#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৪৫
গুমোট বাধা বিষন্ন এক সূর্যস্তমিত প্রহরের দিন। শীতের প্রচন্ড প্রকুপে সারাদিন সূর্যমামার কোনো দেখাই নেই। আশেপাশে বয়ে যাচ্ছে শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস। ক্ষনে ক্ষনে ঝলকা বাতাসে গা কাপিয়ে তুলছে কুবরার।
জানালার ধারে সকাল থেকে জানালার ধারে একমনে বসে বাইরের আকাশের শান্ত দৃশ্য দেখেই কাটিয়ে দেয় কয়েক প্রহর। কাল থেকে কিচ্ছুটিই আর তার ভালো লাগছে না। সে জানে সেখানে নাদিমের কোন দোষ নেই, তবু তার বার বার নাদিমের উপরেই রাগ হচ্ছে।
কাল যখন লিনা নাদিমকে কফি দিতে যায় সেসব কিছু কাচের গ্লাস ভেদ করে বাইরে দাঁড়িয়ে কুবরা সব কিছুই দেখতে পায়। লিনা যে ইচ্ছে করেই কফিটা নাদিমের গায়ে ফেলেছে সেটাও সে লক্ষ্য করেছে। কিন্তু যখন শার্ট পরিষ্কার করার নামে সে নাদিমের গায়ে ঘেষতে যাচ্ছিলো সেটা বুঝতে পেরে কুবরা সটান গিয়ে টেবিলে টিফিন বক্সের বারি দেয়। যার কারনে লিনা দূরে সরে যায়।
কুবরার প্রগাঢ় বিশ্বাস আছে নাদিম একমাত্র তাকেই ভালোবাসে, কোনো দিন তাকে ঠকাবে না। সে এ ও মানে যে সেখানে তার কোনো ভুল নেই তবুও লিনার কাজকর্মের জন্য কুবরার নাদিমের উপরেই রাগ হচ্ছে।
কোনো দরকার তো নেই শুধুমাত্র মেয়ে পিএ রাখার। কই সাদাফ ভাইয়ের পিএ তো ছেলে। তবে তার পিএ কেন মেয়ে হতে যাবে! মানছি আমি সেখানে আপনার কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু এতোগুলো মেইল এম্পলয় থাকতে আপনার মেয়ে পিএ কি জন্য হবে? হুয়াই?? ( একা একা কথা বলে কুবরা)
সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে কুবরা। বাড়িভরতি মেহমান, কোলাহল, গানবাজনা সবকিছুই ফিকে লাগছে। ইচ্ছে করছে এখনই এই বিয়েতে মানা করে উচিত শাস্তি দিতে নাদিমকে। কিন্তু না, বিয়ে তো সে করবেই তবে বিয়ের পর জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে জীবন ত্যানাফ্যানা করে দিবে বিলে প্রবল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। কিন্তু কুবরা ঠায় সেখানে বসে আছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে খোলাসা করে কিছু বলে না। নাহলে বলে অসুস্থ লাগছে তাই একাকি থাকছে।
এদিকে নাদিম কাল থেকেই অনবরত কল দিতেই আছে কুবরাকে। বার বার ফোন সুইচড অফ আসছে। বিয়ের পরেও কয়েক দিন গুলোতে অফিস বন্ধ থাকবে বলে আগেভাগে কাজ সেরে নেওয়ার জন্য জরুরি মিটিং এরেঞ্জ করেছিলো সে কাল। তাই কুবরা রাগ করেছে জানা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে মিটিং এটেন্ড করতে হয় তাকে। ফ্রি হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ৭ টা হয়ে যায়। এদিকে ফোন,মেসেজ দেওয়াতে কোনো রিপ্লে ও দিচ্ছেনা কুবরা। সবে বিয়ের আগের দিন কোনো কারণ ছাড়া এখন বাড়িতে গেলে কি অজুহাত দিবে সেই ভয়ে আর কুবরার কাছে যাওয়া হলো না। একেবারে আজ হলুদের সময় কথা বলবে বলেই আজ পর্যন্ত বসে আছে সে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পার্লারের লোকজন ও ইতিমধ্যে চলে আসে। কুবরা আর উদাসীন হয়ে বসে না থেকে নিজে নিজে রেডি হয়ে সাজতে বসে যায়। যতোই হোক বিয়ের পরিবেশে আর মন খারাপ করে বসে থাকতে চাইছে না। তবে নাদিমকে উচিত শিক্ষা সে দিবেই দিবে।
প্রায় ৭ টার দিকে সকলে সেজেগুজে রেডি হয়ে রওনা দেয় কমিউনিটি সেন্টার এর উদ্যেশ্য।
????
সাদাফঃ এই তুই এতো ছটফট করছিস কেন বল তো? আর এতো তারাতাড়ি চলে আসার মানে কি? আমার বিয়ের সময় দেখিস নি? কতো লেট করে আসছিলো। আগে আসছিস তো আসছিস তা এরকম হাসফাস করছিস কেন? ( কোমড়ে হাত দিয়ে)
নাদিমঃ ভাই দুঃখের কথা কি বলতাম। কাল কতো বড় ব্লাস্টার হয়ছে জানিস না। কাল কুবরা আমার অফিসে গিয়েছিলো বুঝছিস। ( কপাল ডলতে ডলতে)
সাদাফঃ মানে? কবে? আমাদের তো বলেনি সেটা। আর গিয়েছে তো কি হয়েছে। তোর তো আরো খুশি হওয়ার কথা।
নাদিমঃ আরে না। সেটা না আসলে… আসলে কাল অনেক বড় একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে।
সাদাফঃ এই ইক্সেক্টলি কি হয়েছে বল তো আমায়। ( ভ্রু কুচকে)
নাদিম তারপর শুরু থেকে কফি ফেলা, মুছা, কুবরার রাগ, হনহনিয়ে চলে যাওয়া সবকিছুই খুলে বলে। এমন শীতের দিনেও নাদিমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বার বার মুচছে যার মাধ্যমে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ভাজ ফুটে উঠছে।
সবকিছু শুনার পর সাদাফের মুখেও এবার চিন্তার প্রতীক ভেসে ওঠে।
সাদাফঃ তুই বেডা এখনো লুইচ্চা থাইক্কা গেছস। বিয়ে করছিস অলরেডি তোর কি দরকার রে মেয়ে পিএ রাখার? কুবরা যখন তোকে নিয়ে পসেসিভ সেখানে তোর তো উচিত ও যা পছন্দ করে না সেসব থেকে বিরত থাকা।
নাদিমঃ ভাই আমি কি জানতাম ওই মেয়ে এমন গায়ে পড়া টাইপের। কই অফিসে তো আরো মেয়ে এম্পলয় আছে, ওরা তো এমন করে না। আর আমার তো কোনো ভুল ছিলো না দোস্ত। আমার কথা পুরোটা না শুনেই কি না কি বুঝে চেতিয়ে চলে তো গেলোই তার উপির সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
সাদাফঃ হুম এইবার বুঝলাম যে সকাল থেকে কেন এতো মনমরা হয়ে ঘরবন্ধী হয়ে ছিলো। ( ভাবান্মিত হয়ে) ওই দেখ চলে আসছে হয়তো গাড়ির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। ( ব্যস্ত হয়ে)। তুই বস আমি দেখছি ।
চারদিকে গান বাজছে। গাড়ি থামার সাথে সাথে নাদিমের কিছু কলিগ আর অফিস স্টাফ মিলে হইহই করতে করতে একসাথে ১০/১২ টা আতশবাজি ফুটিয়ে তুলে। গাড়ি থেকে নামা মাত্র সাদরে সকল কলিগরা মিলে এসে কুবরার মাথার উপর বড় একটা উড়না নিয়ে চারদিকে থেকে বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি দিয়ে গ্রহন করে তাকে।
আহহ কতো আশা ছিলো নিজের বিয়ে নিয়ে। যেন শুভ্রার মতো করেই গ্র্যান্ডভাবে তার বিয়েটা হয়। বিয়েটা অতো ধুমধাম করে না হলেও নাদিমের বাবার অনুমতিতে গায়ে হলুদ অত্যান্ত ঝাকঝমক ভাবে হচ্ছে। যদিও নাদিমের বাবা আসেনি। নিজেকে যেন সত্যি সত্যিই এক রাজপরী মনে হচ্ছে। এসকল এরেঞ্জমেন্টস দেখে মনটা তখনই খুশি হয়ে উঠে তার।
সামনে আরো কিছুদূর এগিয়ে দেখে রাজকীয় ভাবে সাজানো স্টেজের মধ্যে সেই সিংহাসনে বসে আছে তার চিরচেনা স্বপ্নের একমাত্র রাজা নাদিম। কাচা হলুদ সেরওয়ানীতে আর সবুজ পাজামায়, হাতে ব্রেন্ডেট ঘড়ি, নাগরা জুতো , কুবরার দিকে তাক করা কিলার লুক দব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। এ যেন সত্যিই এক রাজা। তার পাশে সাজানো আরেকটি খালি বসার জায়গা যেটা তার একমাত্র তার জন্য বরাদ্দ।
নাদিম যেন সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতেই পারছে না। সামনে তার হুর পরীর মতো রাজকীয় ভাবে সাজানো লেহেঙ্গা, ব্রাইডাল সাজ, মুখভর্তি খুশির আমেজে সজ্জিত কুবরা। যাকে এতোদিন পর্যন্ত বধুবেশে স্বপ্নে বুনেছে সে আজ স্বয়ং বধুবেশে তার সামনে উপস্তিত।
দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আজ একে অপরের প্রতি এক অন্য মোহে আকর্ষিত। এই মূহুর্তে কুবরার মাথা থেকে নাদিমের প্রতি সব রাগ, মান, অভিমান, যেন উড়ে উবে গিয়েছে। মনে শুধু আনন্দের ঢেউ আর খুশির ঝলকা।
একে একে সকলেই কুবরাকে নিয়ে উপরে দুতলায় চলে যায়। কিন্তু সাদাফ এখনো গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু শুভ্রার দেখা তো মিলছেই না। সে কি আসে নি? না আসার তো কথা। অনেক্ক্ষণ ওয়েট করার পর সাদাফ এবার পা বাড়ায় গাড়ি পার্কিং লটে।
“উফ সবাই দেখছি কনে নিয়ে মত্তো। আমার উপর যে এতোগুলা জিনিস চাপিয়ে দিলো…. একা একা এতাওসব জিনিস নিয়ে যাই কি করে… এই এই আ…আহ… দেখে চলতে পারেন না?? ” ( বা হাত ডলতে ডলতে)
গাড়ির পেছন দিয়ে ডিকি থেকে বিয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে একাই আসছিলো শুভ্রা। এতোগুলা জিনিস শুভ্রা সব নিজে নেওয়াতে সামনে ভালো করে দেখতেও পারছিলো না। আর এসব সে নিযে নিজেই বকবক করছিলো। এদিকে সাদাফ ও শুভ্রাকে খুজতে খুজতে এদিকটায় আসছিলো। এদিক ওদিক খোজাখুজিতে খেয়াল না করায় হঠাৎ ধাক্কা লেগে যায় দুজনের মধ্যে।
সাদাফঃ উপস সরি স…. শুভি.. তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুজেছি জা…. নো…… মা…শা. আল্লাহ…..। ( বিষ্মিত হয়ে)
শুভ্রাঃ আমাকে তো এসব একাই ধরিয়ে দিয়ে সবাই চলে গেলেন। আর আপনি তো সেই বিকেল থেকেই এখানে চলে আসলেন। কেউ একটু হেল্প করবে তারও নাম গন্ধ নেই । ( জিনিস উঠাতে উঠাতে)
সাদাফ শুভ্রাকে থামিয়ে দিয়ে দাড় করিয়ে সটান নিজের কাছে মিশিয়ে ফেলে। শুভ্রার গালে হাতের আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে অন্য হাতে তাকে আরো কাছে টেনে জড়িয়ে নেয়।
সাদাফঃ আচ্ছা তুমার কি আমাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে করে নাকি? এতো সুন্দর কেন তুমি বলোতো? তুমি বুঝোনা,, তুমার এই ঘায়েল করা অপরুপ মায়াময় চেহারা দেখলে আমার বুকের বা পাশ টায় ছ্যাত করে উঠে! আর আজ তো তোমায়…. উফফফফ পুরো একটা পরী মনে হচ্ছে। ( ঘোর ময় কন্ঠে)
সাদাফের প্রতিটা কথা আর নিশ্বাস শুভ্রার মুখের উপর পড়ছে। শীতকালিন ঠান্ডা আবহাওয়াতে সাদাফের উষ্ণ নিশ্বাস শুভ্রাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাপিয়ে তুলছে বারবার। সাদাফের উষ্ণ নিশ্বাসের ধাক্কায় শুভ্রা যেন পাথরের মতো জমে গিয়েছে একেবারে।
“জানো শুভি হঠাৎ করে না আমার আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে গেলো। তুমি এভাবেই বাজার নিয়ে এগিয়ে আসছিলা আর আমি নিশাচরের ন্যায় অপেক্ষা করছিলাম। আর সেই অপেক্ষাতে এভাবেই ধাক্কা লেগে তোমায় আমি পেয়েছিলাম যেমন এখনো পর্যন্ত আকড়ে ধরেছি। ) { শুভ্রাকে নিজের আরো কাছে এনে }
শুভ্রাঃ আর আপনি?? আমি জানি আপনি নাহয় অনেক সুন্দর, অনেক হ্যান্ডসাম। তাই বলে কি এতো সুন্দর পরিপাটি হয়ে আসতে হবে? কি আমি ছাড়া কি অন্য কাউকে ঘায়েল করার ইচ্ছা আছে নাকি উম??? ( সাদাফের কলার ঠিক করতে করতে)
“উ এহেম… এহেম…. আমরা মনে হয় ভুল জায়গায় চলে এসেছি। ” ( সাফিয়া, হীরা, মুক্তা কথাটা বলেই না দেখার ভান করে পেছন ফিরে যায়) ।
সাদাফ-শুভ্রা লজ্জা পেয়ে তাৎক্ষনাত আলাদা হয়ে যায়।
সাফিয়াঃ শুভ্রা শুভ্রা তুই কোথায় রে? আমরা তো তোকে খুজি পাচ্ছি না। এখানে আছিস?? ( শুভ্রাকে না দেখার ভান করে)
সাদাফ লজ্জায় মূহুর্তের মধ্যে ঝট করে পালিয়ে যায়। ওরা যে তাকে পিঞ্চ মারছে এটা বুঝেই আরো কিছু শুনার আগে সে পালিয়ে যায়।
শুভ্রা গুটি গুটি পায়ে সাফিয়াদের কাছে এসে টুস টুস তিন জনকে তিনটে চিমটি কাটে। তিনজনেই একসাথে “আউচ” করে উঠে।
শুভ্রাঃ এতো পাকনামি কে করতে বলে তোদের। চোখের সামনে আমাদের দেখে আবার খুটা দেওয়া তাই না?
হীরাঃ আহাগো তুমলা লোমাঞ্চ করবা আর আমরা কি চাহিয়া দেখিয়া রইমো? তাই একটু লিজেন্ডারি একশন ফলো করলাম আর কি ( ভাব নিয়ে)
সাফিয়াঃ হুম আজ আমরা সিংগেল বলে আর কি ( কাদু কাদু মুখ করে) এইখান থেকে আজ যদি কাউকে না কাউকে না পটিয়ে ছাড়ি তবে আমার নাম সাফিয়া না। ( নাকে আঙ্গুল ঘষে)
মুক্তাঃ হ্যা হ্যা দেখা যাবে আগে চল ওখানে তো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে বোধহয়। ধর এগুলো নে। দুজনের ধাক্কাধাক্কিতে ভেতরে জিনিস গুলোর কি অবস্থা হয়েছে কে জানে। ( প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে)
#চলবে।
( আমি নিজেও অনেক এক্সাইটেড ছিলাম নাদিম কুবরার বিয়েটা অনেক সুন্দর করে লিখবো। কিন্তু পরশু থেকে মন মেজাজ খুব খারাপ। আমার অনেক কিছুই জিনিস চুরি হয়ে গিয়েছে। যে মোবাইল টাতে গল্প সেইভ করে রেখেছিলাম সেটাও চুরি হয়ে গিয়েছে । এখন যেটাতে লিকহে দিলাম সেটাও লিখে মন ভরে না। হতে পারে অনেকের আজকের পার্ট ভালো না ও লাগতে পারে। তাই সবার কাছে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। )