অটবী সুখ পর্ব ৭

0
130

অটবী সুখ

৭.
বিছানার নিচে শত শত কাগজের টুকরো দেখে কপালে দৃঢ় ভাঁজ পরলো ত্রিস্তানের। বিক্ষিপ্ত হলো মন। তনয়া দিনের সারাটা সময় এ রুমেই শুয়ে বসে কাটায়। গোপনে গোপনে কি যেন আঁকিবুঁকি করে। কাজটা নির্ঘাত ওর-ই? চোখ বুজে লম্বা লম্বা তিনটে নিশ্বাস ফেললো ত্রিস্তান। তনয়াকে এতবার বলার পরও একই কাজ পূনরায় করায় খানিকটা রেগে গেল। বাইরে থেকে এসে এখনো একগ্লাস পানিও খাওয়া হয়নি। পরনের শার্ট ঘামে ভিঁজে বিশ্রী অবস্থা। মাথা ব্যথায় টনটন করছে। ঘরে পানি নেই। পানি আনতে হবে। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে তনয়ার রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখলো ত্রিস্তান। তনয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে, কোমড়ে হাত রেখে নানা ভঙ্গমায় হাসছে, লাফাচ্ছে। কাঁধে আলগা ভাবে একটা সুতীর শাড়ি জড়ানো। শাড়িটা মায়ের। তনয়া কোত্থেকে পেল? নিশ্চই ত্রিস্তানের আলমারি থেকে নিয়েছে?

আয়নায় ভাইকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো তনয়া। গায়ের ওপর শাড়িটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে এগিয়ে এলো ভাইয়ের কাছে। উল্লাসে ভরপুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”

সুন্দর! মায়ের মতো সুন্দর লাগছে। তনয়ার চেহারা অনেকটা মায়ের ছোঁয়া পেয়েছে বলেই হয়তো। কিন্তু অকপটে প্রশংসা করতে পারলো না ত্রিস্তান। না চাইতেও গম্ভীর গলায় বললো, “আমাকে না বলে মায়ের শাড়ি নিয়েছিস কেন? যেখান থেকে নিয়েছিস সেখানে রেখে আয়, যা!”
তনয়া জোরে জোরে মাথা দুলালো। সে রেখে আসবে না। ত্রিস্তান উচ্চবাক্য করতে পারলো না। বোন তার কিছু থেকে কিছু হলেই নির্দোষ চোখজোড়া তাক করে তাকিয়ে থাকে। কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে! সে চাইলেও কিছু বলতে পারে না।
জোড়ালো নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তান অনুমতি দিলো, “খেলা শেষ হলে শাড়ি রেখে আসবি, ঠিকাছে?”

তনয়া আবারও জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। এবার না-বোধক নয়, হ্যাঁ-বোধক। ত্রিস্তান তনয়ার হাসোজ্জল মুখটা একটুখানি দেখে চলে যাচ্ছিল, তনয়া আটকে দিয়ে বললো, “ভাইয়া? এই শাড়ি পড়লে কি আমি মায়ের মতো বড় হয়ে যাবো?”
নিষ্পাপ কণ্ঠ। ত্রিস্তান মুচকি হেসে তনয়ার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলো, “তুই তো এমনিতে বড়।”
—“নাহ্, আমি মায়ের মতো বড় হতে চাই।”
—“আচ্ছা।”
—“আমি শাড়ি পরবো। আমাকে পরিয়ে দাও না।”

ত্রিস্তান শান্ত চোখে তাকালো। তনয়া আগের মতো ছোট নেই। বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল, মেয়েটা যথেষ্ট বড়। যতই ভাই হোক, বোনকে শাড়ি পরানোর অধিকার, বিবেক, সামর্থ্য কিছুই ত্রিস্তানের নেই। এটা অসম্ভব।
মৃদু গলায় ত্রিস্তান বললো, “নিজে পরে নেয়।”
—“আমি শাড়ি পরতে পারি না ভাইয়া।”
—“তাহলে পরার দরকার নেই।”
—“কিন্তু আমি পরতে চাই।”
—“পরে পরিস। আমি কাউকে ডেকে আনবো।”
—“না, আমি এখন পরবো। এখন মানে এখন। এখন! এখন! এখন!”

সারাদিনের ক্লান্তি, বিশ্রামহীন ঘুমু চোখ, তিক্ত মেজাজ– সব মিলিয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না ত্রিস্তান। রাগ যেন মুহুর্তেই হানা দিলো সর্বাঙ্গে। অনেকটা উঁচুস্বরেই ধমকে উঠলো, “একবার বলেছি না পরে পরতে? তবুও তর্ক করছিস কেন তনয়া? আর কত জ্বালাবি আমাকে? একটু শান্তি কি আমি পাবো না? সারা জীবন কি তোদের পেছনেই আমাকে দৌঁড়াতে হবে?”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রইলো তনয়া। ভাইয়ের হঠাৎ রাগের কারণ ঠাওর করতে পারলো না। আস্তে আস্তে জলরাশিগুলো ভীর জমালো নেত্রের একদম কোণ ঘেঁষে। বোঝা গেল, তনয়া কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অথচ মুখে স্পষ্ট ভয়, আতঙ্ক! ত্রিস্তান ফিরে চাইলো না। ধুপধাপ পায়ে নিজের রুমে চলে এলো। ওখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে হয়তো মেয়েটাকে সে আরও বকতো।

_

রুমে আসার কিছুক্ষণ পরই ত্রিস্তান বুঝলো, তনয়াকে সে অকারণ বকে ফেলেছে। এতটা বকা উচিত হয়নি। বুঝিয়ে বললেই তো হতো! কিন্তু ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গেছে। অবুঝ তনয়া বিশাল অভিমান আঁকড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। রুমে, বারান্দায়, বাথরুমে- কোথাও নেই। ত্রিস্তান পাগলের মতো শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পরলো তনয়াকে খুঁজতে।

ত্রিস্তান প্রায়ই তনয়াকে বাসায় একা রেখে বাহিরে থাকে। এসময় কোনো দূর্ঘটনা হলে যেন তনয়া নিজ থেকেই ঘর থেকে বেরতে পারে, তাই দরজার ছিটকিনি খোলা শিখিয়েছিল সে নিজেই। এখন আফসোস হচ্ছে, শেখানো উচিত হয়নি। সেই সাথে রাগ হলো এই ভেবে, বাবার কেন এই জঙ্গলের মতো জায়গাতেই বাড়ি বানাতে হলো? তনয়া যদি এখন এই জঙ্গলে হারিয়ে যায়? তখন? সে কিভাবে খুঁজে পাবে বোনকে? উদ্ভ্রান্তের মতো সারা জঙ্গল খুঁজেও তনয়াকে পেল না ত্রিস্তান। ফোনে ততক্ষণে সরোজ, রহিম সবাইকে খোঁজার জন্য তাগাদা দিয়ে ফেলেছে। কেউ পাচ্ছে না। আশ্চর্য! এটুকু সময়ে মেয়েটা গেল কই?

তখন সকাল শেষে দুপুর তিনটে। তনয়াকে না পেয়ে মুখটা শূণ্য হয়ে গেছে ত্রিস্তানের। পরনের জামাকাপড় এলোমেলো, কুঁচকানো, ময়লা। অস্পষ্ট ব্যথায় কাতর হয়ে আছে চেহারা। সে মাথা নুইয়ে ছন্নছাড়া ভাবে হাঁটছে। পুলিশে জিডি করতে হবে। প্রথমেই করা উচিত ছিল। কেন যে করলো না!
হঠাৎ, পেছন থেকে নারী কণ্ঠ ডেকে উঠলো ত্রিস্তানকে। অটবীর কণ্ঠ। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ভয়াবহ রাগ নিয়ে বললো, “আপনি এত দায়িত্বহীন কিভাবে হতে পারেন ত্রিস্তান? ওইটুকু একটা মেয়েকে কিভাবে একা ছেড়ে দিতে পারেন? ইলিয়ানা আন্টির বাসার বাগানে লুকিয়ে ছিল মেয়েটা। ভাগ্যিস আমি ওকে দেখেছিলাম! নয়তো কি হতো বুঝতে পারছেন?”
—“তনয়া তোমার কাছে?”

ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। গলা ভাঙ্গা। গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষটাকে এক মুহুর্তের জন্য চিনতে পারলো না অটবী। এতক্ষণে খেয়ালে এলো, ছেলেটার চোখ মুখ শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। ঘেমে আছে বাজে ভাবে। চোখ দুটো লাল। গাল অল্প ভেঁজা। ত্রিস্তান কি কাঁদছে? কৌতূহলী অটবী মনের প্রশ্নটাই করলো, “আপনি কাঁদছেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। ত্রিস্তানের শান্ত দেহে কেমন যেন তাড়াহুড়ো লেগে গেছে। অটবীর হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিয়েছে সে।
—“তনয়াকে কোথায় রেখেছ?”
—“আমার বাসায়।”
—“চলো।”

অটবী বিস্ময়ে টু শব্দটিও করতে পারলো না। ত্রিস্তানের শক্তপোক্ত হাতটা বাঘের থাবার মতো ধরে আছে ওকে।

_

‘অরবিন্দ অটবী’-তে ত্রিস্তান ঢুকলো না। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, “তনয়াকে নিয়ে এসো।”
অটবী মাথা দুলালো মাত্র। বিনাবাক্যে তনয়াকে নিয়ে এলো। মেয়েটা শাড়ি পরেছে। মুখে এখনো কান্নার ছাপ। কিন্তু ঠোঁটে জ্বলজ্বলে হাসি। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার খোঁজাখুঁজির পর বোনকে সামনে পেয়ে ত্রিস্তান অনুভূতি হীন হয়ে পরলো। তার ভেতরের খবর হয়তো কেউ জানে না। জানবে না। এতক্ষণ সে কাঁটা মুরগির মতো ঝটপট করেছে। আর এখন বরফের মতো জমে আছে।
অটবী হালকা গলায় বললো, “ও আসলে শাড়ি পরতে চাইছিল বারবার। তাই পরিয়ে দিয়েছি।”
তারপর একটু থেমে বললো, “আপনি কি ওকে মেরেছেন?”

ত্রিস্তান নড়েচড়ে দাঁড়ালো। নিশ্চল চোখে তাকিয়ে অটবীর কথার অর্থ বুঝতে চাইলো। সে তনয়াকে মারবে কেন? শুধু তো বকেছে।
অটবী আবার বললো, “ইলিয়ানা আন্টির বাগানে বসে ও কাঁদছিল। আমি ওর কাছে যেতেই বললো, আপনি নাকি ওকে মেরেছেন। শাড়ি পরতে দেননি।”

সঙ্গে সঙ্গে তনয়ার দিকে তাকালো ত্রিস্তান। মেয়েটা এখনো হাসছে। অবুঝ হাসি। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, “মারিনি। বকেছি শুধু।”
—“বকবেন কেন? ও কি কিছু বুঝে করে?”

একথার জবাব পাওয়া গেল না। ত্রিস্তান এক মনে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বারবার বলছে, “আর বকবো না তোকে বোন। আর কখনো বকবো না।”
অটবী ভাই বোনের এসময়টুকু মস্তিষ্কে গেঁথে নিলো। কি সুন্দর দৃশ্য! আপনা আপনি মুখে হাসি চলে আসে। আলতো হেসে বললো, “তনয়া আমাকে চিপস্ আনতে বলেছিল ওর জন্য। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় ওর জন্য কিনে নিবেন।”

ত্রিস্তান মাথা দুলালো, “তুমিও চলো।”
—“জি? কোথায় যাবো?”
—“চিপস্ কিনে দিবো। চলো।”
অটবী যেন বুঝলো না। চোখ দুটো সরু করে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, “চিপস্? কাকে?”
—“তোমাকে।”
—“আমি কি বাচ্চা? আমাকে কেন কিনে দিবেন?”

বিরাম চিহ্নের প্রশ্নবোধক চিহ্নটা মাথায় ঘুরঘুর করছে অটবীর। সেই চিহ্ন চট করে আশ্চর্যবোধকে পালটে হাতটা টেনে ধরলো ত্রিস্তান। ভীষণ নির্দ্বিধায়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “আমার তোমার সাথে আরেকটু থাকতে ইচ্ছে করছে।”

অটবী থমকালো। থতমত খেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললেন?”
—“তনয়া তোমার সাথে থাকতে চাইছে।”
—“আপনি এটা বলেননি।”
—“আমি এটাই বলেছি, অটবী।”

অধৈর্য অটবী মানলো না। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো, “আপনি মিথ্যা বলছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে…”
কথা বলতে বলতে অটবী থেমে গেল। ত্রিস্তান তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না! তনয়ার চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সে সেগুলোই ঠিক করে দিচ্ছে বারবার। বিশ্রী রকমের বিরক্ত হয়ে অটবী বললো, “আপনি আমার হাত ছাড়ুন তো! যখন তখন হাত নিয়ে টানাটানি করেন কেন?”

অথচ ত্রিস্তান ছাড়লো না। বরং সে যেন আরেকটু শক্ত করেই ধরলো। অটবী টের পেয়েছে। মৃদু গলায় বললো, “তোমাকে চিপস্ কিনে দেওয়া যাবে না। চকলেট কিনে দেবো।”
—“আমি আপনার দেওয়া জিনিস নিবো বলে মনে হয়?”
—“হয়।”
—“আমি জীবনেও নিবো না।”

এতক্ষণ বাদে ত্রিস্তান অটবীর দিকে তাকালো। তবে হাসলো না। গাঢ় গলায় বললো, “আমি জোড় করে দিয়ে দিবো।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here