#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১০
সন্ধ্যার খানিক পরে রুমে বসে ফেসবুকিং করছিলাম। হঠাৎ তাজ ভাই রুমে এলেন। আমি ওনাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে ফোনে মগ্ন রইলাম। উনি বিছানায় এক পা তুলে আমার সামনে বসলেন। আমি ফোন থেকে চোখ তুলে ওনার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন করলেন,“কী করছিস?”
আমি বললাম,“নাচছি। কেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”
উনি আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“চল ওঠ।”
আমি প্রশ্ন করলাম,“কেন?”
“ছাদে যাব।”
“তো যান। আমি কী করব?”
“তুইও যাবি।”
“আমি কখন যাব বললাম?”
“তুই বলিসনি, আমি বলেছি। কারণ তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট।”
আমি বিরক্ত মুখে বললাম,“সবসময় এক কথা বলবেন না তো। আমি যাব না।”
“তোকে তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমি বলেছি তাই তুই যাবি।”
“বললাম না যাব না? আমার এখন ইচ্ছে করছে না। আপনার আরেকজন দরকার হলে আফরা আপুকে নিয়ে যান।”
কথাটা বলে নিজেই নিজেকে মনে মনে বকতে লাগলাম। কেন যে সবসময় এক লাইন বাড়িয়ে বলতে যাই আর বিপদে পড়ি। এখন যদি আবার চুড়ি চায়? আবার তো বলেছে সে বললেও যেন না খুলি। লোকটা আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। উনি আমার বাঁ হাতের কব্জি ধরে টেনে বিছানা থেকে নামাতেই আমি চোখ-মুখ কুঁচকে শব্দ করে উঠলাম,“আউচ।”
ওনার হাতের মুঠো থেকে আমি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। উনি ভ্রুকুটি করে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিঁলে যাওয়া অংশটুকু দেখে সেখানে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন,“ছিঁলে গেল কীভাবে?”
আমি ওনার হাতের ওপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে এনে রাগত কন্ঠে বললাম,“আপনি জেনে কী করবেন?”
উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম নিজে আমার হাতের এই অবস্থা করেছে ভেবেই হয়তো চলে গেছে। আমি আবার বিছানায় উঠে ফোন নিয়ে বসলাম। তখনই আবার তাজ ভাই রুমে এলেন। ওনার হাতে ফার্স্ট এইড বক্স। উনি আমার সামনে বসে আমার বাঁ হাতটা টেনে নিলেন। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,“ছাড়ুন, দরকার নেই এসবের।”
উনি আমার কথায় কানই দিলেন না। চুপচাপ হাতের ছিঁলে যাওয়া অংশটুকু স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলেন। কিছু সময়ের জন্য আমি নীরব দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাবা ছাড়া আমার এত যত্ন নেয়ার আর কেউ নেই। ওনার মুখে অনুশোচনা স্পষ্ট। হয়তো বেখেয়ালে আমার হাতের এই অবস্থা করায় ওনার এখন খারাপ লাগছে, কিন্তু মুখে প্রকাশ করছেন না। অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষ করে উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা আটকাতে আটকাতে প্রশ্ন করলেন,“একবারও অয়েন্টমেন্ট লাগাসনি?”
আমি ডানে বায়ে মাথা দোলালাম। উনি আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,“এত কেয়ারলেস কেন তুই? অকর্মা মেয়ে! আমি না লাগিয়ে দিলে তো নিজে আর লাগাতিও না।”
আমি থমথমে মুখে বললাম,“ডেভিল হাসবেন্ডদের মতো নিজে ব্যথা দিয়ে এখন দরদ দেখাতে এসেছে।”
উনি সুযোগ পেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,“তো তুই কি আমাকে হাসবেন্ড ভাবছিস না-কি?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম,“তা কখন বললাম?”
“বুঝি বুঝি, আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিস। এমন হ্যান্ডসাম একটা ছেলে চোখের সামনে থাকলে এমন হবারই কথা।”
“আপনাকে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না আমি। স্বপ্ন তো বাদই দিলাম। যেই না চেহারা।”
কথাটা বলে মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালাম। তারপর দুজনেই চুপচাপ। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেও বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন ওনার দিকে তাকাতেও অস্বস্তি লাগছে। তাই বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। উনি পেছন থেকে আমার ডান হাতটা ধরে আটকে দিলেন। আমি ওনার দিকে না তাকিয়েই বললাম,“হাত ধরলেন কেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। আমি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললাম,“ছাড়ুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
তবুও উনার উত্তর নেই। আমি এবার বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“কী হয়েছে আপনার? স্ট্যাচু হয়ে গেছেন?”
উনি বলে উঠলেন,“নেহালকে এখনও মনে পড়ে তোর?”
আমি একটু বেশিই অবাক হলাম। এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের কারণ খুঁজে পেলাম না। আমি অবাক হয়েই বললাম,“এখন এমন প্রশ্ন করার মানে কী?”
উনি আমার হাতটা ধরেই দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“চল, ছাদে যাব।”
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলেন না। ছাদের সিঁড়ি অবধি যেতেই সামনে পড়ল আফরা আপু। সে আমাদের দেখে প্রথমে খুশি হলেও পরে আমাদের হাতের দিকে তাকাতেই মুখটা কালো করে ফেলল। আমি আরও অস্বস্তিতে পড়লাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু শয়তানটা ছাড়ল না। আপু গোমড়া মুখে বলল,“ছাদে যাচ্ছিস?”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“হ্যাঁ আপু, তুমি যাবে?”
কথাটা আমি সুযোগ বুঝেই বললাম। আফরা আপু সাথে থাকলে শয়তানটা আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবে না। আপু তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“এভাবে হাত ধরে রেখেছেন, ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন না-কি ভাইয়া?”
তাজ ভাই বললেন,“ঘাড়ত্যাড়া হলে কী আর করব বল? ছাদে একা যেতে ইচ্ছে করছে না বলে ওকে ডাকলাম কিন্তু ও বেয়াদবের মতো না করে দিলো। সবাই তো আর তোর মতো ভদ্রতা জানে না। এ হচ্ছে উন্নতমানের ঘাড়ত্যাড়া।”
আফরা আপু মনে হচ্ছে একটু খুশি হয়েছে। তাজ ভাইয়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে তার মুখে হাসি ফুটেছে। আমি রাগত দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আফরা আপু গলে গিয়ে বলল,“ও যেতে চাইছিল না যেহেতু, তো আপনি আমাকে ডাকতেন।”
আমি বলে উঠলাম,“আপু, তাহলে তো ভালোই হয়েছে তুমি সামনে পড়েছো। তুমিই বরং তাজ ভাইয়ের সাথে ছাদে যাও, আমি যাব না। গরমে আমার মাথা ঘুরছে।”
আফরা আপু উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,“আচ্ছা, তুই যা।”
তাজ ভাই আমার হাত টেনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললেন,“ছাদে ফুরফুরে বাতাস আছে। ভালো লাগবে।”
ব্যাস, আমাকে জোর করে ছাদে নিয়ে গেলেন। ছাদে উঠে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আফরা আপুও আমাদের পেছন পেছন এসেছে। ছাদের একপাশে ফ্লোরে একটা পাটি বিছানো আছে। আমি গাল ফুলিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। তাজ ভাই আফরা আপুকে বললেন,“আফরা, এই মাথামোটাকে তো একটু ভদ্রতা শেখাতে পারিস। তোর ছোটো বোন তো। বড়োদের সম্মানটুকুও দিতে জানে না।”
আফরা আপু অবাক হয়ে বলল,“কী বলছেন ভাইয়া? ইলো তো সবাইকে কত সম্মান করে।”
“তাহলে আমার সাথে কী শত্রুতা?”
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,“নিজে সারাক্ষণ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে এখন আমার দোষ দিচ্ছেন? শয়তানের ফুপাতো ভাই।”
উনি বললেন,“একদম ঠিক বলেছিস। এতদিনে সত্যি কথাটা বুঝতে পেরেছিস। আমি তোর মতো আস্ত একটা শয়তানের ফুপাতো ভাই।”
আফরা আপু ফিক করে হেসে উঠল। আমি কটমট করে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আফরা আপু ওনার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে লাগল। প্রথমে একটু গম্ভীর গলায় বলল,“ভাইয়া, আপনি না-কি এ বছরই আবার সুইডেন ফিরে যাবেন?”
তাজ ভাই বললেন,“হ্যাঁ।”
“এসেছেন যখন দেশেই থেকে যান না।”
“দেশে থেকে কী করব? আমার ভাইয়া-ভাবি তো সুইডেন।”
“দেশে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করুন। তাহলে আর যেতে ইচ্ছে করবে না।”
কথাটা আফরা আপু খুব মিষ্টি কন্ঠে বলল। ইচ্ছে না থাকলেও আমি এবার তাজ ভাইয়ের কথা শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। অন্য দিকে তাকিয়েই কান খাড়া করে রাখলাম। তাজ ভাই মৃদু হেসে বললেন,“সুইডেনে এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে দেশে বিয়ে করব কেন?”
“দেশের কোনো মেয়েকে পছন্দ হয় না আপনার?”
আমি এবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনিও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন। ওনার হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না আমি। আফরা আপু হতাশ চাহনিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার জন্য আমার মায়া হলো। সে এই লোকটাকে আসলেই খুব পছন্দ করে। শয়তানটা বুঝেও না বুঝার ভান করছে। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“বিয়ে করলে আফরা আপুর মতো মেয়েকে করবেন বুঝলেন? আপুর মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন।”
আফরা আপু লাজুক হাসল। মনে মনে হয়তো খুশিতে আমাকে কয়েকটা চুমুও খেলো। তাজ ভাই একটু ভেবে বললেন,“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। দেখি আফরার মতো মেয়ে খুঁজে পাই কি না।”
আফরা আপু গদগদ কন্ঠে বলল,“একটু ভালোভাবে খুঁজলে আশেপাশেই পেয়ে যাবেন ভাইয়া।”
এবারও তাজ ভাই হাসলেন। উনি যে কোনোভাবেই আফরা আপুকে পাত্তা দিচ্ছেন না সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। আফরা আপু এসে আমার পাশে বসল। আমি তার সাথে গল্প করতে লাগলাম। তাজ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে তাতে ডুবে গেলেন। এশার আজান শুনে তাজ ভাই আমাদের ডেকে নিয়ে ছাদ থেকে চলে এলেন। উনি বাবার সাথে মসজিদে চলে গেলেন। আমিও আমার রুমে গিয়ে নামাজ পড়লাম। তারপর আফরা আপু আমার রুমে এসে বলল,“ইলো রে, প্লিজ তাজ ভাইকে একটু বুঝা না আমি ওনাকে কত পছন্দ করি।”
আমি বললাম,“বলেছিলাম তো আপু। উনি তো আমার কথা শুনছেনই না। আমার মনে হয় তোমারই বলা উচিত। হয়তোবা উনি চাইছেন তুমি নিজে ওনাকে প্রপোজ করো।”
আফরা আপু মন খারাপ করে বলল,“কিন্তু আমার তো সাহসই হয় না। ওনাকে দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। অন্য কোনো উপায় বের কর না।”
আমি একটু ভেবে বললাম,“এক কাজ করতে পারো। তুমি না ওনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করো। একবার না পারলে বারবার করবে। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।”
আফরা আপু লাফিয়ে উঠে বলল,“এটা ভালো বলেছিস। কী কী করব বল তো?”
“সেসব কাল থেকে ঠিক করব।”
“আচ্ছা। কাজ হলে তোকে আমি অবশ্যই ট্রিট দিবো দেখিস।”
আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। তবে মনে মনে ভাবলাম,“আপাতত এই তাজ নামক শয়তানটাকে আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে নাও তাতেই হবে।”
রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। আমি আর আফরা আপু সেদিকে দৌড় লাগালাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অলিকে নিয়ে রুমে চলে এলাম। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে নামাজ পড়ে আবার আম্মুর কবরস্থানের পাশে গেলাম। ইচ্ছে হলো একটু গ্রামের নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার। করলামও তাই। আশপাশটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। অনেকটা পথ চলে এসেছি। ভাবলাম এবার ফিরে যাওয়া যাক। সূর্য ভালোভাবেই উঠে গেছে। গ্রামের রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। কত লোক ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। আবার কেউ গরু নিয়ে মাঠে ছুটছে। আশেপাশের একটা মক্তব থেকে বাচ্চাদের কুরআন তেলাওয়াতের মধুর সুর ভেসে আসছে। গ্রামের সকালটার জবাব নেই। প্রশংসা করলেও বোধ হয় তা কম হয়ে যাবে। আমি উল্টো দিক ফিরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কয়েক পা এগোতেই একটা দৃশ্য দেখে আমি থেমে গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তার পাশের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে তাজ ভাই আর একটা লোক। লোকটাকে চিনতে আমার ভুল হলো না। কয়েকদিন আগে যেদিন মাঝরাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে তাজ ভাই বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন উনি এই লোকটার সাথেই চেঁচামেচি করেছিলেন। কিন্তু এই লোকটা এখানে কী করছে? আশ্চর্য! মনের ভেতর খটকা লাগল। গ্রামে আসার দিনই আমার মনে হয়েছিল উনি কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটাবেন। এখন আমি একদম নিশ্চিত যে কিছু একটা ঘটবে। লোকটার মাথায় কী চলছে আল্লাহ্ জানে। জিজ্ঞেস করলে তো জীবনেও বলবে না। মনে মনে আমার ভয়ও লাগছে। খারাপ কিছু যেন না হয়। আমার ভাবনার মাঝেই তাজ ভাই আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি চমকে ওনার দিকে তাকালাম। উনি দোকান থেকে বের হয়ে আমার কাছে এলেন। আমি নিজেকে নিজে বকতে লাগলাম। কী দরকার ছিল এখানে আহাম্মককের মতো দাঁড়িয়ে থাকার? উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,“এখানে কী করছিস তুই?”
আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম,“আমি হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসে পড়েছি। এখন বাড়ি ফিরছি।”
তারপর আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম,“ওই লোকটার ওপর না আপনি সেদিন রাতে চেঁচামেচি করলেন? উনি এখানে কী করছে?”
তাজ ভাই বললেন,“ও বেড়াতে এসেছে। আমি জানতাম না এই গ্রামে ওর আত্মীয় আছে। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।”
আমি বললাম,“ও। উনি কে? মানে সেদিন আপনার রাগ দেখে তো ভেবেছিলাম লোকটা হয়তো আপনার কোনো শত্রু হবে।”
উনি হেসে বললেন,“না। ও আমার এক ফ্রেন্ড।”
“তাহলে সেদিন ওমন ব্যবহার করলেন কেন?”
তাজ ভাই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন,“ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়েছে। তুই বাড়ি যা, আমি আসছি।”
উনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছেন না বুঝতে পেরে মাথা দুলিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট করলাম। তারপর অলির সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলাম। বাবা আর মেজো কাকা বাইরে কোথায় যেন গিয়েছে। ছোটো কাকা গোডাউনে গেছে মাল ভর্তি ট্রাক এসেছে তা দেখতে। মেজো কাকি আর ছোটো কাকি নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আফরা আপু আর দাদুমনি বসে বসে আমার আর অলির দুষ্টুমি দেখছে আর হাসছে। তাজ ভাইয়ের ডাকে দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। তাকাতেই আরেকদফা অবাক হলাম। তাজ ভাইয়ের সাথে তারই বয়সী একটা ছেলে। পরনে কালো জিন্স আর লাল শার্ট। তাজ ভাইয়ের থেকে ছেলেটা কিছুটা কম ফর্সা। তবে চেহারার গঠন দেখলে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে। ছেলেটার হাতে লাগেজ। তাজ ভাই ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। তারপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্যে করে হাসিমুখে দাদিকে দেখিয়ে বললেন,“এই হচ্ছে আমার নানুমনি।”
ছেলেটা নিচু হয়ে দাদুমনিকে সালাম করে বলল,“কেমন আছেন নানু?”
দাদুমনি হেসে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ভাই?”
ছেলেটা উত্তর দিলো,“ভালো আছি।”
অলি আর আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারাও আমার মতোই অবাক হয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই আপু ইশারায় প্রশ্ন করল,“এ আবার কে?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইশারায় বুঝালাম আমিও চিনি না। তাজ ভাই মেজো কাকি আর ছোটো কাকিকে ডাকল। ডাক শুনে তারা দুজনেই এল। তাজ ভাই কাকিদের সাথে ছেলেটার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এতে বুঝতে পারলাম আমি, অলি আর আফরা আপু ছাড়া সবাই চেনে ছেলেটাকে। ছোটো কাকি ছুটলেন নাস্তা রেডি করতে। তাজ ভাই এবার আফরা আপুকে দেখিয়ে বললেন,“এ হচ্ছে আমার মেজো মামার মেয়ে আফরা।”
ছেলেটা হাসিমুখে আফরা আপুর সাথে কুশল বিনিময় করল। তারপর অলির সাথেও পরিচিত হলো। আমি ভাবছি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আর আমার দিকে তো ফিরেও তাকাচ্ছে না। অবশেষে তাজ ভাই আমাকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বললেন,“এনাকে কি চিনিয়ে দিতে হবে না-কি আন্দাজ করে বুঝতে পারছিস?”
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। এমনভাবে বলছে যেন ছেলেটা আমাকে আরও আগে থেকেই চেনে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,“ইলোরা, রাইট?”
আমি এবার বেশ অবাক হলাম। আসলেই তো ছেলেটা আমাকে চেনে। কিন্তু কীভাবে? আমি তো একে জীবনেও দেখিনি। তাজ ভাই বললেন,“রাইট। কিন্তু ও তোকে চেনে না তাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।”
ছেলেটা হাসল। আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি কোথায়? আমি সত্যিই ওনাকে চিনি না।”
তাজ ভাই ছেলেটাকে বললেন,“শ্রেয়ান, পরিচয়টা তুই দিবি না আমি দিবো।”
আমি এবার বড়োসড় ঝটকা খেলাম। চোখ গোল গোল করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একপ্রকার উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলাম,“আপনি শ্রেয়ান ভাইয়া?”
শ্রেয়ান ভাইয়া হাসিমুখে উপর নিচে মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ।”
“সত্যি?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“ভাইয়া আপনি জানেন? আপনাকে দেখার কত ইচ্ছে ছিল আমার। হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“তাহলে তো এমন সারপ্রাইজের জন্য তাজ একটা থ্যাংকস পাওনা তোমার থেকে।”
তাজ ভাই বললেন,“একদম ঠিক।”
আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলাম। তারপর আবার শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,“ভাইয়া, আপনার না আরও দুদিন পর চট্টগ্রাম থেকে ফেরার কথা ছিল?”
“হ্যাঁ। আসলে ওখানে যে কাজে গিয়েছিলাম তা হয়ে গেছে তাই গতকাল রাতেই ঢাকা ফিরেছি। তাজ বলল গ্রামে চলে আসতে তাই চলে এলাম। একদম ভোরবেলা রওনা দিয়েছিলাম। আমি কিন্তু জানতাম না যে তুমি আমাকে দেখলে এমন সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। তবে তাজ তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই আমার আসার কথাটা জানায়নি।”
আমি হেসে আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে এখনও প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,“আপু, এ হচ্ছে তাজ ভাইয়ের স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড।”
এতক্ষণে আফরা আপু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে হাসল। মেজো কাকি শ্রেয়ান ভাইয়া আর তাজ ভাইকে বসতে বলল। তারা বসল। ছোটো কাকি ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। ওনারা দুজন খেতে শুরু করল। ইতোমধ্যেই আমি আর আফরা আপু শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছি। আমি ভাবতেও পারিনি উনি এতটা ফ্রি মাইন্ডেড। কী সুন্দর ফ্রেন্ডলি কথা বলেন সবার সাথে! এই এত সুন্দর একটা ছেলে কি না তাজ ভাইয়ের মতো এমন একটা বিপজ্জনক ছেলের বন্ধু! আমার তো বিশ্বাসই করতে ইচ্ছে করছে না।
চলবে………………..?