অদ্বিতীয়া পর্ব ২

0
72

#অদ্বিতীয়া

#পর্ব_০২

#নুজাইফা_নূন

-” হেই মিস বোরকাওয়ালি ! কি হলো আপনার?চোখ খুলুন মিস।আমি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখা মাত্রই আপনি সেন্সলেস হয়ে গেলেন? ইজহান কয়েকবার মেয়েটাকে ডাকলো। কিন্তু তার থেকে কোনো রেসপন্স পেলো না ।ইজহান কি করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে পাঁজা কোলে তুলে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটা দিতেই মেয়েটা তড়িঘড়ি করে উঠে অকস্মাৎ তার সামনে ইজহান কে ঝুঁকে থাকতে দেখে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলো। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে ইজহান বললো,

-” আমাকে দেখে ভীত হ‌ওয়ার কোন কারণ নেই মিস।আমি জনগণের সেবক। সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা দেওয়াই আমার কাজ। বিশ্বাস রাখতে পারেন আমার উপর।”

-” ইজহানের কথায় মেয়েটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা থেকে হিজাব টা খুলে ফেললো। তৎক্ষণাৎ মেয়েটার ঘন কালো কেশ এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো।সেই সাথে বেরিয়ে এলো তার মায়াবী বদন খানা। মেয়েটা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিসংকোচে বললো, পানি হবে আপনার কাছে? প্রচণ্ড তিয়াসা পেয়েছে।”

-” ইজহান পানির বোতল এগিয়ে দিতেই মেয়েটা ঢকঢক করে বোতলের পানি পুরোটাই শেষ করে দিয়ে তার গাত্রে পরিধান কৃত বোরকা টা খুলে ফেলে দিলো। মেয়েটা কে বোরকা‌ বিহীন দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠলো ইজহানের। মেয়েটার গাত্রে লাল বেনারসী জড়ানো ‌রয়েছে।গলায় , কানে স্বর্ণের গহনা। মেহেদী রাঙ্গা হস্তে চুড়ির ঝনঝন শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছে।সর্বোপরি মেয়েটা কে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে সে বিষয়ে আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। ইজহান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ,

-” বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছেন কেনো মিস ?”

-” সেই তখন থেকে কি মিস মিস করছেন হ্যাঁ? আমার সুন্দর একটা নাম আছে । আমি জারা । কোনো মিস ফিস না।”

-” তো মিস জারা বয়ফ্রেন্ড এর জন্য বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছেন বুঝি? কিন্তু যার জন্য পালিয়েছেন সে আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে তাই তো? বুঝতে পেরেছি পালানোর সময় আপনার আবেগ কাজ করছে বিবেক না। একবার ও ভেবে দেখেন নি আপনি বিয়ের আসর ছেড়ে পালালে আপনার বাবা মায়ের কি অবস্থা হবে?যে বাবা মা আপনাকে এতো গুলো বছর আদর স্নেহ দিয়ে বড় করলো তাদের মুখে চুনকালি মেখে আপনি ক্ষণিকের ভালোবাসার পিছনে ছুটলেন? আপনার বাসার এড্রেস বলুন। আমি আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।ইজহানের কথাটা শোনা মাত্রই জারার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠলো।জারা চট জলদি গাড়ি থেকে নেমে অনেক টা অস্ফুটে স্বরে বললো,

-” যে নরক যন্ত্রণা থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি সেখানে আর কিছুতেই ফিরবো না আমি।জারা কে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ইজহান দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে জারার হাত ধরে বললো,সরি এইভাবে আপনাকে আটকানোর জন্য।এই মধ্যে রজনী তে আমি একজন পুলিশ অফিসার হয়ে আপনাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না।আপনি প্লিজ আপনার বাসার এড্রেস টা দিন।আর দিলেও কোনো সমস্যা নেই।কারণ আইনের হাত খুব লম্বা।”

-” বাসা থাকলে তবেই তো এড্রেস দিবো। যেখানে বসবাস করি তাকে আদৌ‌ বাসা বলা হয় কিনা জানা নেই আমার।অন্য সবাই সেটাকে বাসা বললেও আমার কাছে সেটা একটা নরক মাত্র। যেখানে থেকে প্রতিনিয়ত নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে ‌হয়েছে।শুনেছি আমার জন্মের সময় নাকি আমার মা মা’রা যান। মায়ের মৃত্যুর এক মাস পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আমার জন্য মা নিয়ে আসেন। কিন্তু সে মা ছিলো না।ছিলো মা নামের কলঙ্ক।তিনি থাকতেও আমি কাজের খালার কাছে বড় হয়েছি। আমার তথাকথিত সৎ মা একজন প্রস্টিটিউট ছিলেন।যেটা বাবা তাদের বিয়ের পরে জানতে পারে।তিনি ছলে বলে কৌশলে বাবার সমস্ত সম্পত্তি , ব্যাংক ব্যালেন্স সব নিজের নামে করে নিয়ে আমার চোখের সামনে আমার বাবা হ’ত্যা করেছে ঐ ডা’ই’নী মহিলা।আমি আমার বাবা কে চোখের সামনে ঝটপট করতে দেখেও কিছু করতে পারি নি।কারণ আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আমার হাত দিয়েই বাবা কে খু’ন করা হয়েছিলো।বাবার মৃ’ত্যু’র পর তার অত্যাচার আরো বাড়তে লাগলো। বাসগৃহ হয়ে উঠলো একটা আড্ডাখানা। আজেবাজে ছেলেমেয়েদের আনাগোনা শুরু হলো বাড়িতে। রাতভর পার্টি , ড্রিঙ্কস , অনৈতিক কার্যকলাপ চলতো।তিনি চাইতেন আমি ও এই পথের পথিক হয়। কিন্তু আমি নিজেকে যথাসম্ভব তাদের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। এভাবেই চলছিলো আমার জীবন। অকস্মাৎ একদিন আমি আমার সৎ মায়ের পার্টনারের সামনে পড়ে যাই।এরপর থেকে তাদের কুদৃষ্টি পড়ে আমার উপর।আমি সৎ মায়ের কাছে হাত জোড় করে বলি ,

-” আমি আপনার মেয়ের মতো ।প্লিজ আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন না।আমাকে আপনি মুক্তি দিন।আমি এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো।তিনি কিছুটা ভেবে বললেন,

-” তুমি আমার মেয়ের মতো না।আমার মেয়েই তো।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার মেয়েটা বড় হয়েছে।তাকে বিয়ে দিতে হবে। তুমি যেহেতু এই বাড়িতে থাকতে চাইছো না। ঠিক আছে আমি মা হয়ে তোমার অনুরোধ কিভাবে ফেলে দেই বলো ?বিয়ের জন্য তৈরি হ‌ও মা।এই শুক্রবার তোমার বিয়ে। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। একদম রাজ রানী হয়ে থাকবে তুমি।আর যদি বিয়েতে রাজী না হ‌ও, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। বিয়ে না করলে তোমার এই বাড়িতেই থাকবে হবে। তখন তোমার সাথে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, এর জন্য কিন্তু আমি দায়ী থাকবো না।”

-” সেদিন নিজেকে নরপশুদের হাত থেকে বাঁচতে আমি বিয়েতে রাজী হয়ে যাই। কিন্তু পরে জানতে পারি যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার ঘরে আরো দুইটা ব‌উ বাচ্চা রয়েছে। যথারীতি বিয়ের দিন উপস্থিত হয়।আমাকে জোর করে পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দেয়।বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছিলো না। আমি যেকোনো কিছুর বিনিময়ে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছিলাম।আর সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই রাস্তা মৃ’ত্যু। নিজেকে নিজের হস্তে শেষ করে দেওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করে হাতের উপর ব্লে’ড দিয়ে টান দিবো আর তখনি আমাদের বাড়ির কাজের মহিলা রহিমা খালা যার গায়ে আমি আমার মায়ের গন্ধ পেতাম।খালার স্বামী সন্তান ছিলো না। মূলত খালা আমার জন্যেই আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকতো।খালা আমার হাত থেকে ব্লে’ড ফেলে দিয়ে আমার হস্তে বোরকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-” আমি অনেক দিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম।কবে তোকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবো। অবশেষে আজ সেই সুযোগ এসেছে। সবাই বর পক্ষের লোকদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।এখনি সুযোগ। তুই ঝটপট এই বোরকা টা গাত্রে পরিধান করে নে।আর পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যা।না হলে ওরা তোকে বাঁচতে দিবে না মা।”

-” কিন্তু খালা ঐ মহিলা যদি জানতে পারে তুমি আমাকে পালাতে সাহায্য করেছো ।তাহলে তোমাকে সে ছেড়ে দিবে না।”

-” আমার কথা তোর ভাবতে হবে না। তুই তোর নিজের কথা ভাব। আমি তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম আমি তোর খেয়াল রাখবো।তোকে ভালো রাখবো।আজ তোর জন্য যদি আমার মৃ’ত্যু ও হয় হোক।এতে আমার কোনো আফসোস থাকবে না। তুই কথা না বাড়িয়ে ঝটপট বোরকা টা পরিধান কর।”

-” আমি খালার কথা মতো বোরকা পরিধান করে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না। অকস্মাৎ একটা বাস এসে সামনে দাঁড়ায়।আমি কিছু না ভেবেই বাসে উঠে পড়ি। কিন্তু বাস থেকে নামতেই কিছু বখাটে ছেলের কবলে পড়ি। তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে দৌড়াতে শুরু করি।আজ সারাদিন নিজের উপর অনেক ধকল গিয়েছে।যার জন্য একসময় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না।চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। এরপর আর কিছু স্বরনে নেই।চোখ খুলে আপনাকে দেখতে পাই।”

-” সব কিছু শুনে যেন ইজহান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।সে সন্তর্পণে জারার হস্ত দুটো নিজের হস্তের মধ্যে নিয়ে বললো, আমাকে বিয়ে করবেন মিস???”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here