#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৩৭
সন্ধ্যায় সাড়ে ৭ টার দিকে সাদাফ পড়াতে বসেছে শুভ্রা আর কুবরাকে। এতোদিন পড়তে বসলে কমসে কম ১০ বার উঠবে ঘন্টায় পড়ার টেবিল থেকে কুবরা। অথচ আজ এক মনে অন্যমনস্ক হয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে।
সাদাফঃ এই দেখো a -2^10…… কুবরা এই কুবরা মন কোথায় তোমার?? কি হলো আজ? পড়তে ইচ্ছে করছে না?
কুবরাঃ এহ হ্যা?? কি হ.. হয়েছে ভাইয়া ।
সাদাফঃ বলছি খারাপ লাগছে কি? এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে থাকলে তো কিছুই বুঝবে না।
কুবরাঃ ভাইয়া আমার ভালো লাগছে না। কাল পড়বো। আজ আপ্পিকে পড়ান। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। ( এই বলে সাদাফকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই চেয়ার থেকে উঠে সোজা রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয় কুবরা)
সাদাফ ঠোঁট উলটে কি বোধক ইশারা করে শুভ্রাকে। এখন শুভ্রাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে।
সাদাফঃ এই কি হয়েছে বলো তো? তুমি কিছু জানো?
শুভ্রাঃ মনে হচ্ছে ডোজ টা বেশি হয়ে গেলো। ( চ বোধক শব্দ করে)
সাদাফঃ মানে? এই শুভি কি হয়েছে বলোনা প্লিজ।
শুভ্রা তারপর সাদাফ কলেজে যাওয়ার পর পর কি কি হয়েছে সব খুলে বলে। এরপর সাফিয়ার ওসব ভাই বন্ধুর কথা বলাটাও বলে। সব শুনে সাদাফ হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে চেপে ধরে। এদিকে কুবরা শুনবে বলে বড় করে হাসতেও পারছে না সে।
শুভ্রাঃ বিশ্বাস করুম ওই সময় কুবরার মুখ টা দেখলে ডিরেক্ট দলা পেকে যেতেন আপনি। এখনই এভাবে হাসছেন।
সাদাফঃ আসলে তোমার বন্ধবিটা কি একটু মেন্টাল টাইপের না? আমারও কেমন লেগেছে ওর কথায়। তোমার হাসবেন্ড বলাতে কেমন করছিলো। একবার আমার দিকে আরেকবার তোমাদের দিকে।
শুভ্রাঃ না না আসলে ও এমনই। ইচ্ছে করেই পাগলামো করে যেন তাকে নিয়ে হলে মানুষ হাসতে পারে। এতে নাকি তার ভালোই লাগে। আর এসব কথা সে প্রায় বলে। বলতে গেলে মজা করে আর কি। কিন্তু আমার পাগলী বোনটা যে এটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে যে বেচারি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছে। ( চিন্তিত কন্ঠে)
এবার শুভ্রার কথাতে সাদাফ ও সিরিয়াস হয়ে যায়।
সাদাফঃ তা তো ডিপ্রেশনে ভুগার কথাই। আমার বন্ধু তো আরেক বলদা মার্কা। এখনো কুবরাকে আসল কথা টা বলে উঠতে পারেনি। এই জন্যই তো ছোট মেয়েটা সবসময় বিষন্নতায় ভুগে।
কথার কথাতে এখন দুজনেই কুবরাকে নিয়ে টেনশনে পড়ে যায়। তবে সাদাফের মনে আরেক কথা ঘুরছে। নাদিম কি আদেও কুবরাকে সিরিয়াস নাকি এবারেও অন্যান্যদের মতো খেলছে!! কিন্তু সে তো নাদিমের চোখে মুখে কুবরার জন্য যথেষ্ট ভালোবাসা দেখতে পেয়েছে।
নিজ কক্ষে এসে বিছানায় উবু হয়ে হাতে মুখ গুজে টপটপ চোখের পানি ফেলছে কুবরা। আজ তার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না। চারদিকের সবকিছুই বিরক্তি ভরা থমথমে লাগছে। ঢুকরে ঢুকরে মনের মধ্যে শুধু নাদিমের চেহারা উকি দিচ্ছে আর মনে পড়তেই দলা পাকিয়ে কান্না আসতে চাইছে।
মোবাইল ফোনের গ্যালারি তে ঢুকে নাদিমেত সেভ করা রাখা সেই টোল পড়া হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা একমনে চেয়ে আছে কুবরা।
[কেন এতো কষ্ট হয় বলুন তো আমার আপনার জন্য? কেন এতো মনে পড়ে আমার? আপনাকে ছাড়া যে আমার কিছুই ভালো লাগে না। কেন এতো নেশাময় হয়ে উঠেছেন আপনি আমার কাছে যে আপনাকে এক মূহুর্ত না দেখলে আমি ক্ষুদার্ত মাতালের মতো হয়ে যাই!! জানেন ভাইয়া যখন আপ্পি কে এতো কেয়ার, যত্ন, ভালোবাসে আমার না আপনাকে তখন খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে করে আপনার কাছ থেকেও এভাবে ভালোবাসা পেতে। আপনি কি বুঝেন না? যে আমি আপ আপনাকে কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি? বুঝেন না? আপনাকে ছাড়া আমি কতোটা অসহায়। ] {{ এই বলে নাদিমের ছবিময় মোবাইলটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেদে দেয় কুবরা }}
অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে খেতে দেয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে নাদিম। এটা এখন তার প্রত্যেক দিনের রুটিনের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। কখন রেডি হয়ে যতো তারাতাড়ি সম্ভব মোবাইল নিয়ে হাজির হতে পারে শুধু মাত্র কুবরার সাথে কথা বলার জন্য। পরপর এক সপ্তাহ জরুরি মিটিং থাকায় সাদাফ দের বাড়ি ও যাওয়া হয়নি যার কারনে তার প্রেয়সীকেও এক পলক মন ভরে দেখতে পারছে না।
কুবরাকে অনলাইনে দেখাতে হাসিমুখে মেসজ দেয় নাদিম।
নাদিমঃ কেমন আছো?
মোবাইল বুকে নিয়ে কান্না করতে করতে মেসেজ নটিফিকেশন আসায় হাত তুলে দেখে নাদিম মেসেজ দিয়েছে।
নাদিমের মেসেজ দেখেই খুশিতে মন ভরে উঠে কুবরার। তার মানে কি তার সাথে সাথে নাদিমের ও তাকে মনে পড়ছে? পরেক্ষনে কেন যেন নাদিমের উপর খুব অভিমান হচ্ছে। এতই যখন প্রতিদিন মনে পড়ে তাহলে একটু ও কি দেখতে আসার সময় হয় না?
[নাহ একদম না। আজ মোটেও কথা বলবো না। ততোদিন বলবো না যতোদিন না দেখা করবেন উনি। আমি এখানে উনার জন্য কান্না করে ভাসিয়ে বেড়াবো আর উনি চিল মুডে থেকে একটু চ্যাট করলেই জয়ে গেলো নাকি? হোক কষ্ট। তবু কথা বলবো না। দেখি উনি আমায় কেমন ভালোবাসে ] { এই বলে জিদ করে কুবরা নাদিমের আর মেসেজের রিপ্লে দেয় না }
বেশ কিছুক্ষন নাদিম স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই কখন থেকে মেসেজ সিন করলো। অথচ এখনো রিপ্লাই দিচ্ছে না।
নাদিমঃ কি বিজি?? ( মেসেজ দিয়ে)
এবারও কুবরা সাথে সাথে সিন করলো তবে রিপ্লাই দিলো না। হালকা চিন্তাই ভ্রু কিঞ্চিত কুচকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে নাদিম।
( এর আবার হলো কি। অনলাইনেও আছে। পড়াশোনা করলে এক ব্যাপার। কিন্তু এখন দেখি সাথে সাথে সিন ও করছে। আজব তো!!) [ বিড়বিড়িয়ে বলে নাদিম ]
নাদিমঃ কি হলো ম্যাডাম সিন করে রিপ্লাই দিচ্ছেন না যে? কিছু কি হয়েছে?
কুবরা এবারেও সিন করে রিপ্লাই দেয় না।।এই মূহুর্তে নাদিমের মেসেজ দেখে খুব ইচ্ছে করছে তার সাথে কথা বলতে। কিন্তু নিজের প্রবল ইচ্ছাকে জেদ ধরে রিপ্লাই না দেওয়ার ই সিদ্ধান্ত নেয় সে।
চিন্তায় এবারে নাদিমের কপালে ভাজ পড়ে যায়।
( সিন করে উত্তর না দেওয়ার মানে? আমি কি কিছু করেছি? নাকি রাগ করেছে? আমার যদ্দোর মনে আছে রাগ করার মতো কোনো কথা কিংবা কাজ কোনো কিছুই তো করিনি আমি। )
নাদিমঃ কুবরা কি হয়েছে?? রাগ করেছো বুঝি?? আচ্ছা সরি মেরি রানি। এতো রাগ তোমার?? তবে এটাই তো বুঝছি না যে তোমার রাগ টা কিসের উপর? আমি কি কিছু করেছি?
নাদিমের হাসফাস দেখে কুবরার যেন আর দমে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তবু জিদ করে মোবাইলটাই অফ করে রেখে দেয় সে। কথা বলবে না মানে কথা বলবেই না। পাক্কা কথা।
এবার চিন্তায় নাদিম কুবরাকে কল দেয়। মেসেঞ্জারে কল দিলে রিং হয় ধরে না। তারপর ডিরেক্ট কল দিলেও বলে নাম্বার সুইচড অফ। কি হলো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে সামনা সামনি কথা বলতে। কিন্তু এখন সাদাফ দের বাড়িতে গেলে কাল সকাল জরুরি মিটিং টা ভেস্তে যাবে। এই মিটংয়ের জন্য আজ ৭ দিন সাদাফদের বাড়ি যেতে পারে নি। লাস্ট কালই আছে। এটা করলে অনেক বড় একটা প্রজেক্ট সাক্সেস্ফুল হবে।
কিন্তু কুবরা কি জন্য এমন করছে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। না পারছে অফিসের কাজ ফেলতে না পারছে তার সাথে দেখা করতে।
রাগে, বিরক্তিতে, চিন্তায় মোবাইলটা খাটে খানিক জোরে ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে যায় নাদিম।
????
পৌষ মাসের মধ্যসম। দুপুর বেলায় মৃদু রোদের সাথে খেলা করছে আশেপাশে ছোট ছোট মেঘকনা। তার ই নিচে বসে আছে পঞ্চভুজের ন্যায় পাচ বান্ধবী। সকলের দৃষ্টি শুভ্রার দিকে। তবে কুবরা একপাশে নিজ মনে বসে আছে।
সাফিয়াঃ এই , ফুলি আবার কি কারনে ফুলে আছিস। ওদিক হয়ে বসে আছিস কেন??
কুবরাঃ উফফফফ তোরা বল না। আমার ভালো লাগছে না ভাই। ফুলবো কি জন্য? আর ফোলা কি?? শুদ্ধ করে বলতে পারিস না??
সাফিয়াঃ এহ ছোট্ট মেয়ের কিসের এতো ভালো লাগা না লাগা রে? আয় এদিকে আমাদের সাথে এক্ষুনি ভালো করে দিবো তোর মন। আগে বল আমাদের তোদের কক্সবাজার টু ঢাকা কাহিনি। ( কুবরাকে টেনে নিয়ে এসে নিজের পাশে বসাতে বসাতে)
হীরাঃ হুম আয় বয় তো। এই শুভিইইইইইইই…….. বলো তো বাবুনী তোমার বিয়ের কাহিনি। এই কি রকম ইন্টারেস্টিং বল তাই না রে? আমাদের বন্ধু মহলে পুরো ক্লাসে কারো বিয়ে হলো।
মুক্তাঃ হুমমম এবার আমাদের ও বিয়ে হতে কোনো দ্বিধা নেই উফফফফ কি খুশি।
হীরাঃ এই তুই আছিস সারাক্ষন বিয়ে বিয়ে বিয়ে। তোর কপালে একটা পাগল জুটবে। সারাক্ষণ যে বিয়ে নিয়ে মরিশ।
সাফিয়াঃ এই থামবি তোরা!! আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু শুনতে চাই তোদের পেনপেনানি। এই এক মাত্র হাসবেন্ডের শুভিইইইইইইই, বলেন আপনাদের বিয়ের কাহিনী ( ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে)
কথা শুরু করতে গিয়েও লজ্জায় থেমে যায় শুভ্রা। বন্ধবীদের জোরাজোরিতে না বলেও পারছে না আবার বলতে গেলেও লজ্জা লাগছে তার।
শুভ্রাকে লজ্জা পেতে দেখে অতি উৎসাহের সহিতে চেচিয়ে উঠে সাফিয়া।
সাফিয়াঃ উমা…. দেখ দেখ ম্যাডাম ব্লাশ করছে….. । ভাই বল না রে। আমাদের ও তো এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফ্রেন্ড সার্কেলে আমাদের প্রথম কোনো বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। কাহিনি তো জানতেই ইচ্ছে করে বল।
শুভ্রা আর সাফিয়াদের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। তারপর সাদাফের সাথে ধাক্কা লাগায় দেখাদেখি, সোহেলের কান্ড, তাদের পরিচিতি, তারপর প্রপোজ, ঢাকায় আসা থেকে বিয়ে পর্যন্ত সবকিছুই খুলে বলে শুভ্রা।
সাফিয়াঃ মাইরি….. কি রোমান্টিক বিয়াপার স্যাপার হ্যা….. এক্কেবারে ফিল্ম রে… শু…..ভিইইই। ইশশশ কত্তো সুন্দর একটা কাহিনি। আহহহ আমার লাইফেও যদি হতো রে…. ( স্বপ্নমিত আশায় চোখ বন্ধ করে)
হীরাঃ উফফফ তুই আছস সারাক্ষণ বিয়ে আর রোমান্টিক নিয়ে।
মুক্তাঃ হ্যা বেচারি শুভ্রার উপর সোহেল কি টর্চার ই না করলো। এক্কেবারে উচিত শিক্ষা দিয়েছে ভাইয়া তাকে। আরো এক্কেবারে জেল এই ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।
সাফিয়াঃ ধুর…. এটা কাটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো আমাদের সিনেমার হিরো ভাইয়া আছে নাকি বল( শুভ্রাকে হাতের কুনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে)
মুক্তাঃ হুম তাইই ও ঠিক বলেছিস। তবে কাহিনিটা বেশ জম্পেট।
হীরাঃ তো কুবরা ম্যামসাহেবের কি এই জন্যই মন খারাপ যে তোমারও বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তাইইই….. ( গুতো দিয়ে)
হীরার কথা শুনে আনমনেই কুবরার হাসি পেয়ে যায় কুবরার।
সাফিয়াঃ অমারে দেখ দেখ ইনিও মিটিমিটি হাসছে। ( কুবরাকে কাতুকুতু দিতে দিতে)
তিনজনের কাতুকুতু পেয়েও কুবরা সহ সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। পরিবেশটাই কেমন রমরমা হয়ে উঠে মূহুর্তের মধ্যেই। এতোক্ষন পর বোনের মুখে হাসি দেখতে পেয়ে বেশ স্বস্তি হয় শুভ্রার মনে। আরও কিছুক্ষন আড্ডা দেওয়ার পর ঘন্টা বাজতেই ক্লাসে ফিরে আসে পঞ্চবন্ধু ???।
#চলবে।