চন্দ্রাণী ৩০

0
110

#চন্দ্রাণী(৩০)

অবশেষে সকাল হলো। দীর্ঘ একটা রাত পার হয়ে সকাল হলো। রাতের অন্ধকার কেটে যাওয়ার সাথে সাথে কেটে গেলো চন্দ্রর জীবনের অনেক হিসাব নিকেশ।
চন্দ্র বসে আছে উঠানে একটা মোড়া নিয়ে।
আকাশ ভীষণ অন্ধকার হয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।চন্দ্র অপেক্ষা করছে বৃষ্টির জন্য।

রেহানা উঠানের চুলা ঢাকছে প্লাস্টিকের কাগজ দিয়ে। বৃষ্টি এলে চুলা ভিজে যাবে।চুলা ঢাকতে ঢাক্তে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “খিচুড়ি খাবি চন্দ্র?”

চন্দ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “খাবো।”

রেহানা চিৎকার করে শর্মীকে ডেকে বললেন,”শর্মী ফ্রিজ থাইকা গরুর গোস্ত আর ইলিশ মাছ বাইর কইরা ভিজা।তোর আপা খিচুড়ি খাইব।”

রেহানার কথা শেষ হতেই বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি। রেহানা এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। মেয়েকে বসে থাকতে দেখে ডাকতে লাগলো। চন্দ্র উঠছে না দেখে আবারও নেমে এলো উঠানে। হাত ধরে টানতে টানতে মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেলো রেহানা।

ঘরে গিয়েই চন্দ্র মা’কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর রেহানা কিছু বুঝে উঠার আগেই চন্দ্র হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রেহানার বুকটা কেঁপে উঠলো। কেনো কাঁদছে তার মেয়ে?

অস্থির হয়ে রেহানা বললো, “ও মা,কি হইছে তোর?এতো কান্দো কেনো মা?কষ্ট হইতাছে তোর? কি হইছে মা’রে কও না মা।”

চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তুমি এমন কেনো মা?কেনো এমন তুমি?

রেহানা অস্থির হয়ে বললো, ” কেমন আমি?কি হইছে?”

চন্দ্র কিছু বললো না। শুভ্র চন্দ্রর কান্না দেখে নিজেও কান্না করতে লাগলো। রেহানা ভীষণ অস্থির হয়ে গেলো। চন্দ্র কাঁদছে!তার বড় মেয়ে,তার কলিজার টুকরো মেয়ে।

চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রেহানা শুভ্রর গলা টি//পে ধরলেন।অবুঝ ছেলেটা গোঁগোঁ শব্দ করতে লাগলো। রেহানার মাথায় খু//ন চেপেছে যেনো।ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,”কি বলেছিস তুই?কি করেছিস তুই?চন্দ্র কাঁদছে কেনো?সকালে ও তোর রুমে গিয়েছিলো।কি হয়েছে আমার মেয়ের?কাল রাত থেকে ও এতো অস্থির হয়ে আছে কেনো?”

শুভ্রর দুই চোখ টলমল হয়ে গেছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। শর্মী দ্রুত ছুটে এসে মা’কে টানতে লাগলো। সিতারা বানু ও ছুটে এলেন।
অনেক ধস্তাধস্তির পর রেহানাকে সরাতে পারলো দু’জনে। সিতারা বানু রেগে গিয়ে বললেন, “দুনিয়ার সব মানুষ দেখি সারাজীবন পোলার জন্য পাগল হয়,একটা মাত্র পোলা হইলে তারে চোখের মনি কইরা রাখে।আল্লাহ তোমাগোরে শুধু ব্যতিক্রম বানাইলো।মাইয়া কান্দে দেইখা পোলারে এমন কইরা গলা টিইপ্যা ধরে?
কিয়ের এতো আদর মাইয়ার লাইগা?মাইয়া কোন খেতের মুলা?”

রেহানা চিৎকার করে উঠলো। রেহানার দুই চোখ রক্তাক্ত হয়ে আছে। এক্ষুনি যেনো দুই চোখ বেয়ে জল নয় রক্ত ঝরবে।
ভীষণ রেগে বললো, “আমার বড় মেয়ে আমার সব আম্মা।আমার কলিজার পুরোটা আমার বড় মেয়ে।আমার চন্দ্র।চন্দ্ররে নিয়ে আর একটা বাজে কথা ও কইবেন না আম্মা।চন্দ্ররে নিয়ে একটা বাজে কথা যে কইবো তার জিভ আমি ছিঁড়ে ফেলবো।আমার অশান্তি, কষ্ট, যন্ত্রণাময় জীবনে আমার চন্দ্র এসেছিলো রহমত হয়ে। স্বামীর করা সকল আঘাতের মলম ছিলো আমার মেয়ে।আমার মেয়ে আসার পর থেকে আমি স্বামীর আদর ভালোবাসা সব একটু একটু করে ফিরে পাইছি।আমার চন্দ্র আমারে যতটা ভালোবাসে বাকি দুইটা তার এক ফোঁটা ও ভালোবাসতে পারবে না জীবনে। আমার মেয়ের চোখে পানি,আপনি বুঝবেন না আম্মা আমার কলিজা কে//টে রক্ত বের করলেও এতো কষ্ট হতো না আমার মেয়ের কান্না দেখে আমার যেই কষ্ট হচ্ছে।
পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমার মেয়ে একদিকে। ”

সিতারা বানু চুপ হয়ে গেলেন।আজ নতুন না,এসব পাগলামি তো অনেক আগে থেকেই দেখছেন তিনি।

শর্মী শান্ত স্বরে বললো, “মা, ভাইরে মারতেছো কেনো?ভাই আপাকে কি করবে?ও কথা বলতে পারে না,কিছু বুঝে ও না।ও নিজেই তো আপার কান্না দেখে কান্না করতেছে।ওর উপর রাগ দেখিয়ে কি লাভ আছে মা?”

রেহানা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। বাহিরের ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি জানি না। আমি কি করছি আমি জানি না।আমার চন্দ্র কান্দে ক্যান তাইলে?আমার মা ক্যান কান্দে?আমার সহ্য হয় না।”

শর্মী মা’কে কিছু না বলে রান্না বসাতে গেলো।কিছুক্ষণ পর মা যদি দেখে রান্না হয় নি তাহলে আবার শর্মীকে ধরবে।
ছাতা মাথায় দিয়ে বাবুল দাশ এলো।শর্মী হেসে বললো, “কাকু,খিচুড়ি খাইবেন বসেন।”

বাবুল দাশ নতজানু হয়ে বললো, “না গো জননী, তোমরা তো গোমাংস দিয়ে… ”

শর্মী হেসে বললো, “আরে না,আপনার জন্য আমি মুরগির মাংস দিয়ে রান্না করেছি।ভয় পাইয়েন না কাকু।”

বাবুল দাশ হাসলো। এই মেয়ে দুটোকে এজন্য বাবুল দাশের এতো বেশি ভালো লাগে। এরা সব খেয়াল করে। এতো ভালোবাসার প্রতিদান কি দিতে পারবেন তিনি কোনো দিন? তার মতো গরীব, কাজের লোকের প্রতি ওদের যে ভালোবাসা তার প্রতিদান কি হয় কিছু দিয়ে?

বাবুল দাশ খেয়ে চলে যেতেই শাহজাহান তালুকদার এলেন ঘরে। বৃষ্টি থেমেছে। রোদ ও উঠে গেছে। রেহানা থমথমে মুখ করে বসে আছে। তালুকদার বুঝতে না পেরে শুভ্রর দিকে তাকালো। পরক্ষণেই মনে হলো শুভ্র তো কিছু বলতে ও পারবে না।শর্মীকে ইশারা করতেই শর্মী চন্দ্রর রুমের দিকে দেখালো।তারপর ইশারা করলো দরজা নক করতে।

শাহজাহান তালুকদার গিয়ে মেয়ের দরজা নক করলেন।তারপর মেয়েকে কোমল গলায় বললেন,”মা,মা গো।দরজা খোলো গো মা।পিতার আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করো না।”

শর্মী মুচকি হাসতে লাগলো। শাহজাহান তালুকদার মা মা বলে ডাকতেই লাগলেন।সিতারা বানুর বিরক্তি লাগছে।তার বুড়ো ছেলে কেমন নাটক করছে।বউ কেমন গম্ভীর হয়ে বসে আছে। অথচ নাতিনটা বের হচ্ছে না।

খানিকক্ষন পর শাহজাহান তালুকদার সুর করে বললেন,”ও মা,মাগো ফুল পরানের পরী।
তোমার জন্য রাখছি মাগো ফুলের বিছানা করি”

খুট করে দরজা খুলে চন্দ্র বের হলো। তারপর বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। রেহানার বুকের কাঁপন বন্ধ হয়ে গেলো। মেয়ের মুখ দেখে নির্ভার হলেন।

খেতে বসলো সবাই। খিচুড়ি মুখে দিয়ে চন্দ্র চোখ বন্ধ করে ফেললো। ভীষণ ভালো হয়েছে খিচুড়ি। হুট করে মনে পড়ে গেলো টগরের কথা। আচ্ছা টগর কি খাচ্ছে? এরকম বৃষ্টি হলে ওর ও কি খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করে?
কে করে দেয় ওকে খিচুড়ি?

চন্দ্রর ভাবনায় ছেদ ঘটলো বাহিরে ইন্সপেক্টর নির্ঝরের আওয়াজে। নির্ঝর চেয়ারম্যান সাহেব কে ডাকছে।
চেয়ারম্যান সাহেব উঠে গিয়ে দেখলেন টগর আর নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তেই চেয়ারম্যানের হাসিমুখ কঠোর হয়ে গেলো। কঠোর গলায় বলে,”আসুন ভেতরে আসুন।”

ভেতরে এসে টগর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সবাই খেতে বসেছে।চন্দ্র এক নজর টগরের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো।টগরের সাথে চোখাচোখি হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব না এই মুহূর্তে। কেমন যেনো অনুভূতি শূন্য লাগছে চন্দ্রর। চন্দ্র জানে না কি হবে,কি হতে চলেছে। কি করবে চন্দ্র?
টগরের প্রতি মনের দুর্বলতা চন্দ্র অস্বীকার করতে পারবে না তেমনি বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরেও যেতে পারবে না।
কিছুতেই চন্দ্রর পক্ষে সম্ভব না বাবাকে কষ্ট দেওয়া।
কিন্তু!
বাবা মা কেনো তার কাছে এতো কিছু লুকিয়েছে?
বুঝতে পারছে না চন্দ্র কিছু।

নির্ঝর আর টগর ও জয়েন করলো সবার সাথে।
টগরের যদিও কোনো ইচ্ছে ছিলো না বসার কিন্তু শর্মীর পাশের চেয়ারে বসার সুযোগ নির্ঝর মিস করতে চাইলো না।অগত্যা টগরকেও বসতে হলো নয়তো নির্ঝর লজ্জা পাবে।খাওয়ার পর চন্দ্র উঠলো নিজের রুমে যাওয়ার জন্য, সেই মুহূর্তে টগর বললো, “চন্দ্র,বসুন এখানে।কোথাও যাবেন না।”

শাহজাহান তালুকদার চমকে স্ত্রীর দিকে তাকালো। রেহানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো টগরের দিকে।
চন্দ্র হতভম্ব!
বাবার সামনে টগর এরকম আদেশের সুরে কথা বলার সাহস পাচ্ছে কিভাবে?
হতবাক শর্মী ও।

টগর স্পষ্টভাবে আবারও বললো, “চন্দ্র,আমার বাম পাশের এই চেয়ারে এসে বসুন।আমি বসতে বলেছি আমার পাশে,দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”

চন্দ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাবা মা’র দিকে।বাবার দুই চোখে হতভম্বের চাপ,মা’য়ের চোখে ক্রোধ।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here