অচেনা তুমি পর্বঃ১৫

0
1259

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ১৫
নিশ্বাস নিতে পারায় শুভ্রার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। নরম হাত দুটি পেছন থেকে শক্ত শেকলের মতো ধরে আছে কেউ। কিন্তু পিছনে হওয়ায় তাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। শুভ্রাকে টানতে টানতে বিল্ডিংয়ের এক কোনায় নিয়ে যায় সে। এদিকে নাক মুখ চেপে ধরায় শুভ্রার যান যায় অবস্থা।

আজতো আমি তোকে শেষ করে ফেলবো। আর কতোদিন বেচে যাবি আমার হাত থেকে।

পেছন থেকে আসা পুরুষ কন্ঠটি শুনে শুভ্রার বুক ধক ধক করতে শুরু করল।এই কন্ঠ সে চিনে। খুব ভালো করেই চিনে। শুভ্রাকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে বাহু ধরে ঘুরিয়ে ফেলে শুভ্রাকে লোকটি। শুভ্রার সামনের দিকে তাকিয়ে কাঙ্ক্ষিত পৈশাচিক চেহারাটা দেখেই প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম। হ্যাঁ এটা সেই নরপিশাচ যে এর আগেও একবার শুভ্রার উপর ঝাপিয়ে পড়তে চেয়েছিল তবে পারে নি।

সোহেলঃ কি রে এভাবে তাকিয়ে কি আছিস??

সোহেলের মুখ থেকে ধমকা গন্ধ শুভ্রার নাকে আসাতেই তার বমি আসার উপক্রম। সিগারেট আর মদের উদ্ভট গন্ধে শুভ্রার গা গোলাচ্ছে।

সোহেলঃ কি রে নাক ছীটকাচ্ছিস যে এখন? আর এরকম ছটফট ই বা করছিস কেন? ওই সাদাফের সাথে তো সারাক্ষণ গা ঘেঁষে ঘেঁষে থাকিস। এখন তো তুই ওখানেই থাকিস মনে হয় তাই না? তা রোজ কতো করে নিস হ্যা? আমাদের বাড়িতে কাজ করে যেমন ডেইলি নিতি তেমন?

শুভ্রা সোহেলের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে শুধু তাকিয়ে আছে। মানুষের মন কতোটা নিচু হলে তার মনে এসব ভাবনা আসতে পারে।

সোহেলঃ কি হলো এতো অবাক কেন হচ্ছিস। অবশ্য তোর কাছ থেকে তো এসবই আশা করে যায়। আচ্ছা কি করে পটালি বল তো। হাহ তোর যা রুপ তা দিয়ে তো যে কাউকেই পটিয়ে ফেলতে পারবি মূহুর্তেই। তা চল না আমার সাথেও। আমিও সেম রেট দিবো। আমি না হয় অতো বড়লোক নয়। তবে টাকা আমি ঠিকি দিবো। তুই তো টাকার জন্যই কাজ করিস তাই না?…

সোহেলের এই সস্তামার্কা নোংরা কথা শুনে শুভ্রার চোখে আর বাধ টিকলো না। টপটপ কতে গড়িয়ে পড়ছে চোখের পানি।

ঠাসসসসস………..
আমি কোনো তোর কেনা গোলাম নয় যে তুই আমাকে যা করতে বলবি আমি তাই করবো। তখন তোদের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে বলে প্রতিবাদ করিনি বলে এখন কিছু করবো না বলে মনে করিস না। (শুভ্রা)

সোহেলঃ হারামির কুত্তি আমার বাড়ির নুন খেয়ে আমাদের ই গাদ্দারি করা। একে আমার চাকরি খেয়েছিস। আমার বাড়ির বিরুদ্ধে কেস করে মামলা করেছিস। আমার বোনের বিয়ে ভেঙেছিস। এখন আবার আমায় চড় মেরে গরম দেখাচ্ছিস। আজ তো আমি তোর সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তোকে বদনাম করেই ছাড়বো।

এই বলে শুভ্রাকে নিয়ে টানাটানি হেচড়াহেচড়ি শুরু হয়ে গেলো। শুভ্রাতো চোখ বন্ধ করে শুধু বাচাও বাচাও বলে চিল্লাতে লাগলো।

এক পর্যায়ে শুভ্রার কানে মারামারির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। চোখ খুলে তাকিয়ে যাকে দেখে তাকে দেখা মাত্রই মনে হলো তার প্রানে পানি ফিরে এলো।

শুয়রের বাচ্চা শুয়র তোকে আমি একবার ছেড়ে দিয়েছি এটাই আমার বড় ভুল ছিলো। তোর সাহস হয় কি করে আমার শুভ্রার দিকে দ্বিতীয় বার হাত তোলার। আর এই মুখ দিয়েই তো এসব কথা বলেছিলি তাই না? হারামির বাচ্চা তোর এই মুখই আমি আজ থেতলে দিবো। কোন সাহসে তুই আমার শুভ্রার গায়ে হাত দিস। ( সাদাফ রাগে হুংকার দিয়ে দিয়ে এসব বলে)

সাদাফের চুখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে পুরো। রাগের জ্বালা চোখ থেকে টপটপ পানি ঝরছেব। সেখানেও সোহেল মেরে নাক মুখ ফেটে রক্ত বের করে ফেলেছে। মাতাল সোহেলের নিজেকে রক্ষা করার সে ক্ষমতাও নেই সাদাফের সাথে সে ও সমান তালে লড়াই করবেন।

এরপর নাদিম ছুটে এসে বলেঃ দোস্ত দোস্ত শান্ত হো। আমি দেখছি। তুই ভাবিরে সামলা।

এই বলে নাদিম ও শুরু করলো উদুম কেলানি। সাদাফ এখনো দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাগে ফুসতে থাকে। পাশে চোখ বুলিয়ে দেখে শুভ্রা এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। সাদাফ এবার নিজেকে সামলে শুভ্রার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায়একবার বলেঃ শুভি….
শুভ্রা সাদাফের কন্ঠস্বর শুনা মাত্রই সাদাফকে তার দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে ঢুকরে কেপে কেপে কাদতে থাকে।
সাদাফঃ শুভি দেখো। ভয়ের কিচ্ছু নেই। আমি আছি তো। এখনো ভয় লাগছে?
শুভ্রা শুধু না বোধক মাথা নাড়ায়। তারপর সাদাফ উলটা ফিরে সোহেলকে আবার হুংকার দিয়ে বলে উঠে।

তুই জানতে চেয়েছিলি না ও আমার কে? তাহলে শুন ও আমার একমাত্র ফিয়েন্স যাকে আমি ভালোবাসি। এন্ড আমি তাকে বিয়ে করে যোগ্য সম্মান দিবো বলে উনাকে আমাদের সঙ্গে রাখি। তোর মতো কাপুরষ নই যে আমি যাকে তাকে যখন তখন চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহার করবো। (চেচিয়ে)

শুভ্রা সাদাফের কথা শুনে মাথা শুধু অবাক পানে তাকিয়ে থাকে। লোকটা বলছে কি এসব। মাথা কি সত্যিই ঠিক আছে নাকি রাগের মাথায় যা আসছে তাই বলছে।

নাদিমের মাইর খেয়ে মাতাল সোহেল তো নেতিয়ে গেছে। তারপর নাদিম আর সাদাফ শুভ্রাকে নিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে শুভ্রা সাদাফকে বলে এসব যেন তারা বাড়িতে না বলে। নাহলে সবাই খুব টেনশন করবে। তার উপর শুভ্রার মা আবার হার্টের রুগী। সাদাফ ও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাই নি।

বাড়ি গিয়ে তারা কোনো মনে বানিয়ে বলে সবাইকে মেনেজ করে নেয় কারন সাদাফ শুভ্রাকে তখন আশেপাশে খুজে না পেয়ে কুবরাকে পাঠিয়ে দিয়ে দুই বন্ধু মিলে শুভ্রাকে খুজতে গিয়েছিল।

খাওয়াদাওয়া শেষে রাতে সবাই ঘুমাতে চলে যায়। কেন জানি না আজ তার ঘুম আসছে না। সারাদিন সাদাফের সাথে কাটানোর মূহুর্তগুলো ক্ষনে ক্ষনে মনে পড়ছে তার। আর মিটিমিটি হাসছে নিজে নিজে।

আচ্ছা মানুষটার সাথে থাকলে আমার এতটাই অদ্ভুত অনুভূতি কেন হয়? কেন এতো ভালো লাগে যখন আমি উনার সাথে থাকি। কেন এতো ভরসা পাই যখন উনি আমার পাশে থাকেন। একি নেহাত উনি ভালো মানুষ বলেই ভালো লাগা নাকি অন্যকিছু। আচ্ছা উনি আজ সোহেলকে এমনই বা কেন বললেন? উনি বলতেই পারতেন আমি উনার ফুপাতো বোন হই। সেই হিসেবেই উনাদের সাথে থাকা। তবে কেন এতো ভালো লাগছে যখন উনি আমাকে ভালোবাসেন বলেছিলেন। তবে কি আমি….. ইসসস কি সব ভাবছি আমি। (বলেই মিটিমিটি হেসে হেসে নিজের মনে হাজারো কল্পনা করতে করতে একপর্যায়ে গভীর নিদ্রায় হারিয়ে যায় শুভ্রা।)

গভীর রাতে যখন সকলেই গভীর ঘুমে মগ্ন তখন একজন রয়েছে যে গভীর মায়ায় মগ্ন। রকিং চেয়ারে বসে হাতে তার মায়াবতীর ছবি নিয়ে গভীর নেশায় যেন ধীরে ধীরে আসক্ত হচ্ছে সাদাফ।

এই মায়াপরী! কি করে যাদু করেছো বলোতো আমায়। তোমায় এতো ভালো কেন লাগে আমার। কদিনের ব্যবধানে এ ও কি সম্ভব? তোমায় না দেখে যে আমার এক মূহুর্ত ও ভালো লাগে না। তোমার ওই হাওয়াই মিঠাইর মতো তুলতুলে গাল, ফুচকার ঝালে হয়ে উঠা টকটকে লাল ঠোঁট , সূর্যর আলো পড়া ঘায়েলি বাদামী চোখের পাপড়ি এসমস্ত কিছু যে আমায় গভীর ভাবে গ্রাস করছে। ভাজ্ঞিস আমি চুরি করে তোমার ছবি তুলে নিয়েছিলাম। নাহলে তোমায় যে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছিলো আমায়।
আচ্ছা শুভি তোমারও কি আমার মতে এই মতালম্য অনুভূতি হয়? নাকি শুধু আমিই অন্ধকারে আউড়াতে থাকি। তবে তুমি যাই ভাবো না কেন তোমার তো আ।আকেই হতে হবে। হতেই হবে। ( এই বলে সাদাফ মোবাইল টা বুকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়)

এভাবে আস্তে আস্তে আরও কয়েকটি দিন চলে যায়। সাদাফ আর শুভ্রা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। একেবারে ভালো বন্ধু যাকে বলে। তবে দুজন যে দুজনকে কতো গভীর ভাবে ভালোবাসে তা এখনো প্রকাশ করে নি।

নাদিম আর কুবরা তো আছেই ২৪ ঘন্টায় ২০ ঘন্টা ঝগড়া লাগিয়ে লাগিয়ে। তবে নাদিম নাছুরবান্দা ছাড়ার পাত্র নয়। এতো গুলো মেয়েকে এখন সে পটাতে পেরেছে সেখানে এই পিচ্চি কোন ছাড়! কিন্তু কুবরার পেছনে পড়ে পড়ে যেন এখন নাদিমের ও তার প্রতি এক অনুভূতি ফিল হয়। কুবরা নাদিম কে খুচা দিয়ে কথা বললেও এসব দুষ্ট মিষ্টি কথা এখন নাদিমের বেশ লাগে। কিন্তু নাদিমের হাজার রকম ফ্লার্টইং কথাবার্তায় কুবরার মন কিছুতেই গলে না। বরং আরও মুখ ভেংচি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

আজ সকাল সকাল উঠেও শুভ্রা সবার জন্য নাস্তা বানাতে যায়। কুবরা বসে বসে টিভি দেখে। সাদাফ আর নাদিম জগিং করে এসে রেডি হচ্ছে আর বড়োরা ডাইনিং এ বসে আলাপ আলোচনা করে।

হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই কুবরা গিয়ে মামার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করলো দরজা খুলবে কিনা। এখানে আসার পর থেকে এ বাড়িতে কেউ আসে নি। কারণ এখানে তারা নিজেরাই তো বেড়াতে এসেছে আবার এখানে কে আসবে।

মামার অনুমতি নিয়ে দরজা খুলে দেখে একজন যুবতী দাড়ানো। খুব সুন্দর একটা মেয়ে৷ চুলগুলো ব্রাউন কালার করা উন্মুক্ত খোলা।
হাটু পর্যন্ত একটা টাইট পোশাক। মুখে ভারি মেকাপ। দেখতে হুবহু নায়িকার মতো। এ যেন পুরাই সামিরা খান মাহি।

কুবরার অবাকত্ব কে পাশে ঠেলে দিয়ে মেয়েটি বেশ এটিটিউড নিয়ে ভেতরে ঢুকে সাদাফের মা কে জড়িয়ে ধরে।

মেয়েটিঃ ওওও হাম্মি!!! মাই সুইটহার্ট। কেমন আছো (গালের এক পাশে চুমু দিয়ে৷)
সাদাফের বাবা মা আর শুভ্রার মা অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে এতো গুলো গুরুজন আছেন। সালাম দোয়া নেই তার উপর ড্রেসের যে স্টাইল দেখেই সাদাফের মা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললেন। মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে বলেঃ আরে ইলু মা। কেমন আছিস তুই।

মেয়েটিঃনট গুড। তোমরা কক্সবাজার এসেছো আর আমাকে বলো নি কেন হুম?
সাদাফের মাঃ কাজে এসেছিলাম। সবাই এতো ব্যস্ত ছিলাম মনেই ছিলো না।

মেয়েটিঃ আমি যদি না জানতাম তখন তো তোমরা আমাদের না জানিয়েই চলে যেতে। ভাজ্ঞিস আমি কাল নাদিমকে দেখেছিলাম বিচে যাওয়ার সময়। ওর কাছ থেকেই তো জানা।

তখনই সাদাফ আর নাদিম রেডি হয়ে আসছিলো নাস্তা করার জন্য। সাদাফকে দেখা মাত্র মেয়েটি স্যাডি বেইবি বলে দৌড়ে গিয়ে সাদাফ কে জড়িয়ে ধরে।
এদিকে শুভ্রা তখনই নাস্তা নিয়ে রান্নাঘর থেকে আসছিলো টেবিলে রাখার জন্য। বের হয়ে সবার সামনে এই দৃশ্য দেখে পাথরের মূর্তির মতো ঠায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে সে। মনের ভিতর এক শুকনো মোচড় দিয়ে উঠলো। তবে কি এই মেয়েটা সাদাফের কেউ?

মেয়েটির আকষ্মিক এমন কাজে সাদাফ নিজেই ভেবাচেকা খেয়ে যায়। চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করার আগেই মেয়েটি সাদাফ কে জড়িয়ে ধরে। এদিকে সামনে শুভ্রাকে এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদাফের ও কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটিঃ স্যাডি বেইবি!!! এটা ঠিক না আমাকে না বলে তুমি সারা কক্সবাজার ঘুরছো। আর তুমি জানো? তোমার জন্য আমি কতো ওয়েট করে বসে আছি।

মেয়েটির কথা শুনে সাদাফ একবার মেয়েটির দিকে তাকায় তো একবার শুভ্রার দিকে তাকায়। শুভ্রা এখনো ঠায় সাদাফের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভয়ে সাদাফের গলা ধরে আসছে। না জানি শুভ্রা কি না কি ভাবছে এই ভেবে।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here