অনন্যময়ী পর্ব-০২
সানজিতা তুল জান্নাত
ফ্লোরে বসে অনি মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখে তার দিদা জাহানারা বেগম।ছোটবেলা থেকে অনি তার জীবনে যে সীমিত সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে আদর ভালোবাসা পেয়েছে তাদের মধ্যেই একজন হলো তার দিদা। অনির সকল অন্যায় আবদার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর চাওয়া পাওয়া গুলো তার দিদাকে ঘিরেই থাকত।দিদা তার জন্য না চাইতেই সব হাজির করে দিত। দিদাই ছিল তার অর্ধেক পৃথিবী আর বাকি অর্ধেক টা জুড়ে ছিল অদ্রিপু।জন্মের পর থেকে যখন সব কিছু বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই অনি দিদা আর অদ্রিপুর জন্য পাগল। অনিও ছিল যেন তাদের নয়নের মণি।
-অনি দিদিভাই! এখানে এভাবে বসে আসিস কেন? তোর কি শরির খারাপ করছে দিদিভাই? তাহলে চল তোকে বাড়ি নিয়ে যাই।(জাহানারা বেগম)
অনি কোন কথার জবাব না দিয়ে পাশের চেয়ারে দিদাকে বসিয়ে তার কোলে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। জাহানারা বেগম অনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এই মূহুর্তে অনির কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তবে মনের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। এই অস্থিরতার কারণ অদ্রিপু না রিশাদ তা ভেবে পাচ্ছে না।
– কিরে কথা বলছিস না কেন দিদিভাই??
আমি জানি তুই ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়ে আসিস। চিন্তা করিস না আল্লাহ যা কিছু করে তাতেই বান্দার কল্যাণ হয়। আজ যা কিছু হলো তাই হয়ত সকলের জন্য কল্যাণকর। এসব কিছু হুট করে মেনে নেওয়া তোর পক্ষে হয়ত খুব সহজ না। যেভাবেই হোক রিশাদ তো এখন তোর স্বামী। সে আজ বিপদে পড়েছে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। স্ত্রী হিসেবে তোর কর্তব্য রিশাদের পাশে থাকা।একবার দেখেছিস রিশাদের বাবা মার কি অবস্থা।রিশাদের পরিবার তো এখন তোর পরিবার দিদিভাই।তোর পরিবারকে এভাবে একা ফেলেতে পারিস না তুই দিদিভাই। তোকে সব সামলাতে হবে। আমি জানি আমার দিদিভাই টা সব পারবে। আফটা অল ইউ আর মাই ব্রেভ গার্ল।(জাহানারা বেগম)।
-জানো দিদা মানুষ যখন সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে তখন সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটার সান্নিধ্য চায়।প্রিয় মানুষটাকে তার পাশে চায়।আর রিশাদ ভাইয়ার প্রিয় মানুষটা তো আমি নই দিদা। তার প্রিয় মানুষ অদ্রিপু।আমি কখনো তার প্রিয় মানুষ হতে চাইনা।এই সবকিছুই তো অদ্রিপুর আমার নয়।এই পরিবার এই সবকিছু তো অদ্রিপুর পাওয়ার কথা দিদা। আমি তো কখনোই এসব কিছু চাইনি। অদ্রিপুর সাথে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি।অদ্রিপু ফিরে আসলে আমি কিভাবে আপুর সামনে যাব। আপু তো আমাকে ভুল বুঝবে সবার মত আপুও আর আমাকে ভালোবাসবে না তাইনা দিদা।(অনি)
-না সোনা তোকে কেউ ভুল বুঝবে না।তুই আমার লক্ষি দিদি ভাই। তোর মত মেয়ে কে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।(সাবিনা বেগম)
-আমি যদি এতই ভালো হই তাহলে তোমার মেয়ে আমাকে এত বছরেও ভালোবাসলো না কেন দিদা?(অনি)
অনির কথায় সাবিনা বেগমের মুখ বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়।অনির কথার কোন জবাব তার কাছে কোনদিন ছিল না আজও নেই। জাহানারা বেগম অদ্রিকে ভালোবাসলেও মায়ের অভাবটা হয়ত কোনদিন পূরণ করতে পারেননি।আর যে মানুষটা মায়ের অভাব পূরণ করে দিত সেই মানুষটাও অনির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
অনি তার দিদার কোল থেকে মাথা তুলে আস্তে আস্তে পা বাড়িয়ে সামনের দিকে যায়। আইসিইউ রুমের দিকে চোখ বুলিয়ে তার শ্বশুর মশাই রায়হান খানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রায়হান খান অনির উপস্থিতি টের পেয়ে দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলতে থাকে;
জানিস মা আমার ছেলেটা অদ্রি মা কে পাগলের মত ভালোবাসে। অদ্রি মার মতো ভালো মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। অদ্রি মা কে নিজের মেয়ের মত দেখি।আজ সেই অদ্রি মা আমার ছেলের সাথে এভাবে এরকমটা করবে তা আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি।আমার ছেলেটা কখনো কিছু চায়নি। সে তো শুধু ভালোবাসার কাঙাল ছিল। দেখনা আমার হাসি খুশি চঞ্চল ছেলে টা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে।কোন কথা বলছে না আমাকে বাবা বলে ডাকছে না।আমার ছেলের কষ্টটা আমি আর সহ্য করতে পারছি না রে মা।ভেবেছিলাম তোর সাথে বিয়ে দিলে হয়ত ছেলেটার ভালো হবে।আমি যে ছেলেটার ভালো করতে গিয়ে ওকে আরো বিপদে ফেলে দিলাম। আমি বাবা হয়ে এটা কি করে করতে পারলাম। আমার ছেলের এই অবস্থার জন্য আজ আমি দায়ী। রায়হান সাহেব পুনরায় কান্নায় ভেঙে পরেন।
রায়হান সাহেবের কথা শুনে অনি স্তব্ধ হয়ে যায়।সে রায়হান সাহেবকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে।মনে মনে ভাবতে থাকে-
অদ্রি আপু তুমি কিভাবে এই কাজটা করতে পারলে। ফেরেশতার মত মানুষগুলো যারা তোমাকে এত ভালোবাসে তাদের তুমি কিভাবে কষ্ট দিতে পারলে। আমার অদ্রি আপু তো এমন না সে তো নিজের আগে অন্যদের কথা ভাবত। তাহলে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবে রেখে কিভাবে যেতে পারলে।দেখেছ অদ্রি আপু সবাই তোমাকে ছাড়া কিভাবে কষ্ট পাচ্ছে। এই মানুষ গুলোকে তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে সামলাব।
অনির দিদা জাহানারা বেগম অনির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেঃ
দেখছিস দিদিভাই সবাই কেমন কষ্টে আছে। যদি তাদের এই কষ্টের সময় তাদের পাশে না থাকিস তাহলে তুইও কিন্তু অদ্রি দিদিভাইয়ের মত স্বার্থপরের মত কাজ করবি। একবার এই পরিবারটাকে আপন করে নে দিদিভাই। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। নিয়তি কখনো কখনো আমাদের এমন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় যেখান থেকে পেছনে আসার কোন উপায় থাকে না।সব সময় তো তুই তোর ভাগ্যকেই মেনে নিয়েছিস আজো ভাগ্যকে মেনে নিয়ে এই মানুষগুলোকে আপন করে নে।
জাহানারা বেগম অনির ভিতরে কোন ভাবান্তর না পেয়ে তার হাত ধরে পাশের কেবিনে নিয়ে যায়।
কেবিনের বেডে শুয়ে আছে অনির শ্বাশুড়ি মা শায়লা বেগম। এক্সিডেন্ট এর খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে নিজের ছেলের করুণ অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যান শায়লা বেগম। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে এখানে শুইয়ে রাখে। ডাক্তার এসে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়। শায়লা বেগক যতক্ষণ জেগে থাকেন ততক্ষণই ছেলের জন্য আহাজারি করেন।মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ছেলের নাম ধরে ডেকে ওঠেন। শায়লা বেগমের পাশেই বসে কাঁদছে রিশাদের ছোট বোন রিশা।
রিশা অনি কে দেখে মায়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে অনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। রিশা এভাবে আচমকা জড়িয়ে ধরায় অনি দু পা পিছিয়ে যায়।
রিশা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে;
ভাবি প্লিয তুমি থাকো। তোমাকে আমাদের দরকার। প্লিয ভাবি দেখোনা মা ভাইয়ার জন্য কেমন করছে।আমার খুব ভয় করছে ভাবি।
রিশার কথা শুনে জাহানারা বেগমের চোখ ভিজে ওঠে।
অনি রিশাকে কিছু বলতে পারে না। রিশাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।কিছুক্ষণ পর রিশা অনিকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে আবার মায়ের পাশে গিয়ে বসে পরে। অনি শায়লা বেগম আর রিশার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে।
জাহানারা বেগম চোখের জল মুছে অনিকে বলেন; এই ছোট্ট মেয়েটা যার ভাই মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে মা বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে বাইরে বাবা ভেঙে পড়েছে সে একা কিভাবে সব কিছু সামলাবে?এরা সবাই তোকে আপন করে নিতে চায় তুই কেন দূরে যাচ্ছিস?
অনি মনে মনে ভাবতে থাকে যে মানুষটার জন্য অনিকে এরা আপন করে নিচ্ছে সেই মানুষটাই অনিকে কখনো আপন করে নিতে পারবে না কারণ তার সবটা জুড়ে অদ্রিপুর বাস।অনি নিজেও পারবে না অদ্রিপুর জায়গায় নিজেকে দাঁড়া করাতে। তাইতো সে এই মানুষগুলোকে আপন করে নিতে পারছেনা।
অনি শান্ত গলায় জাহানারা বেগমকে বলেন;দিদা আমাকে একটু বাড়ি নিয়ে যাবে প্লিয।
অনির কথায় জাহানারা বেগম হতাশ হয়ে যান। তারপর তিনি শায়লা বেগমের কেবিন থেকে অনিকে নিয়ে বেরিয়ে যান।জাহানারা বেগম রায়হান সাহেব কে কেবিনের বাইরে দেখে তার সাথে কোন কথা না বলে শুধু ব্যথাতুর নয়নে তাকিয়ে থাকেন। রায়হান সাহেব যা বোঝার বুঝে যান।
জাহানারা বেগম অনিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলে রায়হান সাহেব তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে নিজের ছেলের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষারোপ করে অশ্রুপাত করতে থাকেন।
চলবে…..