#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৩৫
শুক্রবার জুম্মার দিন। পৌষ মাস আসতে না আসতেই চারদিকে কেমন শীত শীত আমেজ শুরু হয়ে গেলো। শুক্রবার হওয়াতে বাড়ির পাশের মসজিদে মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। সকাল থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা বিভিন্ন সূরা, গজল , হামদনাত গাইছে। আশেপাশে কোলাহলে ভর্তি। জুমার নামাজ শুরু হতেই মসজিদের খুতবা কানে ভেসে আসছে। বিকেল হতেই মাহফিল শুরু হয়ে যায়।
সাদাফ, নাদিম আর সাদাফের বাবা মিলে মাহফিলে যায় ওয়াজ শুনার জন্য। এদিকে বাড়িতে, শুভ্রা, কুবরা, তাদের মা এবং সাদাফের মা আজ টিভি৷ , মোবাইল না দেখে মন দিয়ে ছাদে বসে ওয়াজ শুনছে।
?️?️?️?️?️
দেশে আসার পরপরই পারভেজ আগে শুভ্রার বিয়েতে চলে যায়। কক্সবাজারে এসে নিজের গ্রামেই আগে ঘুরেবেড়ায় সে। ৫ টা বছরে কতো কিছু পালটে গিয়েছে। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ খুলছে, আগের সেই ভাঙা রাস্তা আর নেই, যাতায়াতের জন্য এখন মূহুর্তেই গেটের বাইরে গাড়ি পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় ওষুধ আর ডাক্তার দেখানোর জন্য শহরে যাওয়া লাগে না। গ্রামের দিক টাই এতো পরিবর্তন হলে নিশ্চয় শহরে আরো অনেক কিছুর উন্নতি হয়েছে।
পুরনো কলেজের কয়েকজন বন্ধু নিয়ে আজ প্ল্যান করে টাউনের দিকে গিয়ে এক্কেবারে বিচে ও ঘুরে আসবে। জুমার নামাজ পড়ে সকলে টাউনের দিকে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। কিছুদূর এসে প্রায় ১ ঘন্টা মতো জ্যামে বসে থাকে।
তারপর মেইন টাউনে প্রবেশ করতে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। রাস্তার যে বেহাল দশা। চারদিকে কন্সট্রাকশনের কাজ, রাস্তার কাজ, মিলিয়ে রাস্তায় হযবরল অবস্থা। কোনো রকম ঘষাঘষি করে অবশেষে বিচে আসতে সক্ষম হয় বিকেলের দিকে।
তবে এখান কার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। আগের তুলনায় এখন বড় বড় হোটেল, রেস্টুরেন্ট ট্যুরিস্ট স্পট তৈরি হয়েছে।
বিচে এসে পুরনো বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে পারভেজ। লাবনি থেকে নেমে কলাতলির দিকে হাটা ধরেছে। চারপাশে কতো মানুষ, কিছু বন্ধু নিয়ে, কিছু ছোট বাচ্চাদের দল, আর কেউ জোড়া কপোত-কপোতী। হাটার সময় পাশ দিয়ে, বাদাম, ডিম, কফি, পানি এই সেই নিবে কিনা ও জিজ্ঞেস করে ।
কলাতলির একটু কাছে আসতেই পারভেজের মনে হলো সে চেনা কাউকে দেখছে। সামনে একজন বোরখা পরবো মহিলা বুকে হাত গুজে সমুদ্র পানে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। এ তো শুভ্রার বিয়েতে দেখা সেই ইলিয়ানা! কেন যেন তাকে দেখে আর এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করলো না পারভেজের। নিজের বন্ধুদের সামনে এগিয়ে যেতে বলে পারভেজ এগিয়ে যায় ইলিয়ানার দিকে।
পারভেজঃ আসসালামুআলাইকুম ।
পাশ দিয়ে পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ শুনে মাথা ঘুরিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে এক সুদর্শন পুরুষ তার দিকে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এক ঝলক দেখা মাত্র ইলিয়ানার মস্তিষ্কে জানান দেয় কয়েক দিন আগে পরিচয় হওয়া সেই ডাক্তার লোকটি।
ইলিয়ানাঃ ওয়ালাইকুমুসসালাম, আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন? আপনি এখানে?
পারভেজঃ ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। এই এতোদিন পর দেশে এসে বন্ধুদের সাথে এখানকার চির ফেমাস জায়গা টাতে ঘুরতে এলাম। তা আপনি কেমন আছেন?
ইলিয়ানাঃ এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আমিও বাসায় ভালো লাগছিলো না তাই একটু হাওয়া খেতে আসলাম। এখানে যে এতো ভিড় প্রান খুলে তো শ্বাস নেওয়ার ই জায়গা নেই।
পারভেজঃ হুম তা ঠিক বলেছেন। তা একা এসেছেন নাকি? কাউকে দেখছিনা যে?
ইলিয়ানাঃ তো কাউকে আশা করছেন বুঝি?
পারভেজঃ না না। আমি তা বলিনি এমনি। একা একা কি ঘুরতে আর ভালো লাগে?? তাই বললাম।
ইলিয়ানাঃ একাই আসি। প্রতিদিন ছাদে দাড়ালে এই দিক টা ভালো করেই দেখা যেতো। তবে আজ আর ভালো লাগছিলো না তাই চলে আসলাম। এখানে এসেও ভালো লাগছে না। কেমন জমজমা পরিবেশ, মানুষে ভর্তি।
পারভেজঃ তা ঠিক বলেছেন। এখানকার চেয়ে আমাদের গ্রাম অনেক ভালো। শান্তময় পরিবেশ। একদিন বেড়াতে আসুন না দেখবেন কতো ভালো লাগবে।
পারভেজের কথা শুনে ইলিয়ানা এক কৃত্রিম হাসি দিয়ে সমুদ্রের দিকে মনোনিবেশ করে। কারণ বেড়াতে যাওয়ার মতো আত্মীয়তার সম্পর্ক এখনো তাদের মধ্যে হয় নি। তবু যাবো বলে পারভেজ কে সম্মতি জানিয়েছে।
টুকটাক কথা বলতে বলতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসে। ইলিয়ামা পারভেজ কে কয়েকবার তাদের বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করলে বাসায় তার মা একা আছে বলে আর যায় নি। এরপর পারভেজ তার বন্ধুদের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর ইলিয়ানা ও বাড়ি ফিরে যায়।
?????
মাহফিল শেষে রাত নয়টার দিকে সাদাদ আর তার বাবা বাড়ি ফিরে আসে। শুধু সাদাফ আর সাদাফের বাবাকে ফিরে আসতে দেখায় কুবরা দরজার এপাশ ওপাশ উঁকিঝুঁকি দিয়ে থাকে। কিন্তু কোত্থাও নাদিম কে দেখতে পায় না।
কুবরাকে এমন উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে সাদাফ ভালোই বুঝতে পেরেছে যে সে নাদিম কে খুজছে। গলা ঝাকরি দিয়ে সাদাফ বলে ” খুজে লাভ নেই। নাদিম চলে গিয়েছে বাড়িতে “।
পেছন থেকে সাদাফের এমন কথা শুনে লজ্জায়
হম্বিতম্বি খায় কুবরা।
কুবরাঃ আ… মি.. মোটেও ওনাকে খুজছি না। বালাইষাট উনাকে কেন আমি খুজবো। আমি যাস্ট বাইরে আমার আমার জুতোগুলো ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখছি। আজকাল কতো কিছু চুরি হয়ে যাচ্ছে আশেপাশে। ( নাদিমের কথা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য)
সাদাফঃ ওওও তাই বলো…. আমি তো ভেবেছি নাদিম দে খুজছো। আচ্ছা চলো খেয়ে নিই। খিদা লেগেছে।
কুবরাঃ হ্যা চলুন ( দরজা বন্ধ করতে করতে)
কুবরা উপর দিয়ে সাদাফ কে মিথ্যা বলে কথাটা কিন্তু ধামাচাপা দিলেও মনে মনে নাদিমের জন্য ঠিকি মন খারাপ হচ্ছে। খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র রুমে গিয়ে আগে নাদিম কে মেসেঞ্জারে নক দেয়। নাদিম কে এক্টিভ ই দেখাচ্ছে এখন।
কিছুক্ষন আগেই নাদিম বাড়ি ফিরে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে মোবাইলটা নিয়ে মাত্র বসেছে কুবরা অনলাইনে আছে কিনা দেখার জন্য।
কুবরাঃ কি ব্যাপার চলে গেলেন কেন?
কুবরা মেসেজ দেওয়ার সাথে সাথেই নাদিম সিন করে। যেন এতোক্ষন কুবরার মেসেজ পাওয়ার জন্যই মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে সে।
নাদিমঃ কেন মিস করছো বুঝি আমায়??
কুবরাঃ মোটেও না। আগে বলুন চলে গেলেন কেন?
নাদিমঃ আচ্ছা সবসময় কি আমি ওখানে পড়ে থাকবো? ওটা কি আমার নিজের বাড়ি?
কুবরাঃ তাও। মামনী তো আপনি থাকলে খুব খুশিই হয়।
নাদিমঃ শুধুই কি মামনী?? তুমি নও??
এটা দেখার সাথে সাথেই কুবরা থতমত খেয়ে যায়। এর প্রতিউত্তরে কি বলবে সে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না। উত্তর দেওয়ার আগের নাদিম আরেকটা মেসেজ দেয়।
নাদিমঃ হুমমম বুঝেছি। তোমাকে একেবারে পার্মানেন্টলি আমার বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। যেন সবসময় আমাকে দেখতে পাও।
নাদিমের এমন কথায় কুবরার মুখে একরাশ লজ্জার হাসি ফুটে উঠে । নাদিম কি বুঝাতে চাইছে তা তার হাসির মাধ্যমেই ভালো ভাবে বুঝা যাচ্ছে। তবুও কুবরা রিপিট আরেকবার জিজ্ঞেস করে,।
কুবরাঃ পারমানেন্ট? তা কি করে সম্ভব??
নাদিমঃ সব কথা কি বুঝিয়ে বলতে হয়? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান কোনটা??
নাদিমের এমন কথায় কুবরার গাল দুটি লজ্জায় লাল টমেটোর মতো ব্লাশিং করছে। এভাবেই একের পর এক দুষ্টু মিষ্টি কথা বলতে বলতে পার করে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা সময়।
➡️➡️➡️➡️➡️
খাওয়াদাওয়া সেরে সাদাফ রুমে ঢুকা মাত্র দেখে শুভ্রা গুনগুনিয়ে খাটের ওপর আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচছে। সাদাফ মুচকি হেসে হেসে শুভ্রার পাগলামি কান্ড দেখছে। মেয়েটাকে দেখলে সে আসলেই কনফিউজড হয়ে যায়। এক সময় একেক রুপ। যখন সবার সামনে থাকবে তখন একরাশ ম্যাচুরিটি নিয়ে ভরপুর। যেন একদম পাক্কা সংসারী গৃহিণী। আর যখন একান্তে থাকে সাদাফের সাথে তখন দুনিয়ার বাচ্চামো সবই তার উপর ভর করে। আর একা থাকলে তো ব্যাস কোনো কথাই নেই। এই যে এখন যেমন। তবে আজই প্রথম সাদাফ শুভ্রাকে গুনগুনিয়ে নাচতে দেখছে। এর আগে কোনো দিন তাকে গান সহ গাইতে দেখেনি।
সাদাফঃ এহেম এহেম… আজ দেখছি ম্যাডাম খুব খুশি….. ।
শুভ্রা নাচতে নাচতে পেছন ফিরে দেখে সাদাফ বুকে হাত গুজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ কে দেখা মাত্রই শুভ্রা হটান স্ট্যাচু হয়ে যায়। ভীত চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে দুইহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে তালি দিতে থাকে ( ??)
সাদাফ শুভ্রাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে শুভ্রার কোমর জড়িয়ে দাঁড়ায়।
সাদাফঃ কি হলো বললে না যে আজ আমার পাগলী শুভি কেন এতোটা খুশি।
শুভ্রা সাদাফের দুই গালে হাত রেখে বলে “” খুশি কারন আমার এই গ্রেট বরটার জন্য আমি কাল থেকে কলেজে যেতে পারবো “”।
সাদাফঃ তাইইই। তাই বলে এত্তো খুশি???
শুভ্রাঃ হুমম এত্তো এত্তো এত্তো খুশি। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আমি আর পড়ালেখাই করতে পারবো না। আজ আমি এত্তো ভালো একটা বর পেয়েছি যার জন্য আমি আবার পড়ালেখা শুরু করতে পারছি। তো খুশি হবো না? ( সাদাফের গলায় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে)
সাদাফঃ কতোটুকু তেই এত্তো খুশি। তোমার বোন তো দেখছি না পড়লেই বাচে।
শুভ্রাঃ ও তো এমনই, বাড়িতেও সারাক্ষণ বকা শুনতো আম্মুর কাছে এর জন্য। কিন্ত টেনশন একটাই আমি তো এসব পড়া বুঝবোই না। বাইরে গিয়ে তো পড়া আমার সম্ভব না। কি করি বলুন তো। ( চিন্তিত মুখে)
সাদাফঃ কেন আমি আছি না? আমিই পড়াবো।
শুভ্রাঃ সত্যিইইইইই। ওয়াওওওওও আপনি কত্তো ভালো। ( এই বলেই সাদাফের সারা মুখ অজস্র চুমুতেই ভরেয়ে দেয় শুভ্রা। )
সাদাফঃ আস্তে আস্তে এতো উম্মাদ হলে কি হবে আমার ছোট্ট বউটার। আজ এত্তো খুশি যে নিজে থেকেই এই প্রথম আমায় আদর করলো।
শুভ্রার এখন হুশ হলো এতোক্ষন সে কি করছে লজ্জায় শুভ্রার মুখও লাল টমেটোর মতো ব্লাশ করছে। মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে মুখ লুকায় সাদাফের বুকে।
#চলবে।