এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৯

0
1680

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯(স্পেশাল পর্ব)
“স্যার আপনার সন্দেহ ঠিক। এই মাত্রই তিন জন আপনার বাড়ির গেইট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা এসেছে উত্তর সাইডের একটা কোনা দিয়ে। মেইন গেইট তো লাগানো।”

মাশরিফ ভ্রুঁতে হাত ঘষতে ঘষতে পেছনে তাকিয়ে মাকে একবার দেখে নিল। ভারী মাদুরের উপর চাদর বিছিয়ে বালিশ নিয়ে বসেছিল তারা। মহিমা বেগম এতোটা সময় নীরবে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছেন এখন তিনি ঘরে যেতে চাইছেন। মাশরিফদের বসার জায়গাটা একটু ভেতরে। বাগানের কোণার দিকে হওয়ায় ভালো করে লক্ষ্য না করলে দেখা মুশকিল।
মাশরিফ ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তিকে বলে,
“ছবি বা ভিডিও করেছ?”

“তুলেছি কিন্তু স্যার পুরা এলাকাতে অন্ধকার। বুঝা যায় না। ফ্ল্যাশ জ্বালিয়েও তুলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, একটা ছবিতে হালকা একটু বোঝা যায়।”

“আচ্ছা রাখ। ওরা কোনদিকে গিয়েছে?”
“দুইজনকে তো বড়ো রাস্তার দিকে যেতে দেখেছি। আরেকজন একটু আগেই চলে গেছে কিন্তু অন্যদিকে। যে অন্যদিকে গিয়েছে তার হাইট কম। বাকি দুজনের মতো না। সে আসলে হুট করে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় ঢুকেছে বুঝতে পারিনি।”

“ক্লিপগুলো আমাকে পাঠাও। আর নজর রাখো।”

“জি স্যার।”

মাশরিফ ফোন রেখে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
“মা, তুমি একটু বসো। আমি আসছি।”
“এখানে আর বসব না। আমি ঘরে চলে যাই।”
“না মা। বসো। পাঁচ মিনিট বসো। তারপর একসাথে যাব।”
”এতো রাতে কই যাবি তুই?”

মায়ের সন্দিহান প্রশ্নে মাশরিফ জবাব ভাবছে। কী বলবে ভেবে মাকে থামাতে বলে,
“তুমি পাঁচটা মিনিট বসোই না। বললাম তো যাব আর আসব। এখান থেকে নড়বে না। আমি কাজটা করেই চলে আসব।”

কথাগুলো বলেই দ্রুত কেটে পরে সে। তারপর বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখে বাহির থেকে সিটকিনিটাও লাগানো! মাশরিফের স্পষ্ট মনে আছে সে সিটকিনি লাগায়নি। তারমানে এটা ওই লোকগুলোর কাজ। মাশরিফ খুব ধীরে নিঃশব্দে সিটকিনি খুলে ও লক খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ওরা কেন এসেছিল সেটা কীভাবে বুঝবে! জানালা গুলো ভালো করে চেক করে দেখতে গেল। একি! জানালা ভেতর থেকে খোলা যাচ্ছে না! তার, মায়ের, গেস্টরুমের ও ড্রয়িংরুমের কোনটারই না। মাশরিফ অবাক হয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ভালো করে পুরো ঘরটা দেখতে শুরু করল। অতঃপর একটা জানালার কাছে একটা বস্তু পায়। বস্তুটা কী-সের তা বোঝার জন্য নিজের ঘরে গিয়ে গ্লাভস এনে সেটা পড়ে তারপর হাতে নিয়ে ভালো করে উলট-পালট করে দেখে বোঝার চেষ্টা করল। ভালো করে বুঝতে না পেরে ওটাকে নিয়েই বাগানে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল,

“চলো ঘরে চলো।”
“কই গেছিলি?”
“এইতো এখানেই। চলো।”

মাশরিফ মাকে নিয়ে বাড়ির প্রবেশ করার আগে বস্তুটা বাগানেই ফেলে গেল। সবগুলো রুমের ফ্যান চালিয়ে দিল আর সদর দরজাটা খোলা রাখল। তা দেখে অবাক হয়ে শুধাল,
“এই মাঝরাতে তোর কী হয়েছে? এখন সব রুমের ফ্যান ছেড়ে সদর দরজা খোলা রাখছিস কেন?”

মাশরিফ কিছু ভাবছিল। আনমনে বলল,
“প্রায় সব জানালা বাহির থেকে সিলড! শুধু মনে হয় রান্নাঘরের কাছেই মানে দক্ষিণ দিকে যেতে পারেনি!”

“কী বলছিস!”

মহিমা বেগমের বিস্ময়সূচক প্রশ্নে মাশরিফ নির্বিকার জবাব দেয়,
“কেউ তো আমাদের খুব বড়ো ক্ষতি করতে চাইছে! এখন আমি যাকে মনে মনে সন্দেহ করছি হয়তোবা সে। কিন্তু কালকে সকাল ছাড়া সেটা বোঝা যাবে না। এখন লাইট অফ রেখেই পুরো ঘরের ফ্যান চালিয়ে দিয়েছি। যাতে ভিতরে কোন বিষাক্ত বাতাস থাকলে সেগুলো বেরিয়ে যায়।”

“তুই যে কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না! আমাদের আবার কে ক্ষতি করতে চাইবে? তুই তোর এই সন্দেহ এবার বন্ধ কর। এগুলো রেখে এবার ঘুমাতে যা। রাত অনেক হয়েছে। আমিও গেলাম।”

মহিমা বেগম নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাশরিফ সেখানে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরের সব ফ্যান অফ করে ঘুমাতে চলে গেল।

_______

পরের দিন খুব ভোরে নামাজ পড়ে মাশরিফ বাগানের সামনের দিকে এক্সারসাইজ করছে। তখন বাড়ির এরিয়ার সামনে কাশফাকে হতচকিত হয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাশরিফ বাঁকা হাসে। অতঃপর কাশফার সামনে গিয়ে বলে,

“কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক দেখে খুব অবাক হচ্ছো মনে হচ্ছে! অন্য কিছু আশা করেছিলে বুঝি?”

মাশরিফের এহেনো কথায় কাশফা থমমত খেয়ে যায়। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছু সেকেন্ড নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“তুমি ভুল বুঝছ। আমি তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলাম! তুমি আর আন্টি তো আজকেই ফিরে যাবে। তাই জন্য দেখতে এসেছিলাম। আর দুই দিন পরেই তো তোমার বিয়ে। তখন তো আর তোমাকে এভাবে দেখতে পাবো না।”

“ওহ আচ্ছা! দেখা শেষ? তাহলে আসতে পারো।”

মাশরিফের এভাবে বলাতে কাশফার অপমানবোধে লাগল। তাছাড়া সে বুঝতে পারছে না, ওরা বেঁচে গেল কীভাবে? কাশফা আর সেখানে দাঁড়াল না।

কাশফা চলে যাওয়ার পর মাশরিফ মনে মনে বলে,
“এখন থেকে তোমার ওপর সর্বদা আমার নজরদারি জারি থাকবে। তুমি কোথায় যাও, কী কর, সব কিছুর খবর আমি পাব। তোমাকে তো ধরতেই হবে। তারপর তোমার মুখ থেকেই সবার সব সত্যটা বের করব। এখন একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলো।”

কাশফা নিজের বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। রাগে গজরাতে গজরাতে টে*রো*রি-স্টদের ফোন করে। তারপর ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে,

“কী কাজ করলেন আপনারা? মাশরিফ তো সুস্থভাবে বাগানে এক্সারসাইজ করছে। আপনাদের কিছুতেই কিছু হলো না।”

টো*রো-রি-স্ট দলের সদস্যরা হতবাক হয়ে যায়। তাদের একজন বলে,
“আমরা তো সব জানালা, দরজা সিলড করে দিয়েছি। এমনকি দুইটা ভেন্টিলেটরে কাঁদামাটি লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি। তবে দক্ষিণ দিকের জানালা সিল করা হয়নি কারণ রাস্তা থেকে শব্দ পেয়ে দ্রুত চলে এসেছিলাম। তাছাড়া গ্যাস ছড়িয়ে পরলে মানুষের কি এতো খেয়াল থাকে? প্রায় সবই সিলড।”

“তাহলে ওরা বেঁচে আছে কীভাবে?”

কাশফার বিরক্তির কণ্ঠ শুনে আরেকজন টে*রো*রি*স্ট বলে,
“হায়াত! তাদের হায়াত আছে বলেই কোনোভাবে বেঁচে গেছে। এবার হয়নি তো কী হয়েছে পরেরবার হবে। চার-পাঁচ দিন পর তুমি আমাদের সাথে দেখা করবে। এখন স্বাভাবিক থাক।”

কাশফাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওরা ফোন ডিসকানেক্ট করে দেয়। কাশফা ঘন নিঃশ্বাস ফেলে লম্বাশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল।

_______

দেখতে দেখতে আজ মাশরিফ ও তিতিরের বিয়ের দিন। শুক্রবার পবিত্র জুম্মার দিন। মাশরিফ, তার মা, বোন-দুলাভাই, ভাতিজা ও ছয় বন্ধুকে নিয়ে তিতিরদের বাড়িতে জুম্মার আগেই হাজির। জুম্মার নামাজের পরপরই আকদটা হবে। তিতিরের এখানকার ফ্রেন্ডরাও হাজির সেইসাথে ইনায়া ও ওর ফ্রেন্ডরা। ছেলেরা সব মসজিদে চলে গেছে। নামাজ শেষে কাজি নিয়ে একসাথে আসবে। মহিমা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে তার বোনের সাথে আছেন।

তিতির নামাজের ওয়াক্ত হতেই নামাজ পড়ে এখন তৈরি হতে বসেছে। নাদিয়া ও ইনায়া তিতিরকে সাঁজাচ্ছে। জারিন বলে,
“আমাদের তিতিরকে আজ সাঁজ ছাড়াই কতো উজ্জ্বল ও সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ।”

ফাইজা হেসে একটু মজা করে বলে,
“মাশরিফ ভাইয়ের ভালোবাসার রঙে আমাদের তিতির আজ রেঙে গেছে। সেটারই প্রতিফলন তার সৌন্দর্যে ঘটছে!”

ঘরে উপস্থিত সকলে একদফা হেসে ওঠে। তিতির লজ্জায় ওদের বারকয়েক থামতে বলে চুপ করে আছে। ওরা কি আর থামে! হাসি-ঠাট্টাতেই তিতিরকে সাঁজানো শেষ হলো। খুব অল্প সাঁজ। অল্প সাঁজে লাল জামদানী শাড়িতে কোনো অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না! লাল জামদানীর সাথে লাল ফুল স্লিভসের ব্লাউজ ও লাল প্লেইন সিল্কের হিজাব। হিজাবের ভেতর দিয়ে পাতলা গোল্ডেন স্টোনের টিকলি ও চেইনের মতো টায়রা। গলায় একটা পাতলা লম্বা গোল্ডেন স্টোনের হার। হাত ভর্তি ডিজাইনার গোল্ডেন স্টোনের কিছু চুড়ি ও বালা। হালকা সাঁজেই তিতিরকে ওরা সবাই হা করে দেখছে। ইনায়া খুশিতে ডগমগ করে বলে,

“উফ! এতো সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। কারও খারাপ নজর না লাগুক।”

এই বলে সে নিজের চোখের কোন থেকে কাজল নিয়ে হিজাবের ভেতর দিয়ে তিতিরের থুতনির নিচে লাগিয়ে দেয়। আরভি বলে,
“পুরো বউ পুতুল লাগছে। মাশাআল্লাহ।”

লিরা এসে তিতিরকে আলতো জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে বলে,
“বার্বিডল! মে গড ব্লেস ইউ ডিয়ার।”
জুলিয়াও এসে উষ্ণ আলিঙ্গন করে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে,
“তোমার উপর সকল সুখ বর্ষণ হোক ডিয়ার! দিস গিফট ফর্ম পারসোনালি মি এন্ড লিরা। জাস্ট অ্যা অর্ডিনারি থিংস, ফর উইশিং দ্যা হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।”

তিতির খুলে দেখে একটা উইন্ড চাইম। তিতির ভীষণ খুশি হয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে।
নাদিয়া বলে ওঠে,
“আমাদের বান্ধবী এমনিতেই পুতুলের মতো। আজ মাশরিফ ভাইতো পা-গ*ল হয়েই যাবে!”

নাদিয়ার কথায় সবাই হেসে ওঠে। জারিন বলে,
“ব্রেকিং নিউজ! ভবিষ্যৎ ডাক্তার তানুজা নূর তিতিরের রূপের ঝলকানিতে মেজর মাশরিফের হৃৎযন্ত্র খানিক সময়ের জন্য থমকে গেছে!”

ঘরের ভেতর হাসির রোল পরলেও ওদের এসব কথায় তিতির বারংবার লাজ রাঙা হচ্ছে। হিয়া গোল্ডেন নেটের ভেতর গোল্ডেন কারুকাজ ও স্টোন বসানো ব্রাইডাল ওড়নাটা এনে তিতিরের হিজাবের উপর দিয়ে সেট করে দেয়। তারপর বলে,

“আকদ হয়ে যাওয়ার পর তোকে যখন মাশরিফ ভাইয়ের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে তখন এই ওড়নাটা দিয়ে মুখ ঢেকে নেওয়া হবে। আর ফুলের পর্দা নাকি আনবে বলেছিল? ওটা কখন আনবে?”

জারিন বলে,
“রণকের বুদ্ধি ছিল ওটা। ও আনবে বলেছিল। দাঁড়াও আমি কল করে জিজ্ঞেসা করি। এতক্ষণে তো নামাজ শেষ। ইমাম সাহেবেরও খুতবা শোনা যাচ্ছে না।”

“হ্যাঁ ফোন করো।”

ওদের কথা বলার মাঝেই তিতির আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নাটা নতুন কেনা হয়েছে। পুরো পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। নিজেকে বধূবেশে দেখে কিয়ৎ নিষ্পলক চেয়ে থাকে। ওর এখন নিজের প্রথম বিয়ের দিনের কথা মনে পরে যায়। সেদিনও সবার ভাষ্যমতে তিতিরকে নাকি পুতুলের মতো লাগছিল। কিন্তু সেই পুতুলের সুখ তো দীর্ঘস্থায়ী হলো না! এবারও কি তেমনটা হবে? শুনেছে বিয়ের কিছুদিন পরেই মাশরিফকে একটা মিশনে যেতে হবে। ভাবতেই তিতিরের বুক কেঁপে ওঠল। অজানা আশঙ্কাতে মন-মস্তিষ্ক ছেঁয়ে গেল। তার কাছে সব কেমন দমবন্ধকর লাগছে। হাঁসফাস লাগছে তার। কিন্তু তার বান্ধবীরার তাকে খুব বেশি সময় এই অস্থীরতার মাঝে থাকতে দিল না। টেনে নিজেদের আনন্দের সাথে সামিল করল।

________

ছেলেরা জুম্মার নামাজ শেষে কাজি নিয়ে হাজির। এবার বিয়ে পড়ানোর পালা।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
সবাইকে ওদের বিয়েতে আমন্ত্রণ রইল।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here