#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৭০ (অন্তিম পর্ব)
(২৩৬)
কী থেকে কী হয়ে গেলো,কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা।সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করে চলেছে মেয়েটা।এইতো,একটা বছর আগেও কতটা সুন্দর ছিলো জীবন,হাসি-খুশি ছিলো পরিবারটা।কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এমন কিছু হবে।কথায় আছেনা,“অতিসুখ সয় না সবার কপালে।” এখানেও তাই হয়েছে,বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে ওর,কান্না করার শক্তিটুকু নেই।আস্তে আস্তে কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে সরে এসে কবরের মাটি ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করেই কেঁপে উঠে,এখনে যে ওর জীবনের একটা অংশ অন্ধকারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।আর কখনো পাবেনা তাকে দেখতে, না পাবে তাকে ছুঁতে।কত স্বপ্ন ছিলো ওকে ঘিরে সব এক দমকা ঝড়ো হাওয়ার সাথে শেষ হয়ে গেলো,পারলো না নিজের দ্বায়িত্ব রক্ষা করতে।মাটির উপর হাত বুলায় আর নিজের মনে কথাগুলো আওড়াতে থাকে।ভাবতে থাকে অতীতের কথাগুলো____
দুইমাসে ইয়ারাবী পুরোভাবে সুস্থ হয়ে যায়, নিয়মিত ক্লাস করা শুরু করে।এর মধ্যে মেঘ আর আবীর এসে মিসেস রায়হানকে নিয়ে যান।বাচ্চারা ছোট,তাড়াছা পড়াশোনার অনেক গ্যাপ যাওয়ার কারণে আবরার বাংলাদেশে এই মূহুর্তে যেতে চাইনা।যতক্ষণ আবরার আর ইয়ারাবী বাড়ির বাইরে থাকে বাচ্চাদেরকে এনা আর মিয়ো মিলে সামলায়,সাথে তো চেলসি- ইনি-মিনি আছেই।ইয়ারাবী ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই এক বিন্দু দেরী না করে বাড়িতে চলে আসে, তারপর হালকা খেয়েই দুই বাচ্চাকে সামলাতে থাকে।বাচ্চারা বেশী কান্না করেনা,তবে যদি শুরু করে তার থামার নাম থাকেনা।আবার কান্নার ধরণটাও খুব ভিন্ন,একজন কান্না থামালে আরেকজন শুরু করে।অতটুকু বাচ্চারা কী বুঝে কে জানে?যদি আবরারকে দেখতে পায় তবে মায়ের কোলে থাকতেই চায়না।এইতো সেদিন ইয়ারাবী মেডিকেল থেকে এসে দেখে ইনি-মিনি বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে।ফ্রেস হয়ে এসে বাচ্চাদের কুসুম গরম পানিতে শরীরটা মুছিয়ে দিয়ে বেবী লোশন মাখিয়ে দেয়,তারপর ঠান্ডার জন্য গরম কাপড় পরিয়ে দেয়।বাবুদের খাইয়ে দিয়ে ওদেরকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে ঘুম পারাতে থাকে।কিন্তু ওরা ঘুমাবে কী,বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে চেয়ে হাত-পা নাড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসি দিচ্ছে।যে হাসি ওর মনে শান্তি বয়ে আনে,একটা মায়ের কাছে এই হাসির দাম যে কী তা অন্য কারোর বোঝার ক্ষমতা নেই সেই মা ব্যতীত।ইয়ারাবী ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বাম হাত দিয়ে ধরে মেয়েটাকে আদর করছে।নরম নরম গালে হাসলে টোল পরে,দুইটা যেন বাবার কার্বণ কপি,মনে হচ্ছে মুখ কেঁটে বাসানো হয়েছে।অনেকক্ষণ ধরে ওদের নানাভাবে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু সব বৃথা, ওদের হাসিই যেন বলে দিচ্ছে ‘মা আমরা ঘুমাবোনা,তাহলে তুমি কেন বৃথা চেষ্টা করছো।’তাই চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে ওদেরকে বিছানায় রেখে পাশে বসে বই পড়তে থাকে।ও যখন শব্দ করে বই পড়ে তখন বাচ্চারা খিলখিল করে হাসে,আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
তবে,ইয়ারাবীর মেয়েটা খুবই দুরন্ত হয়েছে। সারাদিনে যতটা সময় জেগে থাকে সব সময় হাত-পা ছুড়ে খেলতে থাকে। ওকে দেখে ছেলেটাও কপি করার চেষ্টা করে।ছেলে-মেয়ের কান্ড দেখে ইয়ারাবীর হাসি যেন থামতেই চায় না। আবরার হসপিটাল থেকে ফিরলেই ওদের সাথে এসে খেলা করে।দু’জনেই আবরাররে সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে।যদিও কিছুই বোঝা যায় না তবে ওদের এই অনর্থক শব্দগুলো যেন ইয়ারাবী আর আবরারের মনে প্রশান্তির জোয়ার আনে।মেয়েটা আবরারকে পেলে আর ছাড়তেই চায় না।বাবা অন্ত প্রাণ সে। ইয়ারাবী নিজের মেয়ের কান্ড দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় যে এতটুকু বাচ্চা কি করে এতকিছু বোঝে?ইয়ারাবী যতক্ষণ সময় পায় নিজের ছেলে-মেয়ের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করে। ওদের রেখে ওর সময় কাটে বিষাদময়। নিজের ছেলে-মেয়েকে চোখের আড়াল করে না ইয়ারাবী। মাঝে মাঝে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। পরক্ষণে নিজেই উঠে নজর টিকা লাগিয়ে দেয় যাতে ওর ছেলে-মেয়ের নজর না লাগে,যদিও নজর টিকা মানতে চাইনা তবুও বাচ্চাদেরকে দিয়ে দেয়।এখনও তার ব্যাতিক্রম হয়না,বেড থেকে উঠে কালো কাজলের একটা টিকা লাগিয়ে দেয় দুইজনকে।এর মধ্যে মিনি ঘরে প্রবেশ করে এক লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে আয়েশার পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।আর আয়েশা মনে হচ্ছে বারবার মিনির বড় ব্রাউন রঙের লেজটা ধরার চেষ্টা করছে।মিনি যখন লেজটা নাড়াচ্ছে তখন আয়েশা চুপ করে সেটা দেখছে মাঝে মাঝে হাসি দিয়ে দুই হাত উঁচু করছে।ইয়ারাবীর মেয়ের কান্ড দেখে হেসে ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমার মামনি কী করছে?মিনি বুঝি লেজ ধরতে দিচ্ছেনা আপনাকে।কিন্তু আমার মামনি যে খুব সাহসী,এতো বড় মিনির লেজ ধরবে।”
মেয়েটা আ,উ করছে আর সাথে তো ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই আছে।ইয়ারাবী ওর কপালে কপাল ঠেকায়,ঠিক তখনি আবরার রুমে ঢুকে বলে উঠে,
-“আমার মেয়ে বলে কথা,সাহসি তো হতেই হবে।”
-“আমার না বুঝি?”
-“আমি কী বলেছি শুধু আমার,পাগলি।”
আবরার কথাটা বলে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় বাম হাত দিয়ে।ইয়ারাবী ওর ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে,ওর হাতে কিছু কাপড় আর খেলনার প্যাকেট।ইয়ারাবী ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“আজও বুঝি সব দুইটা করে এনেছেন?”
আবারর জিনিসগুলো কাউচের উপর রেখে গায়ের লং কোটটা খুলতে খুলতে বলে,
-“বেবী দুইটা,তাহলে দুইটা করে আনবো সেটাই স্বাভাবিক।”
-“বেবীরা এখনো কিছু বোঝে যে আপনি সব দুইটা এনেছেন।”
-“সুইটহার্ট,ওরা যখন বড় হবে তখন দেখাতে হবেনা ওদের।শোনো,ওই নীল প্যাকেটের মধ্যে তোমার মেডিসিন আছে,দুঃখীত উইলিয়ামের কাছে আগে পাঠাবো সেটা মনে ছিলোনা।”
ইয়ারাবী এক হাত দিয়ে বাচ্চাকে ধরে আরেক হাত দিয়ে কোট কাবার্ডে রাখতে রাখতে বলে,
-“খুব ব্যাস্ত মনে হচ্ছে কয়েকদিন?”
-“হামম,আজকাল টিনেজার ছেলে-মেয়েরা বেশি ড্রাগ এডিক্টেড,ডিপ্রেশন,এমন এমন সব কাজ করে যার পরিনতি খুব ভয়াবহ।আজ দুইটা পেসেন্ট এসেছিলো আর তাদের দুইজনের বয়সই আঠারোর কম।একজন এতটাই ডিপ্রেশনের শিকার যে মানসিক রোগীর মতো আচারণ করছে, আরেকজন ড্রাগ এডিক্টেড।”
-“ও,ল্যাবে যাননি মনে হয়।”
-“না,বিকালে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন আর যেতে ইচ্ছা করছেনা।ফ্রেস হয়ে এসে কথা বলছি…”
আবরার চলে যেতেই ইয়ারাবী আয়েশাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে প্যাকেটগুলো দেখতে থাকে।বেবীদের জন্য তিনটা করে ড্রেস এনেছে আর সাথে ইয়ারাবীর জন্যেও।ওর পাগলামিতে হেসে উঠে ইয়ারাবী,রোজ কিছু না কিছু নিয়ে আসবে হাতে করে।হঠাৎ করে ওর ফোনে একটা কল আসে,ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ‘জে’ অক্ষর ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে।ও ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে ম্যাসেজ অপসনে এসে বাংলায় টাইপ করে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয় অপর ব্যাক্তিকে,তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বালিশের উপর ফোনটা রেখে উঠে যেয়ে কিছু মেডিসিন নিয়ে দেয়।ঠিক তখনি ইব্রাহিম কেঁদে উঠে,ও দ্রুত যেয়ে ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে চুপ করাতে থাকে।কিন্তু ইব্রাহিম গলা ফাঁটিয়ে কান্না করছে,ইয়ারাবী ওকে নিয়ে হাঁটছে, খাওয়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছেনা।আবরার ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইব্রাহিমকে কোলে নিতেই কিছুক্ষণ পরে শান্ত করে যায়,কিন্তু এ শান্ত হতেই আয়েশার গলা ফাঁটানো চিৎকার শুরু হয়ে যায়।ইয়ারাবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কোলে নিন,তাহলে চুপ হবে।”
আবরার হেসে বাম হাত দিয়ে ছেলেকে নিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়।ব্যাস দুইজনের এখন শান্ত,মনেই হচ্ছেনা ওরা গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে পারে।দুই জনেই বাবার কোলে হাসছে,আবরারও রোজকার মতো বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে আর ইয়ারাবী বিছানায় বসে এসব দেখতে থাকে।এভাবে আরে কয়েকমাস অতিবাহিত হয়,বাচ্চারা এখন বসতে পারে।তেমন একটা ভালো ভাবে নয়,তবে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারে কোনো কিছুর সাথে পিঠ ঠেকিয়ে।তবে আয়েশার নিয়ে ইয়ারাবীর যত ভয়,কোলে উঠে বা বসে থাকলা মাঝে মাঝে অনেক জোরে ঝুল দেয়।এতো সেদিন ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এনাকে দুধ গরম করার জন্য পাঠিয়ে দেয়।তারপর ইব্রাহিমকে নিয়ে কিছুক্ষণ রুমের ভিতর হাঁটাহাঁটি করছে আর আয়েশার দিকে খেয়াল করছে।ঠিক তখনি আয়েশা হাতের বলটা বিছানা থেকে নিচে ফেলে নিয়ে ঝুঁক দিতে যায়।এটা দেখেই ইয়ারাবীর জান চমকে উঠে,তবে ও ধরার আগেই চেলসি আয়েশার জামা কামড়ে ওকে আটকে রাখে।সে যাত্রায় আয়েশা বেঁচে যায়।ওদের মুখে ভাতও লন্ডনে করতে হয়েছে,অনুষ্ঠানে ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির পরিবারসহ,তারা,রোজ,ইমন আর মি.ফুয়াদও এসেছেন।ওর মা আসতে পারেনি কাগজপত্র নেই বলে।ধরতে গেলে ইয়ারাবীর ওর পরিবারের সাথে তেমন সম্পর্ক ঠিক না হলেও এখন একটু কথা বলে,হাজার হোক জন্মদাতা পিতা-মাতা।যখন বাচ্চাদের এগারো মাস বয়স,তখন এক সন্ধ্যায় ওরা মিনি সুইমিংপুলের পাশে বসে আছে।ইয়ারাবী ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে ফুল দেখাচ্ছে, আর আবরার মেয়ের সাথে গল্প করছে।তখনি আয়েশা ছটফট করে মায়ের কাছে যাওয়া জন্য, ইয়ারাবী ওকে নেওয়ার হাত বাড়ানোর সাথে আয়েশা মা বলে ডেকে উঠে।প্রথমে ওর কাছে মনে হয়েছি মনের ভুল,কেননা ওদের এতোদিন নাম ধরে ডাকলে আ উ ই করেই সারা দিতো।তাছাড়া অনেকদিন ধরে ইয়ারাবী আম্মি-পাপা,দাদু-দাদা, নানা-নানু শিখিয়েছে কিন্তু ওরা কিছু বলেনি।তাই ওর বিশ্বাস হচ্ছিলোনা,কিন্তু আবরার বলে সত্যিই মা বলে ডেকেছে।ওইদিন থেকে ইব্রাহিম আর আয়েশা শুধু মা,মা করে ডাকে।বাবুদের এক বছর পরার দুইদিন আগেই ওরা বাংলাদেশে এসেছে ইয়ারাবীর জোড়াজুড়িতে।ওরা বাড়িতে পৌঁছালে সবাই বাচ্চাদের কোলে নিতে চায় কিন্তু বাচ্চারা কারোর কাছে যেতে চাইনা।অনেক কষ্টে ইয়ারাবী ওদের বুঝিয়ে সবার কাছে দেয়,জারবা তো বাবুদের পেয়ে খাওয়া-দাওয়া ভুলে খেলতে লেগে যায়।এদিকে আবীরের বাচ্চা দুইটাও ফুপুর সাথে মিলে বাবুদের ছাড়তেই চাইনা।দেখতে দেখতে বাচ্চাদের জন্মদিন চলে আসে,ওরা ঘটা করে জন্মদিন পালন করেনা।বরং সেই টাকা মাদ্রাসা আর এতিমখানায় দিয়ে দেয়।সারাদিন অনেক আনন্দে কেঁটে যায়,কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি কাল তাদের ভাগ্যে কী লেখা আছে?
পরদিন সকালে ইয়ারাবী বাবুদের খাইয়ে দিয়ে নিচে নেমে শ্বাশুড়ি,জায়ের সাথে কথা বলতে আসে।ঠিক তখনি আবরার মেঘের সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকে প্রথমে মায়ের সাথে কথা বলে ইয়ারাবীর দিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ন্যানসির কল ছিলো,পরীক্ষার মাত্র তিন সপ্তাহ বাকী।তোমার ছুটির জন্য যা করতে হয়েছে,এখন বুঝো ঠেলা।আসতে চাইছিলাম না বাট্ তোমার জন্য আসতে হলো।”
-“আপনি এভাবে বলছেন কেন?”
-“তো কীভাবে বলবো?”
মিসেস রায়হান ছেলেকে একটা তাড়া মেরে বলেন,
-“বাদর ছেলে,বৌকে কেন বকছিস?এবারে না ঈদে আসতে পেরেছে না কোরবানিতে,আর আছেই বা কারা ওখানে।যারা আছে সবাই ইংরেজদের বংশধর,কথায় কথায় ইংরেজি।আর তোর ফুপুও সেই বাড়িতে ঠিকমত থাকেনা।ওর তো মন চাই বেড়াতে।”
-“মম্ তোমার বৌ আর নাতি-নাতনিকে নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই বের হই বুঝলে,সুতরাং এই অভিযোগ মানতে পারছিনা।”
-“আর পরিবার?”
-“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে মানলাম।ইয়ু বেবীরা কোথায়?”
ইয়ারাবী একটা বিস্কুট মুখে পুরো নিয়ে বলে,
-“খেলা করছে,ঘরেই আছে।”
-“আহনাফরা আছে তো?”
-“হ্যাঁ,চিন্তার করার দরকার নেই।আমি বালিশ আর কুশন দিয়ে ঘিরে রেখেছি,আর জারবা আমাদের ঘরে বসে পড়ছে।”
-“তাহলে ঠিক আছে।”
দুপুর পর্যন্ত সব ঠিক ঠাক চলছিলো কিন্তু খাবারের পরে যেয়ে ইয়ারাবীর বুকের ব্যাথাটা তীব্র হয়।এই কারণে আবরার ওকে ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলে।ইয়ারাবীও দুই বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে।বিকাল পাঁচটার দিকে ইব্রাহিমের কান্নার আওয়াজে ইয়ারাবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়।ঘুম থেকে উঠে ইব্রাহিম কোলে নিতেই ও চমকে উঠে,কেননা আয়েশার মুখের উপর ওর পাশে দিয়ে রাখা বালিশটা পরে আছে।ইয়ারাবী দ্রুত ছেলেকে রেখেই মেয়ের মুখের উপর থেকে বালিশ টান দিয়ে ফেলে গায়ে হাত রাখতেই স্তব্ধ হয়ে যায়।কেননা আয়েশার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা।ও মেয়েকে কোলে নিয়ে বারবার ডাকতে থাকে কিন্তু মেয়ে আজ তার মায়ের ডাকে সারা দেয়না।ইয়ারাবীর মেয়েকে চেক করে বুঝতে বাকী নেই যে ওর মেয়ে ওর কোলে খালি করে না ফেরার দেশে চলে গেছে।ও গগনবিদারী এক চিৎকার করে উঠে,সবাই ওর ঘরে চিৎকারের শব্দে ছুটে আসে কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনা।ওরা বারবার জিজ্ঞেস করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কেন?কিন্তু ও কিছুই বলেনা,সবাই খুব ঘাবড়ে যায়।পাশে ইব্রাহিম কাঁদছে সেদিকে খেয়াল নেই,ইকরা ইব্রাহিমকে কোলে তুলে নেই।ইয়ারাবী শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আম্মু,আ…আমার মনি আর নেই।আমার মে…য়েটা আমার কোল খালি করে চলে গে..গেছে।আমার কী সর্বনাস হলে রে…”
কথাটা বলেই ও ওখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়।সবাই ওখানে মূর্তির মতো থমকে আছে।মেঘ আয়েশাকে কোলে নিয়ে দেখে ওর শরীর বরফের মতো ঠান্ডা,মা আর জারবা ইয়ারাবীর মুখে পানি দেয় কিন্তু কিছুই হয়না।মেঘ সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আয়েশা মা…মারা গেছে বড় আম্মু,ওর শরীর বরফের মতো ঠান্ডা।”
-“হায় আল্লাহ কী বলিস এসব তুই?দুপুরে খেলা করছিলো,হাসছিলো আর তুই বলছিস মেয়েটা নেই।এ কী সর্বনাশ হলো?”
মুহুর্তের মধ্যে বাড়িটা শোকের ছায়ায় ঢেকে যায়।মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে কী থেকে কী হয়ে গেলো?মেঘ আবীর আর বাবাকে ফোন করে সবটা বলে কিন্তু আবরারকে জানানোর সাহস ওর মধ্যে নেই।কীভাবে দেবে একজন বাবাকে তার সন্তানের মৃত্যুর খবর।তাই বিহানের কাছে ফোন করে সবটা বলে আর আবরারকে না জানিয়ে বাসায় নিয়ে আসতে বলে।ঘন্টাখানিকের মধ্যে সবাই জেনে যায় আয়েশার মৃত্যুর খবর।আস্তে আস্তে মানুষ আসতে থাকে।আবরার ড্রইংরুমের একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে,সবাই ওকে শান্তনা দিচ্ছে যাতে না কাঁদে।অন্যদিকে ইয়ারাবীর জ্ঞান ফেরার পর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে,কিছুতেই সে মেয়েকে দিবেনা।কেউ ওকে বোঝাতে পারছেনা, ইয়ারাবীর একটাই কথা,
-“আমার মেয়েকে আমি দিবোনা,আমার মনি মা ছাড়া থাকতে পারেনা।ও দুধের বাচ্চা কাউকে দিবোনা।আমার মনি ঘুমাচ্ছে আর তোমরা জ্বালাচ্ছো কেন?দিবোনা আমি।”
সবাই ব্যার্থ হয়ে যায় বোঝাতে,আবার কেউ কেড়ে নিতেও পারছেনা মেয়েকে।আবরারের চোখে আজ পানির বন্যা বইয়ে যাচ্ছে,মেয়েরা যে বাবার প্রাণ হয়।আর আয়েশা অতটুকু বাচ্চা হলেও বাবাকে পেলে ছাড়তে চাইতো না।রাতে ঘুম থেকে উঠে কান্না করলে আবরার স্ত্রীকে ঘুমাতে বলে মেয়েকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতো,খাবারের সময় দূরে থাকলে ভিডিও কলে কথা বলতো।যদি আয়েশা কিছু বলতে পারতোনা তবুও আ ই করে বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো।যখন ইব্রাহিম আয়েশার আদরে ভাগ বসাতো তখন আয়েশা ঠোঁট ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠতো।বাইরে যাওয়ার আগেও মেয়েকে আদর করে বাইরে গেছিলো,কে জানতো বাসায় এসে এমন খবর শুনবে।এর মাঝেই নিলয় আবরারের কাছে দৌঁড়ে এসে বলে,
-“দোলাভাই,আপু পাগলামি করছে।আয়েশাকে দিতে চাইছেনা।বাচ্চা মানুষের লাশ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়।”
আবরার দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইব্রাহিম কোথায় জানো?”
-“অনু দিদির কাছে।”
-“ও,কেউ কাড়তে যেওনা আ আয়েশাকে ওর কাছ থেকে।আমি আসছি….”
কথাটা বলতে আবরারের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে,ও বেসিনের সামনে যেয়ে মুখে পানি দিয়ে ঘরে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী কর্ণারের দিকে আয়েশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।ইয়ারাবী দুই খালা বাচ্চাকে কাড়তে গেলে আবরার এক তাড়া মেরে নিষেধ করে দেয়।নিজেকে শক্ত করে ইয়ারাবীর কাছে যেয়ে বলে,
-“ইয়ু,তুমি কী চাও আমাদের বেবীর কষ্ট হোক?”
-“আমি দিবোনা,ও আমার মেয়ে।ও চলে গেলে আমাকে মা বলে ডাকবে কে?চুল ধরে কে টানবে?দাঁত দিয়ে কে কামড় দিবে যদি কোলে না নেই?আমি দিবোনা,আমি পারবোনা একে ছাড়া থাকতে।”
-“কিন্তু এটা যে নিয়ম সোনা,মারা গেলে মানুষকে নিজের কাছে রাখা যায়না।”
মিসেস ইশানি মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
-“মা রে ও কয়েকদিন মেহমান ছিলো তোর কাছে, ও চলে যাবে বলেই এতো চঞ্চল ছিলো রে মা।”
মিসেস রায়হান ওকে বলতে থাকেন,
-“আল্লাহর মাল আল্লাহ ফিরিয়ে নিয়েছেন,কে বলেছে তুই তোর মেয়েকে আর দেখতে পাবিনা?এরা তো জান্নাতের ফুল,হাশরের ময়দানে তুই তোর মেয়েকে পাবি।জানিশ যে সব ছোট বাচ্চারা মারা যায়,তারা বাবা-মা ব্যাতিত জান্নাতে যেতে চাইনা।মা রে অবুঝ হোসনা,আবরারকে দিয়ে দে মেয়েকে।”
-“না,আমার মনিকে আমি দিবোনা।আমার কলিজা আয়েশা,আমার সোনা,আমার মানিক।জানো আমি গান পারিয়ে না ঘুম পারালে এরা ঘুমাইনা।”
আবরারের নিজের চোখে জলে ভিড় জমিয়েছে, শুধু একটু অপেক্ষা টুপ করে ঝড়ে পরার,কিন্তু তার আগেই ও সাবধানে চোখের পানি মুছে ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-“ইয়ু,অনেক দেরী হয়ে গেছে সোনা।আমাদের বাবু তো কষ্ট পাবে তোমাকে কাঁদতে দেখলে।তুমি তো জানো তুমি কাঁদলে বাবুরাও কেঁদে যায়।আর আয়েশা বলবে আমার আম্মি কী পঁচা?পঁচা মেয়েদের মতো কাঁদছে।ওর যাওয়ার সময় হয়েছে, যেতে হবে ওকে।”
অনেক কষ্টে আবরার ওকে বুঝিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাইরে চলে আসে।ভিতর থেকে পুরো বাড়িতে স্পষ্টভাবে ইয়ারাবীর কান্না শোনা যাচ্ছে, চিৎকার করে বলছে,
-“আমার সোনা,আমার মনিকে আমি মেরে ফেলেছে।আজ যদি আমি মরণের ঘুম না ঘুমাতাম আমার মনি আজ আমার কোলে থাকতো।ও আল্লাহ্,তুমি আমার মানিকে কেন নিয়ে গেলে?আমার মেয়েকে না নিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে,ও মা আমার মনি আর নেই মা।আমার এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো।ও মা গো,আমার মেয়ে চলে গেছে,ও মা আমার মেয়ে আর মা বলে ডাকবেনা।”
কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে ইয়ারাবী আবার বেহুঁশ হয়ে পরে।সবাই ওর মাথায় পানি, হাতে পায়ে তেল দিতে ব্যাস্ত।আয়েশাকে যারা গোসল করাবে তাদের কাছে দিয়ে দূরে বসে কাঁদতে থাকে আবরার।ওর বন্ধু,ভাই,বাবা,দাদা সবাই শান্তনা দিচ্ছে,কিন্তু সবার শান্তনা আজ ওর কাছে ফিঁকা।আচ্ছা শান্তনা দিলেই কী আয়েশা ফিরে আসবে ওর বাবা-মায়ের বুকে।এভাবে যে মেয়েটা চলে যাবে সেটা কেউ কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।
আয়েশার গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে জানাযার জন্য নিয়ে যাবে।এমন সময় আবরারের দাদু বলে উঠেন,
-“শেষ বারের মতো নাত বৌকে দেখিয়ে দিয়ে এসো,আর তো দেখতে পারবেনা সন্তানকে।”
ইয়ারাবীকে বাইরে নিয়ে আসা হলে ও দেখে আয়েশাকে কাফনের কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে শুধু মুখটা খোলা।মুখ মনে হচ্ছে আয়েশা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে।ও চিৎকার দিয়ে ওখানেই কাঁদতে শুরু করে।ইকরা ওকে শান্ত করতে করতে বলে,
-“ইয়া,মেয়ের গায়ে উপর চোখের পানি ফেলেনা সোনা।তুমি কাঁদছো কেন?আল্লাহ তোমাকে ক্ষণিকের সময়ের জন্য ওকে দিয়েছিলো।ওর হায়াত ওই টুকু ছিলো।আর কে বলেছে তোমার সব শেষ?তোমার ইব্রাহিম আছে,ওর জন্য বাঁচতে হবে।আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন।”
-“আপু,আমার মনি মনি….”
ও পরে যেতে গেলেই ইকরা ওকে ধরে ফেলে,ওকে রুমে নিয়ে আসলে প্রাপ্ত ওর চেকআপ করে দেয়।ইব্রাহিম অনুর কোলে হঠাৎ করে জোরে কান্না করা শুরু করে,বাচ্চা মানুষ খিদা লেগেছে ওর।কিন্তু মা তো বেহুঁশ,তাই ইকরা ওর কাছ থেকে ইব্রাহিমকে নিয়ে যেয়ে ফিডারে করে দুধ খাওয়াতে থাকে।ফিডারের অভ্যাস থাকায় আর সমস্যা হয়নি।অন্যদিকে জানাযার নামায পড়ে আয়েশাকে বাসার পাশে মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করে,আবরার নিজে কবরে নেমে আয়েশাকে শুয়ায়।ওই সময় ওর মনে হচ্ছিলো আজ সন্তানের জায়গায় ও কেন নেই?শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে আদরে করে দিয়ে কলিজার টুকরাকে শুয়ে দিয়ে কবর দিয়ে দেয়।এক এক মুঠো মাঠে ওর কাছে কয়েক হাজার ভারী পাথর মনে হচ্ছিলো।চলে গেলো আদরের মেয়ে,আর কখনো বা বা বা করে কোলে ঝাপিয়ে পরবেনা,ঘুম না ভাঙলে চুল ধরে টানবেনা মেয়েটা।কবর থেকে একটু একটু দূরে যাচ্ছে আর কষ্টে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে,মনে হচ্ছে সব কিছু ছুড়ে ফেলে মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসুক।কিন্তু সেটা যে করা বড় অন্যায়।
রাতে ইয়ারাবীর জ্ঞান ফিরেই,বাচ্চার জন্য আহাজারি করতে থাকে।কেউ থামাতে পারছেনা ওর কান্না,আর থামাবে কীভাবে?একজন মায়ের সন্তান হারানো কষ্ট অন্য কারোর বোঝার কথা নয়।পাগলের মতো একটা প্রলাপ বকে যাচ্ছে,
-“আমি নিজে মেয়েকে মেরে ফেলেছি।আমার মনি চলে গেছে?ও আল্লাহ্,তুমি আমাকে নিলে না কেন?আমাকে নিয়ে আমার মেয়ের জীবন ফিরিয়ে দিতে?ও আল্লাহ্ গো….”
এতো আহাজারি,এতো দুঃসময়ের মধ্যেও কিছু মানুষের স্বভাব একটুও বদলায়নি।যেমন কয়লাকে হাজার ঘষলেও সেটা কালোই থাকে,তেমন কিছু মানুষের স্বভাব হাজার বদলানোর চেষ্টা করলেও বদলায় না।ঠিক তেমনি মিসেস রায়ীনা,নিকি আর আবরারের মামী ইয়ারাবীকে বলতে থাকে,
-“তোর কী মরণের ঘুম পায়?এখন জেগে আছিস কেন ঘুমা মুখপোড়ী?তুই মরিস না কেন?ফুলের মতো মেয়ের জীবন নিয়ে নিলি?”
-“আরে তুমি তো ডাইনি মা,রাক্ষসী একটা।না জানি ইব্রাহীম বাবাকেও না খেয়ে নেও এই ফকিন্নি। ”
আবরারের মামী কথাটা বেশ আহল্লাদের স্বরে বলে উঠেন।উনি থামতে মিসেস নিকি বলে উঠেন,
-“আরে এই অপয়াকে কিছু বলাই বৃথা?এখন মানুষের সামনে মনি,সোনা বলে নাটক করছে হারামজাদি।তুই কেন খেয়াল করলিনা মেয়েকে?ফুলের মতো মেয়ে তোর জন্য মেরেছে।”
-“আরে আপা থামেন তো,আমি আগেই বলেছিলাম একে বিয়ে না করতে।কিন্তু আমার ননাস তো কথাই শুনলোনা।খেয়েছো মেয়েকে এবার শান্তি।”
উনারা মনে হয় এমন কোনো দিনের অপেক্ষা করছিলেন যেখানে ওকে ইচ্ছামতো কথা শুনাবেন।তাছাড়া আজেকের দিনে ইরাক-ইফাজ-মি.রহমান উপস্থিত নেই,ছুটি পায়নি কেউই,অনু চার মাসের প্রেগন্যান্ট তাই ওকে চলে যেতে হয়েছে।অন্যদিকে ওর বাবা-মা তেমন একটা প্রতিবাদ করবেনা,আর স্বামী সে তো নিজের শোকে শেষ,আশেপাশেও কেউ নেই তাই যা নয় তাই বলছে।ইকরা বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে ঢুকার সাথে সাথে সবাই চুপ হয়ে যায়,ও বাচ্চাকে ইয়ারাবীর কোলে দিয়ে খাওয়াতে বলে ওর জন্য দুধ আনতে চলে যায়।বাড়িতে বেশি মানুষ নেই,আসলে সবাই কাজের জন্য দেশের অন্যান্য প্রান্তে আটকে আছে নয়তো বিদেশে।ইয়ারাবী ছেলে বুকে জড়িয়ে ধরেছে ওমনি আবরারের মামী ওকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠে,
-“ডাইনি ছেলেকে মারবে বলে নিয়েছো?”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বে কেউ উনার মুখে জোরে থাপ্পড় মারে।সামনে তাকিয়ে দেখে সাতাশ বসছের যুবক দাঁড়িয়ে আছে,ছেলেটা আর কেউ নয় ইমন।তার সাথে আবরার।উনি মুখ খোলার আগে আবরার নিজেকে শক্ত করে বলে,
-“এই থাপ্পড়টা আপনাদের প্রাপ্য তাই আমি দেওয়া আগে ইমনই দিয়ে দিলো।আপনারা কোন সাহসে ওকে ডাইনি,রাক্ষসী,মুখপুড়ী বলছেন?কে দিয়েছে এতো সাহস?”
-“দেখে মনে হচ্ছে মার চেয়ে মাসীর দরদ বেশি।”
ইমন উনাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা তাছ্যিল্যের মতো করে বলে উঠে।
-“ও মা হয় আয়েশার,আমাদের কী হচ্ছে সেটা আমার ছাড়া কারো উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই।ও আট-নয় মাস বাচ্চাকে পেটে ধরেছে,জন্ম দেওয়ার সময় অসহনীয় ব্যাথা সয়েছে।নিজের বাঁচার চান্স না থাকলেও বাচ্চাদের জন্ম দিয়ে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছে।আমার সন্তানের জন্য আমরা কী করেছি সেটা আমরা জানি।কই সেই সময়ে আপনাদের এমন দরদ কোথায় ছিলো?অনেক কিছুই বলতাম, কিন্তু মন-মেজাজ ভালো না থাকায় ছেড়ে দিচ্ছি।আলগা লোক দেখানো পিরিত করতে আসবেন না এখানে।”
কথাটা বলেই আবরার ইব্রাহিমকে নিয়ে ইয়ারাবীর কাছে দেয়।উনারা মুখ কালো করে বাইরে বেড়িয়ে যায়।সারাদিন কিছু খায়নি কেউ,আবীর সবাইকে খাইয়ে দিয়ে আবরার আর ইয়ারাবীকে জোর করে খাওয়ায়।অনেক বোঝায় মেয়েটাকে সবাই কিন্তু তারপরও দিনে-রাতে কবরের পাশে যেয়ে কান্না করতে থাকে।আবরার বুঝতে পারে ওকে লন্ডনে নিয়ে যেতে হবে,মেয়ের চিহ্ন আপাততো রাখা যাবেনা ওর আশেপাশে।
কবরের উপর হাত বোলাচ্ছে আর এসব ভাবছে, মাথা ঝিমঝিম করছে,গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছেনা।এই কয়দিনে প্রচুর কান্না করেছে,আর কিছুর শক্তি নেই ওর মধ্যে।কোনো কিছু গলা দিয়ে না নামলেও ছেলেটার জন্য করতে হয়।এসব ভাবতে ভাবতে এক জোড়া পা দেখতে পায় নিজের সামনে,উপরে তাকিয়ে দেখে আবরার গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে।ইয়ারাবীর চাহনি দেখে আবরার বলে উঠে,
-“সোনা,তোমাকে না বলেছি একা একা আসবেনা।চলো মাগরিবের আযান দিবে,নামায পরে আয়েশার জন্য দোয়া করতে হবে।”
ইয়ারাবী ইশারায় বলে উঠে ও যাবেনা।আবরার ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“চোখে মুখের কী অবস্থা করেছে?কাল তোমার জন্য ইরাকের কাছে কত বকা খেলাম।আজও তুমি মেডিসিন নাওনি আর না খেয়েছো।কাল যে ফিরে যেতে হবে।”
ইয়ারাবী ইশারায় বলে ও মেয়েকে রেখে কোথাও যাবেনা।আবরার ওকে উঠিয়ে ধরে বলে,
-“তোমার পরীক্ষা শেষ হলে একেবারের জন্য চলে আসবো এখানে।এখন কথা নয় চলো ভিতরে যাবে।”
(২৩৭)
বর্তমানে অনু চার মাসের প্রেগন্যান্ট।ওর মা এসে অনুদের সাথে থাকে।প্রত্যয়ের মাও যখন বাংলাদেশে আসে ফিলাকে নিয়ে কয়েকদিন ওদের কাছে থাকে।প্রথম প্রথম অনুর খুব কষ্ট হতো এই কোয়াটারে থাকতে,কেননা প্রত্যয় পুরোদিন ব্যস্ত থাকে আর অনুও রোজকার মতো ভার্সিটি থেকে এসে বিড়ালদের সাথে সময় কাঁটাতো,পড়াশোনা করতো শুধু তফাত ছিলো একটাই,আর সেটা হলো রাতে প্রত্যয় ওকে সময় দিতো।তখন নিজেকে একজন সাংসারিক মহিলা মনে হতো।কেননা প্রত্যয় শত ব্যাস্ততার মাঝেও চেষ্টা করে অনুকে সময় দেওয়ার। মাঝরাতে মাঝে মাঝেই অনুর আবদার পূরণ করতে বাইক নিয়েই বেরিয়ে পরে অজানার উদ্দেশ্যে।এতে প্রত্যয় মোটেও বিরক্ত হয়না,বরং ওর বেশ ভালে লাগে।অনুর ছোট ছোট আবদারগুলো রাখার চেষ্টা করে, আসলে ভালোবাসার মানুষ সাথে থাকলে কখনো ক্লান্তি আসে না।আর পুরো দিনে যতটুকু থাকে সেটাও মিটে যায় প্রিয়সীর পাগলামতে।যদিও প্রত্যয়ের বাবা এখনও অনুকে মেনে নেননি তবুও ওর কোনো কষ্ট নেই।প্রাপ্য,ওর ননদ,শাশুড়ি সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। কখনও ওর মনে হয়না ও এখানে একা,অনু খুব খুশি মনেই সবার সাথে কথা বলে।তাই আস্তে আস্তে ও নিজেও মানিয়ে দেয়।
আর যেদিন অনু জানতে পারলো ও প্রেগন্যান্ট মনে হচ্ছিলো ওর সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে।কেননা দিগন্তের ধোঁকার পর ও পরিবার,সংসার,সন্তান এসব স্বপ্ন দেখা প্রাই ছেড়েই দিয়েছিলো।কিন্তু স্বপ্ন যে থেমে থাকার নয়,অনেক সময় স্বপ্ন নিজে এসে ধরা দেয় হাতের মুঠোয়।যখন অনু প্রত্যয়কে অনাগত সন্তানের কথা জানায় তখন প্রত্যয় অনেক পাগলামো করেছিলো।পুরো কোয়াটারে মিষ্টি বিলি করেছিলো,এখনও তার পাগলামো লেগে আছে।কোনো কাজ নিজের হাতে করতে দেয়না,পরীক্ষা আর গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছাড়া বাইরে যেতে দেয়না।শুধুমাত্র ইয়ারাবীর বাচ্চা মারা যাওয়ায় ওকে যেতে দিয়েছিলো।ওখান থেকে আসার পর ওর মন খারাপ থাকে মেয়েটার জন্য, কিন্তু প্রত্যয় অনুকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করে।ভালোই চলছে ওদের জীবন।প্রত্যয় সব সময় একটা কথাই বলে,
-“অনু জীবনের প্রতিটা অংশে তুমি আছো।তুমিহীনা জীবন অন্ধকার,তোমাকে ঘিরে জীবন আমার।
(২৩৮)
দুই সপ্তাহ হয়েছে আবরাররা লন্ডনে ফিরে এসেছে, অনেক জোর খাঁটিয়ে আবরার ইয়ারাবীকে পরীক্ষা দিতে মানিয়েছে।তবে ইয়ারাবী ফিরে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়,আর তা হলো বাড়ির কোথাও আয়েশার কোনো জিনিস নেই।এমন কী আয়েশার কোনো ছবি পর্যন্ত নেই ঘরে।আসলে আবরার লোক দিয়ে সব কিছু একটা ঘরে সরিয়ে ফেলে তালা মেরে রেখেছে।আয়েশাকে ভুলানোর জন্য যা যা করার সব আবরার করছে।আচ্ছা, আয়েশার সব স্মৃতি মুছে ফেললে কী মায়ের মন থেকে ওকে সরানো যাবে?না যাবেনা,কেননা সন্তান যে মায়ের এক অংশ,তাকে ভুলানো পৃথিবীর কারোর সাধ্যে নেই।তাছাড়া প্রায় রাতেই আবরার তালাবন্ধ ওই রুমে যেয়ে কান্না করে ইয়ারাবীর অগোচরে,যা ও জেনে যায় তবে না জানার ভান করে।এসব ভেবেই ইয়ারাবীর নিজের মনে হাসি পায়,কিন্তু হাসতে পারেনা।তবে ইব্রাহিমের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হয়ে যায় ইয়ারাবী,যা আবরার বেশ কিছুদিন ধর লক্ষ্য করেছে।ওকে দুপুরে হাই পাওয়ারের ঔষুধ দিলেও জেগে থাকার চেষ্টা করে,রাতেও ঠিক মতো ঘুমায়না,ছেলের পাশে জেগে থাকে।যদি শুয়ে পরে তো মাঝে মাঝে জেগে উঠে ইব্রাহিমকে চেক করে।আবরার অনেক বোঝায় ওকে,তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে।আবরার আসলে ওর জীবনের একটা নতুন মানে হয়ে ধরা দিয়েছিলো, যার জন্য হাজার কষ্টের মাঝেও ও এক টুকরো সুখ খুঁজে পায়।
দেখতে দেখতে আরো কিছু সময় চলে যায়।তবে এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু যেমন চলে গেছে তবে অনেক কিছু নতুনের মতো গড়ে উঠেছে।যেমন ইফাজ আর তারার সম্পর্কের মোড় ঘুরেছে, একে অপরের মান-অভিমান ভুলে আপন করে নিয়েছে।মেঘ তার জীবনসঙ্গী হিসাবে হিয়াকে বেঁছে নিয়েছে,ইমন আর জারার সম্পর্ক পরিবার জেনে গেছে।তবে ইমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তাই জারার পরিবারের কোনো আপত্তি নেই।
অন্যদিকে জারিকার খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।তবে শুভ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে জারিকার খোঁজ একটু হলেও কেউ জানে।কেননা আয়েশার মৃতু্র সময় জারিকাকে একবার দেখেছিলো বাড়িতে।তবে এই বিষয়ে আর প্রশ্ন করেনি।আদিব স্ত্রী সন্তান আর সাদিয়াকে নিয়ে বাবার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র।শেষ পর্যন্ত পল্লবীর সংসার আর টিকেনা,সায়ন আবারও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে যায়।যার জন্য পল্লবী ওকে তালাক দেয়।এত কিছুর মধ্যে হৃদয় ড্রাগসের ব্যবসায় পুলিশের হাতে আটক হয়,এবার শুধু টাকার অভাবে মুক্ত হতে পারেনি।আর পিয়াস,সে তার পরিনতি ভোগ করছে।পরপর দুইটা বিয়ে করে এখন জেলে নিজের স্থায়ী ঠিকানা বানিয়েছে।কেননা প্রথম স্ত্রীকে বাবা ছেলে মিলে যৌতুকের জন্য হত্যা করে পিয়াসকে দ্বিতীয় বিয়ে করাই।কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রীকে যখন যৌতুকের জন্য চাপ দেয় তখন সে থানায় যেয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করে।
জীবন আসলে একটা সমীকরণের মতো।যেখানে হাসি,আনন্দ,দুঃখ,সুখ সবকিছুই বিচারণ করে।এরা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত,একে অপরের পরিপূরক।জীবনকে বুঝতে হলে এই জিনিসগুলোকে উপলব্ধি করতে হয়।তবে জীবনের গোটা রাস্তা চলায় জন্য একটা ‘তুমি’র প্রয়োজন।যার হাত ধরে নির্ভয়ে পাড়ি দেওয়া যায় হাজার বিঘ্ন,যার চোখে চোখ রেখে ভরসা করে হাত ধরে বলা যাবে ‘জীবন মানে তুমি’।যে তুমিতে আমি আমার নতুন আমিকে চিনেছি।
অসমাপ্ত
[ইহকাল জীবনের সমাপ্তি একমাত্র মৃত্যুর সময়ই ঘটে।তাই উপন্যাসটাকে অসমাপ্ত।থাক না কিছু অসমাপ্ত কাহিনি,যার পরে কী হবে জানা নেই তবে জানি কিছু হবে।জানি সবার হাসি পাবে কথা শুনে।যাই হোক,এই উপন্যাস চলাকালীন সময়ে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি☺️।অনেকে এই উপন্যাসটা ধৈর্য্য নিয়ে পড়েছেন তাদের জন্য ধন্যবাদ?।অনেক দ্রুত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘#কুক_পাখির_ডাক’ নিয়ে ফিরবো।]