তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-২৫

0
2825

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

২৫.

ঐ মানুষটা এমন কেনো?দুদিন দেখা হয়নি।কষ্ট হচ্ছে না তার?নাকি সুহানাকে বাসায় পেয়ে আমার কথা ভুলে গেছে?তাহলে সেদিন ওসব বলার কি দরকার ছিলো?কি দরকার ছিলো আমাকে স্পেশাল ফিল করানোর?দুদিন হলো আরমানের সাথে দেখা হয় না।এ দুদিন বাধ্য হয়ে আমাকেও সিয়ামের সাথে যাতায়াত করতে হয়েছে।ভার্সিটি গিয়ে দেখি আরু আগেই চলে এসেছে,যাওয়ার সময় সোজা গাড়িতে উঠে চলে যায়।আচ্ছা,আরমানই তো ওকে ছাড়তে আর নিতে আসেন।তাহলে উনি দেখা করেন না কেনো?এভোয়েড করছেন আমাকে?কিন্তু কেনো?সিয়ামকে দেখে?নাকি সুহানা কিছু করেছে?ওটাকেও তো দেখি না।আরুকে কিছু বলতেও পারি না।অন্যান্যদিন উর্বি,মালু তো আরমান ভাইয়া,আরমান ভাইয়া করে ভার্সিটি মাথায় তোলে।দুইটা দিন যে মানুষটা আসলো না সেটা চোখে পরে না তোদের?

মন মেজাজ খারাপ করে আজ আগে আগে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকলাম,দেখবো আরু কার সাথে আসে।আজ যদি ওনাকে না পাই কাকতাড়ুয়াটাকে আর মনে করবো না,একদম ভুলে যাবো।যা খুশি করুক উনি।মনের কথা বলবেন না তো?বেশ!কিছুদিন পর যখন আব্বু বলে বসবে সিয়ামকে বিয়ে করতে,মানা করবো না তখন বুঝবেন।কিন্তু এমনটা হলে যে আমি বেচে থেকেও মরে যাবো!পারবো না ওনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে!ওনার সাথে যে নিজেকে জরিয়ে ফেলেছি আমি,আমার মন জানে।কতোটা চাই আমি ওনাকে!
ভার্সিটির গেইটের সামনে যেতেই অনেকটা ভীড় চোখে পরলো।সবাই একজোটে গোল হয়ে দাড়িয়ে কিছু দেখছে,যেনো সার্কাস এসেছে।সুহানা,আরমানের ভার্সিটিতে না আসা,সিয়ামের সাথে আসা নামক অসহ্যকর বস্তুগুলোর ভাবনা মাথায় নিয়ে পাশ কাটিয়ে সবার সাথে চলেই যাচ্ছিলাম।ঠিক তখনই কানে এলো,

-তোমাকে ছাড়া আমি বাচবো না রাকিব।নিজেকে শেষ করে দিবো আমি।

কথাটা শুনে আমি দাড়িয়ে পরলাম।ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা আমার চেয়ে অল্পবয়সী মেয়ে ডানহাতে ছুড়ি নিয়ে বামহাতের কব্জিতে ধরে আছে।সামনে একটা ছেলে বিরক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আবার একটু ভয়ও পাচ্ছে।বোঝাই যাচ্ছে ও যেতে চেয়েও পারছে না,বাধ্য হয়েই দাড়িয়ে আছে।মেয়েটা বললো,

-শোনো রাকিব।আমি তোমাকে ভালোবাসি।তো কি হয়েছে তুমি আমাকে নয়,অন্য কাউকে ভালোবাসো!ডাজেন্ট ম্যাটার!আই ওয়ান্ট ইউ এট এনি কষ্ট!সো ভালোয় ভালোয় বলছি।বি মাইন!নয়তো আমি সুইসাইড করবো।

মেয়েটার কথা শুনে প্রচন্ড রাগ উঠলো আমার।আশেপাশের লোকগুলো সার্কাসের মতো দেখে বেশ মজাই নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।কিন্তু আমার এসব কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে।এ কথা কি এর আগেও এভাবে কেউ বলেছে?আমি বলেছি?নাহ্!তা কখনোই হতে পারে না।তাহলে?কথাগুলো কে বলেছিলো?কবে বলেছিলো?কেনো?কাকে বলেছিলো?কোথা থেকে শুনেছি আমি?

-সে।সে ইট ড্যামিট!বলো রাকিব,বলো,ভালোবাসো তুমি আমাকে বলো।আদারওয়াইজ আই সোয়ার আমি…

বলে যেইনা হাতে ছুড়িটা লাগাতে যাবে,আমি দৌড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে ওটা কেড়ে নিলাম।মেয়েটা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।বাকি সব এখনো সেভাবে দাড়িয়েই তামাশা দেখছে।

-কি করছো তুমি এসব?

-আপনার কি?যান এখান থেকে।

-মানেহ?এসব করে কি প্রমান করতে চাও তুমি?

-হেই!ডোন্ট ইন্টারফেয়ার!দিন ওটা আমাকে এন্ড লিভ ফ্রম হেয়ার।

-না দেবো না।আর যাবোও না আমি এখান থেকে।এসব কি করছো টা কি তুমি?

-লিসেন, আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই।দিন ওটা।

ওই ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,

-না,দিবেন না আপু।এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে।গত এক সপ্তাহ হলো পিছনে পরে আমার।ভালোবাসি,ভালোবাসি করে পাকিয়ে রেখেছে একদম।কতোবার বলেছি আমি ভালোবাসি না ওকে।কিছুতেই মানে না।নির্ঘাত মেয়ে মানুষ বলে সম্মান করে এখনো কিছু বলি নি।আজ এমন নাটক শুরু করে দিয়েছে।

মেয়েটা বললো,

-এসব নাটক মনে হয় তোমার?

ছেলেটা সেভাবে বিরক্তি নিয়েই বললো,

-তা নয় তো কি?জোর করে ভালোবাসা হয় না।

-আমি জোর করেই আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবো তোমাকে।নইলে…

আমি মুখ খুললাম,

-তুমি এতোবড় একটা কথা বলার আগে একটাবারো তোমার মা বাবা,ফ্যামিলির কথা ভাবলে না?ভাবলে না এনন কিছু ঘটলে তারা কতটা কষ্ট পাবেন? তোমাকে বড় করছেন,পড়াশোনা করাচ্ছেন,কতোটা স্বাধীনতা দিয়েছেন,আর তুমি?

-আপনার জ্ঞান আপনার কাছেই রাখুন।আমাকে ছুড়িটা দিন।

-ওহ্!তারমানে তুমি ভেবেই নিয়েছো?

-হ্যাঁ।আই ওয়ান্ট হিম।অর আই উইল ডেফিনেটলি কিল মাইসেল্ফ!

-বেশ।ও বলে দিয়েছে ও তোমাকে ভালোবাসবে না,তুমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছো সুহসাইড করবেই,আমি কি করতে পারি?এখানে আটকালেও তোমাকে তো আর বডিগার্ডের মতো সবখানে পাহাড়া দিতে পারবো না।ডু হোয়াট ইউ ওয়ান্ট।

মেয়েটা হাসলো।শান্তভাবে বললাম,

-কিন্তু মনে রেখো।যেটা তুমি করতে চাচ্ছো,সেটা এমন কারো জন্য করলে যে অবহেলা ছাড়া কিছুই দেয়নি তোমাকে।এমন একজনের জন্য,তোমার কষ্টে যার এতোটুকো দুঃখ হয় না,এমন একজনের জন্য,তুমি চলে গেলেও যার এতোটুকো আক্ষেপ হবে না।

মেয়েটা এবার একটু থামলো।আমি একটা জোরে শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে বললাম,

-আল্লাহ তায়ালা আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলেছে।কেনো তোমাকে চায় না তার জন্য এতোবড় পাপ করবে তুমি?হয়তো উপর ওয়ালা তোমার জন্য আরো ভালো কিছু রেখেছেন।

মেয়েটার চোখমুখ দেখে মনে হলো ও অনুতপ্ত।আরো অনেক্ষন বোঝালাম ওকে।কিছুক্ষন পর ওই ছেলেটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলো,

-সরি।

ছেলেটা বললো,

-তুমি বুঝতে পেরেছো?

-হুম।আর জ্বালাবো না তোমাকে।

ওরা নিজেদের মধ্যে আরো কথা বলে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিলো। ভালো লাগছিলো।কিছুক্ষন দাড়িয়ে আমিও হাটা লাগালাম।ঘটনাটা সত্যিই চেনাচেনা লাগছে আমার।মাথা নিচু করে এসব ভাবতে ভাবতেই হাটছিলাম।আচমকা সামনে কিছুর সাথে ধাক্কায় হুশ ফিরলো আমার।বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম,

-রাস্তার মাঝে কাকতা…

মাথা তুলে তাকিয়ে সামনের মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।কান্না আসছিলো আমার।আরমান করুনভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।জলভরা চোখে আপদমস্তক দেখলাম তাকে।চেহারার এ কি হাল বানিয়েছেন উনি!শার্টের উপরের তিনটে বোতাম এলোমেলোভাবে লাগানো,কলারটাও ঠিকমতো বসে নি।চুলগুলো উশকোখুশকো,চোখজোড়া লাল,ফুলে আছে,চাপ দাড়িগুলো কিছুটা বড় হয়ে এলোমেলো হয়ে আছে,ঠোট শুকনো,কালো হয়ে আছে।না চাইতেও চোখের পানি গাল বেয়ে গরিয়ে পরতে থাকলো।

আরমান আমার হাত ধরলেন।আমি অভিমান দেখাতে একবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।ছাড়াতে তো পারলামই না,উল্টো আরো শক্তি দিয়ে হাত ধরেছে আরমান তাই অনুভব করলাম।উনি আমাকে টেনে সোজা কৃষ্ণচূড়ার তলায় নিয়ে আসলেন।আজও জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।গাছতলায় এসে আমার হাত ছেড়ে দাড়ালেন আরমান।আমি মাথা নিচু করে কাদছি।অভিমান!দুদিন দেখা হয়নি আমাদের।কষ্ট!ওনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?বেশ কিছুক্ষন পর আরমান বললেন,

-কাদছো কেনো?

আমি এবার জোরে হুহু করে কেদে দিলাম।আরমান একটু এগোতেই আমি চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম।ওনার জন্য কষ্ট পাচ্ছি,ওনাকে বুঝতে দেবো না তাই।আরমান পিছন থেকে হাত টেনে ধরলেন আমার।

-হাত ছাড়ুন।ক্লাস আছে আমার!

-তাই বুঝি?আরুর ক্লাস তো দেরিতে।তুমি এতো আগে কেনো?

চুপ করে গেলাম।কান্না থামানোর চেষ্টায় আছি।আরমান হেচকা টানে আমাকে সামনে দাড় করিয়ে দু হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

-গেইটের ঘটনাটা কি চেনাচেনা লেগেছে?

অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে।এইটা কি এখন বলার সময়?দু দিন কোথায় ছিলেন,কেনো আসেননি,কি হয়েছে,চেহারার এই অবস্থা কেনো কতশত কথা পরে রয়েছে আমার।সবটা মুখেই আটকে রইলো।উনি আবারো বললেন,

-বললে না?চেনা মনে হয়।

তখনো চুপ আমি।উনি বললেন,

-এভাবে চুপ করে থাকলে কথাও শেষ হবে না,যেতেও দেবো না বলে রাখলাম।

মাথা উপরে নিচে নাড়ালাম।

-কবে কার সাথে ঘটেছিলো মনে পরে নি?

আবারো ডানে বামে মাথা নেরে না বুঝালাম।আরমানের একটা দীর্ঘশ্বাস কানে এলো।উনি এগিয়ে এসে আমার গালে হাত রেখে বললেন,

-রাকিবের জায়গায় আমি ছিলাম মিথি।আর ওই মেয়েটার জায়গায় সুহানা ছিলো।এবার মনে করো তো।

একবার আরমানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আমি।মাথাটা ধরে চিন্তা করতে লাগলাম।আস্তে আস্তে মনে পরলো আমার।হ্যাঁ!সেদিন সুহানাই এমন করেছিলো।আরমান কড়া গলায় বলেছিলেন সে অন্য কাউকে ভালোবাসেন।সুহানা হাত কাটতে গেলে আরমান ওকে চড়ও মেরেছিলেন।এ সবটাই এই ভার্সিটিতেই ঘটেছিলো।

-মনে পরেছে?

মাথা নারিয়ে হ্যাঁ বললাম।
-গ্রেট!

এটা গ্রেট?নিজের এই অবস্থা কেনো বানিয়েছেন?কেনো আসেননি এ দু দিন আমার সামনে?ওনার হাতদুটো সরিয়ে পিছিয়ে দাড়ালাম আমি।

-কাজ ছিলো,এ নিয়ে ব্যস্ততায় আসিনি।প্রেশারে নিজের যত্নটাও হয়ে ওঠে নি।

তাই বলে এভাবে আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলেন?নিজের শরীরের কেউ এভাবে অযত্ন করে?

-হয়েছে হয়েছে।বউয়ের মতো এতো আমার শরীর নিয়ে ভাবতে হবে না।রাগটা একটু কমাও তো!মনে মনে না বলে মুখে বললেই তো আরো ভালোলাগে আমার।

চুপ করে রইলাম।উনি আবারো দু হাতে গাল ধরলেন আমার।বললেন,

-কথা বলবে না?
চাপা কষ্ট নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম।উনি একটু হেসে বললেন,

-অভিমান হয়েছে দু দিন আসি নি বলে?

আমি গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে অন্যদিক ঘুরে বুকে হাত গুজে দাড়ালাম।তখনো নিশব্দে কাদছিলাম।আরমান আমার হাত টেনে বুকে জাপটে ধরলেন।আমার কান্না বেড়ে গেলো আরো।শব্দ করে কাদছি আমি।উনি বললেন,

-কান্না বন্ধ করো।সহ্য হচ্ছে না।

সহ্য হচ্ছে না?কষ্ট দিতে পারেন,কান্না সহ্য করতে পারেন না?

-কষ্ট দিতে চাইনি।কান্না থামাও,বলছি।নইলে আমার মতো করে কান্না থামাবো।

ওইযে,আবারো মাইন্ড রিড আর থ্রেট।হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলাম ওনাকে।উনি হেসে বললেন,

-এক পাগলিকে ঘরে তুলবো সেই প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।তাই আসতে পারি নি।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম।পাগলিকে ঘরে তুলবে মানে?সুহানা পাগলের কথা বলছে?হ্যাঁ,ওই তো পাগল।অসম্ভবভাবে পাগলের মতোই তো আদিক্ষেতা দেখায় ওনার সাথে।ঘরে তুলবে মানে?বিয়ে করবে?

-এইতো দেখেছো?কতো ভুলভাল ভাবতে পারো তুমি।

রাগ হলো এবার আমার।বললাম,

-আপনার মাইন্ড রিডিং বন্ধ করুন।আমাকে আমার মতো থাকতে দিন,আপনি থাকুন আপনার পাগলি কে নিয়ে।আসছি আমি।

উনি আবারো আমার হাত আটকালেন।একটানে সামনে দাড় করিয়ে মুচকি হেসে আচমকা আমার কপালে ঠোট বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-এতো বেশি কেনো বোঝো তুমি?তাহলে এটা কেনো বোঝো না তুমি আমার জন্য কি?শুধু তোমাকে আপন করবো বলে আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছি,আর তুমি আছো ওই সুহানাকে নিয়ে! পার্মানেন্টলি কাছে নিয়ে আসতে চাই তোমাকে।এই সুহানাকে নিয়ে ভুলভাল বোঝা বাদ দাও।সিয়ামটাকেও ভুলে যাও।গেট রেডি টু বি মাইন।কজ ইউ আর মাইন,ওনলি মাইন।

কথাগুলো বলে আর একমুহুর্ত দাড়ালো না আরমান।লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন ওখান থেকে।আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি। আমার মাঝে ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন।আমাকে আমার কথাগুলোও বলতে দিলেন না।আপন করবেন আমাকে,পার্মানেন্টলি কাছে নিয়ে যাবেন আমাকে।এতোটা রহস্য কেনো ওনার মাঝে?

গাড়িতে বসে আদিবকে কল লাগালো আরমান।
-হ্যালো?কোনো খোজ পেলি আদিব?

….

-গুড!আজকেও থাকবে ও ওখানে।যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে।আর আমি জানি,ও ওনাকে কালকেই নিয়ে আসবে।সো কালকের জন্য সবটা গুছিয়ে রাখতে হবে।

…..

-হ্যাঁ,আমি নিজে কনফার্ম করবো তা।তুই চিন্তা করিস না।

ফোনটা রেখে হাসলো আরমান।গত দু দিনে ইচ্ছা করেই ভার্সিটি আসে নি ও।মাহবুব আলম যে কাগজগুলো আরমানকে দেওয়ার পর ওর কথা রেখেছে কি না সেটা পরখ করতে মিথির উপর নজর রাখবেন তা জানতো আরমান।এজন্যই প্রথমদিন সুহানাকে সেইম ড্রেস পরিয়ে সিয়ামের চোখে ধুলো দিয়েছিলো।দু দিন আসবে না ভেবে ইচ্ছে করেই সেদিন ওতোটা সময় মিথিকে কাছে রেখেছিলো।দিন কেটেছে বাসায় ঘরের কোনে ফাইল চেক করতে আর সিগারেটের ধোয়ার সাথে কষ্টকে উড়ানোর বৃথা চেষ্টায়।যদিও রাত ঠিকই কেটেছে মিথিকে বুকে জরিয়ে।
‘ আমাদের মাঝে সব বাধার দেয়াল আমি গুরিয়ে দেবো মিথি।এইবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে।মাহবুব আলমকে আমি বুঝিয়ে দেবো আট বছর আগের ঘটনায় আমার কোনো দোষ ছিলো না।বুঝিয়ে দেবো,আমি কোনো অন্যায় কাজ করি নি,সবার ভালোর জন্যই কাজ করি।উনার সব ভুল ধারনাও এবার মিটিয়ে নেবো। ‘

আরমানের সাথে কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করছিলো আদিব।কলটা কেটে যেতেই রাস্তার পাশে রিয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো ও।অকারনেই গাড়িটা ব্রেক করে থামালো।অকারনে।কারন এর কারনটার নাম দিতে পারছে না ও।শুধু এটুকো জানে,রিয়াকে দেখলে ও কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে।সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে না অনেক চেষ্টাতেও।
রিয়া বেরিয়েছিলো ওর বাবার মেডিসিনের জন্য।সকালেই শেষ হয়ে গেছে ওগুলো।এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছিলো,কথা বলতে বলতে বেশ কিছুটা এগিয়েছে।অন্য রাস্তা দিয়ে ঢুকেছে ওরা।ও চলে গেছে কিন্তু রিয়া রিকশা পাচ্ছে না এখন আর।রাস্তাটাও একটু ফাকা।দুচারটে প্রাইভেট কার বেশ কিছুক্ষন পরপর যাচ্ছে শুধু,যে রিকশাগুলো আসছে সবগুলোতেই যাত্রী আছে।বিরক্তি নিয়ে দাড়িয়েই আছে ও।গাড়িটা থামিয়ে আদিব এগিয়ে গেলো।ওকে দেখেই হাটা লাগালো রিয়া।আদিব একটু থেমে গেলেও আবারো পা চালিয়ে ওর সামনে গিয়ে পথ আটকালো।মুহুর্তেই রাগে লাল হয়ে গেলো রিয়ার চোখমুখ।

-কি?কি‌ সমস্যা?

-তেমন কিছু না।আপনি এখানে?

-কেনো?

-এমনি জানতে চাইলাম।

-আপনার মতো লোককে কেনো বলবো বলুনতো?

-আমার মতো লোক মানে?দুদিন আগে উপকারই তো করলাম আপনার।

-তার কিছুদিন আগে কিডন্যাপ করেছিলেন।আমাকেও।আমার আব্বুকেও।

আদিব মাথা নিচু করে ফেললো।সত্যিই বলেছে ও।কারন আছে ওর রেগে থাকার।ওভাবেই বললো,

-সরি,আসলে সেদিন আরমান…

-থাক।ব্যাখা চাইনি আমি।যেতে দিন।

-রিয়া আমি সেদিন,,,
-আমার নাম আপনার মুখে মানায় না।রাস্তা ছাড়ুন।নইলে লোকজন জরো করবো।

রাগ হলো আদিবের।ও বোঝাতে এসেছিলো রিয়াকে,আরমান আর ওর কাজের ধরন আর কারন।এই একটা মানুষকে নিজের কাজ নিয়ে ব্যাখা দিতে চেয়েছিলো ও।আরমানকে বলেছিলো ওই।রিয়াকে বোঝালে ব্যাপারটা সহজ‌ হবে।আরমান মুচকি হেসে বলেছিলো তোর যা খুশি তাই কর।এজন্যই ও বলতে চেয়েছিলো।আর এই মেয়ে আত্মঅহংকার নিয়েই পরে আছে।সামনে থেকে সরে এসে গাড়িতে উঠে স্টেয়ারিংয়ে বারি মারলো ও।
রিয়া হাটা লাগিয়েছে।আদিবকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আনমনেই কোথায় কোন গলিতে ঢুকে পরেছে ও নিজেও জানে না।হঠাৎ কেউ ওর সাইডব্যাগটা টান মেরে দৌড় লাগালো।ব্যাগে মোবাইল,টাকা,বাবার প্রেসক্রিপশন সব ছিলো।চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,

-হেল্প,কেউ ধরুন ওই লোকটাকে।হাইজ্যাকার!

রিয়া চেচাচ্ছে।চারপাশে তাকিয়ে একটা কাকপক্ষিও চোখে পরলো না ওর।তার উপর জায়গাটাও অচেনা লাগছে।একদম ছোট একটা গলি।বাসাগুলো একতলাই বেশি।একটু পুরোনো গোছের শেওলা পরা দুটো বাসা।পাশে আরেকটা তিনতলা।গেইটে দাড়োয়ানও নাই।আরেকটু দুরে মোড়।সেটা বেরোনোর নাকি আরো ভেতরের আন্দাজে আসছে না রিয়ার।মোবাইলটাও নেই যে লোকেশন দেখবে বা কাউকে কল করবে।এবার কি হবে ওর?কিছুক্ষন দাড়িয়ে কপাল চাপড়ালো রিয়া।সব দোষ ওই লোকের!উনি না আসলেই আমি ওনাকে নিয়ে ভাবতাম না,এ রাস্তায় ঢুকতাম না।

জায়গাটার হদিস পেতে পাশের বাসার কলিংবেলে চাপ দিলো।একটা অল্পবয়স্ক ছেলে দরজা খুললো।ছেলেটাকে আপদমস্তক দেখে নাক ছিটকানো আসছিলো রিয়ার।চুলগুলো কালার করা,যাকে বলে উচ্চমাত্রায় কালারড্।কানে রিং।ভ্রুতে রিং।স্যান্ডেল গেন্জি আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরা।কেমন কেমন যেনো চাওনি।দাড়িয়েও থাকতে পারছে না,ঢলে পরছে।ভেতর থেকে একবার আর্তনাতের আওয়াজ আসলো।বেশ ভয় পেলো রিয়া।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে পেলো না।চলে আসবে ছেলেটা তখনি ওর হাত ধরে ফেললো।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে রিয়া।হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

-হাত ধরেছেন কেনো?ছাড়ুন।

-আরে মামনি,দরজা খোলালে,ভেতরে আসবে না?

-না,ছাড়ুন আমার হাত।
ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো,

-কে এসেছে রে?
ছেলেটা আরেকহাতে ঠোটের নিচটা ঘষে রিয়াকে পা থেকে মাথা দেখে বাকা হেসে বললো,

-হোম ডেলিভারিড ওয়াইন ব্রো।

ভেতরে তিন ছাড়টা ছেলের উল্লাসের আওয়াজ শুনতে পেলো রিয়া।ওর শ্বাস আটকে গেছে।যেচে এতোবড় বিপদে পরেছে ও।হাত ছাড়াতে পারছে না,চিৎকার করেছে,শোনার কেউ নেই।কি করবে ও।ছেলেটা রিয়াকে টেনে ভেতরে নিয়ে যাবে তখনই,

-ওটা ওয়াইন না,ওয়াইফ! আমার বউ ওটা ব্রো।

বিস্ফোরিতো চোখে পিছন ফিরে তাকালো রিয়া।আদিব পকেটে দুহাত গুজে পায়ের আঙুলের উপর একবার ভর দিচ্ছে,তো পাতার উপর।যেনো নাচ আসছে ওর।নিচে পায়ের ওর সাইডব্যাগটা ঝুলছে।ফিতা হাতে ধরে হাত পকেটে পুরেছে আদিব।ওকে দেখেই ছেলেটা রিয়ার হাত ছেড়ে দিলো।আদিব এগিয়ে এসে বললো,

-আর বলিও না ছোটোভাই,নতুন নতুন বিয়ে করলাম,ফ্লাট নিলাম।সারপ্রাইজ সাজিয়ে বললাম যাও অমুক বাসা।আমি আসছি।এ এসে তোমার দরজায় নক করলো!

রিয়া শুধু আশ্চর্য হয়ে শুনছে।ছেলেটা চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে আছে।আদিবের আগমন ভালো লাগে নি ওর।দরজাটা লাগাবে আদিব হাত দিয়ে আটকে বললো,

-ভাই এ মেয়ে মানুষ মানেই ত্যাড়ামি।গোলকধাধা।অবশ্য খারাপ নাম দাও নি তুমি।ওয়াইন!এদেরকে ওয়াইনের মতো তালগোল পাকাতেই বেশি দেখা যায়।

রিয়া রেগে চলে আসছিলো।আদিব হাত আটকালো ওর।শক্ত করে ধরে রেখেই ছেলেটাকে বললো,

-তা ব্রো,তোমার ঘরে কয়টা ওয়াইন?

ছেলেটা চমকে উঠে দরজা লাগাতে উঠে পরে লাগলো।আদিব এক লাথি মারলো দরজাটাতে।আওয়াজ শুনে আরো দুটো ছেলে আসলো।পেছন পেছন একটা ষোলো সতেরো বছরের মেয়ে।ওর জামার নানা জায়গায় ছেড়া।রিয়া তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে বিছানার চাদর দিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলো।তিনটে ছেলের একটার কলার ধরলো আদিব,আরেকটাকে একঘুষিতে মেঝেতে ফেলেছে।আরেকটা ধাক্কিয়ে বেরিয়ে গেছে।

আদিব টেনে হিচড়ে দুটোকেই বাইরে বের করলো।এরমধ্যে লোকজন জরো হয়ে গেছে ওখানে।রিয়া মেয়েটার কাছে সবটা শুনলো।ছেলেগুলোর একটা ওর বয়ফ্রেন্ড।বাসা থেকে জানাজানির পর ওকে মানা করেছিলো,তবুও ওই জেদ করে কথা বলতো ছেলেটার সাথে।রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে ছিলো ওর সাথে। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো কোনোভাবে,তারপর জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে বদ্ধ রুমে বয়ফ্রেন্ডসহ আরো দুটো ছেলের সাথে দেখতে পায়।সম্রহননের চেষ্টা করেছিলো ওরা ওর।তখনি রিয়া ডোরবেলটা বাজায়।
আদিব ছেলেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটার দিকে এগোলো।ছেলেগুলোকে অন্য লোকজন ধরে রেখেছে।রাগী গলায় মেয়েটাকে বললো,

-চড় তোমারো প্রাপ্য ছিলো।কি এমন বয়স তোমার?এই বয়সে কিসের প্রেম?কিসের বয়ফ্রেন্ড?কিসের এতো বিশ্বাস?আমি না এলে কি হতে পারতো তোমার ধারনা আছে?বুঝতে পারছো?আর জেদ?এতো জেদ কেনো হবে তোমাদের মেয়েদের?বোঝার চেষ্টাই করো না জেদের বসে ভুল করে,ভুল বোঝো।রাগ দেখিয়ে যে নিজের ক্ষতিটাই করতে চলো,তার দায় নিতে চাওনা।মানতেও চাওনা।হোয়াই?

মেয়েটা চুপ।রিয়াকে উদ্দেশ্য করে রাগ আর জেদের কথাটা ওর বুঝতে বাকি রইলো না।আদিব ওর বাসার নাম্বার নিয়ে কথা বলে আসতে বললো।পুলিশে কল করে ছেলে দুটোকেও ধরিয়ে দিলো।লোকজনগুলোর মধ্যে একজন বললো,

-আপনারা কারা?আগে দেখিনি তো আপনাদের এদিকে!

আদিব রিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বললো,

-দরজা জানালা লাগিয়ে বাসাকে কবরের মতো করে না রাখলে ঠিকই দেখতেন।কি করে আপনাদের এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে,আর আপনারা কিছুই জানেন না?

-আসলে ঐটা ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসা।ওনারা তো বিদেশে থাকেন।ওনার বাসায় এনন কিছু হবে তা আমাদের ধারনার বাইরে।

-কি থেকে কি হয়েছে তা পুলিশ দেখবে।কিন্তু আপনারা আপনাদের সামাজিক দায়িত্বকে এড়াতে পারেন না।আজ ওই‌ মেয়েটার সাথে রিয়ারও…

রিয়ার দিকে তাকিয়ে আদিব চুপ করে গেলো।একজন মহিলা বলে উঠলো,

-মেয়েটা কপাল করে বর পেয়েছে।কতো ভালোবাসে ওকে।ওর জন্য আজ আরেকটা মেয়েরও জীবন বাচলো।

কথাটা রিয়ার কানে গেলো।কি বলবে ও বুঝে উঠতে পারলো না।আদিব রিয়ার সাইড ব্যাগটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-জেদ আর রাগের পাশাপাশি নিজেকে আর নিজের জিনিসগুলোকে সামলে রাখতে শিখতে হয়।

কথাটা বলে হাটা লাগালো আদিব।ওর হাটা দেখেই ও বুঝেছিলো রিয়া আনমনে হাটছে,রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে এটাও দেখেছে।গাড়ি ছেড়ে তাই পায়ে হেটে ওকে ফলো করছিলো।রিয়া ব্যাগটা নিয়ে গেলে ও অন্যগলি দিয়ে দৌড় লাগিয়ে ধরে ফেলে ছিনতাইকারীটাকে।ফিরে এসে দেখে একটা ছেলে রিয়ার হাত ধরে আছে।বুঝতে সমস্যা হয়নি ওর উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো।রিয়া তব্দা মেরে দাড়িয়েছিলো।লোকটাকে বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকভাবে দেখলো ও।যদিও জানে,কি থেকে কি হয়েছে,তবুও স্বীকার করবে না ও নিজের দোষ।এক মহিলা এগিয়ে এসে বললো,

-কি গো?বর যে চলে যাচ্ছে!একা একা দাড়িয়ে থেকো না।এগোও এবার।রাস্তাঘাট আসলেই ভালো না।যা দিনকাল পরেছে!

বর কথাটা শুনে চমকে উঠলো রিয়া।বলবে ভেবেও বলা হলো না ওর,বর নয় উনি আমার।গলাতেই আটকে রইলো কথাটা।যাই হয়ে থাকুক,আজ লোকটা বাচিয়েছে ওকে।আগেরদিনও হেল্প করেছিলো।ধন্যবাদ জানানোই যায় এজন্য।দৌড়ে এগিয়ে আর আদিবকে খুজে পেলো না ও।মন খারাপ করে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে লোকেশন দেখে নিলো।কিছুটা এগিয়ে বড় রাস্তায় এসে বাসার জন্য রিকশা নিলো ও।

আরমানের কথা শুনে একরাশ উচ্ছাস নিয়ে ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরলাম।দু দিনে যাই হয়ে থাকুক না কেনো,সে বলেছে,আমাকে নিজের করে নিবে।এতোটুকো সন্দেহ নেই আমার আর ঐ মানুষটা ভালোবাসে আমাকে।সে বলেছে,আব্বুর অনুমতিতেই আপন করবে আমাকে।চোখে মুখে এতোটা খুশির জোয়ার আরু,উর্বি,মালু,রায়হান সবাই খেয়াল করেছে আমি জানি।কিন্তু একটা কথাও বলেনি।ঠোট টিপে চুপচাপ হেসে ইগ্নোর করেছে।যেনো সবটাই স্বাভাবিক,এমনটাই হওয়ার কথা।আড়চোখে ওদের রিয়্যাকশন দু একবার দেখলেও কথা বাড়াইনি আমি,ওতে আমারই মঙ্গল।সবটা ঠিকমতো হলে,আরমান যখন চাইবেন সবাইকে জানানো যাবে।
কিন্তু আমরা যা ভাবি,তেমনটা হয় না।সময় আর পরিবেশ সবটা মুহুর্তেই পাল্টে দেয়।বাসায় ফিরে যা দেখলাম তাতে ছোট ছোট করে গুছিয়ে যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম তা অঙ্কুরেই নষ্ট যাবে এমনটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।হয়তো সম্ভব হলো না,ভালোলাগার মানুষটার সাথে স্বপ্ন গোছানোর।

#চলবে…

®ু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here