#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৪৪
আজ বুধবার। আর মাত্র দুদিন পর নাদিম আর কুবরার শুভ পরিনয়। ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠছে কুবরার। বিয়ের কার্ড ও ছাপা হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগেই। কিন্তু তার প্রধান বন্ধুবান্ধব দের ই তো ডাকা হলো না।
সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নীল রঙের একটা সুন্দর সেলওয়ার, নীল চুড়িদার, হাতে নীল রেশমি চুড়ি, নীল জুতো, নীল হিজাব, সাথে নীল পার্স সেট মিলিয়ে পড়ে রেডি হয়ে নেয় কুবরার। আয়নায় নিজেকে পরিপাটি করে দেখে নিজেরই নিজেকে নীল পরী বলে অবিহিত করছে সে।
উদ্দেশ্য একটা নয় বরং দুটি। বন্ধবীদের বিয়েতে ইনভাইট করে লাঞ্চ টাইমে নাদিমকে সারপ্রাইজ করে খাবার দিতে যাবে সে। এরইমধ্যে যেন নিজের মধ্যে বউ বউ ভাব চলে এসেছে। ইশশ ভাবাতেই লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ খানি ঢেকে ফেলে কুবরা।
কনকনে শীতের প্রহর। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস। এতো দেরীতে হওয়া সত্বেও সূর্যমামার দেখা মাত্র মিলে। রিকশা ছুটছে আপন গতিতে সাথে মনের দুলা ও। কিছুক্ষন পর কলেজ ক্যাম্পাসে এসে যায় সে। কলেজে ঢুকে দেখে মাঠের ওপারে খুলা সিড়িতে বিষন্ন মুখে বসে আছে সাফিয়া, হীরা, মুক্তা।
হাসিমুখে তাদের দিকেই এগিয়ে যায় কুবরা।
সাফিয়াঃ ধুর বাবা কিচ্ছু ভালো লাগছে না। শুভ্রা, কুবরা ছাড়া আড্ডা জমে নাকি। ( বিরক্তি মাখা মুখে)
হীরাঃ হ্যা দোস্ত…. চল আমরাও ছুটি নিয়ে নিই। ওই হারামি দুইটা তো বিয়ে, বর নিয়ে মত্ত আছে। আমাদের আর এখানে ভালো লাগছে না।
মুক্তাঃ ভাই ঠিকি বলেছিস। এমনিতেও জুনিয়র দের পরিক্ষা চলছে বলে অনেক কমই আসছে। চল আমরাও চলে……. এই এই দেখ এটা কুবরা না?? ( দূরে কুবরার দিকে আঙ্গুল তাক করে)
সাফিয়াঃ ধুর… আজ বাদে কাল ওর বিয়ে। ও কেন কলেজে আস্তে যাবে? ( মুক্তার দিকে তাকিয়ে)
মুক্তাঃ আরে বেডি আমার দিকে তাকালে বুঝবি কি করে ওইদিকে দেখ!
সাফিয়া, হীরা এবার দূরে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে সত্যিই কুবরা। আর সে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
কুবরাঃ কিরে তিনজন এভাবে ফকিরের মতো সিড়িতে বসে আছিস কেন?
সাফিয়াঃ চুপ হারামি। একদম কথা বলবি না। নিজে বিয়ে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচছিস! আমাদের কথা কি আর মনে আছে নাকি। ( কুবরার পিঠে থাপ্পড় দিয়ে)
কুবরাঃ আহ… আস্তে…. ভাই তোর এই থাপ্পড় গুলো খুব ব্যাথা পাই রে….
হীরাঃ খুব হওক ব্যথা। নিজেতো বিয়ে নিয়ে মহা নাচানাচিতে। জানিস আমাদের কতো বোর লাগছে তোদের ছাড়া ?
মুক্তাঃ তুই একা যে? শুভ্রা কোথায় রে?
কুবরাঃ আরে ভাই আপ্পির বাসায় অনেক কাজ। আর আমি ভাই ক্লাস করতে আসিনি। তোদের ইনভাইট করতে এসেছি।
সাফিয়াঃ কদিন আগে না করলি ইনভাইট?? ( চোখ ছোট করে)
কুবরাঃ ধ্যাত… হারামি বলে আমি কি আর ওইরকম হারামি রে?? শুকনো হাতে ইনভাইট করা যায় নাকি?? এই নে তিনজনের জন্য তিনটে ইনভিটেশন কার্ড। ( তিনজনের হাতে তিনটে শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে) ।
হীরাঃ বাব্বাহ… বিয়ের কার্ড কেউ শপিং ব্যাগ দিয়ে দেয় আজ আমি প্রথম দেখলাম।… এই এটা এমন ভারি কেন??
কুবরাঃ খুলে দেখনা কি আছে…
তারপর তিনজনে উৎসাহিত হলে তিনটি প্যাকেট খুলে হাত ঢুকিয়ে দেখে একই রকম তিনটে শাড়ি, ফুলের ক্রাফটেট ডিজাইন করা গলা, কান, হাতের, মাথার সেট। সাথে বিয়ের কার্ড।
এসব দেখে তিন বান্ধবী ” ওয়াও” বোধক চিতকার করে কুবরাকে জড়িয়ে ধরে একসাথে।
সাফিয়াঃ ভাই এগুলো আমাদের জন্য??
কুবরাঃ হুম… আফটার আমার বিয়ে বলে কথা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের ট্রিট তো দিতে পারলাম না তাই এগুলো দিলাম। আর নিয়ম হিসেবে এগুলো সব হলুদের দিন পড়ে আসতে হবে। কারন সকলেই সেম ডিজাইনের ড্রেস আর সাজবে।
হীরাঃ ভাই তুই কত্তো কিউট রে( কুবরার গাল দুটো টেনে) আর হলুদ তো কালকেই তাই না?
কুবরাঃ হ্যা কাল সন্ধ্যের মধ্যেই কিন্তু তারাতাড়ি চলে আসবি। মেহেদী কমিউনিটি সেন্টারেই হবে। যেহেতু দুজনের মেহেন্দি ও আপ্পির মতো একসাথে হবে তাই আর বাড়িতে করছে না।
মুক্তাঃ সবই তো বুঝলাম কিন্তু তোর হাতে ওই টিফিন বক্স টা কিসের?
কুবরাঃ আসলে উনার জন্য লাঞ্চ নিয়ে এসেছিলাম। আজ বের যখন হয়েছে একেবারে উনার সাথে দেখা করেই যাবো।
সাফিয়াঃ ওওওমা……. উনার….. জন্য…… ইশশ কি লোমান্তিক লে….. আজ আমাদের একজন উনি নেই বলে আর কি ( ধাক্কা দিয়ে)
হীরাঃআহহহ ডেটিং ফেটিং সবই তোরা করে ফেলছিস। আমাদের যে কবে টাইম আসবে….. ( অপ্র সাইড দিয়ে ধাক্কা দিয়ে)
মুক্তাঃ এই দেখ বুড়ি আবার ব্লাশ করছে…. তুই যে এতোটা লাজুক আগে জানতাম না তো। এই ধরধর ( বলেই তিনজনে মিলে কুবরাকে কাতুকুতু দিতে শুরু করে)
কুবরাকে কাতুকুতু দিয়ে বেশ মজাই পায় তারা। কাতুকুতু পাওয়ায় খিল খিল হাসিটা তাদের নাকি খুব ভালো লাগে। একে অপরকে কাতুকুতু দিতে দিতে সম্পুর্ন নিস্তব্ধ পরিবেশটাই আনন্দে হাসিতে রমরমা হয়ে উঠে ।
বেশ কিছুক্ষন হাসি ঠাট্টা করার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যায় দুটি ঘন্টা। ইতিমধ্যে চারদিকে জোহরের আযান পড়ে গিয়েছে। আড্ডায় মশগুল হওয়ার কারনে আজ আর ক্লাস ও করে নি সাফিয়া, হীরা, মুক্তা। সকলকে বিদায় দিয়ে প্রায় দেড়টার দিকে কলেজ থেকে বের হয় কুবরা।
রাস্তার ধারে হাটছে কুবরা। হাতে নাদিমের জন্য পরম যত্নে তৈরি তার প্রিয় খাবার। আজ নিজ হাতেই নাদিমের জন্য তার প্রিয় কটি খাবার বানিয়েছে সে। আজ বাদে কাল হলুদ আর পরশু বিয়ে। ইশশ ভাবতেই কতো এক্সাইটমেন্ট।
কলেজ থেকে নাদিমের অফিস বেশি দূরে না হওয়ায় হেটেই আসছিলো সে। হাটতে হাটতে অবশেষে নাদিমের অফিসের সামনে। সিকিউরিটি গার্ড সসম্মানে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়। ভেতরে কতো লোক ডেস্কে বসে নানা ধরনের কাজ করছে। কেউ কেউ ফাইল নিয়ে ঘুরছে কেউবা চা কফি নিয়ে তাদের এগিয়ে দিচ্ছে। একজন ফিমেইল এপ্লয় কে ডেকে কুবরা নাদিমের চেম্বার টা জেনে নেয়।
কুবরাঃ এক্সকিউজ মি… বলছি আপনাদের বসের অফিস রূম টা কোনদিকে বলতে পারবেন?
মেয়েটিঃ ওইতো দুতলায় গিয়ে ডানদিকের কর্ণারে।
কুবরাঃ আচ্ছা। মেনি মেনি থ্যাংক্স।
এই বলে কুবরা মেয়েটিকে বিদায় জানিয়া পা বাড়ায় দুতলার উদ্যেশ্যে।
“স্যার এই নিন আপনার কফি” ( লিনা)
“হুম…. এই এই…. দেখে কাজ করতে পারো না তুমি?….. ইশ আমার স্যুট টাই নষ্ট করে দিলে। ( বিরক্ত মুখে) ( { নাদিম })
” সরি সরি স্যার আমি মুছে দিচ্ছি ” ( লিনা)
“ছাড়ো ছাড়ো আমি দেখে নিচ্ছি ” ( নাদিম)
” না না স্যার আমি ক্লিন করে দিচ্ছি ” ( এই বলে লিনা জোরপূর্বক নাদিমের শার্ট পরিষ্কার করে দিচ্ছে)
লিনা হলো নাদিমের পিএ। নাদিম কফি অর্ডার করায় নাদিমকে কফি এগিয়ে দেয় সে। এগিয়ে দেওয়ার সময় হাত কাপিয়ে কফির মগ টা কিছু এলিয়ে পড়ায় নাদিমের শার্ট এ খানিক কফি পড়ে যায়।
আসলে এটা সে ইচ্ছে করেই করেছে। শুরু থেকেই সে কেমন একটা গায়ে পড়া ভাব ছিলো লিনার। মাত্র দু মাস হলো জয়েন করেছে।তবে জয়েনের এক সপ্তাহ পর থেকেই কেমন একটা গায়ে পড়া ভাব ভাব করে। যেকোনো কাজের বাহানাতেই ওমনি টাচ করার বাহানা খুজে যেমনটা এখন কফি ফেলার মাধ্যমে করেছে।
বিষয়টা নাদিম বুঝতে পারলেও তাকে বের করে দেওয়ার মতো কোনো ত্রুটি কিংবা অন্য রিজন পায় নি। আর তাছাড়া ৩ মাসের আগে কেউ রিজাইন ও করতে পারবে না নিয়ম আছে। যার কারনে নাদিম বাধ্য তার সাথে কাজ করতে।
হঠাত কাচের টেবিলে ঠাসসসসস করে আওয়াজ হিতে দুজনেই হচকচিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে কুবরা টগবগিয়ে দাত কটমট করে টেবিলে টিফিন বক্সটা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। রাগের কারণে মাত্র কিছুক্ষণেই চোখ দুটি লাল রক্তবর্ণ ধারন করেছে।
কু… কুবরা তুমি?? ( ভীত হয়ে বলে নাদিম)
কুবরাঃ হ্যা আমি। কেন আমি আসায় খুব অসুবিধে হলো বুঝি? ( দাতে দাত চেপে)
নাদিমঃ আরে অসুবিধে কেন হবে। আমার তো আজ পরম সৌভাগ্য যে তুমি আমার অফিসে এসেছো।
কুবরাঃ হুম এসেছিলাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে, এখন তো আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। ( রাগান্বিত দৃষ্টিতে লিনার দিকে তাকিয়ে)
নাদিমঃ কুবরা তুমি যেমনটা ভাবছো মোটেও সেরকম কিছু নই। বিলিভ মে। আমি একটা ইম্পোরটেন্ট কাজ করছিলাম। আর একটা কফি চেয়েছিলা তখনই……
কুবরাঃ ব্যাস….. আমি তো আপনার কাছ থেকে কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে চাইনি। দুপুরে আপনার জন্য লাঞ্চ বানিয়ে এনেছিলাম। ইচ্ছে হলে খাবেন নাহলে ফেলে দিয়ে কফি খাবেন। আর করুন আপনার ইম্পোর্টেন্ট কাজ।
বলার এক সেকেন্ড হতে না হতেই কুবরা হন হন করে বেরিয়ে যায়।
নাদিমঃ কুবরা প্লিজ আমার কথাটা শুনো দাড়াও কুবরা। ( কুবরার পেছন ছুটে)
লিনাঃ স্যার একটু পরই তো মিটিং শুরু..
নাদিম হুংকার দিয়ে গর্জে বলে উঠে (” রাখো তোমার মিটিং “)
তারপর নাদিম কুবরার পিছু নিতে গেলে নিমিষেই উধাও হয়ে যায় সে। তন্ন তন্ন করে খোজাখুজির পর নিচে পৌছে দেখে কুবরা অলরেডি রিকশা নিয়ে খানিকদূর চলে গিয়েছে।
নাদিম মাথায় হাত বারি দিয়ে ” শিট” উচ্চারণ করে সামনের খাম্বায় লাথি মারে। না পারছে কুবরার কাছে যেতে না পারছে মিটিং ফেলে যেতে। কিন্তু কুবরা তাকে ভুল বোঝার মতো এমন অন্যায় তো সে করেই নি। তবে এতো অনুরাগ কিসের!
#চলবে।