#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৪৮।
চারদিকে ভ্রমরের মতো গুন গুন করছে নানা মানুষ। তারই মাঝে এক টকটকে কচি ফুলের ন্যায় বধুবেশে বসে আছে কুবরা।
নতুন পরিবেশ, নতুন ঘর, নতুন মানুষ সাথে নতুন সংসার বাধার একরাশ স্বপ্ন। ড্রয়িং রুমে একটা চেয়ারে বসে আছে কুবরা। তার আশেপাশে বসে আছে নাদিমদের পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন। একেক জন এসে এসে কেউ তাকে গিফট দিচ্ছে, কেউ শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, কেউ বা তার মিষ্টি পানা মুখ খানি ধরে রুপের প্রশংসা করছে।
নিজেরও এখন অনেকটা ভালো লাগছে। আসার সময় যে মন খারাপটা ছিলো এখানে এসে তাদের সাথে কথা বলে এখন অনেকটা হালকা লাগছে।
নাদিমের খালাঃ বুঝলেন ভাবি, ছোট মেয়ে বিয়ে করাই ভালো। আমরা তো ভেবেছিলাম নাদিম বাবা শহরে থাকে নিজের সমবয়সী কাওকে বিয়ে করবে। যতোই বলেন শহুরে রেওয়াজে তো এখন এটাই চল। তবে বউ আমার ছোটখাটো খুব মিষ্টি লেগেছে।
প্রতিবেশীঃ হ্যা। তা ও ঠিক।আজকাল কার ছেলেমেয়ে যে বিয়ে করে তার কি কোনো ছিরি আছে নাকি। হয় বউ বড় নাহলে সমবয়সী। দেখতেও কেমন বেমানান।
পাশে বসে থাকা বড়রা একেক জন একেক রকম কথা বলছে। এই বয়স নিয়ে কুবরা প্রথমে কতো হীনমন্যতায় ভোগেছিলো যে লোকে কি না কি বলবে। ছোট মেয়ে এই বয়সে বিয়ে করে ফেলছে তার উপর লোকে সুনাম করছে! এসব কথা শুনে লজ্জায় না পারছে এখান থেকে সরে উঠতে না পারছে বসে থাকতে।
কিছুক্ষন বসে থাকতে থাকতে তার মনে হলো ভিড়ের মধ্যে সে যেন লিনা কে দেখেছে। কিন্তু নাদিম তো বললো সে বাইরের কাউকে ইনভাইট করে নি। হয়তো ভুল দেখেছে হয়তো। এতো রাগারাগি সত্ত্বেও নাদিম লিনাকে ডাকতে কেন যাবে?
আবারও কিছুক্ষন বসে থাকার পর সে স্পষ্ট দরজার সামনে লিনাকে দেখতে পায়। রাগে জ্বালায় চোখমুখ তার গরম হয়ে উঠে। এই মেয়েটাকে সে দেখা মাত্রই জ্বলে উঠে। একদম সহ্য করতে পারে না।
শালি… সেজেগুজে আবারও এখানে চলে এসেছিস বেহায়ার মতো! আমি তো নিশ্চিত যে উনি তোকে ইনভাইট ই করেন নি, যেখানে আমি তোকে একদম সহ্য করতে পারি নি। তাও তুই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসতে পারলি? দাড়া তোকে আমি দেখাচ্ছি মজা। ( মনে মনে বলে কুবরা)
কুবরাঃ মিমি শুনছো…
মিমিঃ হ্যা ভাবি বলুন…
কুবরাঃ বলছি আমি আমার একটু ওয়াশরুমে যাবো। আমায় একটু নিয়ে যাবা…?
মিমিঃ নিশ্চয় ভাবি, চলুন ওয়াশরুম ওই দিকটায়।
এরপর মিমি আর কুবরা রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে বাইরের যে রোমটায় নাদিম, সাদাফ, তার অন্যান্য কাজিরা আড্ডা দিচ্ছে সেখানে লিনা ও ঘুরঘুর করছে।
কুবরা হেটে যাওয়ার সময় লিনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। লিনা ও হেটে নাদিমের দিকে এগোচ্ছিলো। যেই দুজন পাশাপাশি হয় তখনই কুবরা নিজের একটা পা লিনার পায়ের সামনে আনাতেই হোচট খেয়ে একেবারে সকলের সামনে চিতপটাং…। কেউ বুঝে উঠার আগেই তারাতাড়ি মিমিকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় কুবরা।
ছোটবাচ্চাদের মতো পুরো হোচট খেয়ে ফ্লোরে নেতিয়ে যায় লিনা। আশেপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা হু হা করে হাসতে থাকে লিনার এমন অবস্থা দেখে। নাদিম তো কুবরাকে আসতে দেখে শুরু থেকে তার দিকেই চোখ ছিলো তাই লিনা কে যে সে ইচ্ছে করে ফেলেছে তা অন্যকেউ না দেখলেও নাদিম দেখেছে। সেও মনে মনে হেসে উঠে বউয়ের পাগলাটে দুষ্টুমি দেখে। সাদাফ আর শুভ্রাতো মুখ টিপে হাসতে হাসতে কুটুকুটি হয়ে যাচ্ছে বোনের কর্মকাণ্ড দেখে।
বেয়াক্কল লিনা বুঝেই উঠতে পারেনি যে সে কি করে পড়ে গেলো। ঠিকি বেহায়ার মতো উঠে দাত কেলিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। সবাই স্বাভাবিক থাকলেও ছোট বাচ্চারা সকলেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো
কিন্তু তাতে যেন তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
রাত ১০ টা নাগাত বাজে। খাওয়ার আয়োজন প্রায় শেষ। বর কনে কে একসাথে বসিয়ে দুই প্রানে লম্বা টেবিলে সারি সারি হয়ে বসেছে সকল আত্মীয় স্বজন। নাদিমের পাশের চেয়ারে সাদাফ বসেছে আর কুবরার পাশের চেয়ারে শুভ্রা বসেছে। কনের বাড়ি থেকে যেহেতু কাউকে না কাউকে আসতে হয় তাই শুভ্রা এসেছে। আর সাদাফ ও এসেছে একটা অন্য কারণে । যা কিছুক্ষন পর টের পাওয়া যাবে।
খাওয়াদাওয়া যখন শুরু হয় তখন আবার লিনা এসে হাজির হয়। সাদাফ আর নাদিমের বসার মাঝখানে ঢুকে দাড়িয়ে থাকে সে। তারপর তরকারির বাটি নিয়ে শুধু নাদিম আর সাদাফকে তরকারি সার্ভ করে দেওয়ার বাহানায় তাদের দুজনের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকে সে৷
সাদাফঃ আরে আপনার সার্ভ করার দরকার নেই। আমি আছি করে দিচ্ছি।
লিনাঃ না না.. তা কি করে হয়। আমি তো স্যার এর পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। সব কাজ তো আমারই করা উচিত। আপনি বসুন আমি সার্ভ করে দিচ্ছি।
এদিকে তো দুই বোন রাগে চটে পুরাই গরম। আগে তো নাদিমের পিছু পিছু ঘুরতো। এখন দেখি নানান বাহানায় সাদাফের সাথেও ঘেষাঘেষি শুরু করে দিচ্ছে!
শুভ্রাঃ শুধু কি উনাদের দিলে হবে? আমরাও তো আছি এদিকে। দায়িত্ব যখন নিয়েছেন আমাদের ও সার্ভ করুন ( দাত কটমটিয়ে বড় করে বলে যাতে সবাই শুনে)
শুভ্রার কথা শুনে অনেকেই লিনার দিকে তাকিয়ে আছে এইবার। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুখটাকে বাংলার পাচের মতো বানিয়ে শুভ্রা আর কুবরার প্লেটে সার্ভ করতে যায় লিনা।
” খুব শখ নারে শাকচুন্নি তোর খাবার সার্ভ করার? দেখাচ্ছি মজা আমি তোকে। তোর জন্মের মতো খাবার বেড়ে দেওয়ার সাধ ঘুচিয়ে দিবো আমি। ” ( পাশে লিনা দাড়াতেই মনে মনে বলে কুবরা)
যেই কুবরাকে দেওয়ার পর শুভ্রাকে দিতে যাবে তখনই সকলের চোখের অগোচরে নিজের হাত টাকে আস্তে করে বাটির নিচে রেখে লিনার দিকে কাত করে দেয়। ব্যাস গরম গরম তরকারি আর ঝোল সব গুলোই লিনার ড্রেসে পড়ে সর্বনাশ…!
লিনাঃ আয়ায়ায়া ও মাই গড…( তরকারির বাটিটা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে)
লিনার চিৎকার শুনে সকলের দৃষ্টি এবার তার দিকে চলে যায়। সাদা গাউনে তরকারির হলুদ ঝুল পড়ে পুরাই নষ্ট হয়ে একাকার।
কুবরাঃ “চ” এমা…. এ আপনি কি করলেন মিস এসিস্ট্যান্ট…. পারতেন না যখন তাহলে বলতেন। না পেরে অযথা লোক দেখানোর কোনো দরকার ছিলো? ( অসহায় ভঙ্গিতে)
লিনা চোখ কটমট করে কুবরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কুবরা যে ইচ্ছে করেই লিনার উপর বাটিটা ফেলেছে সেটা কুবরার খুটা দেওয়া কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে।
” এভাবে তাকিয়ে কি হবে শাকচুন্নি.. যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে। এবার তোর বিদায়ের পালা আর মহা রাজার ব্যান্ড বাজানোর বালা। ” ( লিনার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে)
শুভ্রাঃ এমা.. ড্রেস টা তো এক্কেবারে নষ্ট হয়ে গেলো। এখন কি হবে। তুমি তো আর আলাদা ড্রেস আনো নি। এই অবস্থাতেই খাওয়া দাওয়া করবে?
শুভ্রার কথা শুনে উপস্থিত বাচ্চারা সকলে মিলে আবার হেসে উঠে। রাগে, অপমানে আর সইতে না পেরে গটগট করে হেটে চলে গেলো লিনা ।
লিনা চলে যাওয়ার সাথে সাথে শুভ্রা,কুবরা দুজনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদাফ আর নাদিমের দিকে তাকায়।
খাওয়াদাওয়া শেষে পাড়া প্রতিবেশী সবাই যে যার যার মতো নিজ বাড়িতে চলে যায়। যারা দূর থেকে এসেছে তারা সকলে থাকবে আজ। কুবরা নাদিম রেখে সাদাফ আর শুভ্রা মিলে নাদিমের ঘরে যায়। মূলত বাসর ঘর সাজানোর জন্যই এসেছে তারা।
নাদিমের কোন বড় ভাই বোন কিংবা ভাবি নেই যে বাসর ঘর সাজাবে তাই সাদাফ শুভ্রা এসেছে।
হাতে এক বোল গোলাপ আর ক্যান্ডেল ধরাম করে আওয়াজ করে ফ্লোরে রাখে শুভ্রা। সাদাফ দরজা বন্ধ করছিলো ওই সময়। আকষ্মিক আওয়াজে হুর করে কেপে উঠে সাদাফ। এর স্পষ্ট কারণ হলো লিনা।
সাদাফঃ আস্তে শুভি.. ধুরুম ধারুম করছো কেন?
শুভিঃ ও আমি এখন ধুরুম ধারুম করে কাজ করি তাই না? ওই লিনা বুঝি খুব সুন্দর হেল্প করে?
সাদাফঃ এমন করে কেন বলছো শুভি.. আমি কি বলেছিলাম নাকি ওকে হেল্প করতে ও যেচে পড়লে কি করবো বলো তো? ( পেছন থেকে এসে শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে)
শুভ্রাঃ ছাড়ুন তো বাড়তি কাজের সময় নেই। এখনই ১২ টা বেজে যাবে। কাজ গুলো করবো কবে। আমাকে তো আর ওই লিনা কি টিনার মতো কেউ সাহায্য করতে আসবে না.. ( ফুল দিয়ে সাজাতে সাজাতে)
সাদাফঃ কেন আমি আছি না? আমি থাকতে তুমি কেন করবে বলো? তুমি বসো কেমন.. এগুলো তো আমার দু মিনিটের কাজ। ( শুভ্রাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে)
শুভ্রা সাথের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে গিয়ে ক্যান্ডেল গুলো নেয় আর একটা ম্যাচ নেয়। সাদাফ ও চুপচাপ ফুল গুলো সাজায়। বেশ কয়েকবার টুক টুক করে ম্যাচ জ্বালাতে গিয়েও বার বার ব্যর্থ হয় শুভ্রা। বিষয় টা সাদাফ লক্ষ্য করে মুচকি মুচকি হাসে শুধু।
সাদাফঃ মনের মধ্যে আগুন থাকলে আর ম্যাচের আগুনের কি দরকার?
শুভ্রাঃ একদম পিঞ্চ মারবেন না। আমার মনে মুটেও কোনো আগুন নেই। ( ম্যাচ জ্বালানোর ট্রাই করতে করতে)
সাদাফঃ ও তাই নাকি? তাহলে এতো পুড়া পুড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে? ( শুভ্রার দিকে এগিয়ে এসে)
শুভ্রাঃ আপনি না খুব বাড়তি কথা বলেন। বললাম না দেরি হয়ে যাচ্ছে!
সাদাফ শুভ্রার পেছন দিকে এসে হাত দুটো শুভ্রার হাতের উপর এক বারেই ম্যাচ টা জ্বালিয়ে দেয়।
সাদাফঃ তুমি আমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এতোই ব্যস্ত যে রোমের দিকে চোখ বুলিয়ে তাকানোর সুযোগ ও তোমার নেই। ( শুভ্রার কাধে মুখ রেখে)
শুভ্রা তারপর চোখ দুটি ঘুরিয়ে দেখে সাদাফ অলরেডি ফুল দিয়ে সম্পূর্ণ ঘর সাজিয়ে ফেলেছে।
সাদাফঃ এই শুভি.. সরি বলছি তো। আমি জানি তুমি আমার উপর কিন্তু কোনো রাগ করে নেই। সো রাগ করে থাকার ভং ধরবে না। তবে তোমার ওই লাল টগবগে ফুলে থাকা মুখটা দেখতে আমার কিন্তু বেশ লাগে।
শুভ্রা কিছু না বলে চুপচাপ একের পর একটা ক্যান্ডের জ্বলাচ্ছে ওই অবস্থাতেই। কারন সে জানে সাদাফ এসব করে তার রাগ ভাঙানোর জন্যই করছে।
সাদাফঃ এই শুভি চলো না আজ আমাদের বাসরটাও করে ফেলি। ( গালে একটা হুট করে চুমু দিয়ে)
শুভ্রা চোখদুটো বড় বড় করে সটান সাদাফের কাছ থেকে সরে আসে।
শুভ্রাঃ আপনি কি পাজিইই… বাসর সাজাতে এসেছি নাকি করতে এসেছি হ্যা? হয়েছে আমার কাজ শেষ আমি যাচ্ছি।
সাদাফঃ কোথায় যাচ্ছো মিস পালাই পালাই?? হুম… ( শুভ্রার হাত ধরে ফেলে)
শুভ্রাঃ দে..খুন এটা কিন্তু আমাদের নিজেদের বাড়ি নই হ্যা? উল্টাপাল্টা কিচ্ছু করবেন না..
সাদাফঃ তাতে কি হয়েছে? এখানে কে দেখতে আসছে নাকি? তাছাড়া তুমি তো আমার একমাত্র বউ। তোমার সাথে কিছু করবো না তো ওই লিনার সাথে করবো? ( এক টানে শুভ্রাকে কাছে নিয়ে আসে)
শুভ্রাঃ আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি একটু বেশিই লিনা, লিনা করছেন?? ( চোখ দুটি ছোট ছোট করে)
সাদাফঃ তুমি যে এতো হিংসুটে,, আমি আগে বুঝিনি তো…( শুভ্রার কাছে আসতে আসতে)
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়াতে টনক নড়ে দুজনের। মূহুর্তেই দুজন আলাদা হয়ে দূরে সরে যায়। শুভ্রা গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাইরে মিমি আর এক জন নাদিমের কাজিন দাঁড়িয়ে আছে।
মিমিঃ আপু আম্মু জিজ্ঞেস করতে বলছে যে সাজগোছ কি কম্পলিট হয়েছে নাকি..
শুভ্রাঃ এই তো সবই কম্পলিট, মাত্র কম্পলিট হলো। এবার কুবরাকে নিয়ে আসতে পারো।
??????
সাদা বিছানাতে মাঝখানে টকটকে লাল রঙা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ আকা। ঘরে চারদিকে লাল আলোময় করে রেখেভহে শতাধিক রঙ বেরঙের ক্যান্ডেল। চারদিকে মৌ মৌ সুরভিত গোলাপের শুভাশ। তারই৷ মাঝে ছোট্ট কলির ন্যায় বসে আছে কুবরা।
নাদিম কোনো প্রকার দেরী না করে তরিঘরি করে তৈরি হয়ে নেয় বাসর ঘরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়ার আগে বাধ সাজে দরজায় সাদাফ।
সাদাফঃ আহা আহা আহা… এতো সহজে তো যাওয়া যাবে না? বের করো বের করো ? ( হাত দিয়ে টাকার ইশারা করে)
নাদিমঃ মেয়েদের মতো কি তামাশা শুরু করেছিস তুই এসব? ( ভ্রু কুচকে)
শুভ্রাঃ না না আমিও আছি। এতো সুন্দর করে বাসর সাজিয়েছি আমাদের ইনাম লাগবে তো…
নাদিমঃ আচ্ছা ভাবি বলুন কতো লাগবে? ( কোমড়ে দুই হাত দিয়ে)
সাদাফঃ বেশি না মাত্র মাত্র মাত্র এক লাখ টাকা। ( ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে)
নাদিমঃ কিইইই… দুইটা ফুল আর মোমবাতি জ্বালানির দাম এক লাখ টাকা!!! তোর কি আমাকে ফতুর বানানোর ইচ্ছা? বাপ দাদার জন্মে শুনেছিস বাসর সাজানোর ইনাম ১ লাখ টাকা!!
সাদাফঃ বাপ দাদা থেকে শুনি নি তো কি হয়েছে আমি আমার নাতি নাতনিদের শুনাবো। কি বল? দেখ আমার সময় তুই যতো চেয়েছিলি আমি কোনো কম্প্রোমাইজ না করে দিয়ে দিয়েছিলাম। এবার তোর পালা।
নাদিমঃ বুঝেছি। বদলা নিচ্ছিস তাই না? ভাই আমি কি তোর মতো এতো বড়লোক নাকি যে এতোটাকা সার্চ করছিস?
সাদাফঃ হুম টিট ফর ট্যাট। এবার বের কর বের কর তারাতারি।
নাদিমঃ আমি জানতাম তুই এরকম কিছু করবি। তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস। তোর মতলব আমি বুঝবো না তো আর কে বুঝবে। এই নে ধর ( দুই পকেট থেকে দুইটা প্যাকেট বের করে) আমারে মুক্তি দে ভাই, আমারে যাইতে দে ??। ধর এখানে ৫০/৫০ করে আছে। ( একটা প্যাকেট শুভ্রাকে দেয়, আরেকটা প্যাকেট সাদাফকে)
সাদাফঃ দাড়া দাড়া আগে গুনে দেখতে দে ঠিক ঠাক আছে নাকি। তুই তো চিটিং ও করতে পারিস।
নাদিমঃ ভাইইই আমার বউটা একা বসে আছে এতোক্ষন। এমনিতে রেগে ফুলে আছে এখন দেরী হয়ে গেলে কি থেকে কি হয়ে যায় ভাই…. পুরা রণচণ্ডী রুপ ধারণ করবে বুঝতে পারছিস তুই??
শুভ্রাঃ থাক না। আপনি বড্ড জেদ করছেন। এই জন্যই আসার জন্য এতো তোরজোর করছিলেন তাই না? ভাইয়া আপনি যান তো। এই লোক শুধু শুধু সময় নষ্ট করে ।
নাদিমঃ থ্যাংকিউ ভাবি..। আপনার মতো ভালো ভাবি যেন কোটি কোটি হয় আমার। আসি আমি।
নাদিমের বলতে দেরি কিন্তু যেতে দেরি নেই। কথা শেষ হতে না হতেই দরজার উপারে গিয়ে উধাও হয়ে যায় সে।
সাদাফঃ এই এটা কি হলো? এতো সহজে ছাড়া পেতে দিলে তুমি?
শুভ্রাঃ বেশ হয়েছে । সবসময় বেশি বেশি আপনার যে উদ্যেশ্যে এসেছেন সেটা তো পেয়ে গেছেন। বেচারা কত্তো টেনশনে আছে কুবরা রেগে আছে বলে। আপনি আরো তার বিপি বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
সাদাফঃ ও তুমি বুঝবে না? আমরা ছোট বেলা থেকেই এরকম। আর ওরে ক্ষেপাইতে আমার বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু এটা বুঝলাম না যে ও এতো সহজে আমাকে টাকা দিয়ে দিলো কি করে। আগে তো পকেট থেকে ৫০ টাকাও বের করতে পারতাম না। ( প্যাকেট খুলতে খুলতে)
সাদাফ শুভ্রা তারপর প্যাকেট খুলে দেখে শুভ্রার প্যাকেটে একটা মোটা টাকার বান্ডিল কিন্তু সাদাফের টায় শুধু সাদা কাগজের একটা বান্ডিল।
সাদাফঃ নাদিম্মা……. তুই কত্তোবড় বাটপার রে… সহজে ছাড় দেওয়ায় তোর এই পরিনাম দিলি। তুই আমার সামনে আয় তারপর তোকে দেখে নিবো। ( বড় করে বলে)
নাদিম তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে দেখে কুবরা নেই। খুজে দেখে খাটের ওপর, রোমের ভেতর, বারান্দায় কোথাও নেই। তবে কি সে বাসর ঘরে আসে নি? কিন্তু শুভ্রা তো বললো সে এসে এখানে অপেক্ষা করছে। হটাৎ ওয়াশরুমের দরজার আওয়াজ হওয়ায় ফিরে তাকি দেখে কুবরা শাড়ি সাজ ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। তবে বিয়ের গাঢ় সাজের ঘন কাজল চোখের ঘরে লেপ্টে আছে। পরনে সাদা একটা সেলওয়ার কামিজ। মোমবাতির হালকা আলোতে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে তাকে।
কুবরা নাদিমকে দেখা মাত্রই গটগট করে এসে বিছানা বসে পড়ে। নাদিমের বুঝতে বাকি রইলো না যে কুবরা এখনো তার উপর রেগে আছে। নাদিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা শার্ট আর একটা ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। সারাদিনের ক্লান্তি আর ধকলে আগে একটু রিফ্রেশমেন্ট হওয়া চাই তার। মিনিট পাচেক পর নাদিম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে কুবরা এখনো আগের ন্যায় চুপচাপ বসে আছে সেই একই জায়গায়।
নাদিম আবার কুবরার সামনে হাটুগেড়ে বসে। নাদিম সামনে আসা মাত্রই কুবরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। কুবরার দুই হাত তার দুই হাতের মধ্যে আবৃত করে মাথা ঠেকায় নাদিম তার কোলে।
নাদিমঃ প্লিজ কুবরা আর এরকম করো না। অনেক কষ্টের বিনিময়ে আমি তোমাকে পেয়েছি। তাহলে পরিনামে পেয়ে লাভ কি যদি তুমি আমার থেকে এভাবে দূরে দূরে থাকো?
কুবরা এবার ও চুপচাপ থেকে নাদিমের দিকে তাকিয়ে আছে।
নাদিমঃ কুবরা প্লিজ আর চুপ করে থেকো না। তুমি আমার বকো, হাজার কথা শুনাও, দরকার হলে মারো কিন্তু দয়া করে চুপ করে থেকো না। তোমার এই নির্বাক আচরণ আমাকে যে ভেতরে ভেতরে বিষিয়ে মারে। তুমি যা বলবে তাই করবো আমি।সত্যি বলছি কিন্তু প্লিজ আমার উপর রাগ করে থেকো না। আমি তো তুমি রাগ করো এমন কিছুই করি নি। তাহলে আমার দোষ টা কোথায় বলো। ( বলতে বলতে চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে কুবরার হাতে পড়ে)
নাদিমের আকুতি মিনুতি দেখে কুবরার রাগ গলে পানি হয়ে যায়। আজ বিয়ের প্রথম দিয়ে সে কাদছে! সত্যিই তো তার কোনো দোষ ছিলো না। তবে নাদিমকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে?
কুবরাঃ আমি যাই বলবো তাই করবেন?
এতোক্ষন পর কুবরার মুখে কথা শুনে কান্না জর্জরিত চেহারা টা কুবরার কোল থেকে তুলে উঠে বসে নাদিম।
নাদিমঃ হ্যা সত্যি। যাই বলবে তাই করবো। যাতে তোমার খুশি। কিন্তু প্লিজ এভাবে চুপচাপ থেকো না।
কুবরাঃ ঠিক আছে তবে। আমার একটাই শর্ত আর সেটা হলো ওই লিনা শাকচুন্নি কে আপনার অফিস থেকে বিদায় করতে হবে। ব্যাস আর কিছু না।
নাদিমঃ কিন্তু ও তো জয়েন করেছে দু মাস হলো এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ওকে তিন মাস কাজ করতে হবে। এখন আমি কি করে ওকে এতো তারাতাড়ি রিজাইন করাবো।
কুবরাঃ ও আমি জানি না। কাল থেকে যদি আমি ওকে আর দেখি কিংবা অফিসে কাজ করে দেখি আমি সোজা বাড়িতে চলে যাবো। একদম ডিভো…..
কুবরা ডিভোর্সের নাম নেওয়ার আগেই নাদিম হাত দিয়ে কুবরার মুখ বন্ধ করে নেয়।
নাদিমঃ একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি এতোটুক চিন্তা করে ফেললে কুবরা! ও কি ময়লার ময়লা আমি যেকোনো ব্যবস্থা করে অফিস থেকে দূরে সরিয়ে দিবো। একটা উটকো মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে কুবরা? আজ বিয়ের দিনে আমাদের প্রথম রাতে এই কথা বলতে পারলে?
নাদিম কথা বলার সময় টপটপ করে চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। সাধারত ছেলেরা সহজে কান্না করে না। তবে যখন খুব কষ্ট পায় তখন চোখের জলের আর বাধ সাধে না। নাদিমের দূর্বল আকুতি তে বুঝা যাচ্ছে যে সে কুবরাকে কতোটা ভালোবাসে। নিজের কাছে পেয়ে আবার দূরে চলে যাবার কথা শুনে মন টা জর্জরিত হয়ে উঠে তার।
কুবরা স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে তার চলে যাওয়ার কথা শুনে নাদিম কতোটা কষ্ট পেয়েছে। একটা মানুষ কতাটা ভালোবাসলে কাছের মানুষ চলে যাবে বললে বাচ্চাদের মতো কেদে উঠে। কুবরার মন প্রান থেকে এবার সব রাগ উজাড় হয়ে যায়। নিজেও কান্না ভেঙে পড়ে শক্ত করে নাদিমকে জড়িয়ে ধরে।
কুবরাঃ আপনাকে কষ্ট দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আমি? আমার যে অন্য কাউকে আপনার পাশে দেখলে সহ্য হয় না। ওই শাকচুন্নি আপনার সাথে যেভাবে ঘেঁষে ঘেঁষে ছিলো আমার যে মনের ভেতর খুব জ্বলছিলো। আপনি শুধু আমার শুধুই আমার। তাহলে অন্য মেয়ে আপনার কাছাকাছি আসার সাহস পায় কি করে বারবার? ( কাদতে কাদতে)
নাদিমঃ আমি সত্যিই জানতা না কুবরা ও সেরকম। আমি কালকেই ব্যবস্থা করে কিছু একটা করছি। তবে তুমি কি তাকে কম হেনস্তা করেছো? আমি কিন্তু সব দেখেছি।
কুবরাঃ বেশ করেছি একদম ভালো করেছি। কুটু শাকচুন্নি। বিয়াতা জামাইর উপরেও নজর দেয়। কতোটা বেহায়া মেয়ে। আমি তো পারিনি যে আরো কতোকিছু করতে।
নাদিমঃ ভালো এইবার চলো… তুমি জানো আমি তোমার জন্য তিনদিন দিন রাত ঘুমুতে পারিনি? আজ তো আমার ব্যাটারি আমার সাথেই আছে। চলো ঘুমুবো। ( এই বলে নাদিম কুবরাকে কোলে তুলে নেয়)
কুবরাঃ আমি ব্যাটারি? ( চোখ ছোট ছোট করে)
নাদিমঃ হ্যা তুমি তো ব্যাটারিই একদম এই টুকু ??? ( কুবরাকে খাটে রেখে)
কুবরাঃ তো করেছেন কেন ব্যাটারিকে বিয়ে! লম্বা দেখে একটা খাম্বা করলেই তো পারতেন..( নাদিম থেকে দূরে সরে অপর পাশ হয়ে)
নাদিমঃ ওরে পাগলি তুমি কি বুঝবে লম্বা খাম্বা থেকে কি আর এনার্জি পাওয়া যায়? ব্যাটারি থেকেই তো ফুল এনার্জি পাওয়া যায়। ( এক টানে কুবরাকে নিজের বুকে নিয়ে এসে)
লজ্জায় কুবরা নাদিমের পাশ ফিরে তার বুকে লুকিয়ে পড়ে। তারপর নাদিম কোলবালিশ বুকে নেয় মতো করে কুবরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে দুজনে মিলে প্রাপ্তির অবসান ঘটিয়ে হারিয়ে যায় ভালোবাসা মিশ্রিত নিদ্রার রাজ্যে।
#চলবে।
(আচ্ছা বিয়ের পার্ট গুলো কি কারো মনমতো হয়? এর আগেও শুভ্রার বিয়ের সময় খুব কমের রেস্পন্স পেয়েছিলাম। এইবার ভেবেছিলাম কুবরা নাদিমের বিয়ে নিয়ে যেহেতু সবাই এক্সাইটেড অনেকে খুশি হবে। কিন্তু দেখে মাত্র দুজন ছাড়া কেউ একটু সাড়া ও দিলো না। আচ্ছা কোনো কারনে গল্প পড়তে আর ভালো লাগছে না? শেষ করে দিবো?)