#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১২
ফজরের নামাজের পর মনটা এমনিতেই স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায়। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টা সবচেয়ে বেশি প্রশান্তিময়। আজও তাজ ভাইয়ের ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। উনি দরজার বাইরে থেকেই ডেকে গেছেন। আমি আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম। অলি আর জেমির ঘুমন্ত মুখটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলাম। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কানের দুল আর একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কানের দুল দুটো হাতে নিলাম। গতকাল রাতে মেলায় যেই দুল দুটো আমার পছন্দ হয়েছিল এগুলো সেগুলোই। কিন্তু এগুলো তো আমি কিনিনি। এখানে এল কীভাবে? কাগজটা হাতে নিয়ে দ্রুত ভাঁজ খুলে ফেললাম। কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে দুই লাইনের চিরকুট চোখে পড়ল। তাতে লেখা,
“পছন্দের জিনিসগুলো কাছে পেয়েও হাতছাড়া করতে নেই। এসব জিনিস সবসময় নিজের কাছে রেখে দিতে হয়। বুঝতে শিখো বনলতা।”
লেখাটা পড়ে আমি আরও অবাক হলাম। হাতের লেখাটা খুব সুন্দর। আবার আমাকে বনলতা বলে সম্বোধন করেছে! চিরকুট যে লিখেছে তার মনটা খুব সুন্দর বলতে হবে। কিন্তু এটা কার কাজ? আফরা আপু? না, সে তো মেলায় সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিল। তাহলে? তাজ ভাই? উনি কেন দিবেন? শয়তানটা তো আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। তাহলে বাকি থাকে শ্রেয়ান ভাইয়া। হ্যাঁ, তার মানে এটা শ্রেয়ান ভাইয়ার কাজ। কিন্তু উনি নক না করে আমার রুমে ঢুকেছেন? তাও আবার রাতের বেলায়! এটাও তো বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া আমাকে এটা দেয়ার হলে তো মেলাতেই দিতে পারত। এভাবে দেয়ার কী আছে? আশ্চর্য! দুল জোড়া পেয়ে বেশ খুশিই লাগছে। কিন্তু গিফটদাতাকে খুঁজে না পেলে শান্তি পাব না। এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে তাই কানের দুল আর কাগজটা আবার রেখে দিলাম। অজু করে এসে নামাজ আদায় করলাম। আজ আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না তাই আবার শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখটা লেগে এল। তারপর ছোটো কাকির ডাকে যখন চোখ খুললাম তখন সকাল নয়টা বাজে। ছোটো কাকির ভাষ্যমতে সে এর আগেও দুবার আমাকে ডেকে গেছেন। কিন্তু আমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরোনোর সময় কানের দুল দুটোর কথা মনে পড়ল। গিফটদাতাকে খুঁজে পাওয়ার একটা উপায় খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ভাবার পর পেয়েও গেলাম। আমার কানের দুল দুটো কান থেকে খুলে রেখে দিয়ে ওই দুল দুটো পড়লাম। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলে দাদুমনি, আফরা আপু, শ্রেয়ান ভাইয়া, তাজ ভাই আর অলি বসে খাচ্ছে। বাবা আর কাকারা বোধ হয় আগেই খেয়েছে। আমাকে দেখে মেজো কাকি খেতে ডাকল। আমি গিয়ে দাদুমনির পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া মিষ্টি হেসে বললেন,“গুড মর্নিং ইলোমিলো।”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“গুড মর্নিং। বাট ইলোমিলো কী?”
উনি বললেন,“আমি ঠিক করেছি তোমাকে এই নামেই ডাকব। আপত্তি আছে?”
আমি হেসে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,“নাহ্।”
আফরা আপু খেতে খেতে বলল,“তবে নামটা কিন্তু সুন্দর দিয়েছেন ভাইয়া।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“মানুষ যেমন নামও তেমন। তবে মানুষটার তুলনায় নামটা কিছুই না।”
আমি হাসলাম। আফরা আপু আর দাদুমনি ভ্রু বাঁকিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকাল। তাজ ভাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল। মনটাও অস্থির হয়ে উঠল। উনি দিব্যি বসে বসে একহাতে ফোন চাপছেন আরেক হাতে খাবার খাচ্ছেন। আশেপাশের কোনো কথাই যেন তার কানে ঢুকছে না। খেতে খেতে হঠাৎ আফরা আপু বলে উঠল,“ইলো, এই দুল না তুই রেখে এলি? তাহলে তোর কানে এল কীভাবে?”
আমি চোখ তুলে তাকালাম। বুঝলাম আফরা আপু এটা দেয়নি। শ্রেয়ান ভাইয়াও বললেন,“তাই তো। কখন কিনলে আবার?”
তার মানে শ্রেয়ান ভাইয়াও দেয়নি। বাকি থাকে একজন। আমি অবাক হয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। আফরা আপু আবার জিজ্ঞেস করল,“কিরে? বলছিস না যে?”
আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই বলে উঠলেন,“না কিনলে কি উড়ে এসে কানে জুড়ে বসেছে? এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে? কিনবে না বলেও হয়তো কিনে ফেলেছে। পিচ্চি মানুষ, মনের ঠিক নেই।”
আমি আহাম্মক বনে গেলাম। আমি কখন কিনলাম! তবে ওনার বলা মিথ্যা কথাটাই প্রমাণ করে দিলো যে উনিই গিফটদাতা। চিরকুটে উনি আমাকে ‘বনলতা’ বলে সম্বোধন করেছেন, আবার ‘তুমি’ বলেছেন! এটাও কি সম্ভব? এসব স্বপ্ন না-কি সত্যি! আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে উনি ওই চিরকুটটা লিখেছেন। এভাবে গিফট দেয়ার মানে কী? আমার হঠাৎ কাশি উঠে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। আমি ওনার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলাম। দাদুমনি বললেন,“আস্তে খা বইন।”
কেউ আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করলাম। আজ আবার তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া কোথাও একটা চলে গেলেন। আমার সন্দেহ জাগল যে ওনারা বাইরে ঘুরতে যান না। নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যান। ছোটো কাকা অলিকে স্কুলে দিতে গেলেন। আফরা আপুও নিজের রুমে চলে গেল। জেমিকে কোলে নিয়ে আমি দাদুমনির সাথে বসে গল্প করতে লাগলাম। দাদুমনির সাথে গল্প করার মজাই আলাদা। সে সবসময় তার জীবনের হাসিখুশি মুহূর্তগুলোর কথা বলে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। দাদুমনির ছোটো বেলার গল্প শুনলে আমি খুব আনন্দ পাই। কত হাসিখুশি ছেলেবেলা ছিল তার! সেসব শুনলে আমার নিজের জন্য আফসোস হয়। তার সাথে গল্প করলে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনিতেই কেটে যায়। আজও তাই হলো। গল্প করতে করতে দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেল। আমি রুমে গিয়ে আগে জেমিকে গোসল করালাম। ওকে গোসল করাতে গেলে আমার ঘাম ছুটে যায়। পানি দেখলেই ওর লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। জোর করে ধরে গোসল করাতে হয়। ওকে রুমে রেখে আমিও গোসল সারলাম। ততক্ষণে যোহরের আজানও দিয়ে দিয়েছে। আমি নামাজ পড়ে আবার রুম থেকে বের হলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া এখনও বাসায় ফেরেনি। বাবা আর মেজো কাকা বসে কথা বলছেন। আমি গিয়ে বাবার পাশে বসলাম। বাবা আমাকে বলল,“তাজরা তো এখনও ফিরল না। একটু ফোন করে দেখ তো। আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ।”
বাবাকে তো আর বলতে পারব না যে আমি ফোন করব না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাজ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করলাম। পর পর কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল। তারপর আবার ফোন করলাম। তাও কেটে গেল। আমি বাবাকে বললাম,“উনি তো ফোন ধরছে না।”
মেজো কাকা বললেন,“দুই বন্ধু হয়তো ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত। থাক, এসেই তো পড়বে।”
আমি ভাবছি ওনারা বাইরে গিয়ে এত সময় পর্যন্ত কী করে। বাবাকে গতরাতের বিষয়টা বলব? না থাক। নিজেই তো ভালোভাবে কিছু জানি না। নিজে নিশ্চিত না হয়ে কাউকে বলা ঠিক হবে না। শুধু শুধু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। ছোটো কাকি সবাইকে খেতে ডাকল। একে একে সবাই গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেও দেখলাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া এখনও আসেননি। এবার আমি একটু বেশিই অবাক হলাম। কী এমন কাজ যে সারাদিন বাড়ি ফিরতে পারেনি? আসরের আরও কিছু পর আফরা আপু আমাকে পাকড়াও করে তার রুমে নিয়ে গেল। আমাকে বলল তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে। মূলত তাজ ভাইকে ইমপ্রেস করার জন্যই সে শাড়ি পরবে। আমি বললাম,“আপু, আমি তো আর সবসময় তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে পারব না। এক কাজ করো, তুমি আজ শাড়ি পরা শিখে নাও। তাহলে এরপর থেকে যখন ইচ্ছে নিজে নিজেই পরতে পারবে।”
আপু একটু ভেবে বলল,“এটা ঠিক বলেছিস। তাহলে তুই আমাকে শিখিয়ে দে, আমি নিজে নিজে পরার চেষ্টা করি। ওয়েট, আরেকটা শাড়ি আনছি।”
আপু তার আলমারি থেকে আরেকটা শাড়ি বের করে আমার হাতে দিলো। আপুর হাতের শাড়িটা পিংক কালার আর আমারটা হোয়াইট। আমি নিজে পরতে পরতে আপুকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম কীভাবে পরতে হয়। আপুও আমারটা দেখে দেখে পরতে লাগল। আমারটা তাড়াতাড়ি পরা হয়ে গেলেও আপুর অনেকক্ষণ লেগে গেল। আপু উৎফুল্ল হয়ে বলল,“ওয়াও! এখন থেকে নিজে নিজে পরার চেষ্টা করব। আমি তো শাড়ি পরিই না। দু একবার যা পরেছি তাও মা পরিয়ে দিয়েছিল। এখন থেকে মাঝে মাঝে পরতে পারব।”
আমি হেসে বললাম,“তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে আপু।”
আপু আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,“তোকেও খুব কিউট লাগছে। সাদা শাড়িতে তোকে খুব মানায়।”
আমি হাসলাম। এই কথাটা আমি বাবার মুখেও অনেকবার শুনেছি। আফরা আপু বলল,“শাড়ি তো পরলাম। তাজ ভাইয়া তো এখনও বাড়িই ফিরল না। এখন কী করব?”
আমি বললাম,“চলো ছাদে যাই। গল্প করতে করতে সময় কেটে যাবে।”
“হ্যাঁ, এটা ভালো বলেছিস। চল।”
“একটু ওয়েট করো। আমি শাড়িটা চেঞ্জ করে নেই।”
আফরা আপু বাঁধা দিয়ে বলল,“এই না। পরে চেঞ্জ করিস। বললাম না তোকে খুব সুন্দর লাগছে?”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,“গরম লাগছে তো।”
আফরা আপু আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,“ছাদে গেলে গরম লাগবে না।”
ছাদের সিঁড়ি অবধি পৌঁছনোর আগেই পড়লাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সামনে। আফরা আপু তাজ ভাইকে দেখে লাজুক হেসে বলল,“আপনাদের এতক্ষণে ফেরার সময় হলো? বাড়ির সবাই কত টেনশন করছে জানেন? ফোনও তো ধরেননি।”
তাজ ভাই বললেন,“আমাদের এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। একসাথে সময় কাটাতে গিয়ে বিকাল হয়ে গেছে। আমি বড়ো মামাকে পরে ফোন করে বলেছিলাম।”
আফরা আপু অবাক হয়ে বলল,“এখানে আপনাদের ফ্রেন্ড এল কোত্থেকে?”
আফরা আপুর প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেল শ্রেয়ান ভাইয়ার কথায়। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললেন,“মা শা আল্লাহ্ ইলোমিলো। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। সাদা শাড়িতে একদম পুতুল পুতুল লাগছে।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
তাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে বলল,“হঠাৎ শাড়ি পড়ার কী হলো তোদের? ঐ পিচ্চি, তোকে যে সকিনার মতো লাগছে তা কি জানিস?”
তাজ ভাইয়ের কথায় শ্রেয়ান ভাইয়া আর আফরা আপু হেসে উঠল। আমি শক্ত মুখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“আপনাকে তাকাতে বলেছে কে? প্রশংসা করতে হিংসা লাগে?”
“যা সত্যি তাই তো বললাম। আজকাল সত্যি কথা বললেও দোষ?”
আমার রাগ উঠে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“এই তাজ, শুধু শুধু মেয়েটাকে খেপাচ্ছিস কেন? ইলোমিলো, ওর কথায় রাগ কোরো না তো। তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে।”
আফরা আপু গদগদ কন্ঠে তাজ ভাইকে প্রশ্ন করল,“ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”
তাজ ভাই একনজর আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,“ভালো।”
এরইমধ্যে ছোটো কাকি সেখানে এসে বলল,“তাজ, তোমরা গোসল সেরে এসো যাও। আমি চা করছি।”
তাজ ভাইয়া হেসে বললেন,“আচ্ছা মামি।”
কাকি রান্নাঘরের দিকে যেতে নিতেই আফরা আপু বলে উঠল,“কাকি, আমি চা বানাচ্ছি।”
কাকি অবাক দৃষ্টিতে আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। যে মেয়েকে জোর করেও রান্নাঘরে ঢুকানো যায় না, সে কি না আজ তাজ ভাইয়ের জন্য ইচ্ছে করে রান্নাঘরে যেতে চাইছে! আপুর মাথাটা একদম গেছে। আফরা আপু রান্নাঘরে চলে গেল। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াও গোসল করতে চলে গেলেন। আমি আফরা আপুর সাথে রান্নাঘরে যেতে গিয়েও থেমে গেলাম। কিছু একটা ভেবে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে গেলাম। রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকছেন আর তাজ ভাই বিছানায় সটান শুয়ে আছেন। বুঝলাম শ্রেয়ান ভাইয়া গোসল করে বের হলে উনি ঢুকবেন। শ্রেয়ান ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকানোর সাথে সাথে আমি রুমে ঢুকলাম। ধীর পায়ে তাজ ভাইয়ের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওনাকে ডাকতে কেমন যেন লাগছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তাজ ভাই বলে উঠলেন,“কিছু বলবি?”
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। উনি তো এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন। তাহলে বুঝলেন কী করে আমি এসেছি? আমি বললাম,“একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”
উনি চোখ না খুলেই বললেন,“শুনছি, বল।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,“দুল দুটো আপনি দিয়েছেন?”
উনি না জানার ভান করে বললেন,“কিসের দুল?”
আমি এবার কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,“ঢং করছেন? গতকাল আমি যেই কানের দুল পছন্দ করেছিলাম সেগুলো তো আমি কিনিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের ওপর এই কানের দুল আর একটা চিঠি পেয়েছি আমি।”
উনি একটু নড়েচড়ে বললেন,“তো?”
ওনার খাপছাড়া কথায় মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম,“আমি নিশ্চিত, কাল রাতে আপনি এগুলো রেখে এসেছেন।”
এবার উনি চোখ খুলে তাকালেন। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“আমার অত ঠেকা পড়েনি যে আমি টাকা খরচ করে তোকে তোর পছন্দের দুল কিনে দিব। তা-ও আবার লুকিয়ে। আজাইরা বকবক করিস না কানের কাছে।”
“তাহলে কি এসব উড়ে উড়ে চলে এসেছে আমার রুমে?”
“তা দুলকেই জিজ্ঞেস কর।”
“আপনি মিথ্যা কথা কেন বলছেন? গিফট দেওয়ার হলে এমন লুকিয়ে দেওয়ার কী আছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“এই পিচ্চি, এত বেশি বুঝতে চাস কেন? গিফট যখন পেয়েছিস তা নিয়ে খুশি থাক।”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“নিব না আমি এসব। আপনার জিনিস আপনিই রাখুন।”
কথাটা বলেই আমি কান থেকে দুল খুলতে লাগলাম। উনি চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন,“খুলছিস কেন? বললাম না আমি দেইনি?”
আমি ততক্ষণে দুল দুটো খুলে ওনার এক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,“আমি সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি।”
ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই শাড়ির আঁচলে টান পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রচন্ড রাগও উঠে গেল। তেজ নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই তাজ ভাইয়ের মুখটা দেখে মিইয়ে গেলাম। চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। মনে হচ্ছে পারলে এখনই আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। আমি হাত দুটো কচলাতে কচলাতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওনার হাতের মুঠোয় আমার শাড়ির আঁচল ধরা। উনি ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু শয়তানটা তো আঁচল ছাড়ছেই না। কানের লতিতে ওনার হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল। উনি আমার দুই কানে আবার দুল দুটো পরিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ আমার চুলের খোঁপাটা খুলে ফেললেন। আমার চুলগুলো অবাধ্যের মতো মুখে-পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। উনি আমার মুখের ওপর পড়া চুলগুলো ঠেলে পেছনে দিয়ে দিলেন। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সরে দাঁড়ালাম। উনি আমার শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে বললেন,“ফেরত নেওয়ার জন্য তাজওয়ার কাউকে কিছু দেয় না।”
ওনার কথাটা কানে গেলেও আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালাম না। এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আফরা আপু আমাকে দেখে বলল,“এই ইলো, আমি চা করেছি। এখন কি রুমে দিয়ে আসব?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,“তোমার ইচ্ছা।”
আপু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,“রুমেই দিয়ে আসি। তুই বস, আমি আসছি।”
আমি ঘাড় কাত করে সোফায় বসে পড়লাম। তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তাজ ভাই গোসল করে বের হলেই আবার ওনার সামনে পড়তে হবে। কিন্তু এখন আর আমি ওনার সামনে পড়তে চাই না।
চলবে…………………….?