অটবী সুখ পর্ব ৬

0
68

অটবী সুখ

৬.
মাত্র গোসল করে এসেছে ত্রিস্তান। ছোট্ট আধভাঙ্গা আয়নায় তার শুকিয়ে যাওয়া মুখশ্রী ভেসে বেড়াচ্ছে। শ্যাম্পু করায় চুলগুলো ঝরঝরিয়ে পরে আছে কপালে। পরনে শুধু মাত্র ট্রাউজার। খালি বুকটার ডানদিকে লম্বালম্বি কাঁটা দাগ। বুড়ো আঙুল দিয়ে দাগটা হালকা করে ছুঁয়ে দিলো ত্রিস্তান। আঘাতটা তনয়ার দেওয়া। ত্রিস্তানের স্পষ্ট মনে আছে, মা-বাবার রক্তাক্ত লা’শ যখন তাদের সামনে আনা হলো, তনয়া অতি দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কথা বলছিল না, কাঁদছিল না, চুপচাপ মা-বাবার শিওরে বসে তাদের নিষ্পলক দেখছিল। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছিল, তনয়া কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। কিছুতেই মা-বাবাকে কবর দিতে দিবে না। সবার পিছু পিছু গোরস্থানেও চলে গিয়েছিল সে। হাতে ছিল ধারালো ছুড়ি—
অতীতের কথাগুলো মনে পরলে আজও গা শিরশির করে ওঠে ত্রিস্তানের। বুকের ক্ষতটা যেন নতুন উদ্যমে জ্বলতে শুরু করে। যন্ত্রণায় কাতর করে তুলে ধুকধুক যন্ত্র। ত্রিস্তান ছটপট শরীরে একটা গেঞ্জি জড়িয়ে নিলো। বাজার থেকে এসেই রান্না সেরে ফেলেছিল বিধায় এখন একটু শান্তি লাগছে। খাবার গুলো এক এক করে টেবিলে সাজাতে সাজাতে সে হাঁক ছাড়লো, “তনয়া? খাবার দিয়েছি। তাড়াতাড়ি আয়।”

তনয়ার খিলখিলানো হাসি শোনা যাচ্ছে। অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার ঘরে আসছে মেয়েটা। লাফানোর দরুণ মাথার দু’পাশের বেণীও সমান তালে দুলছে। হাতে বড়োসড়ো একটা টেডিবিয়ার। গোলাপি রঙের। সে এসেই বললো, “আজকে কি রান্না করেছ, ভাইয়া? আমার পছন্দের খাবার না হলে কিন্তু খাবো না। তোমার সাথে কথাও বলবো না। তুমি তখন পঁচা হয়ে যাবে।”

তনয়া স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে না। কিংবা ভুলে গেছে। কথা বলার সময় কেমন বাচ্চাসুলভ সুর বেড়িয়ে আসে কণ্ঠনালি মাড়িয়ে। শুনতে ভালোই লাগে। ত্রিস্তান চেয়ার টেনে দিয়ে বললো, “বয়।”
তনয়া বসলো না। ভ্রু বাঁকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “একটা চেয়ার টেনেছ কেন? আমার পরী বসবে না? আরেকটা চেয়ার টেনে দাও।”

ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটা চেয়ার টেনে দিলো। তনয়ার টেডিবিয়ারের নাম পরী। পরীকে তনয়া খুব ভালোবাসে। সে যা যা করে, পরীকেও তা তা-ই করায়। প্রতিদিন গোসল করায়, রাত-দুপুরে ঘুম পাড়ায়, নিয়ম মেনে তনয়ার পাশাপাশি ত্রিস্তানকে পরীর জন্যও প্লেটে খাবার বাড়তে হয়। পরে অবশ্য পরীর খাবারটা ত্রিস্তানই খেয়ে হজম করে। তনয়া সেটা জানে না। জানলে হয়তো খুব কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে পুরো বাসা মাথায় তুলে বলবে, “পরীর খাবার তুমি কেন খাও ভাইয়া? পরীর ক্ষিধা লাগে না? না খেলে ও মা’রা যাবে না?”

ত্রিস্তান খাবার বেড়ে দিয়ে তার বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা উচ্ছ্বল মনে খাবার খাচ্ছে। ঠিক খাচ্ছে না। নষ্ট করছে বেশি। মাঝে মাঝে পরীর সাথে গুপ্ত আলোচনায় ফিসফিস করছে। সেই আলোচনার অল্প অল্প কানে আসছে ত্রিস্তানের। তনয়া আজকে কি কি দুষ্টোমি করবে, তার লিস্ট করছে। মেয়েটা আবার দুষ্টোমি করতে ভারি পটু!
হঠাৎ দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। ত্রিস্তান উঠে গিয়ে দরজা খুললো। সরোজ এসেছে। দরজা খোলা মাত্র ছেলেটার দাঁত বের করা হাসি উপচে পরছে। ত্রিস্তান গম্ভীর গলায় বললো, “কেন এসেছিস?”

সরোজ একটা খাম এগিয়ে দিলো, “রহিম ভাই দিসে। আজকের ভাগ।”
খামটা নিলো ত্রিস্তান। একটু ফাঁক করে দেখলো, মোটামোটি ভালোই টাকা। কয়েকদিন ভালো মতো চলা যাবে।
—“দুপুরে খেয়েছিস কিছু? না খেলে ভেতরে আয়।”

সরোজ এবার মাথা নুইয়ে লাজুক হাসলো। বাম হাত দিয়ে মাথার পেছনের চুল চুলকাতে চুলকাতে বললো, “কাজ আছে ভাই। এখন খাইতে পারবো না।”
ত্রিস্তান ভ্রু কুঁচকালো, “কি কাজ?”
—“ওই আরকি, বুঝোই তো। প্রেমিকা অপেক্ষা করতাছে।”

লজ্জার দরুণ লাল হয়ে গেছে সরোজের ফর্সা মুখ। ত্রিস্তানের চোখে চোখ রাখতে পারছে না ছেলেটা। অকারণেই অসংখ্যবার চোখের পলক ফেলছে। ত্রিস্তান আর কিছু বললো না। দরজা লাগিয়ে একবার তনয়াকে দেখে নিলো। মেয়েটা এখনো অর্ধেক ভাতও শেষ করেনি। একটু পর দৌঁড়ে আসবে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।
ত্রিস্তান আস্তে আস্তে নিজের রুমে চলে গেল। টাকার খামটা বিছানার ওপর অযত্নে ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসলো। ত্রিস্তানের বাসাটা এলাকার একটু ভেতরেই। জঙ্গলের মাঝখানে। তার বাবার আবার পাহাড়, গাছপালা অনেক পছন্দের ছিল। এই বারান্দার এই চেয়ারটাতে বসেই তিনি প্রকৃতি উপভোগ করে বই পড়তেন। ত্রিস্তান তো আর বই পড়ে না! সে অত গাছপালা প্রেমীও না। কিন্তু সময়ে অসময়ে এই বারান্দায় বসে থাকা তার পুরোনো অভ্যাস। এই বারান্দায় এসে ত্রিস্তান আর অভিনয় করতে পারে না। বুক চিড়ে আর্তনাদগুলো এক এক করে বেড়িয়ে এসে বলে, “ওহে সুখনীল ত্রিস্তান, তুমি আজীবন দুঃখীই রয়ে যাবে।”

বিদ্যালয়ের পেছনে একটা পরিত্যক্ত পুকুর আছে। জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে, পানি নোংরা, কালো। কোথা থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। সরোজের বমি পেয়ে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে নাক চেপে সে খেঁকিয়ে উঠলো, “প্রেম করার জন্য আর জায়গা পাইলি না? ইছ! কি গন্ধ! এইরম জায়গায় প্রেম করা যায়?”

নলী নিজেও ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছে না। কিন্তু এছাড়া আর কোনো জায়গা নেই। পৃথা ইদানিং গোয়েন্দা সেজে আশেপাশে ঘুরছে। সে যেখানে যায় সেখানেই পিছু পিছু হাঁটা ধরে। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই।
ভীষণ বিরক্ত হয়ে নলী বললো, “আমিও যেন সখে এসেছি এখানে? বুবু জানলে কি হবে জানেন তো? প্রেম করা একেবারে ঘুচিয়ে দিবে।”

সরোজ চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো, “ইছ নীলিমা! ইছ! ইছ! তুই নষ্ট হইয়া গেছিস! আগে তো এমন ভাবে কথা বলতি না!”
—“আগে বলতাম না তো কি হয়েছে? এখন থেকে বলবো। আপনার কোনো সমস্যা আছে?”

ততক্ষণে সরোজ প্রায় বমি করে দিচ্ছিল। নলী চিৎকার দিতেই কোনোমতে সামলে নিলো। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠে বললো, “এইখানে থাকা সম্ভব না নীলিমা। তাড়াতাড়ি কথা শেষ কইরতে হবে। চিঠিতে কি জানি বলবি বলছিলি? দ্রুত ক!”
নলী একটু ইতস্তত করলো। কথাটা অটবী সম্পর্কে। সে আসলে বলতে চাইছিল না। কিন্তু চেপেও রাখতে পারছে না। প্রথমে ভেবেছিল পৃথাকে বলবে। কিন্তু ওর ঠিক নেই। পরে নলীকেই ভুল বুঝবে। অনেক ভেবেচিন্তে নলী সিধান্ত নিয়েছে, কথাটা সে সরোজকেই বলবে।

—“আপনি বলেছিলেন না? বুবুর সাথে ত্রিস্তান ভাইয়ের কিছু আছে? আমারও এখন তাই মনে হয়। কালকে রাতে আমি ত্রিস্তান ভাই আর বুবুকে গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি।”

সরোজ একমুহুর্তের জন্য আশেপাশের বাজে পরিবেশ ভুলে গেল। খুশি লাফিয়ে উঠে উচ্চস্বরে বললো, “তোরে বলছিলাম না আমি? দেখছিস? আমার কথাই ঠিক হইছে।”

অটবীর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আজকে প্রথম পরীক্ষা ছিল। কিচ্ছু মন মতো হয়নি। কমন পড়েনি। কিংবা বলা যায়, কমন পরেছে, কিন্তু অটবী পড়েনি বলেই তার জন্য প্রশ্নপত্র এভারেস্ট জয়ের থেকেও কঠিন লেগেছে।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে অটবীর মনটা হু হু করে উঠলো। আশেপাশে তার সহপাঠীরা কি আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরছে! মুখের বিরাট হাসি যেন আঠার মতো লেগে গেছে ঠোঁটে। কিছুতেই সরছে না। আবার যারা খারাপ করেছে, ওদেরও কোনো না কোনো বান্ধবী আছে। খারাপ করায় সান্ত্বনা দিচ্ছে। অটবীর তো বান্ধবীও নেই। সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ নেই।

রাস্তার মোড়ে সরোজকে দেখতে পেল অটবী। কি অগোছালো হয়ে এসেছে ছেলেটা! পরনে লুঙ্গি, শার্ট। হা করে চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই অটবীর সরোজকে পছন্দ না। চাল চলনের কোনো ঠিক নেই। একদম না দেখার মতো করে চলে যেতে নিলে সরোজ আচমকা ডেকে উঠলো, “অটবী আপু?”

অটবী দাঁড়ালো। সরোজের দিকে তাকাতেই ছেলেটা মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার না পরীক্ষা ছিল আপু? কেমন হয়েছে?”

পরীক্ষা খারাপ হলেও সেটা ঠিক কাউকে বলা যায় না। মনের জ্বালা বাড়ে। সেখান থেকেই ‘মোটামোটি’ শব্দটা বেড়িয়ে আসে মুখ থেকে। অটবীও তাই।
—“তুমি এখানে কি করছো?”

সরোজ কিছু বলতে নিচ্ছিলো। পেছনে ত্রিস্তানকে দেখে থেমে গেল আবার। মুখের হাসি আরও চওড়া করে বললো, “ওইযে, ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে আসছি। উনি উনার মাস্টার্সের সার্টিফিকেট নিতে আসছেন।”
ত্রিস্তান যে অটবীর পেছনে, সেটা সে জানে না। চাপা স্বরে বলতে গিয়েও সে বেশ জোরেই বলে ফেললো, “তোমার ত্রিস্তান ভাই আবার পড়ালেখাও করেছে? বাহ্!”

তাচ্ছিল্য সুর। ত্রিস্তান শুনে হাসলো। ক্ষীণ হাসি তবে দীর্ঘ।
—“কেন? চোররা বুঝি পড়ালেখা করতে পারবে না?”
সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অটবী। লজ্জা পেয়েছে বুঝি মেয়েটা? পেয়েছে বোধহয়। গালদুটো আস্তে আস্তে রক্তিম রঙে লেপ্টে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করে বললো, “আমি ওভাবে বলিনি।”
—“তাহলে কিভাবে বলেছ?”

অবস্থা বেগতিক। সরোজ পাশে দাঁড়িয়ে দম ফাঁটানো হাসি চেপে রেখেছে। এদু’জন কি ভুলে গেছে সেও তাদের সাথে আছে? ভুলে গেছে নিশ্চিৎ! ওর দিকে তো তাকাচ্ছেই না।

অটবী কিছু বলছে না দেখে ত্রিস্তান নিজেই আবার কথা শুরু করলো, “তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
অটবী ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো, “ভালো।”
—“মিথ্যা বলছো কেন?”
—“জি?”
—“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো হয়নি।”

অটবী আশ্চর্য হয়ে তাকালো এবার। সরাসরি, চোখে চোখ রেখে। ত্রিস্তানের চোখদুটো কি গভীর! স্বচ্ছ!
অটবী আমতা আমতা করে বললো, “তেমন কিছু না। ভালোই হয়েছে।”
—“তোমার একটা ভীষণ খারাপ দিক আছে। তুমি নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে ভালোবাসা। এই তুলনা তোমাকে আরও বেশি দুঃখী করে তোলে। ভাবো, ওর এটা আছে বলেই ও সুখী। তোমার এটা নেই বলেই তুমি দুঃখী।”

কথা সত্য। অথচ অটবী এত সহজে মানতে চাইলো না। পালটা বললো, “আপনি তো তুলনা করেন না। তবে আপনি আমার থেকেও বেশি দুঃখী কেন? সবার দুঃখী হওয়ার আলাদা আলাদা কারণ থাকে ত্রিস্তান।”
—“আমারও আছে। আমার নামই দুঃখ।”

বাতাসে অটবীর মাথার ঘোমটা উড়ছে। ভীষণ অচেনা দৃষ্টিতে ওকে দেখছে মেয়েটা। ত্রিস্তান সত্যিই এ দৃষ্টি চেনে না। তবে, এ দৃষ্টিতে ওর ঘোর লাগছে না। নেশা হচ্ছে না। মাদকতায় মস্তিষ্ক বিগড়ে যাচ্ছে না। অথচ অদ্ভুত কিছু হচ্ছে। অচেনা অদ্ভুত।
অটবী বললো, “সামান্য নাম দিয়েই নিজের জীবনের সুখ,দুঃখ বিবেচনা করে ফেললেন? আপনি তো আমার থেকেও খারাপ।”

শুনে ত্রিস্তান হাসি আটকাতে পারলো না। হেসে ফেললো মাথা নুইয়ে, নিঃশব্দে। চোখের কোণে সুখের জলেরা চিকচিক করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো। আচমকা অটবীর মাথায় হাত বুলিয়ে সে বললো, “অটবী, আমি চাই তুমি পাগল করা সুখী হও।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
প্রচুর বানান ভুল থাকতে পারে। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here