প্রিয়তার প্রহর (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৪

0
150

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৪ )

“মৃত্যু” এমন একটি শব্দ যা এক লহমায় বদলে দিতে পারে জীবনের বাঁক। আরিফ হোসাইনের মৃত্যুতে প্রিয়তার জীবনের বাঁক ওলটপালট হয়নি। কারন প্রিয়তা নিজের জীবনের সকল পথ নিজেই বেছে নিয়েছিল। তাই বুঝি হাউমাউ করে কাঁদছে না মেয়েটা। বাবার মৃত্যুতে কি শোকাহত হয়নি প্রিয়তা? জানতে চায় আশপাশের লোকজন। সে যে শোকে পাথর হয়েছে এ কথা কাকে বোঝাবে?

হাসপাতাল থেকে লাশ আনা হয়েছে আরিফের বাড়িতে। বাড়ির বাইরের বারান্দায় নামানো হয়েছে লাশ। জনসমাগমে ভরতি এই স্থানে প্রিয়তা এক জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। কপোল বেয়ে রয়েছে নোনা পানির চিহ্ন। চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে প্রিয়তার। মাথা ব্যথায় উশখুশ করছে সে। দীপা কেঁদে চলেছে স্বামীর পাশে বসে। হাউমাউ করে কান্না করছে মহিলা। প্রিয়তাকে এভাবে কাঁদতে না দেখে কিছু মানুষ গুঞ্জন তুলছে। মেয়ে কি তবে বাবাকে ভালোবাসে না? বাবা যতই খারাপ হোক, মেয়ের তো উচিত বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করা। প্রিয়তা করছে না কেন? প্রিয়তা সব শোনে। তবুও মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। আরহাম মৃত্যু শব্দটা বুঝে। প্রচণ্ড কাঁদছে ছেলেটা। মিসেস নাবিলা বারংবার চেষ্টা করেও আরহামকে থামাতে পারছেন না। প্রিয়তাও ভাইয়ের কাছে ঘেঁষছে না। কাঁদুক ছেলেটা। বাবার মৃত্যুতে কাঁদুক। প্রহর আশপাশে কোনো কারণ ছাড়াই নজর বুলায়। এগিয়ে আসে লাশের দিকে। সাদা কাফনে জড়িয়ে রাখা লাশটা কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে। প্রহরের ভয় নেই। লাশ দেখার ইচ্ছে জাগে তার। নরম স্বরে বলে,

” আমি শেষবার আঙ্কেলকে দেখতে চাই।

দীপার কান্না থামে। ঘনঘন পলক ফেলে মহিলা। চাহনি দৃঢ় হয় তার। চোখ ফিরিয়ে বলে,

” মৃত মানুষকে আর কি দেখবে? কবরের ব্যবস্থা করো গিয়ে। কোনো দায়িত্ববোধ নেই দেখছি। সরো সরো।

প্রহর সরে না। বসে পরে লাশের পাশে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই হাতের আঙুল দ্বারা সরিয়ে দেয় সাদা কাপড়। কয়েক সেকেণ্ড যেতে না যেতেই দীপা রেগে আবারো মুখ ঢেকে দেয় আরিফের। রাগী স্বরে বলে,
” বললাম না কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে? কতক্ষণ লাশ এখানে থাকবে? যাও এখান থেকে। তোমাদের ডাকাই আমার ভুল হয়েছে।

প্রহর উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তাকে লাশের কাছে আসতে না দেখে সুযোগ পেয়ে যায় দীপা। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
” বাপ মরে গেছে খুশি হয়েছো তো? খুব খুশি তাই না? সম্পত্তি সব পেয়ে গেছো। বাপকে আর কি দরকার?

প্রিয়তা এসব কথায় পাত্তা দেয় না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এগোয় বাবার লাশের সামনে। প্রিয়তার চোখের পানি ঘাসে পরে। শুষ্ক লাগে চেহারা প্রিয়তার চেহারা। এলোমেলো অগছালো মেয়েটা বাবার লাশের পাশে বসে। চেঁচামেচি করে না প্রিয়তা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিফের মুখে হাত বুলায়। নির্মল, শান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বলে,

” তুমি উঠবে না আব্বু? আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। এবার প্লিজ উঠো। আমি চাইতাম তুমি অনুতপ্ত হও, নিজের ভুল বুঝতে পারো। বিশ্বাস করো কখনোই চাইনি তুমি এভাবে চলে যাও। কখনোই চাইনি তোমার কষ্ট হোক। এতদিন তবুও মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে তোমরা আছো, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বেশ সুখেই আছো। কিন্তু এখন? এখন নিজেকে কি বলে বোঝাবো? উঠো না।

উঠে না আরিফ, নড়েচড়ে না। শ্বাস না নেওয়া আরিফ মেঝেতে লুটিয়েই থাকে। প্রিয়তার হুঁশ ফিরে। বাবাকে উঠতে না দেখে উত্তেজিত হয় তার কায়া। বেশ সজোরে ঝাঁকায় মৃত শরীরটাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

” এই আব্বু। উঠো। বলেছি তো আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি কান ধরছি। উঠো তুমি। আল্লাহ্, এমন মজা করে না আব্বু। দেখো সবাই কষ্ট পাচ্ছে।

প্রিয়তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। কপোল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে। রক্তিম হয় চোখ আর নাক। নাক টানে প্রিয়তা। হু হু করে কেঁদে উঠে। বাবার শীতল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে। কান্না করে খুব। বিরামহীন অশ্রুতে টইটম্বুর হয় চোখ। ফুঁপিয়ে ওঠে প্রিয়তা। ভুলে যায় দিক্বিদিক। চেঁচিয়ে দীপার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

” আব্বু আপনাকে বিয়ে করেছিল সুখে থাকার আশায়। কেমন সুখ দিলেন আপনি? পাশে থাকতে পারেন নি? এত টেনশন করতে দিলেন কেন? কেন আব্বুকে প্রাণ হারাতে হলো হ্যাঁ?

দীপাও চেঁচিয়ে উঠে সমান তালে। বলে,
” বাপ তো মানো না ওরে। তোমার কথার ঝাঁঝেই মানুষটা চলে গেছে। বাবার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও তো জানো না। কোনোদিন খোঁজ ও তো নাও নাই। এখন আব্বু আব্বু কইরা ঢং দেখাও? দেখাও যে বাপরে ভালোবাসো?

প্রিয়তা অধিক শোকে পাথর হয়। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলে চোখ। মাথা ব্যথায় কুঁচকে উঠে ললাট। ভেতরের যন্ত্রণা কাবু করে প্রিয়তাকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে প্রিয়তা। ছটফট করে। প্রহর এগিয়ে আসে নিকটে। প্রিয়তাকে আগলে ধরে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

” কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তা? থামুন এবার।

প্রিয়তা থামে না। কেঁদে চলে। মস্তিষ্ক অগোছালো হয় প্রিয়তার। তাল হারিয়ে ফেলে। সবকিছু ঘোলাটে লাগে। পড়ে যেতে নেয় প্রিয়তা। চোখ বুজে আসে। ক্লান্ত স্বরে বলে,
” আমার শ্বা..শ্বাস নিতে ক..কষ্ট হচ্ছে প্রহর। দম বে..বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁচবো না বোধহয়। বাঁচবো না।

জ্ঞান হারায় প্রিয়তা। প্রহরের বুকে মাথা রেখে ঢলে পরে। আগলে নেয় প্রহর। নরম শরীরটাকে চেপে ধরে বক্ষে। ইহানকে কল করে। রাতে ঘুমোনোর পূর্বে এখানে আসার খবরটা ইহানকে জানিয়েছিল প্রহর। বলেছিল শপিং করেই ইহানের বাসায় যাবে। কিন্তু এখন যাওয়ার উপায় নেই। ফোন দিয়ে প্রহর বলল, ” প্রিয়তার আব্বু মারা গেছেন। প্রিয়তা অসুস্থ হয়ে পরেছেন। বিয়ে ক্যানসেল। এখানে গণ্ডগোল আছে বুঝলি? লাশ ভালো মতো দেখে নিবি। আমার সব ঠিকঠাক লাগছে না। প্রিয়তাদের বাড়িতে আয়। আমি প্রিয়তাকে নিয়ে আমার বাড়ি ফিরছি।

_______

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তানিয়াকে বিছানায় পায়নি ইহান। সারা বাড়ি খুঁজেও তানিয়ার অস্তিত্ব মেলেনি। ইলমা বেগম ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছেন। তানিয়া কোথায় গেছে তা তিনি জানেন না। ইহান নিজ ঘরেই তানিয়ার বস্ত্র খোঁজে। সবই ঠিক আছে। এর মানে পোশাকাসাক নেয়নি। ইহান পুরো ঘরে নজর বুলায়। টেবিলের উপরে সাদা রঙের কাগজ পায়। সেখানে লেখা ছিল,

অপ্রিয় স্বামী,

বাবার কাছে ফিরে যাচ্ছি। আপনার মতো গোমড়ামুখো, অতি গম্ভীর, জেদি মানুষের সাথে সংসার করা আর পুতুলের সাথে খেলা করা একই কথা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আপনার ওই কোঁকড়ানো চুলগুলো ধরে নায়কদের মতো দশ ফিট দূরে ফেলে দিতে। অনুভূতিহীন মানুষের সাথে কি আর সংসার করা যায়? বাসায় এসে জোর করে কোলে তুলে না নিয়ে গেলে আর কখনোই ও বাড়ি ফিরবো না।

ইতি,
আপনার অবাধ্যগত বউ।

সকালের ঘটনা ভেবেই গম্ভীর হয় ইহান। প্রিয়তাদের বাড়ি যাবে এখন। সাথে মেয়েটা গেলে ভালো হয়। গণ্ডগোল থাকলে সাথে একজন দক্ষ লেডি পুলিশ নিলে কাজ সহজ হয়। ফোন করবে কি করবে না ভাবে ইহান। ইগোটাকে সরিয়ে কল করতে খুব মানে লাগে ইহানের। তবুও কাজের স্বার্থে ফোন করে ইহান। ফোন খানিকক্ষণ বাদে উঠায় তানিয়া। গম্ভীর স্বরে বলে,

” হ্যালো।

ইহানের মাঝে জড়তা কাজ করে। সর্বদা গম্ভীর থাকে সে। অনুভূতি প্রকাশ করতে দ্বিধায় পরে সবসময়। তানিয়াকে আসতে বলতে ভিষণ অসস্তি লাগে ইহানের। বললে নিশ্চয়ই তানিয়া হাসবে। কৌতুক স্বরে বলবে , ” কি? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলেন না তাই তো? তাহলে বলুন আমাকে ভালোবাসেন”।

গাম্ভীর্য বজায় রেখে ইহান বলে,
” প্রিয়তাদের বাসায় যেতে হবে। রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি এসো।

” কেন? প্রিয়তার বাসায় কি কাজ?

” প্রহর আর প্রিয়তা এখানে ফিরেছে। আজ ওদের বিয়েও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরেই প্রিয়তার বাবা মারা গেছে। প্রহর বললো ওখানে কিছু গণ্ডগোল আছে। মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাই যেতে হবে।

তানিয়ার যেতে ইচ্ছে হয়। প্রিয়তা আর প্রহরকে একত্রে দেখার ইচ্ছে জাগে। অভিমান ভুলে শান্ত কণ্ঠে বলে,

” প্রিয়তার বাসায় দেখা হবে। আসছি।

_______

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে। আধশোয়া অবস্থায় বসেছে বিছানায়। মাথাটায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে প্রিয়তার। সময়টা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় সে। সন্ধ্যে হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় ছ টা উনত্রিশ বাজে। একটু শীত শীত লাগছে প্রিয়তার। ললাটে ভেজা কাপড়ের অস্তিত্ব টের পায়। জ্বর এসেছে তার? জলপট্টি দিয়েছে কেউ। চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকায় প্রিয়তা। মনে পরে মাঝ দুপুরের ঘটনা। সাথে সাথেই প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে ওঠে। শব্দের দাপটে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে প্রহর। প্রিয়তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সযত্নে। প্রিয়তার কান্নাকাটিতে বিচলিত না প্রহর। এটা যেন হবারই ছিল। শান্ত কণ্ঠে বলে,
” আবার কাঁদছেন?

প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় কাবু হয়ে থাকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। আকাশ সম ব্যথায় নেতিয়ে থাকে। কম্পিত কণ্ঠে বলে,

” আমার জীবনে কান্না ব্যতিত আর কি আছে হুহ? ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্না করা ছাড়া আর কি পারি আমি? আমার কারণেই আব্বু চলে গেছে। আমি একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। একটু ভালো ব্যবহার চেয়েছিল আব্বু। আমি দিতে পারিনি।

” আপনি দোষী নন প্রিয়তা। আপনি আপনার দিক থেকে ঠিক। উনি দোষ করেছেন, যার ফলস্বরূপ আপনি দুরত্ব বাড়িয়েছেন। আপনি তো কখনো চাননি আঙ্কেল চলে যাক দুনিয়া ছেড়ে। কখনো অভিশাপ দেননি। এটা উনার ভাগ্যে ছিল প্রিয়তা। আল্লাহ্ ব্যতিত কেউ ভাগ্য বদলাতে পারে না। তাই এত অনুশোচনা করবেন না।

” আব্বু কি আমাকে ক্ষমা করবে?

প্রহর কিছু বলে না। চুপ থাকে। পাশে বসে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সময় গড়ায়। সন্ধ্যে সাতটা বাজে। প্রিয়তার কান্নার পরিমাণ কমে। চুপ হয়ে যায়। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে। প্রহরের দিকে তাকিয়ে প্রাণহীন কণ্ঠে বলে,

” লাশ কোথায়?

” উনার দাফন শেষ হয়েছে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। দীপা আন্টি দেরি করতে চাননি।

আবার ও নিস্তব্ধ হয় ঘরটি। ছুটে আসে আরহাম। প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট বুকে। ছেলেটার চোখে পানি। প্রিয়তাকে জেগে উঠতে দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

” আপু তোমার খুব জ্বর। কত্তক্ষণ ঘুমোলে তুমি। আব্বুকে শুইয়ে দেওয়া হলো তুমি দেখলে না।

গভীর নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় প্রিয়তা। আরহামের জীবনে ওর বাবা-মায়ের ভূমিকা এত ঠুনকো কেন? আরিফ হোসাইন চলে গেল। রেখে গেল নিষ্পাপ এক ছেলেকে। এই ছেলেটার বাবার নামের পাশে মরহুম শব্দটি উচ্চারিত হবে। এতিম বলে সম্বোধন করবে ছেলেটাকে। না মেনে নিতে পারে না প্রিয়তা। চেষ্টা করবে ভাইকে সর্বোচ্চ সুখী রাখার। জড়িয়ে নেয় আরহামকে। বলে,

” তুমি তো দেখেছো।

” হ্যাঁ। আব্বুকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা হলো জানো? আব্বু শব্দ করলো না। আব্বু তো মরে গেছে তাইনা?

কেঁদে ফেলে আরহাম। প্রিয়তা বলে,

” নিধি আপুর কাছে যাও আরহাম। তোমার প্রহর ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

চোখ মুছে চলে যায় আরহাম। প্রিয়তা উঠে বসে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে প্রহরকে। ঠোঁটের কোণে মৃদ্যু হাসি ফোঁটে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তাইনা?

প্রহর মুচকি হাসে। বলে,

” হুহ্। ছিলো।

প্রিয়তা চুপ থাকে। লজ্জায় মাথা নত করে বলে,

” আমি চাই আজই বিয়েটা হোক।

” আপনি আগে সুস্থ হন প্রিয়তা। এসব পরে ভাবা যাবে।

” উঁহু। আজই বিয়ে হবে। আমি ঠিক আছি।

অবাক হয় প্রহর। প্রিয়তার এহেন কথায় বিস্ময় চেপে ধরে তাকে। অবিশ্বাসের সাথে অস্ফুটে বলে,

” প্রিয়তা।

সম্মোহনী চোখে তাকায় প্রিয়তা। লজ্জায় রক্তিম হয় মুখ। হৃদস্পন্দন থামে। নত মুখে বলে,
” আপনাকে ভিষণ প্রয়োজন আমার প্রহর। আপনার বুকে মাথা রেখে নির্ঘুম রাত্রি পাড়ি দিতে চাই। আপনার দেহে আবৃত থাকতে চাই বৈধ ভাবে। চুমু খেতে চাই আপনার প্রশস্ত বুকে। আমার সুখ চাই প্রহর। এই দুঃখের সাগরে আপনিই একমাত্র সুখের দিশা। আপনি কাছে থাকলে আমার সুখ সুখ লাগে। পুরো পৃথিবীকে অনবদ্য লাগে।

প্রহর খুশিতে আত্মহারা হয়। বোঝাতে পারে না অনুভূতি। গাঢ় হাসি ফুটে উঠে চোখে। দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয় প্রহরের। রম্যতার কণ্ঠে বলে,

” আপনি খুব দুষ্টু হয়ে গিয়েছেন প্রিয়তা। এত দুষ্টু না হলেও চলতো।

একই ভাবে হাসে প্রিয়তা। ফিসফিস করে বলে,

” শারিরীক নয়, মানসিক সুখের জন্য হলেও আপনাকে আমার চাই। ভিষণ ভাবে চাই।

________

রাত হয়েছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে চাঁদ। ইহান, তানিয়া, প্রহরের বাড়ির মানুষ জন, প্রিয়তা আর আরহাম ব্যতিত বাড়িটায় আর কেউ নেই। কাজী এসেছে মাত্র। বয়স্ক লোকটার পরণে ধবধবে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। বড় বড় দাঁড়ি রেখেছেন। মাথায় টুপি পড়ে বসে আছেন বারান্দায়। বিদ্যুত চমকাচ্ছে। অন্ধকার আকাশে বাজ পড়ার কারণে ঝলমল আকাশ করে উঠছে মাঝে মাঝে। কাজী তাড়া দিলেন। প্রিয়তাকে সাজিয়ে আনা হলো বারান্দায়। মেয়েটার পরণে গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি। কোনোরকম প্রসাধনী নেই মুখে। গলায় সোনার চেইন আর কানে দুল। চোখের নিচে গাঢ় কাজল দিয়েছে প্রিয়তা। চুলের খোঁপা আগলা রয়েছে। ফোলা ফোলা চোখমুখে বারান্দায় আসে প্রিয়তা। মাথার ঘোমটা টেনে আনে ললাটে। নত মুখে বসে সোফায়। খানিকক্ষণ বাদে প্রহরকে আনা হয় বারান্দায়। প্রিয়তা তাকায় না সেদিকে। প্রহরের নজর পরে প্রিয়তার নত মুখে। মুচকি হাসে ছেলেটা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রহর। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার পানে। নজর সরে না এক রত্তি। কাজী দোয়া-দুরূদ পড়েন। খানিকক্ষণ বাদে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করেন। প্রহর সময় নেয় না। পরপর তিনবার কবুল বলে সাইন করে কাগজে। প্রিয়তাকে কবুল বলতে বলায় কাঁপে না প্রিয়তার কণ্ঠ। বেশি সময় নেয় না। কবুল বলে বেশ অনায়াসে। সাইন করে কাগজে। সকলেই উচ্চস্বরে “আলহামদুলিল্লাহ্” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কাজী যেতেই প্রহর দ্রুত পাশে এসে বসে প্রিয়তার। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ রেখে নিচু কণ্ঠে বলে,
” প্রিয়তমা, আমার সব সুখ আপনার হোক। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত হোক প্রহরময়।

প্রিয়তা লাজুক হাসে। নত মুখ আরো নত হয়ে আসে। লজ্জায় মূর্ছা যায় মেয়েটা। হাঁসফাঁস করে। ইশশ প্রিয় মানুষের কণ্ঠে এত মাদকতা কেন?

_____

বৃষ্টি পড়ছে। ঝমঝম বর্ষণের শব্দ ঝংকার তুলছে। প্রহরদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় এসেছে। খেয়েদেয়ে মিষ্টি মুখ করে বাইরে বেরিয়েছে ইহান আর তানিয়া। একই সময়ে বেরিয়েছে বলে বিরক্ত হলো তানিয়া। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। গাড়িঘোড়া নেই তেমন। ছাতার নিচে থেকেও ভিজে যাচ্ছে তানিয়া। পায়ের নিচের শাড়ির অংশ ভিজে একাকার। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। ইহান গাড়িতে ওঠে। গাড়ি স্টার্ট দেয় না। বসেই থাকে গম্ভীর ভাবে। বেশিক্ষণ থাকতে পারে না চুপচাপ। উচ্চস্বরে বলে,

” উঠে বসো তানিয়া।

তানিয়া ছাতা সহ এগিয়ে আসে গাড়ির জানালার কাছে। গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে,

” আপনার সাথে যাবো না। ফ্লার্ট করতে চাইছেন? আমি কিন্তু বিবাহিত।

ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটুকু বলে তানিয়া। তানিয়ার এমন অহেতুক কথাবার্তায় বিরক্ত হয় ইহান। ললাটে ভাঁজ পরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” বাজে বকো না। উঠে বসো। বাড়ি চলো। আম্মা তোমার অপেক্ষায় আছে।

” আন্টিকে বলে দিবেন, তার অমন জেদি ছেলের সাথে আমি সংসার করতে পারবো না।

” আমার জেদ তুমি দেখোইনি তানি। রাগ বাড়িয়ো না।

তানিয়া শোনে না। এক হাতে ছাতা ধরে অপর হাতে শাড়ির কুঁচি গুলো উঁচু করে ধরে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সম্মুখে। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ইহান নামে গাড়ি থেকে। ছাতা নিয়ে হেঁটে চলে তানিয়ার পিছু পিছু। তানিয়া তা দেখে হাসে। হাঁটার গতি বদলে দৌড়ায় তানিয়া। রাস্তায় জমে থাকা পানির তোয়াক্কা করে না। ছুটে চলে নিজের মতো। ছাতাটাও ছুঁড়ে মারে। তানিয়ার দৌড় দেখে ইহান ও দৌড়ায়। ফাঁকা পাকা রাস্তায় দুজন মানব মানবী দৌড়াতে থাকে নিজের খেয়ালে। সপসপ শব্দ করে পানি ছিটে যায় সবখানে। ধরা পরে তানিয়া। তানিয়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে ইহান। থামে তানিয়া। ইহানের নিকটে আসে। ইহানের হাতে থাকা বন্ধ ছাতাটা ফেলে দেয়। বাতাসে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পরে ছাতা। খিলখিলিয়ে হাসে তানিয়া। বলে,

” আপনাকে এভাবে দৌড়াতে দেখতে দারুন লেগেছে। পুরোই সিনেমা।

ইহানের রাগ বাড়ে। শাড়ির আঁচল টেনে ধরে শক্তি দিয়ে। গাড়ির দিকে ফিরে যেতে চায়। রাগী কণ্ঠে বলে,

” খুব অবাধ্য হচ্ছো তানিয়া। এত অহেতুক বকবক করা আমার পছন্দ নয়।

” আমাকে তো পছন্দ।

থতমত খায় ইহান। চোখ নামায়। দুজনেই ভিজে গেছে। কাপড় থেকে পানি পরছে এক নাগাড়ে। ইহানের কোঁকড়া চুল ভিজে একাকার। তানিয়ার চুল থেকে পানি পড়ছে। তানিয়া ইহানের পাশে পাশে হাঁটে। পুনরায় বলে,
” বলুন। আমাকে পছন্দ নয়?

” তোমাকে আমি ঠিক কতটা পছন্দ করি তা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না। অপ্রকাশিত ভালোবাসা সবচেয়ে সুন্দর।

” কিন্তু আপনাকে প্রকাশ করতে হবে। নইলে আমি ফিরবো না।

একটি অটো আসে। ততক্ষণাৎ অটোটাকে থামায় তানিয়া। উঠে বসে অটোতে। চলতে থাকে অটো। ইহান দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। তানিয়া অটো উধাও হবার পৃর্বে চেঁচিয়ে বলে,

” চিঠিতে যা লেখা ছিল তা না করলে কখনোই আপনার বাড়িতে ফিরবো না। আপনি যদি জেদি হন তো আমিও আপনার বউ। সবসময় এক কাঠি উপরে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

[ ইহা একখান রোমান্টিক পর্ব🤭 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here