এক_চিলতে_রোদ Part_41
#Writer_Nondini_Nila
মানুষের গিজগিজ করছে বাড়ি জুড়ে। আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তাই নিয়ে কতো শত আয়োজন। সকালের খাবারের পর আমি বসে আছি তিন্নি আপুর রুমে। তিনি আমাকে দিয়ে তার লেহেঙ্গার ফতুয়া সিলাই করাচ্ছে। যেখানে থেকে ফতুয়া বানিয়েছে তারা ঢিলা বানিয়ে দিয়েছে। সেটা করছি আমি। ড্রেস আনার পর এই অবস্থা দেখে চিন্তিত মুখে বসে ছিলো তিন্নি আপু। আসলে ড্রেসটা বানিয়ে আনা হয়েছে দূরে থেকে। এখন সেই ট্রেইলার্সের দোকানে যাওয়ার কেউ নাই কারণ সবাই এখন কাজে ব্যস্ত আর গেলেও লেট হবে।
তখন তাদের এই সমস্যার সমাধান ইমা আপু এসে দিলো। বললো আমি নাকি সিলাই পারি। তাই আমাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। আমার অবশ্য খারাপ লাগছে না। আমি আগেও করেছি আমার জামা যখন এমন হয়েছে। তা আমি নিজেই সিলাই করেছি। সেটা নিয়ে আবার কাউকে বলে চাচির থেকে বকা খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি তাই।
আমার কাজ শেষ হতেই তিন্নি আপুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,,,
‘ আপু হয়ে গেছে দেখেন তো ঠিকঠাক হয়েছে কিনা?’
আপু এগিয়ে এসে হাতে নিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট হলো তাইনা?’
আমি বললাম, ‘ নাহ কষ্ট হবে কেন? এটা তো সামান্য কাজ। আমার ভালো লাগছে আপনার হেল্প করতে পেরে।’
তিন্নি আপু এগিয়ে আমার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো, ‘ তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে তো। কি সুন্দর কথা বলো? এজন্য বুঝি ইহান ভাই তোমার জন্য এতো পাগল?’
আমি ইহান ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জা পেলাম খুব। সবাই খালি ভাইয়াকে টানে কেন বুঝিনা। কথা বলা শুরু আমাকে দিয়ে হলেও শেষ হয় ভাইয়াকে নিয়ে। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
‘ আরে মেয়ে লজ্জা পেলে নাকি? লজ্জা পেয়ো না আমি এমনি মজা করলাম। আমি তোমার বোনের মতোন তো তাইনা মজা একটু করতেই পারি।’
আমি মাথা নাড়িয়ে হুম বললাম। আপু আরো কিছু বলবে তখন ভাইয়া কন্ঠ শুনে চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ইহান ভাই দরজা দাড়িয়ে আছে।
আমি তাকাতেই ভাইয়ের চোখে চোখ পরলো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ভাইয়া আমি তাকাতেই বললো,
‘আমার জন্য এক কাপ কফি করে নিয়ে আয় রুমে।’
বলেই পেছনে ঘুরে বড় বড় পা ফেলে সেকেন্ডে চলে গেলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। তিন্নি আপু বললো,
‘ওরে বাবা বিয়ের আগেই হুকুম করা শুরু হয়ে গেছে নাকি।’
আমি চুপ করে আছি। আপু আমাকে বললো,’ যাও কফি দাও গিয়ে। তোমায় হবু বর না হলে আবার রেগে যাবে। দেখলে না কেমন রাগ করে তাকিয়ে ছিলো।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভাইয়ার আবার রাগের কারণটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমি চিন্তিত মুখ করে বেরিয়ে এলাম। রান্না ঘরের দিকে যাব দিনা তখন আমাকে টেনে নিয়ে এলো ওর বান্ধবীদের কাছে। দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাদের কাছে এনে বললো,
‘ এই হলো আমার নতুন ফ্রেন্ড ঊষা।’
হাই হ্যালো বলতে লাগলো। আমি চিন্তিত মুখে হাসার চেষ্টা করলাম।
‘এটা কে?’
‘আমার রিফাত ভাই আছেনা তার শালিকা।’
‘ও একটু আগে যে হ্যান্ডসাম ছেলেটা গেল তার বোন?’
আমি ভাবছি এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা আবার কে? তখন দিনার কথা শুনে আমি বুঝে গেলাম এটা ইহান ভাই।
দিনা বললো, ‘না তার বোন না বউ!’
দুজনে চরম অবাক হয়ে আমার দিকে বললো, ‘হোয়াট?’
তারপর একজন বললো, ‘ কি বলছিস? বউ এটা কি করে সম্ভব ? তুই না বললি রিফাত ভাইয়ের শালি তাহলে তার শালার বোন না হয়ে বউ হয় কেমনে?’
দিনা বললো, ‘ আরে আপন বোন না তো ঊষা চাচাতো বোন।’
এবার ক্লিয়ার হলো তাদের। তারা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
‘তোমাদের বিয়ে কবে হয়েছে?’
আমি মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। সবাইকে এই সব বলার কি দরকার? আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
দিনা বললো, ‘ ওদের বিয়ে এখনো হয়নি। এনগেজমেন্ট হয়েছে শুধু। বিয়েও খুব তারাতাড়ি হবে।’
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,, ‘তাইনা রে ঊষা।’
আমি কথায় পাত্তা না দিয়ে।কথা ঘুরিয়ে বললাম,,,
‘ আমি যাই। আমাকে ভাইয়া কফি নিয়ে যেতে বলেছে।’
বলেই এক সেকেন্ড দাঁড়ালাম না। চলে আসতে নিলাম। পেছনে থেকে ওদের কথা আমার কানে এলো। ওই মেয়ে গুলো বলছে ভাই কাকে বললো?
দিনা বললো, ইহান ভাইকে। তা নিয়ে হাসাহাসি। আমার রাগ হলো ওদের হাসি শুনে। আমি রেগেই কফি করলাম। আমাকে তিন্নি আপুর মা বলেছিলো তিনি করে দিবেন। আমি না করে নিজে করেছি।
আমি কফি নিয়ে এসে দেখি ভাইয়া রুমে পায়চারী করছে। আমি যেতেই আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বিছানায় বসে পরলো। আমি এগিয়ে কফি হাত বাড়িয়ে দিলাম। ভাইয়া কফি হাতে নিলে আমি চলে আসতে নেই।
ভাইয়া পেছন ডেকে বলে, ‘ তোর সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা আছে।’
আমি দাঁড়িয়ে পরলাম থমকে,
আবার কি ইম্পর্টেন্ট কথা বার্তা বলবে। আমি ওরনায় আঙ্গুল পেছাতে পেছাতে ঘুরে দাঁড়ালাম। ভাইয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
‘আজ শাড়ি পরবি?’
আমি মাথা তুলে তাকালাম।
‘কি হলো বল?’
আমি হকচকিয়ে বললাম, ‘ হুম দিনা বলছিলো সবাই এক রকম শাড়ি পরবে।’
‘তোর আজ পড়ার মতো ড্রেস আছে?’
আমি বললাম, ‘ শাড়ি তো পড়া হবে অন্য ড্রেস দিয়ে কি করবো?’
ভাইয়া শক্ত মুখে বললো, ‘ তোকে আমি যা জিজ্ঞেস করছি তাই বল।’
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘আছে। ‘
‘ওকে আজ শাড়ি পড়বি না। এটা বলার জন্য ডেকেছিলাম। ‘
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘ শাড়ি পড়বো না কেন?’
‘আমি মানা করেছি তাই।’
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। ভাইয়া আরো অনেক কথা বললো। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনলাম তারপর ভাইয়া বললো,
‘যা এবার। আমার কথা মাথায় থাকে যেন।’
আমি হতভম্ব হয়ে বেরিয়ে এলাম।
দুপুরে গোসল শেষে সবাই রেডি হচ্ছে আমি আর দিনা এক রুমে। দিনা নিজেই শাড়ি পরতে পারে খুব সুন্দর করে তাই একাই পরবে। আমাকেও পরাবে বলছে আমি বিছানায় চুপ করে বসে আছি।
দিনা এগিয়ে এসে বললো, ‘ এমন করে বসে আছো কেন? উঠো এই যে শাড়ি চলো তোমাকে আগে পরিয়ে দেয়।’
আমি নড়লাম না। দিনা বললো, ‘কি হয়েছে?’
আমি সব বললাম। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তাই তুমি পরবে না ভাবছো? এমনটা ভেবো ও না। শাড়ি না পরলে তোমাকে সবার মাঝে কেমন লাগবে দেখতে ভাবো? ইহান ভাই যার জন্য না করুক না কেন? তুমি পড়ো পরে না হয় বুঝিয়ে বলো?’
‘শুনবে না। ভাইয়া খুব রাগী আমাকে বকবে অনেক।’
‘কি বলছো? তোমাকে বকবে আমার তো বিশ্বাস হয়না। সে তোমাকে খুব ভালোবাসে বকতেই পারবে না। যাও আমি তোমার সাথে গিয়ে তার কাছে বলবো আমি তোমাকে জোর করে পরিয়েছি।’
‘মানবে না!’
‘এতো ভয় পাও কেন? চলো তো। কিছু হবে না।’
দিনা আমার কথা শুনলো না। নানা ভাবে আমাকে বুঝিয়ে রাজি করালো। ভেতরে ভেতরে আমি ভয় পাচ্ছি। কিন্তু দিনার কথা শুনে রাজি হতে মন চাইছে। তাই তো রাজি হয়ে গেলাম। ও আমাকে খুব সুন্দর করে কুচি করে শাড়ি পরিয়ে দিলো। আঁচলেও কুচি উঠিয়ে। ও নিজে বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পরলো। আমি চুল ছাড়লাম না। গরম আর ভাইয়া না করেছে চুল যেন ছাড়া না দেখি। শাড়ি না হয় পড়লাম। ওটা রাখি। দিনা আমাকে সাজিয়ে দিলো। গোলাপি রঙের শাড়ি, সোনালি ব্লাউজ, মাথায় গাজরা দিয়ে খোঁপা। হাতে আমি সোনালি আর গোলাপি রঙের চুড়ি পরলাম। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর কপালে টিপ, চোখে মোটা কাজল। দিনা একটা গলায় নেকলেস আর কানে ঝুমকা পরিয়ে দিলো। সাজ কম্পিলিট করে আমি ভয়ার্ত মুখ করে বসে আছি। ভাইয়া আমাকে এই অবস্থায় দেখলে কি বলবে আল্লাহ জানে?
সবাই বের হলাম। এখন ছেলে পক্ষেরা হলুদ দিতে এসেছে। গেটের কাছে ফুল, চকলেট আরো নানান জিনিস নিয়ে দাঁড়াতে হলো। আমার হাতে গাঁদা ফুল ছেঁড়া একটা পাত্র। তা বর পক্ষের সবার মাথায় ছিটাতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে আছি কাচুমাচু মুখ করে। আশেপাশে ভাইয়া নাই। সবাই চলে যাচ্ছে আমি হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছি। হুট করেই কেউ আমার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরলো। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি অচেনা একটা ছেলে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছি।
‘কি হলো ম্যাডাম আমাকে দিবেন না?’
আমি ঢোক গিলে ফুল দিতেই ছেলেটা হাসতে হাসতে চলে গেলো।
সবাই চলে গেলে আমরা ও এলাম। ইমা আপু তিন্নি আপু কে নিয়ে স্টেজে বসালো।
আর বাকিরা যারা ছেলের বাড়ি যাবে তারা গাড়িতে গিয়ে বসলো। আমাকে নিয়ে দিনা বসলো। তখন ইহান ভাইকে দেখলাম। তিনি গম্ভীর মুখ করে এগিয়ে আসছে। বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি পরেছে সবাই। ভাইয়া ও পরেছে। ভাইয়াকে গম্ভীর মুখে দেখেই আমার আত্না কেঁপে উঠলো।
ভাইয়া এগিয়ে এসে সুন্দর করে দিনাকে বললো,
‘ আমি এখানে বসতাম। আপনি একটু অন্য কোথাও ম্যানেজ করে নিন প্লিজ।’
দিনা মাথা দুলিয়ে উঠে গেলো। আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি দিনার যাওয়ার দিকে। এভাবে একা রেখে চলে গেলো। আমার কাছে এসে ভাইয়া বসলো। ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া আমার দিকে তাকালো ও না কথা ও বললো না। আমি অনেকক্ষন ভয় পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ উঠিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া সামনে তাকিয়ে আছে আবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। কথা বলবো নাকি বলবো না।
অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলেই ফেললাম,
‘ ভাইয়া আমি আসলে…..
এমন ভাবে তাকালো যে আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। আমার কথা আপনাআপনি থেমে গেছে। ঢোক গিলে তাকিয়ে আছি ভয়ার্ত চোখে। ভাইয়া তার সুন্দর ঠোঁট নাড়িয়ে শান্ত গলার বলা কথা শুনে আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।
ভাইয়া বললো, ‘ তোকে আমি বলেছিলাম শাড়ি না পরতে। আমার কথা অমান্য করা আমি পছন্দ করি না ঊষা। কাজটা ভালো করিস নি।’
আর কথা বললো না আমি কাঁপছি অসম্ভব রকমের। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কথা বলতে পারছিনা।
গাড়ি থেকে নামার সময় সবাই নেমে গেলো ভাইয়া নামছে না। তার জন্য আমিও নামতে পারছিনা সবাই চলে গেল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। সবাই যেতেই ভাইয়া গাড়ির দরজা অফ করি দিলো আর নিজে আমার দিকে ঘুরে বসলো আমি এসবে ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
‘ দরজা আটকালেন কেন? যাবেন না। সবাই তো চলে গেলো? আম…..
ভাইয়া আমার কথার গুরুত্ব না দিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধের কাছে শাড়ির আঁচল ধরলো। আমি চমকে উঠলাম। বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া কি করছে শাড়ি খুলছে কেন?
‘কি করছেন?’
আমার এই বিষ্ময়কর চোখ মুখের দিকে তাকালো না ভাইয়া। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তিনি পিন খোলার চেষ্টা করতে আমি আঁতকে উঠে হাত বুকে চেপে ধরলাম।
#চলবে