#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ০৪
পরদিন সকালবেলা শুভ্রা একই সময়ে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি তার সকল কাজ সেরে নিলো। কাল থেকে সোহেল মাত্রাতিরিক্ত খুশি থাকায় সে আর শুভ্রার সাথে বদ আচরণ করে উঠে নি। শুভ্রা যখন প্রথম প্রথম কাজ করতে এসেছিল তখন সব স্বাভাবিক ই ছিল। দুয়েকমাস যেতেই সোহেলকে কেমন তার ভালো ঠেকে না। আর এখন তো দেখছে ইদানীং বেশি বাড়াবাড়িই করে ফেলছে। মালিকপক্ষের ছেলে বলে কাউকে কিছু বলতেও পারে না। কাকে বলবে সে? কে ই বা বিশ্বাস করবে তার কথা? তবে আজ সকালবেলা নাস্তা করার সময় নাস্তা দিতে যাওয়ার সময় শুভ্রার হাত আবার ধরে ফেলে। ধরা এক কথা কিন্তু হাত টাকে এমন বাজে ভাবে ধরে যে স্টাইলে ধরে স্পর্শ পেলেই গা ঘিন ঘিন করে উঠে শুভ্রার। জোরপূর্বক কোন রকম ছাড়িয়ে শুভ্রা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর বিল্ডিং থেকে বের হয়ে নিচে এসে ফ্লেক্সিলড, বিকাশ এর দোকানে যায় সে। উদ্দেশ্য মা কে টাকা পাঠাতে হবে। মি.আনিসুর রহমান প্রত্যেক রাতে এসে শুভ্রাকে তার মজুরি দিয়ে দেন। তারপর সকাল বেলা এসে ৫০০ টাকার ৪০০ টাকা তার মাকে দেয় আর ১০০ টাকা সে নিজে রাখে। শুভ্রা যখন দোকানে যাচ্ছিলো তখন সাদাফ আর নাদিম ও অই দোকানে যাচ্ছিলো ফ্লেক্সিলোড করতে। একই সাথে তারা দোকানে ঢুকে আর সাদাফ এক মনে নিজের ধ্যান এ মোবাইল চালাচ্ছিল। দোকানদার শুভ্রাকে দেখল সে দোকানের এক কোনে দাড়িয়ে আছে তাকে দেখা মাত্র বলে উঠলো
ঃ আরে শুভ্রা মা ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
শুভ্রাঃআসসালামু আলাইকুম আংকেল।
শুভ্রার গলার আওয়াজ শুনা মাত্রই সাদাফ মোবাইল থেকে মুখ তুলে আগে শুভ্রার দিকে তাকায়। সে এতক্ষন নাদিম এর সাথে এভাবে কথা বলায় মুখ ফিরাতে নাদিম ও তাকায় শুভ্রার দিকে।
দোকানদারঃ ওয়ালাইকুমুসসালাম। কেমন আছো মা?
শুভ্রাঃ জ্বি আংকেল আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনি?
দোকানদারঃআমিও আছি আল্লাহর রহমতে। তো আজকেও টাকা পাঠাবা?
শুভ্রাঃ জ্বি আংকেল।
দোকানদারঃ তো কথা বলবা আম্মার সাথে?
শুভ্রা পাশে সাদাফ আর নাদিম আছে কিনা দেখার জন্য চোখ ঘুরালে দেখে সাদাফ আর নাদিম উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে উঠে। সাদাফকে দেখেই শুভ্রা কেমন ভড়কে যায়। প্রায় থ মেরে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সাদাফ ভেবেছে শুভ্রা সাদাফকে চিন্তে পেরে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে। কিন্তু তাকে আবারও ভুল প্রমাণিত করে শুভ্রা।
শুভ্রাঃনা না আংকেল আজ আর কথা বলবো না। আপনি বরং টাকাটা পাঠিয়ে দেন। এই বলে শুভ্রা টাকাটা দিয়ে চলে গেল। সাদাফ আজও লক্ষ ককরল শুভ্রার গালে কালকের দাগ টা না থাকলে হাতে আবার বেশ সুন্দর করে লাল হাতের ৪ আখগুলো দাগ বসে আছে।
শুভ্রার যাওয়া দেখে দোকানকার নিজেই হেসে উঠে।তারপর বলল মেয়েটা এমন ই। যেদিন দোকান লোক থাকবে সেদিন আর তার নিজের কাজ বলতে কিছু থাকবে না।
সাদাফঃ আপনাকে যে টাকা দিয়ে গেল, এসব কিসের টাকা?
দোকানদারঃ আরে ও হলো যে কি ওই বিল্ডিংয়ের মালিকের বাসায় কাজ করে। এই ৭/৬ মাস হবে কিনা। যেদিন থেকে এসেছে সেদিন এর পরদিন থেকে রোজ আসে ৪০০ টাকা নিয়ে তার মা কে বিকাশ করে দিতে। তাকে নাকি ডেইলি ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। ১০০ নিজে রাখে আর গুলো গ্রামের বাড়িতে মা কে দেয়। আর ওবাড়ির মালিকটা ভালো হলেও মালকিন বেশ কিপটে ওতোটা নাকি ছেড়ে রাখে না। মা কে কয়েক মিনিট কথা বলার জন্যও সময় দেয় না। তাই আমার কাছে এসে মোবাইলটা নিয়ে কিছুক্ষন কথা বলে।
সাদাফঃ এভাবে পরের বাড়িতে কাজ করার কোনো প্রয়োজন? উনাকে দেখে তো মনে হলো বেশ ভদ্র আর শিক্ষিত একজন মেয়ে। বয়স ই বা কদ্দুর হবে ১৬ কিংবা ১৭।
দোকানদারঃ মেয়েটার নাকি বাবা নেই। সে ও নাকি বড় মেয়ে বাড়ির। তাই টাকা রোজগারের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের হাল ধরছে।
কথাটা সাদাফ এর মনে ছ্যাত করে লাগলো। টাকা রোজগারের জন্য বুঝি এভাবে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়। তা ও তো দেখে মনে হচ্ছে রোজ তার উপর শারীরিক টর্চার করা হয়।
এতক্ষন পর এসে নাদিম মুখ খুললো। মুবাইল থেকে মুখ তুলে শুভ্রার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকা আর শুভ্রার পোশাক জানান দিচ্ছে যে এটাই কালকের ধাক্কাজনিত মেয়েটা। সাদাফ এর চুপ থাকার পর নাদিম বলে উঠলোঃ মামা,,, এটাই তাহলে ভাবি না,,,,, তাই বলি সাদু মিয়া হঠাৎ কাদু কেন হয় গেলো।
তারপর তারা তাদের কাজ সেরেই সেখান থেকে চলে গেলো।
আজও শুভ্রা ছাদে এসেছে গাছে পানি দেওয়ার জন্য। সাদাফের আজ কেন মনে হলো অন্তত শুভ্রাকে দেখার জন্য হলেও তার ছাদে যাওয়া চাই।
সাদাফঃ এই চল ছাদে যাই বাতাস খেয়ে আসি। এখানে সারাদিন রুমে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছি।
নাদিমঃ উমম মিয়া বুঝি বুঝি। সবই বুঝি। বাতাস খাইতে যাবা নাকি বাতাস লাগাইতে যাইবা সব ই বুঝি।
সাদাফঃ মানে? কি বলছিস এসব উলটা পালটা
নাদিমঃ কিছু না চল। দুইটা কফি আনতে বল। (সাদাফের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে)
সাদাফঃ আচ্ছা চল ( সে ও নাদিমের পিঠে এক ঘুষি দিয়ে দিলো)
ছাদে উঠা মাত্রই সাদাফ পাশের ছাদে নিচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো। নাদিম বেশ বুঝতে পারছে সাদাফ কাউকে খুজছে। ঠোঁট টিপে হেসেই পাশের আরেকটা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় একটা মেয়ে ছিলো। তাকে দেখেই বললো
নাদিমঃ ওই দেখ ভাবি।
সাদাফঃকই কই!!! ( বেশ উৎসাহ নিয়ে)
নাদিমঃ ওই দেখ ওউ পাশের বিল্ডিংয়ে।
সাদাফ এবার চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে বলে,
সাদাফঃ ভাবি মানে কার বউ বুঝাতে চাচ্ছিস তুই?
নাদিমঃ আরে বেডা তুই যারে বুঝতেছস সে আর কি?
সাদাফঃ আমি মানে। আমার কি গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি বউ আছে যে তুই ভাবি বলছিস?
নাদিমঃ ঢপ মারিস না দোস্ত তোরে আমি বুঝি। ( কিছুটা হায় ভংগি দিয়ে ?) তুই যে এহানে বাতাস খাইতে আসোস নাই তাও বুঝি। ওই দেখ ভাবি!!!
ঠিক তখনই শুভ্রা ছাদে উঠছিলো। আর বাগানে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করছিল।
সাদাফঃ শালা বার বার ভাবি ভাবি কেন করস বল তো?? বার বার ফাজলামো ভালো লাগে না নাদিম্মা আমার।
সাদাফ এবার নাদিমের কথা বিশ্বাস না করেই উল্টো হয়ে দাড়িয়ে আছে। নাদিম তাকে কোনো মতে জোর করে পেছনে ফিরিয়ে শুভ্রাকে দেখায়।
নাদিমঃ শালা ওই দেখ ভাবি। সত্যি সত্যিই বলছি।
সাদাফ নাদিমের কথায় এবার লজ্জা পেয়ে গেলো। এসব সে কি করছে? কোনো বাড়ির কাজের লোকের জন্য কেন তার এতো আগ্রহ, কেন তার এতো টান? বার বার তাকে দেখার জন্যই বা কেন ওতো আকুলতা? কি আছে এই মেয়েতে? এসব সে শুভ্রার দিকে তাকিয়েই ভাবছিল। হটাৎ দেখছে শুভ্রা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কি!! সে ভুল দেখছে না তো? পালাই পালাই মেয়েটা আজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে!
শুভ্রা আজও পানি দেওয়ার ফাকে আশে পাশে তাকাচ্ছিল। ঠিক ই দেখলো কালকের সেই জায়গায় দুই জন লোক দাড়িয়ে আছে।রোদের তীব্রতা না থাকায় আজ সে তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সাদাফ কে সে চিনতে পেরেছে। ব্ল্যাক ট্রাউজার সাথে ব্রাউন গেঞ্জি ফর্সা লম্বা জিমওয়ালা শরীরটা হাতে কফির মগ নিয়ে কি আকর্ষণীয়ই না লাগছে। না চাইতেই আজ কোনো পুরুষ মানুষের প্রতি শুভ্রার চোখ আটকে যায়। আর এই লোকটাকে দেখলেই তার কেমন চেনা চেনা অবিয়ব লাগে। যেন তার দিকে তাকিয়েই থাকি আর বের করি কার মতো যেন লাগে তাকে।
দুজন দুজনের দুজনের দিকে বেশ কিছুক্ষন থাকানোর পর নাদিম বেশ বড় করেই বলে উঠলো মামা ভাবিরে আর কতো দেখবি। আশেপাশে আমরাও আছি তো ভায়া। সাদাফের এবার হুশ আসে সে কি করছিল। এতোক্ষন কারো দিকে তাকিয়ে থাকায় সাদাফ আর শুভ্রা মনে মনে বেশ লজ্জা পায়। তবে নাদিমের বড় করে বলা কথাটা আর ভাবি ডাকটা স্পষ্ট শুনেছে। নাদিম যে তাদের দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে সেটা নাদিমের শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বলাকেই বুঝে গিয়েছে। কিন্তু তাকে কেন ভাবি বলা হলো সে নিজেই তার হিসেব মিলাতে পারছে না। তারপর নাদিম আবার শুভ্রা কে বলে উঠলো “কেমন আছেন? ” সাতপাচ না ভেবে এখন শুভ্রা দিলো এক দৌড়।
সাদাফ এবার বেশ রেগে গেলো। গেলো তো আবার পালিয়ে। সব এই নাদিম্মার জন্য।
সাদাফঃ কি!!”””” নাদিম্মা। এভাবে বেন্ড সাউন্ড দিস লজ্জা করে না??
নাদিমঃ ছোট বেলায় যখন আমি কারো দিকে তাকাতাম তখন বন্ধুরা মিলে তোরা কি করতি মনে আছে?? এখন তোকে দেখছি তাই শোধ নিলাম আর কি ( শার্ট এর কলার কিছুটা ঝাকি দিয়ে)
সাদাফঃ ভাই সেটা ছোট বেলা। এখন কি করলি এটা? বাচ্চা মেয়েটা লজ্জা পেলো তোর কথায়। আবার পালিয়ে গেলো। এখন আমাদের ব্যাপারে কি ভাব্বে বল তো?
নাদিমঃউলে উলে উলে ভাইটা আমাল লাগ কলে না। তোর জন্য ওই মেয়ে কেন হাজার টা মেয়ে আমি তুলে আনতে রাজি। আর এই একটা মেয়ের ইম্পোরটেন্স পাওয়ার জন্য এরকম করছিস তুই? জীবনে তো প্রেম করিস ই নাই। এখন আবার প্রেমে পড়ছিস একটা বাইচ্চা মেয়ের লাইজ্ঞা। তোরে দেখলেই তো পালাই যায়।
সাদাফঃ তুই তো বেডা প্লে বয়। প্রেম ভালোবাসার কি বুঝবি রে? দিনে কয়টা বদলাস খেয়াল কি তোর নিজের ও আছে?? আমারব জ্ঞান দিতে আইছস! ভাগ!
এই বলে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷
পরদিন সকাল বেলা সোহেল অফিসে যাওয়ার পর মিসেস লুতফা বললো তাদের নাকি আজ কোন বিয়েতে দাওয়াত আছে। তাই সায়মা, মিসেস লুতফা আর মি.রহমান দাওয়াত খেতে যাবে। মি.রহমান মিসেস.লুতফাকে বলেছিলেন অবশ্য তার সাফ মানা যে বাড়ির কাজের লোকের জন্য এতো আলগা দরদের কোনো প্রয়োজন নেই। আর সোহেলের আজ হাফ ছুটি তাই দুপুরে এলে তাকে খাবার দিতে হবে।
#চলবে।