অদ্বিতীয়া পর্ব ৪

0
75

#অদ্বিতীয়া
#পর্ব_০৪
#নুজাইফা_নূন
-” আমি ইরহান ভাইজানের বাচ্চার মা হতে চলেছি ভাবি। অবিবাহিত একটা মেয়ের প্রেগন্যান্ট হবার মতো পাপ বোধহয় এই ধরণীতে দ্বিতীয় আর কিছু নেই। সেই পাপ আমি নিজেই করে ফেলেছি। দুই মাস পিরিয়ড মিস হ‌ওয়া, মাথা ঘোরানো, বমি হ‌ওয়ায় ভড়কে গিয়েছিলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো?কার কাছে সাহায্য চাইবো?পরে আমার ছোট বেলার বান্ধবী শেফালীর কথা মনে পড়লো।ও একটা হসপিটালে আয়ার কাজ করে।ওর সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা করে জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। আমার মধ্যে ছোট্ট একটা প্রাণ, ইরহান ভাইজানের অংশ বেড়ে উঠছে।”

-‘পলির মুখ থেকে কথাটা শুনে যেনো অদ্বিতীয়ার মনে হলো তার চারপাশ দিয়ে পুরো ধরণী ঘুরছে। অদ্বিতীয়া মনে মনে বললো, কয়েক ঘণ্টা আগে স্ব চোখে স্বামীর রঙ্গলীলা দেখলাম। এখন আবার এই সংবাদ।না জানি নিজের স্বামীর সম্পর্কে আরো কতো অজানা তথ্য রয়েছে। যেখানে মেয়েরা স্বামী নামক ব্যক্তিটার আশেপাশে কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে না।তার ভাগ কাউকে দিতে চায় না। সেখানে আমার স্বামীর সন্তানের মা ‌অন্য কেউ হতে যাচ্ছে। ছিঃ ভাবতেই ঘৃণা লাগছে ঐ‌ অমানুষ টার নোংরা হস্ত আমার শরীরে ও বিচরণ করছে। অদ্বিতীয়া আর কিছু ভাবতে পারলো‌‌ না। লোচনে আঁধার নেমে এলো তার। স্বামী নামক ব্যক্তিটার প্রতি সমস্ত ভক্তি শ্রদ্ধা এক নিমিষেই ঘৃণা তে পরিণত হলো। অদ্বিতীয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, কতোদিন চলছে এসব? নিশ্চয় দু একদিনে এমনটা হয় নি। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা শুধু মাত্র অধরে অধরে সীমাবদ্ধ ছিলে।এখন তো দেখছি জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছে।”

-“আমি জানি ভাবি আপনি আমাকে খারাপ মেয়ে মনে করছেন। অবশ্য এটা মনে হ‌ওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এমনটাই মনে করতাম। কিন্তু ভাবি আমি অপরাগ ছিলাম। অন্যদের মতো আমার ও একটা সুখের সংসার ছিলো ভাবি। যেখানে আব্বা মা ভাই বোন নিয়ে আমার বাস ছিলো।আব্বা কৃষি কাজ করতো ।।কৃষির উপর নির্ভর করে আমাদের পাঁচ সদস্যের ছোট্ট সংসার খুব ভালো ভাবে চলতো।মাসে দুই তিন দিন আমরা গোশত, মাছ খেতাম।আর সেদিন গুলো আমাদের কাছে ঈদের দিন মতো হতো।আমি দুপুর থেকে ঘর দোর পরিষ্কার করতাম, তিন ভাই বোনে ভালো জামা পরতাম।বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিলো না। মা ল্যাম্প জ্বালিয়ে রান্না করতো আর আমরা তিন ভাই বোন উনুনের কাছে গোল হয়ে বসে পড়াশোনা করতাম।রান্না শেষ হলে রাতে যখন খেতে বসতাম, তখন আমাদের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতো।মা কাকে বেশি গোশতের টুকরো দিলো, কাকে বেশি আলু দিলো, কাকে বড় মাছের টুকরা দিলো এসব নিয়ে তিন ভাইবোনের মধ্যে এক প্রকার ঝগড়া মারামারি শুরু হয়ে যেতো।আব্বা এসব দেখে মুচকি হেসে বলতো ,তোরা দাড়িপাল্লা এনে ওজন করে দেখ কার বেশি হয়ছে ,কার কম হয়ছে।সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো আমাদের সংসার।তখন আমি ক্লাস এইটে পড়তাম ,আমার ভাই ক্লাস ফোরে পড়তো।আর বোনটা সবার ছোট ছিলো।মাত্র তিন বছরের। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলাম আমি। প্রাইভেট পড়ার মতো সামর্থ্য ছিলো না।আমার বান্ধবী মারিয়ার বাবা আমাদের ক্লাস টিচার ছিলো।মাঝে মাঝে কোনো পড়া না বুঝলে আমি মারিয়াদের বাড়ি গিয়ে স্যারের থেকে পড়া বুঝে আসতাম‌‌।আবার মারিয়ার থেকে বিভিন্ন নোটস এনেও পড়তাম।দিনটা ছিলো শুক্রবার।শনিবারে আমাদের একটা পরীক্ষা নেবার কথা ছিলো‌। কিন্তু আমি একটা ম্যাথে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। এজন্যই আমি আমার ভাই পাভেল কে নিয়ে মারিয়াদের বাড়ি আসি কিছু ম্যাথ বোঝার জন্য।এক পর্যায়ে গল্প , পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে কখন যে ধরনীর বুকে আঁধার নেমে আসে বুঝতে পারি না। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার স্যার আমাদের বাড়িতে আসতে দেয় না।রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আর ভাই সেখানেই রাত্রি যাপন করি।ভোরের আলো ফুটলে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নাকে কেমন যেনো পোড়া পোড়া গন্ধ পাই।আর একটু সামনে আগাতেই দেখি বাড়ির আঙিনায় মানুষের সমাগম বাড়ছে। আমাদের বাড়ি অনেক টা নিরিবিলি পরিবেশে ছিলো।সচারচর কেউ আসতো না আমাদের বাড়ি। অকস্মাৎ এতো মানুষের সমাগম দেখে অজানা এক আ’ত’ঙ্কে পুরো শরীর কম্পিত হয়ে উঠে আমার।মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই সত্য হয়। মানুষের সমাগম ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি আব্বা মা বোন এমনকি আমাদের ঘরের চিহ্ন টুকু ও নেই।সব আগুনে দগ্ধ হয়ে গেছে। রাতে মা রান্না শেষ করে ভেজা লাকড়ি উনুনের উপর শুকানোর জন্য রেখে দিতো।সেই ভেজা লাকড়ি আস্তে আস্তে শুকিয়ে আগুন লেগে যায়।আর সেই আগুনে সবাইকে জ্বালিয়ে দেয়।আব্বা সারাদিন মাঠে কাজ করতো। অন্যের কামলা খাটতো। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে ঘুমোলে তার কোন হুঁশ থাকতো না।আর মায়ের সারা অঙ্গে ব্যাথা বিষ ছিলো। সারারাত ঘুমাতে পারতো না।তাই ঘুমের ঔষধ খেয়ে রাতভর পড়ে থাকতো।তাই হয়তো আগুন লাগলে তারা টের পায় নি।আর যখন টের পেয়েছিলো তখন হয়তো তাদের ঘর থেকে বের হ‌বার কোনো রাস্তা ছিলো না।হয়তো বাঁচার জন্য হাঁক ছেড়েছিলো। কিন্তু তাদের চিৎকার কারো কর্ণপাত হয় নি।আমি আর ভাই বেঁচে থেকেও যেনো ম’রে গেছিলাম। কোথায় যাবো ? কার কাছে থাকবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের দুঃসময়ে চাচীজান অর্থাৎ ইরহান ভাইজানের আম্মা আমাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আমাদের পাশের গ্ৰামে তার বাবার বাড়ি ছিলো।তিনি আমাদের এই করুন অবস্থা দেখে আমাকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন।আর ভাই কে গ্ৰামের লোকেরা একটা মুদিখানার দোকানে রেখে দেন। কিন্তু শর্ত দেন ভাই দোকানে কাজ করার বিনিময়ে তারা ভাইকে থাকতে দেবে আর দু বেলা খেতে দিবে। কিন্তু কোনো মাইনে দিবে না। ভাই তাতেই রাজি হয়। ভাই কে ছেড়ে আমি ও চলে আসি চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কিন্তু একটা মেয়েকে কতোদিন বসিয়ে বসিয়ে খেতে দিবে তারা।তাই চাচী আমাকে বাড়ির কাজে নিযুক্ত করেন।আমি ঘর দোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ করতাম।এমনকি ইরহান ভাইজানের রুম পরিস্কার করা, তার কাপড় চোপড় পরিষ্কার করতে হতো আমাকে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই ইরহান ভাইজান কুদৃষ্টি পড়ে আমার উপর। নানান কাজের বাহানায় তার রুমে ডাকতো আমাকে। শুধু তাই নয়। রাতে মাঝে মধ্যে তিনি আমার রুমে গিয়ে বাজেভাবে স্পর্শ করতো ।আমি অনেক চেষ্টা করেও কাউকে এই ব্যাপারে বলতে পারি নি।বললে কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতো না।আবার আমার শেষ আশ্রয়স্থল টুকু ও হারিয়ে যেতো।আমি ইরহান ভাইজানের থেকে যথাসম্ভব নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারি নি।
অকস্মাৎ একদিন খবর আসে ভাই যে দোকানে কাজ করতো সেখানে মাস শেষে অনেক টাকার গড়মিল হয়েছে। মালিকের ধারণা টাকা চুরি হয়েছে।সেই টাকা চুরির দায়ভার ভাইয়ের উপর পড়ে।মালিক জানায় ভাই যদি সব টাকা না দিতে পারে তাহলে ভাইকে পুলিশে দিবে।আমি চাচাজান কে এই ব্যাপারে বলি ।তিনি যেহেতু চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি চাইলে ব্যাপার টা মিটমাট করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান নি।আবার আমি টাকা চাইলেও তিনি টাকা দিতে নারাজ হন।ভাইকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আমি চাচাজানের লকার থেকে টাকা চুরি করি। আর সেটাই ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।যে ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে কলঙ্কিনী হতে হয়েছে আমাকে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here