আমার নিজের একমাত্র বেশটু আমার কথা শোনে না। বিদায় পৃথিবী এই পৃথিবী আমার জন্য না।অনিরে ভালো থাকিস গেলাম আমি।

বই টা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে চশমার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দষ্টিতে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে অদ্রি রাইসা কে বলল;
হইছে তোর নাটক এখন থাম।ড্রামাকুইন কোথাকার??।আল্লাহ যে কোন পাপের জন্য তোর মত বান্ধবি শাস্তি হিসেবে দিল সেই হিসেব টা আমি আজও মেলাতে পারলাম না।আমার কপালটাই খারাপ।
অদ্রির কথায় রাইসা ফিক করে হেসে উঠল।
একটু ভাব নিয়ে বুকে দুই হাত ভাঁজ করে অদ্রিকে বলল-হিসেবটা আমি তোমায় মিলিয়ে দিচ্ছি বালিকা।তুমি যে রাতের পর রাত দিনের পর দিন পড়াশোনা করে এই বই গুলোর উপর অমানবিক অত্যাচার করো একটু দয়া মায়া করো না সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকো তার জন্যই তো বই গুলো অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে বিচার দিছে ব্রো।এসব তোমার জটিল মস্তিষ্কের বোঝার মত বিষয় না। অযথা চাপ দিও না। বাট তুই কি এই কথা গুলো বলে আমাকে ইন্সাল্ট করলি নাকি?। আমার মত বান্ধবি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হুহহ। রাইসা অদ্রির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটল।

অদ্রি কিছুটা রেগে গিয়ে রাইসাকে বলল – শয়তান আর একটা উলটা পালটা কথা বললে তোকে আমি হোস্টেলের ছাদ থেকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিব।

-কুল ডাউন জানেমন। এত উত্তেজনায় তোমার ব্রেইন যেকোন সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু। হিহিহি??।(রাইসা)
-রাইসায়ায়ায়ায়া তোকে তো আমি ছাড়ব না।(অদ্রি)
অদ্রির কথা শুনে রাইসা এক দৌড় দিয়ে অদ্রির ত্রিসীমানার বাইরে চলে যায় আর অদ্রিকে বলে; বিকেলে ৪টায় ভদ্র মহিলার মত রেডি থাকিস যদি কথা না শুনিস একদম কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব। তবুও তোকে যেতেই হবে জানেমন।বাই দ্যা ওয়ে আমার পিছনে দৌঁড়াইয়া তোর এনার্জি ওয়েস্ট করিস না আমি স্কুলে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম ব্রো?।

রাইসার কথা শুনে অদ্রি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।পরমূহুর্তেই অনি হেসে ওঠে রাইসার পাগলামি গুলো দেখে। অদ্রি মুখে যতই না বলুক সে রাইসার কথায় কখনো ফিরিয়ে দিতে পারে না আর রাইসাও অদ্রিকে ছেড়ে দেয় না।স্কুল লাইফ থেকে তারা বেস্ট ফ্রেন্ড। রাইসার কথা ভাবতে ভাবতেই অদ্রির মন বিষাদে ছেয়ে যায় কিছু একটা ভেবে।
অশ্রু কণা গুলো অদ্রির অবাধ্য হয়ে চশমার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। রাইসার মত অনিও অদ্রির সাথে এভাবেই পাগলামি করত।অনির সেই পাগলামি গুলো অদ্রি প্রচণ্ডভাবে মিস করে।
কোথায় হারিয়ে গেলি তুই বাবুনি। তোর এই অদ্রি আপুর কথা কি একবারও মনে পরে না? আমাকে ছাড়া তুই কিভাবে থাকতে পারিস?আমাকে কি একটুও মিস করিস না।এত স্বার্থপর কিভাবে হতে পারলি??
অনির কথা মনে হতেই রাইসার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দু চোখ বুজে ফেলে অদ্রি। অশ্রু কণা গুলো চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।চশমাটা রেখে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে গোসল শেষ করে একটা হলুদ কালার সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে আসে অদ্রি।

এক মগ কফি নিয়ে বারান্দার রেলিং এর পাশে এসে দাঁড়ায় অদ্রি।এই ধোঁয়া ওঠানো এক মগ কফি অদ্রির সকল ক্লান্তি অবসাদ সাময়িকের জন্য দূর করে দিতে যথেষ্ট। কফির মগে চুমুক দিয়ে দু চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদ্রি।
মনে মনে কবিতা আওড়াতে থাকে;

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
যেখানে ছিলাম আমি;আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

-(বনলতা সেন; জীবনানন্দ দাশ)

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here