তোমার আমার প্রণয় পর্ব-৫৫

0
5366

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_55

সময় করো জন্যই অপেক্ষা করে না।সে তার নিজস্ব গতিতে চলমন থাকে।সেদিন দৃশ্য বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর ফাহিম অনেক খুঁজেছিল।সে তার বোনকে কখনোই কষ্টে দেখতে চায়নি।তাই বাবাকে অনেক বার এই বিয়ে বন্ধ করার অনুরোধ করেছে।কিন্তু তার বাবা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে গেছে।বাবার এই রূপের সাথে তারা পরিচিত না।মা কোনো দিন বাবার এই রূপের কথা জানায় নি।অথচ সে ভাবতো তার বাবা সবার জন্য আদর্শ।

বাবাকে রাজি করতে না পেরে দৃশ্যর বিয়ে পরীক্ষা পর্যন্ত পিছাতে বললো।আসলে ফাহিম কিছুটা সময় চাইছিলো বিয়েটা বন্ধ করার।ওই ছেলের সাথে নিজে কথা বলেছে।এমনকি দৃশ্য আর মাহাদ যে বিয়ে করে নিয়েছে সেটাও জানিয়েছে।কিন্তু সেই বেয়াদব তবুও দৃশ্যকে বিয়ে করতে রাজি।ফাহিম বুকে গেছে এই ছেলের সাথে তার বোন কখনোই সুখী হতে পারবে না।ফাহিম আর তার বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করে হলুদের দিন রাতে ওই ছেলেকে তারা তুলে এনে আটকে রাখবে।আর বিয়ে ভেঙে গেলে ছেড়ে দিবে।এতো দিনে বাবাও সবার কাছে কিছুটা হেনোস্ত হয়ে দৃশ্যর বিয়ের ভুত মাথা থেকে নামিয়ে ফেলবে।বাবাকে সে একটা শিক্ষা দিতে পারবে।

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বোনটা যে তার ভাইয়ের উপর ভরসা রাখতে পারেনি।হলুদের আগের দিনই বাসা থেকে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে গেছে।ফাহিম হন্যে হয়ে দৃশ্যকে খুঁজেছে।সব আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে খবর নিয়েছে।এমনকি সে লোক দিয়ে মাহাদের ঢাকার বাড়িতে খবর নিয়েছে।সে ভেবেছে হয়তো দৃশ্য মাহাদের কাছে চলে এসেছে।কিন্তু না।দৃশ্য মাহাদের কাছে আসেনি।সেদিন ফাহিম চিৎকার করে কেদেছে।সেই দুঃসময় সে বোনটার পাশে থাকতে পারেনি।হাত ধরে ভরসা দিতে পারেনি।তার সেই ছোট্ট বোনটা কোথায় আছে?কেমন আছে কিছুই সে জানেনা।

সেদিন থেকে সে বাবার সাথে কোনো কথা বলেনি।সব কিছুর মুলেই যে বাবা রয়েছে।এতো ইগো কেনো তার?এই ইগোর কাছে সন্তানদের সুখ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।বাবা সবার সাথে অন্যায় করেছে।তাকে সে কখনই মাফ করবে না।
আশরাফ হুসাইন ছেলের সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনি।অন্যদিকে দৃশ্যর পালিয়ে যাওয়ার কারণে ছেলে পক্ষের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে।এলাকায় তাকে অনেকটা হেনস্ত হতে হয়েছে।ছেলে মেয়ে সব তার অবাধ্য হয়ে গেছে।

তার বেশ কিছুদিন পর একদিন ফাহিমের কাছে খবর আসে তার বাবা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।ফাহিম ছুটে গেছিলো হসপিটালে।যতো যাই হোক বাবাকে তো।রক্তের সম্পর্ক তার সাথে।হসপিটালে তখন তার বাবার অপারেশন চলছিলো।অপারেশনের পর তারা জানতে পারে ব্রেনে আঘাত পাওয়ার কারণে বাবার শরীরের ডান পাশ প্যারালাইস হয়ে পরেছে।বাবা আর কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারবে না।

আনিকা কবির স্বামীর করুন অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েছিলেন।মানুষটা তাকে ভালো না বাসলে কি হবে?সেতো ঠিক ভালোবেসে এসেছে।তার সব অন্যায় দেখেও সে মানুষটা কে ছেড়ে চলে যেতে পারেনি।

হসপিটালে তখন আশরাফ হুসাইনকে পার্টির অনেক লোকেরা এসে দেখে গেছে।তার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে সকলে ফাহিমকে তার বাবার জায়গাতে বসতে বলে।ফাহিম আগে থেকেই রাজনীতির সাথে পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো।তাই তার জন্য দায়িত্ব নেয়া সহজ ছিলো।
ফাহিম ক্ষমতায় আসার পর সে সবার জন্য ভালো কাজ করতে শুরু করে।সে মোটেও তার বাবার মতো স্বার্থপর না।সে দেশের সেবা করতে চায়।

হুইল চেয়ারে বসে বসে আশরাফ হুসাইন এখন জীবনের হিসাব মিলাচ্ছেন।এতো অহংকার তার নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে।ছেলে তার সাথে কোনো কথা বলে না।তার একমাত্র মেয়ে ঘরছাড়া।আর যাকে সে বিয়ের পর থেকে অত্যাচার করে আসছে সেই মানুষটাই এখন নিঃস্বার্থ ভাবে তার সেবা করে যাচ্ছে।সে নিজে কিছুই করতে পারেনা।আনিকা কবির সারাক্ষণ তার দেখাশোনা করে।মানুষটা বলার আগেই সব বুঝে যায়।

আজ নিজের প্রতিটা কাজে আশরাফ হুসেনের আফসোস হয়।এই মানুষটাকে সে কখনোই ভালোবাসেনি।আর না দিয়েছে সম্মান।তবুও তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি।নিজের ইগোর জন্য একমাত্র বোনটাকে হারিয়েছে।তখন যদি দিশাকে আরিফের কাছে বিয়ে দিতো তবে বোনটা তার জীবিত থাকতো।একই অন্যায় সে নিজের মেয়ের সাথেও করেছে।মেয়েকে কখনোই সে ভালোবাসা দেয়নি।আদর করে কাছে ডাকেনি।মেয়েটা তাকে সব সময় ভয় পেতো

।একটাবার মেয়েটার সুখের কথা চিন্তা করে ওই ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি হলে মেয়েটা আজ সুখী হতো।না জানি কোথায় আছে দৃশ্য।মেয়েকে সে কখনোই একা বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি দিতো না।জ্বর কারণে দৃশ্য কখন বাইরের কঠিন বাস্তবতা দেখেনি।আজ মেয়েটা একা কি করে চলছে?মরার আগে একটাবার কি মেয়েকে দেখতে পারবে না?একটা বার কি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাবে না?

ফাহিম রাজনীতিতে নামার পর থেকে ভীষণ ব্যাস্ত।আসলে সে সব কষ্ট ভুলার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেছে।একটা কাজে আজ সে ঢাকায় এসেছে।কাজ শেষ হলে সে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠার আগেই একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো অলরেডি ভিড় জমে গেছে।ফাহিম বুঝতে পারলো মাত্রই একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।কিউরিসিটি ধরে রাখতে না পেরে সে সামনে এগিয়ে গেলো।

দেখলো একটা মেয়ে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে।রক্তে পিচঢালা রাস্তা ভেসে যাচ্ছে।ফাহিমের বুকটা কামড়ে উঠলো।ইসস কি বিভৎস অবস্থা।ফাহিম দেখলো ভীর অনেক হলেও কেউ মেয়েটাকে সাহায্য করতে আসছে না।সবাই তামাশা দেখছে।কেউ কেউ তো ভিডিও করছে।ফাহিমের রাগ হলো।মানুষের মধ্যে আর মনুষ্যত্ব বোধ নেই।করো বিপদে এরা এগিয়ে আসবে না।কিন্তু মজা দেখবে।

ফাহিম দ্রুত এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে।মেয়েটাকে সোজা করে শোয়াতেই ফাহিমের দুনিয়া থমকে গেলো।মনে হচ্ছে কেউ তার হৃদপিণ্ড টা টেনে বের করে ফেলেছে।এটা স্বপ্ন নয় তো।যাকে সে এতো খুজে বেরিয়েছে তাকে এমন রক্তে মাখামাখি অবস্থায় পাবে সে চিন্তা করতে পারেনি।কতদিন পর সে মুখটা দেখছে।ফাহিম দৃশ্যকে দেখে মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়লো।সে কাপা কাপ গলায় দৃশ্যকে ডাকতে লাগলো

-“দৃ…..দৃশ্য?দৃশ্য বোন আমার।এই যে দেখ ভাইয়া এসে পড়েছি।এই বুড়ি কথা বল।রাগ করেছিস ভাইয়ার সাথে?
দৃশ্য…?

কিন্তু দৃশ্যর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।ফাহিম দেখলো দৃশ্যর মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছে। পরনের পাঞ্জাবি দিয়ে দৃশ্যর মুখের রক্ত পাগলের মতো মুছতে লাগলো।তার সাদা পাঞ্জাবি মুহূর্তেই লাল রং ধারণ করলো।কিন্তু মাথা থেকে রক্ত এসে আবার দৃশ্যর মুখ লাল রক্তে মাখামাখি হতে লাগলো।ফাহিম চিৎকার করে কেঁদে বলতে লাগলো

-“দৃশ্য বোন আমার।তোর কিছু হবে না।এইযে ভাইয়া আসর পড়েছি।চোখ খোল দৃশ্য।একবার চোখ খুলে দেখ ভাইয়া এসেছি।আর কিছু হবে না।”

বলেই সে দৃশ্য রক্তে ভেজা সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।আর বলতে লাগলো
-“তোর কিছু হবে না।ভাইয়া আছি না।প্লিজ কেউ একটু সাহায্য করুন।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা ছেলে আসলো ফাহিমের কাছে।সে বললো
-“মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে।আগে রক্ত পরা বন্ধ করতে হবে।”

বলেই পাশে পরে থাকা দৃশ্যর ওড়নাটা দিয়ে দৃশ্যর মাথা বেধে দিলো।আর ফাহিমকে তারা দিয়ে বললো
-“উনাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।”

ফাহিম দ্রুত দৃশ্যকে কোলে তুলে নিলো।আর ছেলেটাকে বললো
-“আমার কাছে গাড়ি আছে।আমাকে হসপিটালে একটু পৌঁছাতে হেল্প করুন।”

-“জি অবশ্যই।”

ফাহিম গাড়ির পেছনে দৃশ্যকে শুইয়ে দিলো।দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।কিন্তু তার হাত প্রচন্ড কাপছে।সে কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছে না।একবার হাতের দিকে তাকালো।দুই হাত রক্তে ভেজা।সে তার হাত পাঞ্জাবিতে মুছতে লাগলো।ছেলেটা এতক্ষণ পাশে দাড়িয়ে সবটাই দেখছিলো।সে বুঝতে পারলো লোকটা এখন ড্রাইভ করতে পারবে না।সে ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে বলল

-“আমি ড্রাইভ করছি।আপনি পেছনে বসুন।”

ফাহিম অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটার দিকে।তারপর দ্রুত পেছনের সিটে দৃশ্যর পাশে বসে পড়লো।দৃশ্যর মাথা নিজে কোলে তুলে নিলো।আর ছেলেটা গাড়ি হসপিটালের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল।সারা রাস্তা ফাহিম ফুঁপিয়ে কেদেছে।ভীষণ ভালোবাসে সে বোনটাকে।ছোট বেলা থেকে বোনটার সব আবদার সে পূরণ করেছে।আর আজ সেই আদরের বোনের এই মর্মান্তিক অবস্থা দেখে সে প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়েছে।

__________
শামসুন্নাহার বেগম ক্ষিপ্ত মনে আরিফকে কল করলো।আর বললো

-“আব্বা এই বাড়ির কেউ আমারে দাম দেয়না।তোর ভাই নাই তাই কেউ আমার কথা শুনেনা।”

-“কি হয়েছে আম্মা?”

-“তোর ভাইয়ের বউ আর পোলা পাগল হইয়া গেছে।তারা ওই জানোয়ারের বাচ্চার মাইয়ারে এই বাড়িত তুলতে চায়।কেমনে তারা ভুইলা গেলো সব।ওই আশরাফের লাইগা আমার দুই পোলায় কতো কষ্ট পাইলো।আমার বড়ো আব্বায় দুনিয়া ছাড়লো আর তুই ছারলি দেশ। এরা কেমন কইরা ওই লক্ষ্মী মাইয়ারে বাড়িত তুলতে চাইতাছে?”

আরিফ বুজলো মায়ের এতো অভিযোগের কারণ।সে নরম সুরে বললো
-“আম্মা আপনি বেশি ভাবছেন।ওই বাচ্চা মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই। মাহাদের উচিৎ ছিলো মেয়েটাকে আরো আগে এই বাড়িতে আনা।বরং তোমার নাতি দেরি করে ফেলেছে।”

-“কি কস তুই।আমি ওই মাইয়ারে এই বাড়িত ঢুকতে দিমু না।আমার সংসারে আর কোনো অশুভ ছায়া আসতে দিমু না।আমার পোলার মরণের কতা তোরা ভুলতে পারস কিন্তু আমি না।আমি কাওরে মাফ করুম না।আমি মাহাদরে আবার বিয়া করামু।একবার বউ পাইলে হেই সব ভুইলা যাইবো।”

-“আম্মা আপনি ভালো করেই জানেন মাহাদ অন্য কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিবে না।এতো দিন কি নাতির কষ্ট নিজ চোখে দেখেন নি?দৃশ্যকে ছাড়া আপনার নাতি কখনোই সুখী হতে পারবে না।আম্মা দিশা এই পৃথিবীতে নেই।তবুও ওকে আমি ভুলতে পারিনি।আর না পেরেছি তার জায়গা অন্য কাউকে দিতে।সেখানে দৃশ্য মাহাদের সামনে আছে।সবচাইতে বড় কথা দৃশ্য মাহাদের বউ।আম্মা ওই বাচ্চা মেয়েটার উপর আর রাগ পুষে রাখবেন না।আপনি একটু ভেবে দেখেন মেয়েটার কি অপরাধ?”

শামসুন্নাহার বেগম কিছুটা দমে গেলেন।কি বলবে বুঝতে পারছে না।তিনি বললেন

-“আব্বা দেশে আইবা না?”

-“আমি তো আসার আগে মাহাদকে বলে এসেছিলাম এইবার দেশে তখনই আসবো যখন মাহাদ গুড নিউজ শুনাবে।আমার মনে হয়ে সে দিন আর বেশি দেরি নেই।”

রবিন গাড়িতে বসে বার বার আড়চোখে মাহাদকে দেখছে।তার স্যার আজ অন্য মুডে আছে।ভীষণ অস্থির।বাসা থেকে বেরিয়ে হাসি মুখে বলেছে

-“রবিন তোমার ম্যাম এর বাসায় চলো এক্ষনি।”

তখন খুশি থাকলেও এখন ভীষণ অস্থির।গাড়ি দৃশদের বাসার সামনে থামতেই মাহাদ মুখের মাস্ক পড়ে দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।দোতলায় উঠে বসার ডোর বেল বাজাতেই জিনিয়া দরজা খুলে দিলো। মাহাদকে এই সময় দেখে কিছুটা চমকে গেলো।মাহাদ ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো লতাও বেশ চিন্তিত হয়ে বসে আছে। মাহাদকে দেখে উঠে দাড়ালো। মাহাদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো

-“দৃশ্য কোথায়?”

জিনিয়া চিন্তিত হয়ে বললো
-“দৃশ্য এখনো বাসায় ফেরেনি।কখন থেকে কল করে যাচ্ছি রিসিভ হচ্ছে না।”

লতা বললো
-“কখনো তো এমন করে না।দেরি হলে কল করে জানিয়ে দেয়।”

মাহাদের চিন্তা বাড়তে লাগলো। কাল রাতের পর আর দৃশ্যকে দেখা হয়নি।ঠিক আছে তো?অজানা ভয় মাহাদের বুকে হানা দিতে লাগলো।সে বললো দৃশ্যর নম্বরে আবার কল দিতে।লতা আবারো কল করলো দৃশ্যর নাম্বারে।

আকাশ হসপিটালে বসে আছে।তার পাশেই লোকটা রক্তে ভেজা পাঞ্জাবি পরে পাশের রুমটার দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।তার নিজেরও একটা ছোট বোন আছে।ফাহিমের অবস্থা সে বুঝতে পারছে।হঠাৎ পাশের চেয়ারে হাত চলে গেলে চমকে উঠলো।চেয়ারটা কাপছে।পড়ে বুঝতে পারলো আসলে ব্যাগের ভেতরের ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে।মেয়েটার কাছ থেকে একটু দূরেই ব্যাগটা পড়ে ছিলো।গাড়িতে উঠার সময় সে ব্যাগটা নিয়ে এসেছে।সে ফোনটা তুলে হেলো বলতেই অপড় পাস থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ বলে উঠলো

-“কে আপনি? দৃশ্য কোথায়?ওর ফোন আপনার কাছে কেনো?”

লতার কথা শুনে মাহাদ অস্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।কিন্তু একটু পর লতা চিৎকার দিয়ে বললো
-“কি বলছেন এসব?”

মাহাদের বুক মুচড়ে উঠে।লতার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়।লতা যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।জিনিয়া অস্থির হয়ে জিজ্ঞাস করলো কি হয়েছে।লতা কাদতে কাদতে বললো

-“দৃশ্যর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।ওকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।”

কথাটা শুনে মাত্রই মাহাদের সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠলো।শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।সে নিশ্চয়ই ভুল শুনছে।তার দৃশ্যর কিছুই হতে পারেনা।কিছুই না।

রবিন সবটা শুনে মাহাদকে ধরে নিচে নামায়।গাড়িতে উঠে মাহাদ অস্থির হয়ে যায়।সে যেনো নিজের মধ্যে নেই।তার মনে হচ্ছে বুকে কেউ বিশাল বড় পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।রবিন সবাইকে নিয়ে দ্রুত হসপিটালে রওনা দেয়।

মাহাদ হসপিটালে পৌঁছে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।পাগলের মতো ছুটতে থাকে।দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্না ধরা।রিসেপশনিস্ট এর কাছে জিজ্ঞেস করার কথা বেমালুম ভুলে যায়।হসপিটালের সবাই মাহাদকে দেখে ভিড় জমাতে শুরু করে।এতো বড়ো সেলিব্রেটিকে দেখে সবারই কৌতহল জাগে।রবিন দ্রুত দৃশ্যর কথা জিজ্ঞেস করে মাহাদকে দৃশ্যর কাছে নিয়ে যেতে থাকে।আর বডিগার্ডকে কল করে আসতে বলে।এতো ভিড় সে একা টেকেল দিতে পারবে না। তাছাড়া কিছু ক্ষণের মধ্যেই হয়তো খবরটা মিডিয়া অব্দি চলে যাবে।
মাহাদ ওটির সামনে এসে থমকে দাড়ায়।সেখানে ফাহিম বসে ফুপাচ্ছে।ফাহিমের জামার দিকে নজর যেতেই তার কলিজা কেপে উঠে।সাদা পাঞ্জাবিতে লাল রক্তের ভেজা। এগুলো নিশ্চয়ই তার দৃশ্যর রক্ত। তার বউটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে আল্লাহ ভালো জানে।মাহাদ দৌড়ে ওটির দরজার সামনে চলে যায়।দরজা খোলার চেষ্টা করে।কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক। মাহাদ পাগলের মতো দরজা ধাক্কাটা লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো

-“দরজা খোলো।আমাকে আমার দৃশ্যর কাছে যেতে দাও।ওর কিচ্ছু হবে না।আমি কিচ্ছু হতে দিবো না।এইযে দেখো আমি চলে এসেছি পিচ্ছি।আমার উপর রাগ করে শাস্তি দিচ্ছ তাই না?দৃশ্য…দৃশ্য!!”

ফাহিম প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে মাহাদকে দেখে অনেকটা চমকে যায়।দৃশ্যর কথা মাহাদ জানালো কি করে?সে মাহাদের পাগলামি দেখছে।ছেলেটা তার বোনের জন্য পাগলামি করছে।রবিন মাহাদকে কিছুতেই আটকাতে পারছে না। মাহাদ যেনো আজ এই দরজা ভেঙেই ছাড়বে।শেষে ফাহিম উঠে এসে মাহাদকে টেনে হিচড়ে দরজার কাছ থেকে নিয়ে আসে।সে ফাহিমকে দেখে অস্থির হয়ে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে বললো

-“আমাকে যেতে দে ফাহিম।ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে।ও ভালো নেই।আমি একটা বার ওকে দেখবো।দরজা খুলতে বল।”

ফাহিম মাহাদের দুই গালে চেপে ধরে বললো
-“দৃশ্যর অপারেশন চলছে মাহাদ।একটু শান্ত হো।এমন পাগলামি করিসনা।”

মাহাদ চিৎকার করে বললো
-“কি করে শান্ত হবো?তোর বোনকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।ওকে ভীষণ ভালোবাসি আমি।এতদিন দূরে ছিলো।কিন্তু নিজেকে সান্তনা দিয়েছি সে তোর কাছে ভালো আছে।কিন্তু তুই আমার পিচ্চির খেয়াল রাখতে পারিসনি।”

মাহাদ ফাহিমের কলার চেপে বলতে লাগলো
-“আমার বউকে তোর হাতে তুলে দিয়ে এসেছিলাম না?ওর খেয়াল কেনো রাখতে পারলি না?আমার বউটা কতো কষ্ট করেছে জানিস?সব আমার জন্য হয়েছে।আমি ওকে ছেড়ে না আসলে এমন কিছুতেই হতো না।আমাকে ওর কাছে যেতে দে।ওকে এই মুহূর্তে না দেখলে মরেই যাবো আমি।”

বলেই মাহাদ আবার যেতে চাইলে ফাহিম জোর করে আটকে রাখে।লতা আর জিনিয়া এক পাশে দাড়িয়ে কান্না করে যাচ্ছে।আর আকাশ অবাক হয়ে মাহাদ কে দেখছে।এতো বড়ো সেলিব্রেটি এই মেয়েটার জন্য এমন পাগলামি কেনো করছে?আর মেয়েটাকে বউ বলছে কেনো?তার মানে কি সে এই মেয়েটাকে গোপনে বিয়ে করেছে?

ফাহিম বললো
-“মাহাদ তুই এমন করলে ডক্টররা তাদের কাজ করতে পারবে না।তুই কি দৃশ্যকে সুস্থ দেখতে চাস না।তাহলে শান্ত হো।তোর দৃশ্য ঠিক হয়ে যাবে দেখিস?”

মাহাদ ফ্লোরে বসে পড়লো।দুই হাতে চুল খামচে চিৎকার করে কাদতে লাগলো।এমন কেনো হচ্ছে তাদের সাথে?এই মেয়েটা আর কত কষ্ট সহ্য করবে?আপনজনদের ধারা মেয়েটা কতো কষ্ট পেয়েছে।আবার এমনটা কেনো হলো।আজ দৃশ্যর কিছু হলে সে মরেই যাবে।এই মেয়েটা যে তার প্রাণ।রবিন মাহাদের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে।তার নিজেরই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মাহাদকে সে কখনো এমন ভাবে দেখেনি। মাহাদ চিৎকার করে কাদছে।ফাহিম মাহাদের চিৎকার দেখে নিজেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।রবিন মাহিম কে কল করে সবটা জানালো।

বেশ কিছুক্ষন পর ডক্টর ওটি থেকে বেরিয়ে আসলে মাহাদ আর ফাহিম দৌড়ে আসে। মাহাদ অস্থির হয়ে বলে

-“ডক্টর আমার দৃশ্য কেমন আছে?”

-“দেখুন রোগীর অবস্থা তেমন একটা ভালো না।মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছে।প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে।সমস্যা হচ্ছে ব্রেনে ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে।সেটা বন্ধ না হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর আঘাত পেয়েছে।এছাড়া ডানপা ফ্র্যাকচার হয়েছে।আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি বাকিটা আল্লাহর হাতে।”

ডক্টরের কথা শুনে মাহাদ আর ফাহিম স্তব্ধ হয়ে পড়ে। মাহাদ অস্থির হয়ে বলতে শুরু করে
-“ওর কিছু হবে না।আপনি কিছু করুন ডক্টর।আমাকে ওর কাছে যেতে দিন।আমি একটা বার ওকে দেখবো।”

ডক্টর বললেন
-“এখন সম্ভব না।”

মাহাদ হঠাৎ ডক্টরের পায়ে পড়ে গেলো।আর বলতে লাগলো
-“ডক্টর প্লিজ।আমি দূর থেকে একটু দেখবো।ওকে এক্ষনি না দেখলে আমি মরেই যাবো।প্লিজ ডক্টর একটা বার আমার পিচ্চিকে দেখতে দিন।”

ডক্টর ভীষণ অবাক হলো মাহাদের পাগলামি দেখে।সে নিজেও মাহাদে অনেক বড় ফ্যান।তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েটার সাথে মাহাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।তিনি মাহাদকে পাঁচ মিনিটের জন্য দৃশ্যর কাছে যাওয়ার পারমিশন দিলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here