তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:১১

0
457

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১১

কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে। এই প্রতিভাটা সবার মধ্যে থাকে না। খুব মিশুক মানুষরাই এটা খুব সহজে করতে পারে। শ্রেয়ান ভাইয়া এমনই একজন মানুষ। এসে হতে সে আমাদের সবার সাথে এত এত গল্প করেছে যে তার বায়োডাটাও মুখস্থ হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই তাকে একদম আপন করে নিয়েছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া বাইরে গেলেন। অলি যেতে চাইলেও তারা কেউ সাথে নিতে রাজি হলেন না। উল্টো অলিকে বুঝাল কাল ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। তারাও তো ঘুরতেই যাচ্ছে। অলিকে সাথে নিলে কী ক্ষতি হত? আফরা আপু, অলি আর আমি বাড়ির উঠানে পাটি বিছিয়ে পেয়ারা খাচ্ছি আর গল্প করছি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল সকালের কথা। তাজ ভাইয়ের ঐ বন্ধুও গ্রামে বেড়াতে এসেছে আবার এখন শ্রেয়ান ভাইয়াও। কেন জানি এই ব্যাপারটা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে। তবু ব্যাপরটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। আফরা আপু হঠাৎ বলল,“এই ইলো, শ্রেয়ান ভাইয়া দেখতে কেমন রে?”

আমি বললাম,“কেন? আমি কি ওনাকে একা দেখেছি না-কি? তুমিও তো দেখলে।”

“আরে তোর কাছে কেমন লাগে?”

“অবশ্যই ভালো লাগে। ওয়েট, এখন এটা বলো না যে শ্রেয়ান ভাইয়াকেও তোমার‌ পছন্দ হয়েছে।”

আফরা আপু শব্দ করে হেসে বলল,“আরে না। আমার জন্য তো তাজ ভাইয়া আছেই। আমি ভাবছি শ্রেয়ান ভাইয়াকে তোর সাথে খুব মানাবে।”

আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“কী বলতে চাইছো?”

আফরা আপু হেসে বলল,“শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে প্রেম কর। ”

“পাগল হয়েছ? দরকার নেই আমার।”

“আরে ভেবে দেখ না। উনি কিন্তু তাজ ভাইয়ার থেকে কম যায় না।”

আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়ার অতীত সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না বলেই এসব বলছো।”

আফরা আপু প্রশ্ন করল,“কিসের অতীত?”

“পরে বলব। এখন বলো তাজ ভাইকে ইমপ্রেস করার ব্যাপারে কী ভাবলে?”

“তেমন কিছু না। আমার মাথায় কিছু আসছে না। তুই ঠিক কর না।”

আমি মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর আফরা আপুর সাথে এ বিষয়ে কিছু সময় আলোচনা করলাম। তখনই আমাদের পাশ দিয়ে বাবা হেঁটে যেতে যেতে বলল,“আফরাকে এবার ধরে বেঁধে আমাদের বাসায় নিয়ে যেও আম্মা। সারা দিন-রাত এমন আড্ডা দিতে পারবে।”

আফরা আপু হেসে বলল,“ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে না কাকা। আমি নিজেই যাব।”

আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। যে মেয়েকে জোর করেও আমাদের বাসায় নিতে পারলাম না সে কি না এখন নিজের ইচ্ছেয় যাবে! কারণটা অবশ্যই তাজ ভাই। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম,“বাবা, পেয়ারা খাবে?”

বাবা বাড়ি থেকে বের হতে হতেই উত্তর দিলো,“না আম্মা। তোমরা খাও।”

আফরা আপু আর আমি মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ঢুকলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া বাড়ি ফিরল এশার পরে। প্রতিবার গ্রামে এসে রাতের বেলায় গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে খুব ভালো লাগে আমার। সাথে বাবাও থাকে। আমি গিয়ে বাবাকে বললাম,“ও বাবা, চলো না ঘুরে আসি।”

বাবা সোফায় হেলান দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বলল,“এখন আমার শরীরটা ভালো লাগছে না আম্মা। কাল সকালে নিয়ে যাব।”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আমার তো এখন যেতে ইচ্ছে করছে।”

পাশ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,“চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,“সত্যি?”

শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বলল,“হ্যাঁ।‌ যাও রেডি হয়ে এসো।”

বাবা বলল,“যাবে যাও, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবে।”

আমি ঘাড় কাত করে আফরা আপু আর অলিকে নিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। রেডি হয়ে এসে দেখলাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াও রেডি। আমি তাজ ভাইকে প্রশ্ন করলাম,“আপনিও যাবেন?”

তাজ ভাই বললেন,“আমার অত শখ নেই তোদের সাথে ঘুরঘুর করার।‌ শ্রেয়ান বলেছে বলেই যাচ্ছি।”

শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“হ্যাঁ, ওকে ছাড়া যাব না-কি?”

আমার ঘোরার যে বারোটা বাজতে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। এই শয়তানটা থাকতে আবার আমাকে শান্তি দিবে! বড়োদের বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।‌ তাজ ভাই গাড়ি নিতে চাইলেও আমি রাজি হলাম না। আমি বললাম রিকশা নিয়ে ঘুরব। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে কিছুদূর হেঁটে এসে আমরা দুইটা রিকশা নিলাম। আমি, আফরা আপু আর অলি একটা রিকশায় উঠলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া আরেকটায় উঠল। জোৎস্না রাত হওয়ায় আমি মুগ্ধ হয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। একটা বড়ো মাঠের পাশে এসে আমরা রিকশা থামালাম। কারণ সেখানে অনেক মানুষের ভিড় আর অনেক দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। আফরা আপু বলল,“আজ মনে হয় এখানে মেলা বসেছে।”

আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। সাধারণত আমি যখন গ্রামে আসি তখন মেলা হয় না। তাই একটু বেশিই খুশি হলাম। আমি ভেতরে যেতে চাইলাম। তাজ ভাই এবার আর আপত্তি করলেন না। আমরা সবাই মেলার ভেতরে গেলাম। মাঠের একপাশে সব খাবারের দোকান আরেকপাশে বিভিন্ন রকমের দোকান। গ্রামের মানুষজন একেকটা দোকানে ভিড় করে আছে। আমরা প্রথমে খাবারের দোকানের দিকে গেলাম। আমি আগেই বলে উঠলাম,“ফুসকা খাব।”

তাজ ভাই চোখ পাকিয়ে বললেন,“এসব বাজে খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার কোনো দরকার নেই।”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“আপনি তো আর খাবেন না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে তো খাব। আপনার কী?”

উনি আবার বললেন,“বললাম না দরকার নেই।”

আফরা আপু গোমড়া মুখে বলল,“এমন করছেন কেন ভাইয়া? কিছু হবে না। খাই না?”

তাজ ভাই একইভাবে বলল,“না, বাইরের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত না।”

আমি গাল ফুলিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে বললেন,“আরে তাজ, না করিস না তো। কিচ্ছু হবে না। কারণ ওদের তো এসব খাওয়ার অভ্যাস আছে।”

তাজ ভাই বলল,“হ্যাঁ, তুই তো ওদের সাপোর্ট করবিই। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুইও মেয়েদের মতো এসব পেটপুরে খাস।”

শ্রেয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,“দোস্ত, তুই জাস্ট একবার খেয়ে দেখ। তারপর তুইও আমার মতো হয়ে যাবি।”

আমি খুশি হয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, ওনাকে বাদ দিন। চলুন আমরা খাই।”

শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বলল,“ওকে চলো।”

তাজ ভাই আর আমাদের বাঁধা দিতে পারলেন না। মনে মনে আমি প্রচন্ড খুশি হলাম। আমরা ফুসকার দোকানে গেলাম। একটা লোক কাঁচে ঘেরা ভ্যান গাড়িতে ফুসকা বিক্রি করছেন। গাড়ির পাশেই কয়েকটা প্লাস্টিকের টুল। সেখানে বসেই সবাই ফুসকা খায়। আমরা গিয়ে টুলে বসে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া চার প্লেট ফুসকা অর্ডার করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুসকা ওয়ালা আমাদের সবার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিলেন। আমরা খেতে শুরু করলাম। তাজ ভাই একটা টুলে বসে ফোন চাপছেন। আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, ফুসকাটা দারুণ না?”

শ্রেয়ান ভাইয়া ফুসকা মুখে পুরে হেসে উপর নিচে মাথা দোলালেন। আফরা আপু তাজ ভাইকে বলল,“ভাইয়া, একটা খেয়ে দেখুন না? অনেক মজা।”

তাজ ভাই আপুর কথায় পাত্তাই দিলেন না। ভাব দেখলে ইচ্ছে করে পঁচা পানিতে চুবিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে। অলি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“ও ভাইয়া, তুমি না বোকা। এত মজার খাবার কেউ না খায়!”

আমি বললাম,“অলি, সবার মুখে ভালো খাবার রোচে না, বুঝলি?”

সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,“চুপচাপ খা। এগুলো ভালো খাবার? আসল ভালো খাবার তো খেতে ইচ্ছে করে না। এসব আজেবাজে খাবারই ভালো মনে হয়। বেয়াদব।”

আমি গাল ফুলিয়ে চুপচাপ ফুসকা শেষ করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের সবার বিল মিটিয়ে দিলেন। ফুসকার দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা মাঠের অন্যপাশে গেলাম। ঘুরে ঘুরে একেকটা দোকান দেখতে লাগলাম। আফরা আপু ইতোমধ্যে বিভিন্ন রকম কসমেটিকস কেনা শুরু করে দিয়েছে। সাথে অলিকেও কিনে দিচ্ছে। তাজ ভাই অলিকে কিছু খেলনা কিনে দিলো। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,“ইলোরা, তুমি তো কিছুই কিনলে না। বলো কী পছন্দ হয়, আমি কিনে দিচ্ছি।”

আমি হেসে বললাম,“না ভাইয়া, আমার কিছু লাগবে না। এমনিতেই আমি তেমন সাজগোজ করি না। কিছু কিনলে তা অযথা পড়ে থাকে।”

শ্রেয়ান ভাইয়া আমার বারণ না শুনে আমাকে খুব সুন্দর এক মুঠো কাঁচের চুড়ি কিনে দিলেন। আমি আর নাও করতে পারলাম না। দোকানে চোখ বুলাতে বুলাতে এক জোড়া কানের দুল আমার চোখ কেড়ে নিল। দুল দুটো একটু বেশিই সুন্দর। আমি সেগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখলাম। দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন,“নিবেন না-কি আপা?”

আমি হেসে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,“না মামা।”

“নেন না। আপনারে খুব মানাইব।”

“লাগবে না মামা।”

আফরা আপু বলল,“নে না। তোকে খুব মানাবে। আমি অলরেডি দুই জোড়া কিনে ফেলেছি, নইলে আমিই নিতাম।”

আমি বললাম,“না আপু। বাসায় যা আছে তাই তো পড়ে থাকে। অযথা কিনে ফেলে রাখব কী করতে?”

আরও কিছুক্ষণ আশেপাশের দোকান ঘোরাঘুরি করার পর অলি হঠাৎ তাজ ভাইয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,“ভাইয়া, আমি নাগরদোলায় চড়ব।”

তাজ ভাই বললেন,“না অলি, এখন আমাদের বাসায় ফিরতে হবে। রাত এগারোটা বেজে গেছে।”

অলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা মেলা থেকে বেরিয়ে এলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে, আফরা আপুকে আর অলিকে হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলেন। তাজ ভাইয়া দুইটা রিকশা দাঁড় করালেন। আমি একটা রিকশায় ওঠার সাথে সাথে তাজ ভাইও উঠে আমার পাশে বসে পড়লেন। আমি আর আফরা আপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তাজ ভাই এমন ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি। শ্রেয়ান ভাইয়া অন্য রিকশায় বসে বলল,“আফরা, তুমি অলিকে নিয়ে এটায় চলে এসো।”

আফরা আপু অলিকে নিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে অন্য রিকশায় উঠল। রিকশা চলতে শুরু করতেই আমি তাজ ভাইকে বললাম,“আপনি এটায় উঠলেন কেন?”

উনি বললেন,“আমার ইচ্ছে। তোর কোনো সমস্যা?”

“আপনি ঐ রিকশায় যান।”

“এখন রিকশা থামাব না।”

আমি কয়েকবার বলার পরও উনি একই কথা বললেন। আমি রিকশা ওয়ালাকে রিকশা থামানোর কথা বললেও উনি থামাতে দিলেন না। আমি গাল ফুলিয়ে রিকশার সিট আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম। সমস্যা হচ্ছে রিকশায় সচরাচর চড়া হয় না বলে আমি কখনও রিকশায় উঠলে পাশের জনের হাত ধরে রাখি। আমার শুধু মনে হয় এখনই বুঝি রিকশা থেকে পড়ে যাব। মনে মনে ভাবলাম এই লোকের সাথে গাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া যাবে না। হঠাৎ ডান হাতের বাহুতে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকালাম। দেখলাম তাজ ভাই আমাকে তার হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন। আমি হালকা নড়েচড়ে উঠতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“কী সমস্যা?”

আমি নিচু স্বরে বললাম,“হাত সরান।”

উনি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“তোর কী মনে হয়? আমি শখ করে তোকে ধরে রেখেছি? নিজেই তো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলি।”

আমি আমার বাঁ হাত দিয়ে ওনার হাত ঠেলে বললাম,“আমি ঠিক আছি। ছাড়ুন।”

উনি আমার বাঁ হাতের বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন,“একদম চুপ থাকবি। বকবক ছাড়া থাকতে পারিস না? বাঁচাল মেয়ে!”

আমি ওনার ওপর রাগ করতে পারলাম না। ওনার বুকের কাছে ঠেকে থাকায় আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। বারবার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। নেহালের পাশে বসেও আমি অনেকবার গল্প করেছি। কিন্তু তাতে যথেষ্ট দূরত্ব ছিল। এই প্রথম আমি কোনো ছেলের এতটা কাছে বসেছি। আমার কিছুটা অস্বস্তিও লাগছে। সারাটা রাস্তা আমি ওনার বুকের কাছে ঠেকে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। হঠাৎ করেই আমার মনে হচ্ছিল বাবা ছাড়াও আমাকে আগলে রাখার আরেকজন মানুষ আছে। বাড়ির সামনে রিকশা থামাতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে নেমে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে কারও অপেক্ষা না করেই গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। বাড়িতে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসতেই জেমি শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল। আমাকে দেখেই ও আমার কোলের মধ্যে বসে পড়ল। আমি কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। তারপর ওকে রেখে ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি অলি বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে। এতটুকু সময়ের মধ্যে ড্রেস চেঞ্জ করে এসে ঘুমায়েও পড়ল! আমি মৃদু হাসলাম। বিছানায় উঠে বসতেই প্রচুর পানি পিপাসা পেল। এখন পানি খেতে হলে বাইরে যেতে হবে। ধুর! বাইরে যেতে ইচ্ছেও করছে না এখন। তবু বিছানা থেকে নেমে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বাইরে গেলাম। ডায়নিং টেবিলের পাশে গিয়ে পানি খেলাম। বাড়ির সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সবার রুমের দরজা বন্ধ। আমি নিজের রুমে ফেরার সময় খেয়াল করলাম তাজ ভাইয়ের রুমের দরজা অর্ধেক খোলা। কৌতুহল বশত আমি এগিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে থেকেই ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখলাম তাজ ভাই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তার মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। শ্রেয়ান ভাইয়া চুপচাপ তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তখনই তাজ ভাইয়ের রাগত কন্ঠ কানে এল। উনি বললেন,“একটাকেও ছাড়ব না আমি। সামনে পেলে জানে মেরে ফেলব।”

আমার পিলে চমকে উঠল। এটা কী বললেন উনি! আমি চোখ বড়ো বড়ো করে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। শ্রেয়ান ভাইয়া পাশ থেকে তাজ ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,“মাথা গরম করিস না। শান্ত হ। এখন যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। কোনো ভুল করা চলবে না। আমি আছি তো। বি স্ট্রং।”

আমি দুহাতে মুখ চেপে ধরে দ্রুত সেখান থেকে সরে নিজের রুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম। এসব কী শুনে এলাম আমি! তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া কাউকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? তাজ ভাই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামে এসেছেন। আর শ্রেয়ান ভাইয়াও ওনার সাথে আছেন! ওনারা কাদেরকে পেলে মেরে ফেলবেন? আমার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু আমি কেন? ওনাদের দেখলে কেই বা বলবে ওনাদের মাথায় এমন জঘন্য বুদ্ধি ঘুরছে? তাজ ভাই তো আট বছর ধরে গ্রামেই আসেননি। তাহলে গ্রামে তার কোন শত্রু থাকতে পারে? চিন্তায় আর ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। খারাপ আশঙ্কায় মাথাটাও ধরে গেল। বুকের মধ্যে এখনও ধুকপুক করছে। আমি দ্রুত বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম। বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। অনেকক্ষণ এভাবে থেকেও চোখে একফোঁটা ঘুম এল না। বারবার তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার বলা কথাগুলোই মনে পড়ছে। চেষ্টা করেও সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। আমি অসহ্য হয়ে গেলাম। তবুও জোর করে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। তার অনেকক্ষণ পর দুচোখে ঘুম নেমে এল। আপাতত আমি এই সাংঘাতিক চিন্তা থেকে রেহাই পেলাম।

চলবে…………………..• >}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here