প্রস্থান — ১ম পর্ব।

0
2789

১.
আড়ালে দাঁড়িয়ে মা’কে দেখছে রশ্মি। তাঁর মা একটা নিস্তব্ধ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, একটা মাঝবয়েসী লোকের সাথে কথা বলছে। মায়ের সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি; গাড়ি আর তাঁর মায়ের ঠিক মাঝখানেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। পরণে স্যুট-টাই। মুখটা শ্যামবর্ণ। হাসলে দাঁত বের হয়; সাদা চকচকে দাঁত।
লোকটাকে সে চেনে না৷ আগে কখনোই দেখেনি। বাবা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর হয়েছে। নিকট কোনো আত্মীয় হলে ইতোমধ্যে লোকটার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু এমনটা হয়নি৷ অথচ তাঁর মা এমন হেসে কথা বলছে, যেন লোকটা খুব পরিচিত, দীর্ঘ-দিনের জানাশোনা, কাছের কেউ!

মেঘেরা আকাশে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। গর্জন নেই। বৃষ্টি আদৌ আসবে কী-না, তার নিশ্চয়তা নেই। তবুও পরিবেশটা এখন শান্ত-নিস্তব্ধ, ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে; সময়টা সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্ত বলেই বোধহয়! কিন্তু রশ্মির ভিতরটা অস্থির হয়ে আছে, এক অজানা শঙ্কায়! মা’কে যেন লোকটার পাশে ঠিক মেনে নিতে পারছে না সে। লোকটাকে তাঁর পছন্দ হচ্ছে না একটুও। কালো ঠোঁট জোড়ার কোণে কেমন বিশ্রী হাসি! কথার ছলে বারবার মায়ের কাছে আসতে চাচ্ছে যেন। যদিও-বা তাঁর মা হালকা করে পিছিয়ে আসছে সাথে-সাথে; কিন্তু এই জড়তা যেন শুধুই কেউ দেখে ফেলার ভয়ে; এমনটাই মনে হলো রশ্মির। তবে তাঁর সবচেয়ে যেটা বেশি জঘন্য লাগল, সেটা হলো লোকটার তাকানো। সে তাঁর মায়ের বুকের দিকে তাকাচ্ছে বারবার; চাহনিতে লালসা! হাড্ডি দেখলে যেমন কুকুর লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকে, লোকটাও ঠিক তাঁর মায়ের বুকের দিকে সেভাবে তাকিয়ে আছে। মায়ের পরণে শাড়ি। আঁচল দিয়ে নিজের গলা অব্দি ঢেকে রেখেছেন তিনি। কিন্তু লোকটার এই নোংরা ইঙ্গিত নিশ্চয়ই উনার অগোচরে নেই। তবুও তিনি হেসে হেসে কথা বলে যাচ্ছেন; দেখে মনে হচ্ছে এটা অতি সাধারণ ব্যাপার তাঁর কাছে। সহজেই উপেক্ষা করা যায় এই চাহনি!

রশ্মির সর্বাঙ্গ কেমন শিউরে উঠল সহসা! বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মা-কে কোনো পুরুষ মানুষের সাথে এভাবে হেসে হেসে, এত আনন্দ নিয়ে কথা বলতে দেখছে সে। প্রবল বাতাস শুরু হয়েছিল বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসেছিল, ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখা গেলেই বাড়ির অদূরের এই রাস্তাটা কেমন শূন্য হয়ে যায়, এদিকে মায়ের অফিস থেকে ফেরার সময় এটা; সেজন্য। আগে কখনো এভাবে আসেনি, মায়ের জন্য অপেক্ষাও করেনি। আজই হঠাৎ এবং প্রথমবারের মতো এখানে এসে এইরকম একটা ঘটনা স্ব-চোক্ষে দেখল সে। দেখে রাগে-ক্ষোভে তাঁর চোখ লাল হলো। সাথে ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে গেল।

মুখের ঘাম মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করল রশ্মি। উনাদের কথাগুলো শোনা যাচ্ছে না। পাশেই একটা ফ্যাক্টরি। সেখান থেকে এমন আওয়াজ আসছে যে, জোরে কথা বললেও স্পষ্ট শোনা যায় না। আর উনারা দুজন তো এমন আস্তে আস্তে কথা বলছে, মনে হচ্ছে যেন ফিসফিস করে; যাতে হাওয়ার কানেও কথা না পৌঁছায়!
কিছুক্ষণ পর মা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল, সময়টা দেখল বোধহয়। রশ্মির মনে হলো, এবার দুজনের আলাপের সমাপ্তি ঘটবে। দুজনে বেশ নড়েচড়ে দাঁড়িয়েছে। একবার সে ভাবল এগিয়ে যাবে, দুজনের সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবল, এটা সঠিক সময় নয়; তাই সে আস্তে আস্তে আড়াল থেকে বেরিয়ে, মায়ের অগোচরেই পিছু হেঁটে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল। কিছুটা এগোতেই চোখ পড়ল তাঁর বাড়ির ঠিক পাশের দুতোলা বাড়ির, উপরের তলার একটা বারান্দায়; সুব্রত ভাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, হাতের জলন্ত সিগারেটটা নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে, খুব ধোঁয়া উড়ছে!

রুমানা বেগম গলির ওই পথটা ছেড়ে বাড়ির কাছের সরু পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন, খুব দ্রুত। পরপর তিনটে বড় বিল্ডিং, তাঁর পরেই উনার স্বামীর গড়া একতলা একটা বিল্ডিং। মোবাইল বের করে সময়টা আবার দেখে তিনি পায়ের গতি আরও বাড়ালেন। মুখে বললেন, “ইশ, খুব দেরি হয়ে গেল। রশ্মি নিশ্চয়ই খুব রেগে আছে। আজ ওর পিকনিকের টাকা জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল।”

কলিং বেল বাজাতে হলো না। দরজাটা ঈষৎ ফাঁকা দেখে আস্তেধীরে ঘরে ঢুকে গেলেন রুমানা বেগম। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে এগোলেন।
দরজা খোলাই ছিল। তাই বাইরে থেকেই তিনি দেখতে পেলেন, রশ্মি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দুটো দিয়ে গ্রিলটাকে মুঠোবন্দি করার বৃথা চেষ্টা করছে। রাগের বহিঃপ্রকাশ এটা। মৃদু হাসলেন তিনি। মেয়েটা তার কত বড় হয়ে গেছে। মনে হয় এই তো সেদিন কোল আলো করে এলো; প্রথম সন্তান ছিল তাঁর, আনন্দের সীমাবদ্ধতা ছিল না সেদিন। এখনো মেয়েটার সেই ছোট-ছোট হাত-পা গুলো চোখের সামনে ভাসে। ছোট একটা মুখ, খরগোশের চোখের মতো ছোট ছোট চোখ। গায়ের রঙ খুব ফরসা না হলেও হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে! দেখতে দেখতে যে কেমন করে ২৩টি বছর কেটে গেল, তিনি ধরতেই পারলেন না। আজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে তাঁর মেয়ে। যে মেয়েকে পায়ের উপর পা রেখে হাঁটা শিখিয়েছেন, সেই মেয়ে আজ একা-একা গোটা দেশ ঘুরে বেড়াতে চায়। এবার বায়না ধরেছে, বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার যাবে। বারংবার মানা করেছিলেন তিনি, শ্রাবণ মাস, যখন-তখন ঝড় শুরু হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে যখন বলেছে যাবে, তখন যাবেই। টাকা দিলে দাও, না দিলে সে কোনো না কোনোভাবে জোগাড় করে হলেও যাবে। তাকে আটকানো যাবে না কিছুতেই, এত জেদি! নিরুপায় হয়ে রাজি হয়েছিলেন তিনি। স্বামীহারা বিধবা মহিলা, একমাত্র মেয়েকে নিয়েই ঢাকা শহরে বাস করছেন দীর্ঘদিন যাবত। মেয়ে রাগের মাথায় কিছু করে না বসে, এই ভয়টা তাকে সর্বক্ষণ কুড়ে কুড়ে খায়৷ তাই অনুচিত আবদার হলেও তিনি মেনে নেন, কখনো বাধ্য হন।

হালকা কেশে ঘরে ঢুকলেন রুমানা বেগম।
রশ্মি বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। চেহারায় কাঠিন্যতা। মা ভাবলেন, টাকা দিতে দেরি হয়েছে বলে মেয়ে রেগে আছে। কিন্তু সত্যিটা তো ভিন্ন৷ রশ্মির এই রাগের কারণটা কী, সেটা তিনি এই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারছেন না।

“কী হলো, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?” যদিও জানেন, তবুও প্রশ্ন করলেন রুমানা বেগম।
রশ্মি নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলল, “তোমার আজ দেরি হলো যে?”
একগাল হেসে রুমানা বেগম বললেন, “আর বলিস না। বাসে এত ভীড় ছিল আজ, কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না। ছেলে হলে কোনো না কোনো ভাবে এসে যেতাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন বাসে উঠতে পারলাম না, তখন সিএনজিতে করে বাড়িতে এলাম। ভাগ্যিস আজ বেতনটা হয়েছিল। নাহলে মহা মুশকিলে পড়ে যেতাম। সিএনজির ভাড়া তো সবসময় থাকে না আমার কাছে।”
রশ্মির চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, “মিথ্যে! কেন মিথ্যে বলছ, মা? আমি তো নিজের চোখে দেখলাম তুমি ওই প্রাইভেট গাড়িটা থেকে নামলে। স্যুট-টাই পরা লোকটার নিজের হাতে গাড়ির দরজা খোলে দিয়েছিল তোমার জন্য।” কিন্তু না, কথাগুলো সে বলতে পারল না৷ কেউ যেন গলাটা টিপে ধরল অকস্মাৎ! পাথরের মতো শক্ত আর বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে।
রুমানা বেগম খানিকটা বিস্মিত হলেন মেয়ের এই নিরবতা দেখে৷ এই মেয়ের নিরবতা বিরলতম ব্যাপার৷ ভীষণ রাগী, জেদি আর রুক্ষভাষী মেয়ে ও। রাগ হলে বাড়িতে মারাত্মক একটা দুর্যোগ বয়ে যায়। মা হয়েও মেয়েকে তিনি কখনো শাসন করতে পারেননি, কারণ ওর যেন কখনো বাবার অভাববোধে কষ্ট না হয়। ভদ্রলোক মারা যান ওর ছোট বয়সেই। এরপর থেকে তাকে একাই বাবা-মা’র রূপ ধারণা করতে হয়েছে।

বিস্ময় কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর নিজের ব্যাগটা রাখলেন রুমানা বেগম। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বললেন, “এখন পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি। বাকি যা লাগবে, যেদিন যাবি সেদিন দিয়ে দিবো।”
রশ্মি মুখ ভার করে বলল, “লাগবে না। আমি যাব না।”
“আহা! রাগ করছিস কেন? এখানে আমার কী করার আছে বল? আজকেই বেতনটা দিলো। আর আজকেই তোর টাকা জমা দেওয়ার শেষ দিন। এখনো সময় আছে। বিকাশ করে টাকাটা পাঠিয়ে দে।”
“বললাম তো লাগবে বা।” আগের থেকেও ভারি আর কড়া গলায় কথাটা বলে বাথরুমে ঢুকে গেল রশ্মি।
রুমানা বেগমের চোখ ভিজে এলো। অসহায় হয়ে বাথরুমের দরজার দিকে ছলছল চাহনিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, টাকাটা মেয়ের মোবাইলের নিচে চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি৷

মা চলে যাওয়ায় কিছুক্ষণ পর রশ্মি বাথরুম থেকে বের হলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর মায়ের ব্যাগটা দেখে, এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে মোবাইলটা বের করল। কল লিস্ট চেক করে দেখল, আজকে সারাদিনে মাত্র দুটো নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। একটা নম্বর তাঁর, আর একটা মিস্টার মুজিবর নামের একজনের। কল হিস্টোরিটাতে চোখ বুলিয়ে মায়ের প্রতি তাঁর ঘৃণা আর আক্রোশ, সব একসাথে জন্মাল!

২.
“হ্যালো, ফিরোজ সাহেব বলছেন?” মৃদুস্বরে, চোখেমুখে লাজুকতা টেনে জানতে চাইল চিত্রা।
“হ্যাঁ, বলছি। আপনি কে?”
ওপাশের মানুষটার গলাটা গম্ভীর শোনালো বেশ। সচকিত বলো চিত্রা। এমনটা আশা করেনি সে। তাঁর ধারণা ছিল, মানুষটার কণ্ঠ অত্যন্ত কোমল হবে। ছেলেটার ছোট বোন সেদিন এমনটাই বলেছিল। অবশ্য পাত্র আর পাত্রী দেখাদেখির মধ্যে অনেক লুকোচুরি থাকে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে বলল, “আমি চিত্রা। চিনতে পেরেছেন?”
“না তো। কোন চিত্রা? কী কারণে ফোন দিয়েছেন আমাকে?”
আবার সেই কঠিন আওয়াজ। চিত্রা চোখ পিটপিট করে, ইতস্ততভাবে বলল, “আসলে, আমি ধানমণ্ডিতে থাকি। আপনার বাড়ি থেকে গতপরশু আমাকে দেখতে এসেছিল। নম্বরটা সেদিন আপনার বোন দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। ভেবেছিলাম আপনি একবার ফোন করবেন। কিন্তু দুদিন পেরিয়ে গেল, তবুও আপনার ফোন পেলাম না। তাই ভাবলাম নিজেই একবার ফোন দিই।” প্রতিউত্তরের আশায় কয়েক থেকেন্ড নীরব থাকল চিত্রা৷ কোনো শব্দ না পেয়ে মলিন গলায় নিজেই জানতে চাইল, “এখন চিনতে পেরেছেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। আপনার সাথে তো আমার বিয়ের কথা চলছে। সরি, আপনার নামটা আমি ভুলে গেছিলাম। আর এত ব্যস্ত ছিলাম যে, নিজেও ফোন করতে পারিনি।”
এবার আওয়াজটা খানিক পরিবর্তন হলো। চিত্রার মুখে হাসি ফুটল। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ভাগ্যিস চিনতে পেরেছেন।” এরপর বিছানায় নড়েচড়ে, ভালো করে বসে বলল, “আচ্ছা, যে কারণে ফোন দিয়েছি, সেটা বলে নিই; আমরা আগামীকাল আসছি আপনাদের বাড়িতে। আর হ্যাঁ, সকালে নয়, বিকেলে। আপনি একটু আপনার বাবা-মাকে বলে দিবেন।”
“আচ্ছা, বলব।”
এরপর দুজনেই চুপ। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা দূর করতে চিত্রা কিছু বলতে যাবে, তখনই শুনলো ফিরোজের কণ্ঠ। “আচ্ছা, এখন রাখছি তাহলে। ভালো থাকবেন।”
ফোনটা কেটে গেল। হতভম্ব হয়ে বসে রইল চিত্রা। লোকটা জবাবের জন্যও অপেক্ষা করেনি। এত তাড়াহুড়ো! অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে চারিদিকে তাকালো সে। চারটা মেয়ে মুখ আর একটা ছেলে মুখ উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁর এমন লজ্জাবোধ হলো যে, ইচ্ছে করছে হাতের মোবাইল মাথায় বাড়ি মারতে। মোবাইল বা মাথা, যেটাই ভাঙুক, একটা কিছু হবে!

নুপুর নামের মেয়েটা নীরবতা কাটিয়ে, খানিক বিদ্রুপের সাথে বলল, “কী কী, কী হলো? খুব তো বলছিলে, তোমার ফোন পেয়ে ফিরোজ সাহেব একেবারে পাগল হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ কথা বলবে। হয়তো তোমার নম্বর জোগাড় করতে পারেনি, তাই ফোন দেয়নি। এবার কী হলো? পাগল হলো? পাবনায় সিট বুক করতে হবে নাকি? আমি ফোন করে দেই বরং।”
চিত্রা মুখে ভেংচি কেটে বলল, “একটা মারব। আমি মোটেও বলিনি পাগল হয়ে যাবে। বলেছি খুশি হবে।”
“সেটাও তো হলো না।” ছেলেটা পাশ থেকে বলল।
চিত্রা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আহা! খুশি হয়নি তোকে কে বলল? হয়তো খুব ব্যস্ত। সরকারি চাকরি। ব্যস্ত তো থাকবেই।”
“এইসব বলে আমাদের নয়-ছয় বুঝিও না, আপু।” ছেলেটা হেসে হেসে বলল, “সরকারি অফিসারেরা অফিস টাইমের বাইরে তেমন কাজ করে না। অফিস টাইমেই ওদের সব কাজ।”
চিত্রা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই যাবি এখান থেকে।”
ছেলেটা নড়ল না। পাশে থাকা ওর বড় বোনকে খোঁচা দিলো, কিছু বলার জন্য। পাশের মেয়েটা সাথে সাথে কিছু বলল না। বিছানাতে বসে, পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মুরুব্বিদের মতো ভাবান্তর ভঙ্গিতে বলল, “আমার খুব টেনশন হচ্ছে, আপু; বুঝলে! তুমি বকবক করতে থাকা একটা মেয়ে। আর এই লোক তো কথাই বলতে জানে না। খিটখিটে মেজাজের মনে হলো। আমার মনে হচ্ছে, তোমার কপালে দুঃখ আছে। বিয়ের পর মাইর-গুতাও জুটতে পারে। শুনেছি সরকারি কর্মকর্তারা খুব একটা রোমান্টিকও হয় না।”
বড় বোনের কথা শেষ হতেই চিত্রাকে সুযোগ না দিয়ে ছেলেটা আবার বলে উঠল, “এর থেকে আমি বেটার অপশন। দেখো, এখনো বিয়ে হয়নি। সময় আছে। খালুকে বলো আমার কথা৷ বেশি না, একবার অনুরোধ করলেই রাজি হয়ে যাবো।”
ছেলেটার কথা শুনে চিত্রাকে ঘিরে বসা উপস্থিত সকল মেয়েলোক খিলখিল আওয়াজ তুলে হেসে উঠল। চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার কান টেনে ধরে বলল, “তবে রে দুষ্টু, এত শখ আমায় বিয়ে করার। মাত্র স্কুলে পড়িস। আর এত পেঁকে গেছিস। তুই জানিস, তোকে সেই ল্যাংটাকাল থেকে আমি দেখে আসছি। আমার সামনেই তোর জন্ম হয়েছিল। আর এখন আমাকে বিয়ে করতে চাস।” চিত্রা নিজেও হাসি চেপে রাখতে পারল না। ঠোঁটের মাঝ দিয়ে স্লিপ কেটে বাসাতের সাথে বেরিয়ে এলো হাসিটুকু।
ছেলেটা ‘উউউ’ করে কান ছাড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “তবে তো ভালোই। আমার সবকিছুই জানা আছে তোমার। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হবে।”
চিত্রা মারার জন্য হাত তুলতেই ছেলেটা এক লাফে খাট থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেল। বাকিরা তো হেসে লুটোপুটি; এমনকি চিত্রা নিজেও অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে। এরা সবাই তাঁর কাজিন। কেউ মামাতো বোন, কেউ ফুফাতো বোন, কেউ খালাতো বোন-ভাই, নিজের বোনও আছে। সবাই অবিবাহিতা। সে-ই সবার বড়। অনার্স শেষ হয়েছে তাঁর। তাই বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
সবাইকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে চিত্রা বলল, “যা যা, এবার সবগুলো বের হ ঘর থেকে। অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমাবো।”
“সেকি! মোটে তো ৯টা বাজে। আজ সারারাত মাস্তি হবে। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে দিচ্ছি না। ভাই তো গিটার নিয়ে এসেছে। আজ নাচবো, গাইবো, আরও কত কী! না না, আজ ঘুমাতে দিবো না। কতদিন পর এলাম বলো তো।”
পাশ থেকে অন্য একজন সন্দেহের চোখে চিত্রাকে পরখ করে বলল, “কী ব্যাপার বলোতো, তাড়াতে চাইছো কেন? আবার ফোন করবা নাকি?”
চিত্রা চোখ টিপে, মুচকি হেসে বলল, “এবার আমাকে করতে হবে না। নম্বর পেয়েছে না, দেখবি ফ্রি হয়ে নিজেই করল করবে।”
“কচু করবে।” মুখ বাকিয়ে ভেঙাল মামাতো বোন। হেসে হেসে বলল, “শুনেছি সরকারি কর্মকর্তারা খুব কৃপণস্বভাবের হয়।”
চিত্রা এবার ধমক সুরে বলল, “সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপারে আর কী কী শুনেছিস বলতো?”
সবাই এবার আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামতে শুরু করেছে, বেরোনোর আগে বলল, “শুনেছি এদের ট্রান্সফার হয় যখনতখন। দেখা গেল, বাসর রাতে চিঠি এলো, তাঁর ট্রান্সফার হয়ে গেছে, আজকেই যেতে হবে। আমার আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে, সেদিন সারারাত তোমাকে একা একা বেড়াল মারতে হবে।”
চিত্রার আর সহ্য হলো না। বিছানা-ঝাড়ু হাতে তুলে সবাইকে দৌড়ানি দিলো। হো হো করে হাসতে হাসতে ঘর ত্যাগ করল সবাই।

সে রাতে অনেক আশায় ছিল চিত্রা, কিন্তু সমস্ত আশা নিরাশায় রূপ নিয়েছে। কোনো ফোন আসেনি তাঁর মোবাইলে।

পরদিন বিকেলে ফিরোজদের বাড়িতে এলো চিত্রা, তাঁর বাবা-মা এবং ভাই-বোনেরা। একটা দুতোলা বাড়ির পাশে পরপর আরও কয়েকটা বিল্ডিং আছে। জায়গাটা কলনির মতো। গাড়ি থেকে নেমে, একটা সরু পথ দিয়ে হেঁটে আসতে হয়। জায়গাটা অবশ্য সরু নয়, পাশ দিয়ে জায়গা আছে অনেকটা, মাঠের মতো, সবুজ ঘাস ছেয়ে আছে চারিদিকে। পথটুকু শুধু চিকন করে ঢালাই করা।
কিছুটা সামনে যেতেই বাড়িটা দেখতে পায় সবাই। চিত্রার বেশ লজ্জা লাগছিল নিজের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই। এখনো লজ্জাটা আছে। তাঁর আসার কথা ছিল না প্রথমে। কিন্তু ভাই-বোনেরা এমন জোড়াজুড়ি করল যে, বাবা-মা রাজি হতে বাধ্য হলো। অবশ্য তাঁর যে একেবারে উৎসাহ নেই, তেমনটা না। কিন্তু মুখে বলেনি কিছু। বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে সে। ছোট বোনের থেকে হাজারগুনে ভালো, এমনটা প্রতিবেশীরা সবসময়ই বলে। সবার সাথে হাসিখুশি, প্রাণবন্ত হয়ে কথা বলে। হেসে-খেলে মাতিয়ে মাখতে পছন্দ করে। যখন কথার খেই ফোটে, চারিদিকটা একটা উৎসবের ন্যয় মুখরিত হয়। স্কুল শেষ করেছে, কলেজ শেষ করেছে, অনার্সও শেষ। এখন পর্যন্ত ভয়াবহ কোনো ভুল কাজ করেনি। অনেক প্রপোজাল আসলেও ইন্টারেস্ট দেখায়নি কখনো। বড় মেয়ে বলেই মাথায় একটা চিন্তা ছিল সবসময়, বাবা-মায়ের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তাঁর। যে সম্মান অনেকগুলো বছরে অর্জন করেছে তাঁর পরিবার, তাঁর একটা ভুল পদক্ষেপে যেন সেই সম্মান মুহূর্তেই ধূলোর সাথে মিশে না যায়। সেজন্য নিজের জীবন নিয়ে সতর্ক ছিল সবসময়, এখনো আছে।

সবাই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাইকে উপেক্ষা করে চিত্রার চোখ পড়ল ফিরোজের দুই চোখে। সে-ও তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। চোখের ইশারায় স্বাগতম জানালো। এক দেখাতেই চিনে ফেলল সে। প্রথমবার ছবি দেখে যে শিহরণ জেগেছিল সারা দেহে, ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে মোচড় দিয়ে উঠেছিল, দেহের সর্বাঙ্গে থাকা তুলোর মতো নরম লোমগুলো অকস্মাৎ শীতল আবেশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সে অদ্ভুত এক অনুভূতি; আজও তেমন হচ্ছে, বরং বেশি। ভেতরটা উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করছে। ফিরোজ মৃদু ভাবে হাসতেই সে-ও হাসি দিলো। ঘটনাটা কারোরই নজর এড়ালো না। পাশ থেকে ওর মামাতো ভাই, মাহিম কণুইতে টোকা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী হচ্ছে আপু?”
চিত্রা লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। মাহিমের কথাটা অনেকেই শুনেছে। তাঁর বাবা একবার চোখ বড় করে তাকালো, আড়চোখে দেখল সে। কিন্তু দুষ্টু ভাই-বোনগুলো এত সহজে খ্যান্ত হওয়ার নয়। মাহিমের বোন আস্তে আস্তে, সুর করে গাইলো, ‘কুচ কুচ হোতা হে’।

সোফায় বসতেই শান্ত হলো সবাই। ড্রয়িংরুমটা খুব বড় নয়, মাঝারি সাইজের। মধ্যেখানে গোল করে সোফা রাখা, আর দুই পাশ দিয়ে উপরে উঠার সিড়ির দিকে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা। নিচ তলায় ঘর নেই তেমন। রান্নাঘর আছে, বাথরুম আছে, আরও একটা ঘর দেখা গেল ড্রয়িংরুম থেকেই।
একটা তিন সিটের সোফায়, চুপচাপ বাবা-মায়ের মাঝে বসে আছে চিত্রা। একটা চকলেট কালারের শাড়ি পরে এসেছে সে। একই রঙের ব্লাউজ। আঁচলটা মাথায় ঘোমটার মতো করে দেয়া। মুখটা ফরসা হওয়াতে ডার্ক কাপড়ে বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে! ফিরোজ বসেছে ঠিক উল্টো দিকে। ওর পরণে লাল পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। চুলগুলো ছোটছোট, গালে দাড়ি নেই এখন; ক্লিন সেভ! হাতে একটা ঘড়ি আছে। দেখেই মনে হয় খুব ফরমাল।

ফিরোজের বাবার সাথে চিত্রার আগে পরিচয় হয়নি। আজ লোকটাকে দেখল সে। দেখে বয়স বুঝার উপায় নেই। বেশ রুগ্ন দেখাচ্ছে। কপালের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। চোখ দুটো ভিতরে চলে গেছে। পরণে সাদা পাঞ্জাবি। বেশ চুপচাপ, শান্ত; মাঝে মাঝে দুই একটা কথা বলছেন, মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় কথা বলছেন ফিরোজের মা। তিনিই বোধহয় হেড এই বাড়ির, চিত্রার এমনটাই মনে হলো পরিবেশ দেখে।
সবাই আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, এমনসময় হঠাৎ জুতোর ঠকঠক আওয়াজ শোনা গেল। চিত্রা মাথা তুলে দেখল, ধূসররঙের শার্ট পরিহিত একটা লোক হনহন করে এগিয়ে আসছে। সে অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল, লোকটার মধ্যে একটা ফরেনারের ছাপ আছে। চেহারা খুব ফরসা। তবে গালভর্তি দাড়ি। চুলগুলোও বেশ বড়বড়। হাঁটার তালে চুলগুলো যেন সমুদ্রের ঝড় তুলেছে। চোখে সানগ্লাস। কালো প্যান্ট এর সাথে কালো জুতো। গলার টাই-টা বাঁকা হয়ে আছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। একহাতে কালো ব্যাগ, আর এক হাতে চাবির গোছা। ড্রয়িংরুমের সবাইকে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল লোকটা, এমনসময় ফিরোজের বাবা, খালেদ সাহেব নাম ধরে ডেকে উঠলেন।
“সুব্রত, একটু দাঁড়িয়ে যা।”
সুব্রত দাঁড়াল। তবে পিছনে তাকালো না। সিঁড়ির দিকে মুখ করে বিরক্তিমাখা গলায় বলল, “কিছু বলবেন?”
খালেদ সাহেব দাঁড়িয়ে, হাসিমুখে বললেন, “ফিরোজের বিয়ের তারিখ ঠিক হচ্ছে। এখানে এসে বোস।”
সুব্রত আগের মতোই সাবলীলভাবে ভাবে বলল, “আমি না থাকলে কী বিয়ের তারিখ ঠিক হবে না? অবশ্যই হবে। সুতরাং আমাকে এইসবে টানবেন না।”
সুব্রতর কথা শেষ হতেই ফিরোজ দাঁড়িয়ে, নিজের বাবার উদ্দেশ্যে বলল, “আহ, বাবা! কেন শুধু শুধু অপমানিত হতে যাও। যে থাকতে চাচ্ছে না, তাকে কেন জোড়াজুড়ি করছ?”
ফিরোজের কথার সাথে ওর মা আর বোনও একই সুরে সমর্থন করল। খালেদ সাহেব আর কিছু বললেন না। অসহায় ভঙ্গিতে বসে পড়লেন আগের মতো। সুব্রত ইতোমধ্যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে।

পুরো ব্যাপারটাই সবার সামনে ঘটল। চিত্রার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেলেটা কে? আপনি তো বলেছিলেন আপনার দুটো ছেলে-মেয়ে-ই।”
খালেদ সাহেব মাথা তুলে, শীতল গলায় বললেন, “ও আমার বড় ভাইয়ের ছেলে।”
“আপনার ভাই-ভাবীকে তো দেখলাম না।”
ফিরোজের মা বললেন, “উনারা তো সেই কবেই মরে গিয়ে শান্তিতে আছে। আর এই ঝামেলা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের মুক্তি নেই। খোদা জানে আর কতদিন একে সহ্য করতে হবে।”
“আহ, মা!” মৃদু আওয়াজ করে মা’কে থামতে বলল ফিরোজ, “ওর কথা বাদ দাও তো৷ ও নিজের মতো আছে, থাকুক। ওকে নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।”

ফিরোজের মা থামলেন। আবার বিয়ের আলোচনা শুরু হলো। সবাই আগের মতোই হাসিমুখে কথা বলতে লাগল। শুধু হাসি নেই খালেদ সাহেব আর চিত্রার মুখে। খালেদ সাহেব মাথা নুইয়ে, মলিন চেহারা করে বসে আছেন; আর চিত্রা একরাশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
সেদিন রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের বাড়ি চলে এলো চিত্রার পরিবার।

প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসবে।

প্রস্থান — ১ম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

বি:দ্র: কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই। ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন, ভালোলাগা-খারাপলাগা শেয়ার করবেন। ব্যতিক্রমী একটি উপন্যাস হতে যাচ্ছে এটি, যা আপনাকে আনন্দ দিবে, দুঃখ দিবে, আর অনেক কিছু শেখাবেও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here