-” বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীর ঠোঁটের আলিঙ্গন দেখে যেনো পায়ের তলার মাটি সরে গেলো অদ্বিতীয়ার।হাত পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসে তার। দর্শনেন্দ্রিয় থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ে ।এসির মধ্যে থাকার পরেও ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের মুক্ত দানার সৃষ্টি হয়। অদ্বিতীয়া তার গাত্রে পরিধান কৃত শাড়ির আঁচল দ্বারা ললাটের ঘাম মুছে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নেয়। মাত্র তিনদিন হয়েছে রহমতপুর গ্ৰামের চেয়ারম্যান শামসুল জোয়ার্দারের ছোট ছেলে ইরহান জোয়ার্দারের সাথে অদ্বিতীয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।এখনো দুটো হস্ত মেহেদির গাড়ো লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে রয়েছে। তনু থেকে কাঁচা হলুদের গন্ধ আসছে।অথচ এরই মধ্যে স্বামীর রঙ্গলীলা দেখতে হলো অদ্বিতীয়া কে। বিয়ের দু’দিন পার হলেও স্বামী কে মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য নিজের কাছে পেয়েছে অদ্বিতীয়া। কিন্তু ইরহান জোয়ার্দার তাকে ভালোবেসে তার কাছে আসে নি।এসেছে নিজের শরীরের ক্ষুধা মেটাতে। তবুও অদ্বিতীয়া তার নিয়তি কে মেনে নিয়েছে।কারণ তার দাদি তারা বিবি তাকে বারবার বলে দিয়েছে, সোয়ামি অমূল্য রতন। সোয়ামি যেমনি হোক , সোয়ামির সংসারে মানিয়ে নিতে। সোয়ামি তাকে যেভাবে চাইবে সেভাবে তাঁর নিকট নিজেকে শপে দিতে। অদ্বিতীয়া আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে স্বামীর রঙ্গলীলা দেখতে পারলো না। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তার। অদ্বিতীয়া লোচনের পানি মুছে সন্তর্পণে রুম থেকে বের হতে যাওয়ার সময় ভুলবশত তার হস্ত লেগে টেবিলের উপর রাখা ফুলদানি নিচে পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার দরুন বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়।সেই শব্দ পেয়ে ইরহানের কার্যে ব্যাঘাত ঘটে।সে তৎক্ষণাৎ কাজের মেয়ে পলি কে ছেড়ে দিয়ে অদ্বিতীয়ার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার অধরে হস্ত দ্বারা স্লাইড করতে করতে বললো,
-” ডোন্ট প্যানিক সুন্দরী।টেক ইট ইজ। এই বয়সে এমন একটু আধটু হয়।এটা আমার দোষ না সুন্দরী। আমার বয়সের দোষ। তবে আজ যেটা দু নয়নে দেখেছো সেটা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখো।ভুলেও যেনো এই কথা ইজহান জোয়ার্দারের কর্ণপাত না হয়।কোনো ভাবে যদি ভাইয়া এই ব্যাপারে জানতে পারে, তাহলে কিন্তু তোমার সাথে খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে বলে অদ্বিতীয়া কে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ইরহান রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ইরহানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে অদ্বিতীয়া বললো, তুমি আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলে দাদি । তুমি সবসময় বলতে,
-” তুই মেলা ভাগ্যবতী রে ধলা বু। তুই আমার নাহাল কালা হস নি। তুই ধলা চামড়া পাইছোস। ধলা মাইয়াগোরে বিটা মাইনষে বহুত ভালোবাসা দেয়। তুই দেহিস ধলা বু তোর সোয়ামি তোরে মেলা ভালোবাসা দিবেনে।তোর এই চাঁন্দের নাহাল বদনখানা দেখলি যেকোনো বিটা মানুষ যুগ যুগ পার করে দিতি পারবি। তুই সোয়ামি সোহাগা হবি রে ধলা বু। তোমার ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হলো দাদি। আমি পারলাম না আমার সৌন্দর্য দিয়ে বরকে আমার আঁচলের তলায় বেঁধে রাখতে।এটাই যে আমার নিয়তি দাদি।মাত্র ষোলো বছরে আমার জীবনে যে কতো দূর্বিষহ ঘটনা ঘটে গিয়েছে একবার ও চেয়ে দেখলো না আমার স্বার্থপর বাবা মা।”
-“অদ্বিতীয়া খুবই সাধারণ একটা মেয়ে।এতটাই সাধারণ যে সামান্য একটা টিকটিকি মা’র’তে ও তার হাত কাঁপে। এই সাধারণ মেয়েটার সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হয় মাগুরা জেলার ডুমুরশিয়া গ্ৰামের খাঁন পরিবারে। অদ্বিতীয়ার বাবা চাচারা মোট তিন ভাই। কিন্তু কারো ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হয় নি। খাঁন বংশে অদ্বিতীয়া প্রথম কন্যা হওয়ার সংবাদে সবাই যেন আসমানের চন্দ্র হাতে পায়।আনন্দে উৎসবে মেতে উঠে গোটা পরিবার।পুরো গ্ৰামে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অদ্বিতীয়ার বাবা আজমল খাঁন তার কন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুম্বন দিয়ে মেয়ের নাম দেন অদ্বিতীয়া। আস্তে আস্তে ছোট্ট অদ্বিতীয়া সবার আদর স্নেহে বড় হতে থাকে। কিন্তু সেই আদর ভালোবাসা বেশিদিন তার জীবনে স্থায়ী হয় না। অদ্বিতীয়া যখন সাত বছরের তখন অদ্বিতীয়ার বাবা মায়ের রোড এক্সিডেন্টে মৃ’ত্যু হয়।সেটা আদৌ এক্সিডেন্ট না খু’ন ছিলো সেটা বোধগম্য হয় না ছোট অদ্বিতীয়ার । বাবা মায়ের মৃ’ত্যু’র পর যেন অদ্বিতীয়ার চাচাদের আসল চেহারা তার সামনে প্রদর্শিত হয়।যে চাচাদের চোখে এতো দিন ভালোবাসা দেখতে পেয়েছে সে চোখে যেনো অদ্বিতীয়া ঘৃণা লালসা দেখতে পায়। অদ্বিতীয়ার বাবার কোটি কোটি টাকার সম্পদ তারা আত্মসাৎ করে নিজেদের করে নেয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া মেয়েটার জীবনের কালো অধ্যায় শুরু হয়।”
________________________
-” একি তীয়া তুমি ফ্লোরে বসে রয়েছো কেন?শরীর খারাপ করছে? শামসুল জোয়ার্দারের বড় ছেলে অর্থাৎ ইজহান জোয়ার্দারের স্ত্রী জারার প্রশ্নে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে অদ্বিতীয়া।জারা অদ্বিতীয়া কে আদর করে তীয়া বলে ডাকে। সম্পর্কে সে অদ্বিতীয়ার বড় জা হলেও অদ্বিতীয়া কে সে নিজের বোনের থেকেও বেশি ভালোবাসে।এই তিন দিনে মানুষ টা অদ্বিতীয়ার কোমল হৃদয়ে জায়গা দখল করে নিয়েছে। মানুষ টা কে দেখা মাত্রই অদ্বিতীয়া কালবিলম্ব না করে জারা কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-” আমার সাথেই কেনো সবসময় খারাপ হয় আপু? আমি কি জীবনে কখনো সুখের নাগাল পাবো না?”
-” জানি নারে বোন।আমি বুঝতে পারছি না তোমার চাচারা কিভাবে তোমাকে একটা নরকের মধ্যে ঠেলে দিলো।তোমাকে বিয়ে দেওয়ার আগে তাদের অনন্ত একটা বারের জন্য হলেও ইরহানের ব্যাপারে
খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিলো।শুনেছি ইরহানের নামে অনেকগুলো কেস আছে।যার মধ্যে রে’প কেস ও আছে কয়েকটা। কিন্তু শামসুল জোয়ার্দার নিজের ক্ষমতা আর টাকার জোরে সেগুলো কে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। তুমি এসব কথা ভুলেও কারো সামনে বলো না।তাহলে শামসুল জোয়ার্দার তৎক্ষণাৎ তোমার জিভ কর্তন করে নিবে। পাঁচ বছর হলো আমি এই পরিবারের বউ হয়ে এসেছি। কিন্তু আজো এই পরিবারের রহস্য উদঘাটন করতে পারি নি।মাঝে মাঝে ভাবি ইজহানের মধ্যে কি সত্যি শামসুল জোয়ার্দারের র’ক্ত প্রবাহিত হয়েছে?ইজহান , ইরহান দুজন আপন ভাই হবার পরেও দুজন যেনো দুই মেরুর। সত্যিই হাতের পাঁচ টা আঙ্গুল কখনো সমান হয় না। যদিও তুমি ইরহানের বিবাহিত স্ত্রী তবু ও তোমাকে বলতে হচ্ছে ইরহানের মধ্যে আমি কখনো কোনো মানুষের বৈশিষ্ট্য পাই নি।সবুর করো আস্তে আস্তে সবার আসল চেহারা তোমার সামনে আসবে।”
-” তুমি অনেক ভাগ্যবতী আপু।ভাইয়ার মতো একটা ছেলেকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছো।”
-” সত্যিই জারা মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী।তবে ইজহান কে পেতে জারার অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে।ইজহান পেশায় একজন পুলিশ অফিসার।যদি ও তার পুলিশের চাকরি করার কোনো ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু শামসুল জোয়ার্দার নিজের ভিত মজবুত করার জন্য তার বড় ছেলেকে পুলিশ অফিসার বানিয়েছেন।তার পোস্টিং হয় বরিশালে। পুলিশে জয়েন করার পর ইজহান সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে কাজ করতে থাকে। তার কাজ দেখে উপরমহল ও সন্তুষ্ট হয়। একের পর এক কেস সলভ করে প্রশংসায় ভাসতে থাকে ইজহান। যথারীতি ইজহান নিজের ডিউটি শেষ করে ফর্মাল ড্রেস পরে বাড়ির সবার জন্য শপিংয়ের উদ্দেশ্য গাড়ি নিয়ে বের হয়।বাড়ির প্রত্যকটা সদস্যদের জন্য কিছু না কিছু ক্রয় করে ইজহান।যার দরুন বেশ রাত হয়ে যায় তার।সে ভেবেছিলো আজকেই রহমতপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিবে।কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় ইজহান সকালে গ্ৰামে যাওয়ার মনস্থির করে। শুনশান রাস্তায় ইজহান ড্রাইভ করছে। মাঝে মধ্যে শীতল বাতাসে তার গা শিউরে উঠছে। ব্যাপার টা মন্দ লাগছে না ইজহানের ।সে ড্রাইভ করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেনো একটা মেয়ে তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে।ইজহান অতি দ্রুত ব্রেক নেয়। মেয়েটা হুট করে যেভাবে তার গাড়ির সামনে এসে পড়েছে মূহুর্তের মধ্যে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পাড়তো।ইজহান কালবিলম্ব না করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে মেয়েটা কালো বোরকা দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে। শুধু মাত্র তার মায়াবী কাজল রাঙ্গা চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।যে চোখে নিজের স’র্ব’না’শ দেখতে পেলো ইজহান।ইজহান কিছু বলার আগেই মেয়েটা ইজহানের বুকে ঢলে পড়লো।ইজহান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
-“প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার স’র্ব’না’শ। ”
[ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
চলবে ইনশাআল্লাহ।।।
#অদ্বিতীয়া
#সূচনা_পর্ব
#নুজাইফা_নূন