প্রস্থান — ৩৩তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৪২.
প্রখর রোদে বাজার থেকে বাড়িতে ফিরল চিত্রা; ঘেমে একাকার সে; জামা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। রিকশা থেকে নেমে সদর দরজার সামনে দাঁড়াল। কলিংবেলে চাপ দিলো বারকয়েক। এরপর কয়েক মিনিট কেটে গেল৷ কোনো সাড়া নেই। বেশ ক্লান্ত-বিধ্বস্ত, সে। এই অপেক্ষা বড্ড অস্বস্তিকর! খানিক রাগ নিয়ে আরও কয়েকবার চাপল কলিংবেল। এরপর আবার অপেক্ষা।
“শুনছেন?”
হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো চিত্রা। চমকিত হয়ে পিছনে তাকালো। একটা লম্বাচওড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রঙ ফরসা। গালের দাড়িগুলো অত্যন্ত পাতলা। চুলও অনেকটা তাই। পরণে স্যুট। হাতে ওয়াকিং স্টিক। চিত্রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে দেখল, লোকটার বা পা-য়ে সমস্যা।
“জি, বলুন।” সিঁড়ির কিছুটা ধাপ নেমে এসে বিস্মিত গলায় বলল চিত্রা। এই লোককে আগে কখনো দেখেনি সে।
লোকটা এগিয়ে এলো চিত্রার দিকে। অদূরে থেকে বলল, “আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন?”
“জি।”
চিত্রার কথা শুনে লোকটা বাড়িটার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে আবার বলল, “এখানে কি সুব্রত নামে কেউ থাকে? ফরসা দেখতে। আমার থেকেও বেশি। হি ইজ অ্যা সাইনটিস্ট। চোখগুলো ধূসর রঙের। চেনেন ওকে?”
চিত্রা ভড়কে গেল লোকটার কথা শুনে। ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, “আপনি সুব্রত ভাইয়ের কে হন?”
লোকটার ঈষৎ চঞ্চলিত হয়ে বলল, “অর্থাৎ সুব্রতকে আপনি চেনেন।”
“হ্যাঁ, চিনবো না কেন? আশ্চর্য!” আপাদমস্তক ভাবে হাসল চিত্রা। আবার বলল, “আমি উনার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী।”
“থ্যাংক গড!” লোকটা সাথে সাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখে প্রশান্তির হাসি। কিছুক্ষণ পর উজ্জীবিত কণ্ঠে জানতে চাইল, “সুব্রত এখন কোথায় আছে? বাড়িতেই?”
চিত্রা কিছুটা শক্ত হয়ে বলল, “আগে বলুন আপনি কে? পরিচয় না দিলে আমি কিছুই বলব না।”
লোকটা হাসল সশব্দে। মুখে বলল, “উতলা হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি ভয়ংকর কেউ না।”
“আমি ভয় পাচ্ছি না। অযথা কথা না বলে নিজের পরিচয়টা দিন।” আরও শক্ত হলো চিত্রা। লোকটাকে কেন জানি তাঁর সুবিধার লাগল না!
“আমি জাকির।” মৃদুস্বরে হাসল। আরও বলল, “সুব্রতর বন্ধু।”
লোকটার কথা শুনে চিত্রার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। বলল, “আমার জানা মতে সুব্রত ভাইয়ের কোনো বন্ধু নেই।”
জাকির বলল, “এখন যোগাযোগ নেই। তবে আগে ছিল। ৫-৬ বছর আগে। আসলে আমাদের পরিচয় হয়েছিল কলেজে।”
“ওহ্ হো!” আনন্দে চিত্রা প্রায় লাফিয়ে উঠল! দুই হাতের তালু এক করে একটা শব্দ সংঘটিত করে বলল, “আপনিই সুব্রত ভাইয়ের সেই কলেজের বন্ধু? পরবর্তীতে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।” জাকিরের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। মুখে হাসি লেগেই আছে। সে বলতে লাগল, “অনেকগুলো বছর আগে একবার এসেছিলাম এই বাড়িতে। আজ এতগুলো বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে মনে হচ্ছিল, এই প্রথম বাংলাদেশে এলাম, এইসব আগে কখনো দেখিনি আমি, জানতামও না এইসবের সম্মন্ধে, সবকিছু অচেনা। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে সঠিক জায়গায় আসতে পারলাম। খুব ভালো লাগছে। এক গ্লাস পানি দেবেন? ঢাকায় এসে এত এত পানি খেলাম। কিন্তু তৃপ্তি পেলাম না কোথাও।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না।” ব্যস্ত হয়ে আবার সদর দরজার কাছে গেল চিত্রা। আরও দুবার কলিংবেলে চাপ দিয়ে হাস্যজ্বল ভাবে বলল, “আপনার ব্যাপারে আমি সুব্রত ভাইয়ের ডায়েরি পড়ে জেনেছিলাম। আপনি উনার একমাত্র বন্ধু।”
চিত্রার কথা শুনে জাকির ভুরু টানটান করে বলল, “বাহ্! খুব পরিবর্তন হয়েছে তো সুব্রত’র। শালা ছোটবেলা থেকে ডায়েরি লিখতো। কিন্তু কখনো আমাকে পড়তো দিতো না। সবসময় বলতো, ও ডায়েরি এইজন্যই লিখে, যাতে কথাগুলো ও আর ডায়েরির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য কাউকে বলার প্রয়োজন হয় না।”
“সুব্রত ভাই এখনো এমনই। নিজে থেকে আমাকে ডায়েরি পড়তে দেয়নি। আমিই তাঁর অগোচরে পড়েছি। যদিও উনি জানতে পেরে খুব রাগ করেছিলেন এই কারণে।”
জাকির হাসল মৃদু আওয়াজে। চিত্রা আরও কয়েকবার কলিংবেল বাজাল। এরপর জাকিরের দিকে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে বলল, “আসলে এইসময় বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। যে মেয়েটা কাজ করে, ও একটু ঘুমায় এইসময়।”
“ওহ্ আচ্ছা।” মাথা ঝাঁলাল জাকির।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিলো সুলতানা। চিত্রা ওকে দেখেই রাগান্বিত হয়ে বলল, “কোথায় ছিলে? সেই তখন থেকে বেল বাজিয়েই যাচ্ছি।”
সুলতানা অপরাধীর মতো নতকণ্ঠে বলল, “আসলে ভাবী, এমন ঘুম ধরেছিল না, কী বলব!”
“আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখো কে এসেছে; মেহমান।”
সুলতানা উৎসুকভাবে বাইরে তাকিয়েই দেখল জাকিরকে। দরজাটা আরও মেলে বলল, “আসুন।”
ভিতরে গিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল জাকির। চারিদিক দেখতে দেখতে বলল, “সবকিছু পাল্টে গেছে। বাড়ির রংটাও ভিন্ন ছিল আগে।” এরপর চিত্রার দিকে চোখ স্থির করল সে। ঠোঁট টিপে বলল, “কলেজে থাকতে একবারই এসেছিলাম তো। আসলে সুব্রত নিজের ব্যাপারে কখনো বলতো না। অনেক জোড়াজুড়ির পর একবার বাড়িতে এনেছিল।”
চিত্রা মাথ ঝাঁকাল হালকাভাবে। সুলতানা দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, ওকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দ্রুত পানি দাও, সুলতানা।।”
“ঠিক আছে, ভাবি।” নির্দেশ মেনে রান্নাঘরের দিকে গেল সুলতানা।
চিত্রা অপর পাশের সোফাতে বসতে বসতে আবার বলল, “সুব্রত ভাই এখনো চুপচাপই থাকেন। নিজের ব্যাপারে কথা বলতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। আমি একটু বেশিই কৌতূহলী তো, সেজন্য অনেক তথ্য বের করেছি। আপনার ব্যাপারে এভাবেই জেনেছি।” গলার আওয়াজ কমিয়ে আনলো চিত্রা। মাঝেমাঝে উপরের দিকে তাকাতে লাগল সে। বাড়িতে তাঁর শাশুড়িও উপস্থিত। বোধহয় ঘরে অবস্থান করছে এই মুহূর্তে!
জাকির বলল, “সুব্রত বাড়িতে নেই? অবশ্য এটা বাড়িতে থাকার সময় নয়।”
চিত্রা বলল, “ঠিক ধরেছেন। সুব্রত ভাই এখন অফিসে।”
জাকির আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “রুশা ভাবি কোথায়? উনি নেই?”
লোকটার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল চিত্রা! মনেমনে ভাবল, ‘রুশা ভাবির কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? উনি কি জানেন না রুশা ভাবি অনেক আগেই ইন্তেকাল করেছেন?’ ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল চিত্রা।
চিত্রাকে নির্বাক দেখে জাকির আবার বলল, “কী হলো? উনিও কী বাড়িতে নেই? কোনো কাজে গেছে?”
চিত্রা ভাবনা থেকে বেরিয়ে, আড়ষ্ট গলায় বলল, “আপনি রুশা ভাবির ব্যাপারে কিছু জানেন না?”
জাকির হাসল সশব্দে। বলল, “জানবো না কেন? সুব্রত তো সর্বপ্রথম আমাকেই বলেছিল ওর প্রেমে পড়ার কথা।”
“কীভাবে বিচ্ছেদ হয়েছিল, সেটা বলেনি?”
“বিচ্ছেদ!” জাকির তাজ্জব বনে গেল! “কার বিচ্ছেদ? যা বলার স্পষ্ট করে বলুন।”
চিত্রা গম্ভীরমুখে বলল, “বিয়ের দু’মাস পরেই রুশা ভাবির মৃত্যু হয়েছিল।”
“হোয়াট?” জাকির চেঁচিয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “আপনি ঠিক বলছেন?”
চিত্রা নিচের দিকে তাকিয়ে, ভার গলায় বলল, “হ্যাঁ। ঠিক বলছি।”
জাকির মুখে হাত দিয়ে নিজেকে সামলাল। আবার ধপাস করে সোফায় বসে, কিছুক্ষণ আপন মনে ভেবে জানতে চাইল, “কিন্তু কীভাবে হয়েছিল এইসব?”
“ছাদ থেকে পড়েছিলেন উনি। আত্মহত্যা। তবে এর জন্য সুব্রত ভাইয়ের শাস্তি হয়েছিল। সবাই বলেছিল, সুব্রত ভাই রুশা ভাবিকে নির্যাতন করতো। এই কারণেই আত্মহত্যা করেছিল রুশা ভাবি।”
চিত্রার কথা শুনে জাকিরের কপাল আরও চওড়া হলো। ভুরু কুঁচকে, চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। সে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, “এইসব মিথ্যে কথা। অসম্ভব। সুব্রত এইরকম কাজ করতে পারে না। ও খুব ভালোবাসতো মেয়েটাকে।”
চিত্রা আফসোসের সাথে বলল, “সুব্রত ভাই সম্পর্কে জানার পর আমিও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আর যাই হোক, যার প্রতি এত গভীর ভালোবাসা ছিল সুব্রত ভাইয়ের, তাকে কোনোভাবে কষ্ট দিতে পারেন না সুব্রত ভাই। কিন্তু কী করার? সুব্রত ভাইয়ের জেল হয়েছিল ৫ বছর।” এরপর জাকিরের দিকে তাকাল সে। আবার বলল, “কিন্তু আপনি এইসব জানেন না শুনে খুব অবাক হচ্ছি।”
জাকির কাতর গলায় বলল, “কীভাবে জানবো? ওর বিয়ের পর থেকে তো আমাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।” একটু থামল জাকির। আরও কাতর হয়ে বলল, “আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল সেসময়। এই যে আজ আমার হাতে স্টিক দেখছেন, আজ থেকে কয়েক বছব আগে এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একজন শক্তিশালী পুরুষ ছিলাম আমি। খুব দৌড়াতে পারতাম। অথচ আজ এই অবস্থা!” বিমর্ষ হয়ে পড়ল জাকির। ধরা গলায় আরও বলতে লাগল, “কয়েক মাস আগে তো চেয়ারে বসে থাকতে হতো। আসলে, যেদিন সুব্রত জানালো, ওর বিয়েটা পাকা হয়েছে, ঘটনাটা সেদিনেরই! তখন বেশ রাত। আমি আর আমার স্ত্রী দোকান থেকে ফিরছিলাম গাড়ি করে। হঠাৎ এক্সিডেন্ট হয় গাড়ির। যখন জ্ঞান ফেরে, আমি অনুভব করি, আমার পা নেই। আসলে আমার দুটো পা-ই অচল হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পরই আমি জানতে পারি, এক্সিডেন্টে শুধুমাত্র আমার পা-ই অচল হয়নি, বরং আমার আরও বড় ক্ষতি হয়েছে। আমার স্ত্রী মারা গেছে। খুব ভেঙে পড়ি আমি। তবুও সুব্রতর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সম্ভব হয় না আর। অনলাইনে পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছিল ও। দেশের তেমন কারোর সাথে যোগাযোগ ছিল না, যে ওর খোঁজ দেবে। তবে সেদিনকার তারিখটা জেনে এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম, সুব্রতর বিবাহ ততদিনে হয়ে গেছে। এরপর দেখতে দেখতে কেটে গেল ৫টা বছর। এই মাস ছয়েক আগেই দাঁড়াতে পারলাম। তবুও এই লাঠির প্রয়োজন হয়। এটা ছাড়া কষ্ট হয় খুব। গতকাল রাতেই দেশে ল্যান্ড করলাম। প্রথমেই এখানে এলাম।”
চিত্রা বিস্মিত হয়ে শুনছিল জাকিরের কথাগুলো। শেষ হতেই লক্ষ করল, লোকটার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত! সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না সে। নির্লিপ্ত হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে, নিজেকে শান্ত করে জাকির বলল, “সুব্রতর জন্য আমার খারাপ লাগছে। যদিও জানি না বিয়ের পর কী ঘটেছিল। তবে, যদি সত্যি সত্যিই সুব্রত দোষী হয়ে থাকে, তাহলে ওর জন্য আজ যে সহানুভূতি হচ্ছে, সেটা ঘৃণায় পরিনত হতে সময় লাগবে না।”
চিত্রা বলল, “সুব্রত ভাই রুশা ভাবিকে আজও ভালোবাসে। আমাকে উনি নিজে বলেছে। উনার জন্য সুব্রত ভাই নতুন করে কিছু শুরু করতে পারছেন না। সাধারণ একটা চাকরি করছেন। অথচ উনি বড় কেউ হতে পারতেন। আমরা বেশ ক’বার বলেছি বিয়ের কথা। কিন্তু উনি বিয়ে করতে নারাজ। রুশা ভাবির স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাঁটাতে চান।”
এমনসময় দুতোলা থেকে আওয়াজ এলো। “কে এসেছে, চিত্রা?” দীপালি বেগম উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন।
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে জাকিরের উদ্দেশ্যে মিহি সুরে বলল, “আপনি, কিছু বলবেন না, প্লিজ।”
দীপালি বেগম নিচে নেমে আসছেন ধীর পায়ে। চিত্রা সোফা ছেড়ে এগিয়ে গেল। বলল, “উনার নাম জাকির। সুব্রত ভাইয়ের বন্ধু।”
“বাবাহ্! ওর আবার বন্ধুও আছে।” তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন দীপালি বেগম।
চিত্রা বলল, “কলেজের বন্ধু। বিদেশে থাকে। আজই এসেছে।”
জাকির দাঁড়াল এবার। কিছুটা এগিয়ে সালাম দিয়ে বলল, “আন্টি, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি বোধহয়। কিন্তু আমি আপনাকে চিনেছি।”
দীপালি বেগম ভুরু কুঁচকালেন। জানতে চাইলেন, “কীভাবে চেনো?”
জাকির প্রাণবন্ত গলায় বলল, “কলেজে থাকতে একবার এসেছিলাম। তাছাড়া আগে প্রায়ই আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করতাম সুব্রতকে। ও সবার খোঁজখবর দিতো। সেভাবেই মনে রেখেছি। আপনিও তেমন পরিবর্তন হননি। এখনো ইয়াং আছেন বেশ।” কথাগুলো শেষ করে মৃদু হাসল সে।
“আচ্ছা।” দীপালি বেগমও হাসলেন মৃদুস্বরে। বিনয়ী হলেন বেশ! “দাঁড়িয়ে কেন? বসো।” এরপর ছোট টেবিলটার দিকে তাকালেন তিনি। বললেন “শুধু পানি? চিত্রা, ওকে চা-খাবার দাও।”
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে গলা উঁচিয়ে বলল, “সুলতানা, হলো?”
“এইতো ভাবি, আর একটু।” রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলো সুলতানা।
জাকির হেসে বলল, “আপনারা শুধু শুধু এত ব্যস্ত হচ্ছেন। আমাকে এক্ষুণি আবার বেরোতে হবে।”
“সেকি! মাত্রই তো এলেন।” চিত্রা অবাক হয়ে বলল কথাটা।
জাকির জবাবে বলল, “আবার আসবো আমি। তবে এখন বেরোতে হবে। আসলে, গ্রামে যাব। ভিটে বাড়িটা দেখব। বাবা-মায়ের কবরও ওখানে।”
চিত্রা অনুরোধ করে বলল, “অন্তত চা খেয়ে যান।”
আর ‘না’ করতে পারল না জাকির।
চা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোলো জাকির; চিত্রা এগিয়ে দিতে এলো। দরজার বাইরে এসে জাকির বলল, “নতুন কোনো সিম নেওয়া হয়নি। তাই নম্বর দিতে পারছি না। আপনি সুব্রতর নম্বরটা দিনা আমাকে। আমি যোগাযোগ করব, ইনশাআল্লাহ।”
“ওকে।”
নম্বর নিয়ে জাকির আবার বলল, “আচ্ছা, আপনি তখন আমাকে ‘কিছু’ বলতে মানা করলেন কেন?”
চিত্রা তাকালো জাকিরের দিকে। বলল, “সুব্রত ভাই নিজে গোপন রেখেছে ব্যাপারটা। এখন যদি আমরা তা প্রকাশ করে দেই, তবে এর পরিনতি মারাত্মক হবে। শেষ হবে প্রলয় দিয়ে। সুব্রত ভাই খুব রেগে যাবেন। উনাকে আর রাগাতে চাই না আমি। উনার অতীত জানার প্রতি আমার আগ্রহ। আমাকে জানতেই হবে সেদিন বাসর রাত থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কী ঘটেছিল।”
জাকির উজ্জ্বল মুখ করে বলল, “বাহ্! তা, আপনি তো ডায়েরি পড়েছেন। ওখানে লেখা ছিল না?”
“আপনি যতদূর সম্পর্কে অবগত আছেন, ওখানে ততদূরই বলা আছে।”
জাকির কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “সেক্ষেত্রে আপনি একটা কাজ করতে পারেন। ওর ‘স্টাডি’ রুমে খোঁজ করতে পারেন। ছোটবেলায় ওর একটা অভ্যাস আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ও ঘন ঘন ডায়েরি চেঞ্জ করে। কারণটা অবশ্য জানা নেই আমার। তবে আমার বিশ্বাস, বাকি ঘটনা আপনি কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন।”
চিত্রার বড্ড আফসোস বলো সহসা। এর আগে ‘স্টাডি’ রুমে যাওয়ায় সুযোগ হয়েছিল বেশ ক’বার। যদি দ্বিতীয় ডায়েরির খোঁজ করতো, তবে হয়তো পেয়েও যেতো। এখন তো খুব সতর্ক, সুব্রত ভাই৷ ‘স্টাডি’ রুম সারাক্ষণ বন্ধই থাকে।
জাকিরকে রিকশা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরল চিত্রা।
৪৩.
চারিদিকে অস্পষ্ট আলো। মাগরিবের আজান হয়নি এখনো। সারাদিনের তীব্র গরমের পর এখন একটু আরাম। পশ্চিমের আকাশ রাঙা হয়ে আছে। রশ্মিদের বাড়ির দরজায় করাঘাত করল সুব্রত। দরজাটা ফাঁকা হয়ে গেল।
ড্রয়িংরুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো নেই। সুব্রত অবস্থান অনুমান করে রশ্মির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওটাও আস্তে করে ধাক্কা দিলো। ঘর অন্ধকার। জানালার কাছে একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুখশ্রী আবছানা; অদ্ভুত! জানালা খোলা। হাতে টর্চলাইট।
নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সুব্রত। রশ্মির পিছনে দাঁড়ালো। জানালা বরাবর কিছুটা দূরে যে নতুন কবরটা আছে, লাইটের আলোটা সরাসরি ওখানেই পড়েছে। এছাড়া বাকি সবখান আঁধারে তলিয়ে গেছে সূর্য ডোবার সাথে সাথে। বাইরে খুব বাতাস। বোধহয় আজ বৃষ্টি হবে। বাতাসে রশ্মির খোলা চুলগুলো উড়ছে। আচমকা কেউ ওকে দেখলে ভূত ভেবে ভুল করবে!
গভীর মনোযোগে মায়ের কবরটা দেখছে রশ্মি। ঘরে যে কারোর উপস্থিতি ঘটেছে, এই ব্যাপারে সে অবগত নয়। হবেই বা কীভাবে? তাঁর ধ্যানমগ্ন তো সম্পূর্ণ এই নীল কাগজে ঢাকা কবরের দিকে। মাথা এবং পায়ের কাছের খেজুর গাছের ডালগুলো এখনো জীবন্ত মনে হচ্ছে। পাতাগুলো কাঁচা-ই। মাত্র দু’দিন হলো কী-না!
রশ্মির কোনো ভ্রুক্ষেপ না দেখে সুব্রত আচমকা ডেকে উঠল, “রশ্মি” বলে।
অকস্মাৎ ডাক শুনে আঁতকে উঠল রশ্মি। হতচকিত হয়ে পিছন ঘুরতেই টর্চলাইটের আলোটা পড়ল দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখটার উপর। সে অশ্রুভেজা দৃষ্টিতে সুব্রত ভাইয়ের মুখটা দেখল; খানিকটা অস্পষ্ট মনে হলো তাঁর!
“কেমন আছো, রশ্মি?” রশ্মিকে স্বাভাবিক করতে প্রশ্নটা করল সুব্রত।
রশ্মি চোখ নামিয়ে নিলো। ভীতসন্ত্রস্ত মুখটাতে হাতের তালু বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “ভালো।” এরপর আবার লাইটের আলো জানালা দিয়ে কবরটাতে রাখল সে। জানতে চাইল, “আপনি, এইসময়?”
সুব্রত কিছুটা পিছিয়ে এসে বলল, “আজ একটা জায়গায় গেছিলাম। তাই আসতে দেরি হলো। চিত্রা এসেছিল রাতের খাবার নিয়ে?”
“না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিলো রশ্মি। আরও বলল, “আমি আসতে বারণ করেছি।”
“কেন?” অবাক হলো সুব্রত।
“সারাজীবন তো আর ও আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে না। এটা হতেও দেওয়া যায় না। সেজন্য এখন বারণ করেছি। নিজেকে এইসবে মানিয়ে নিতে হবে এখন থেকে।”
সুব্রত কিছু না বলে ঘরের আলো জ্বালাল হঠাৎ। আর তৎক্ষনাৎ বিরক্ত হলো রশ্মি, “আহ্! সুব্রত ভাই, আলো নেভান। প্লিজ। আলো সহ্য হচ্ছে না।”
সুব্রত গম্ভীর গলায় বলল, “হবে কীভাবে? আজ দু’দিন ধরে নিজেকে অন্ধকারে গুটিয়ে রেখেছ। এভাবে থাকলে তো আলো সহ্য হবেই না।”
রশ্মি কিছু বলল না। নির্বিকারে তাকিয়ে রইল কবরটার দিকে।
সুব্রত আবার বলল, “দেখো, তোমার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি। কাচ্চি বিরিয়ানি। চিত্রা বলছিল, তুমি পুরান ঢাকার এই বিরিয়ানি খুব পছন্দ করো। এটা আনতে গিয়েই ফিরতে সন্ধ্যা হলো আসলে।”
রশ্মি এবারও নির্বাক। সুব্রত বিরিয়ানির প্যাকেট উঁচু করে ধরে বলল, “এই দেখো, একদম গরম-ধোঁয়া উঠা বিরিয়ানি।”
তবুও রশ্মির সাড়া না দিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট বিছানায় রেখে সামনে এগোলো সুব্রত। আবার রশ্মির পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, “রশ্মি, চলো।”
“সুব্রত ভাই, বিরক্ত করবেন না তো।” রশ্মি ধমক সুরে বলল কথাটা।
সুব্রত পাল্টা ধমকালো, “আমি বিরক্ত করছি? এখানে দাঁড়িয়ে কী মহা কাজ করছ তুমি? আর এভাবে কবরে আলো দিয়ে রেখেছ কেন? লাইট বন্ধ করো।”
রশ্মি হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে, আরও ধমকে ওঠে বলল, “চুপ। আমি আলো না দিলে মায়ের কবরে আলো দিবে কে? অন্ধকারে থাকবে মা?”
সুব্রত এবার রশ্মির একটা হাত চেপে ধরল। এরপর অন্য হাতটা। লাইটটা কেড়ে নিয়ে বলল, “অনেক পাগলামি হয়েছে। এবার বন্ধ করো।”
“সুব্রত ভাই, ছাড়ুন আমাকে।” নিজেকে ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করতে লাগল রশ্মি। উচ্চবাচ্য করে বলল, “রাগ হচ্ছে কিন্তু।”
সুব্রত ছাড়ল না। রশ্মিকে টেনে বিছানার কাছে নিয়ে এলো। জোর করে বসিয়ে দিলো বিছানার উপর।
রশ্মি আরও গর্জে ওঠে বলল, “সুব্রত ভাই, ছাড়ুন আমাকে। আর প্লিজ, লাইটটা নেভান। আমার চোখ জ্বালা করছে।”
সুব্রত নিরুপায় হয়ে, ঘরের আলো নেভাল। রশ্মির হাতে যে টর্চলাইট ছিল, সেটার আলো সরাসরি দেয়ালে পড়ে চারিদিকে একটা আলোর ছাপ পড়েছে। সে আবার কাছে এসে, ওর সামনে, মেঝেতে হাটু গেড়ে বসল। আবারও ওর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “এভাবে ভেঙে পড়ো না, রশ্মি। তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমার জীবন এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই অসুস্থ হয়ে যাবে তুমি।”
রশ্মির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। মুখে কিছু বলতে পারল না সে।
সুব্রত আবার বলল, “দেখো, তোমার মা তো এত কষ্ট করে তোমাকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। একটা ঘটনার জন্য তুমি মায়ের সমস্ত ত্যাগকে বৃথায় পরিনত হতে দিবে?”
“কী করব আমি?” রশ্মির কণ্ঠ কাঁপা-কাঁপা। “মায়ের যেমন আমি ছাড়া কেউ ছিল না, তেমনি আমারও মা ছাড়া কেউ ছিল না।”
“আমরা তো আছি।” সুব্রত আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করল রশ্মিকে।
রশ্মি জবাবে সেই কাতর গলায় বলল, “মা তো নেই, না। মায়ের অভাব কেউ পূরণ করতে পারবে না। একদিন আপনারা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন৷ আর আমি একা হয়ে পড়ব। মায়ের সাথে যেন আমার আর ঝগড়া না হয়, সেজন্যই তো সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মা-কে আর কষ্ট দিবো না। যদি ওই লোকটাকে মা বিয়ে করতে চায়, আমি বাধা দিবো না। আমি তো মেনেই নিয়েছিলাম। তবুও কেন মা কষ্ট পেলো? এভাবে চলে গেল?”
সুব্রত কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল, “কোন লোকের কথা বলছ, তুমি?”
“ওই যে, মা’র অফিসের লোকটা। যার সাথে মা’র সম্পর্ক ছিল।”
“তুমি নিশ্চিত আন্টির সাথে লোকটার সম্পর্ক ছিল?”
রশ্মি দৃঢ় স্বরে বলল, “সেদিন তো নিজের চোখেই দেখেছিলাম, তাঁরা পাশাপাশি বসে আছে। বিশেষ বন্ধু না হলে ওভাবে বসে থাকে? কিন্তু আমি মেনে নিয়েছিলাম।”
“যদি সম্পর্কটা ভালোই থেকে থাকে, তবে ওই কেইস করেছিল কেন?”
“আমি জানি না।”
“সেদিন যে লোকটা তোমাদের বাড়িতেই ছিল, তা তো আগে বলোনি।”
“মা-ই তো নেই। উনার কথা বলে কী হবে? মা তো শ্বাসকষ্টে মারা গেছে। আমি ওভাবে চলে গেছিলাম দেখেই বোধহয় কষ্ট পেয়েছিল, মা। এম্বুলেন্স লোকটাই ডেকেছিল। এরপর তো আমি হাসপাতালে চলে গেছিলাম। উনার সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। এমনকি মা’র জানাযাতেও না। অফিসের শুধুমাত্র একজন এসেছিল। উনি মায়ের ভালো বন্ধু ছিল।”
সুব্রত জানতে চাইল, “উনার নামটা কী?”
রশ্মি বলল, “মা’র মোবাইলে ফোন করেছিল গতকালকেও। নম্বরটা মিসেস আজিম লিখে সেভ করা।”
“ওহ্।” এরপর রশ্মির হাত ছেড়ে দিয়ে, বিছানায় ওঠে বসল সুব্রত। কিছুক্ষণ নীরবে ভাবার পর বলল, “এবার অন্তত আলোটা জ্বালাই।”
“না।” কড়া গলায় নিষেধ করল রশ্মি।
সুব্রত হতাশ হয়ে বলল, “ঠিক আছে। তবে আমিও আর থাকছি না। বাড়িতে যাচ্ছি।”
“যান। আপনাদের কাউকে আমার দরকার নেই।” রশ্মি কান্নাভেজা গলায় বলল।
সুব্রত বলল, “সত্যিই চলে গেলাম।”
“গেট আউট। প্লিজ।” উচ্চকণ্ঠে কথাটা ভলে চোখ বুজে ফেলল রশ্মি।
সুব্রত আর বসে থাকল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তখনও চোখ বুজে আছে রশ্মি। সুব্রত সদর দরজা দিয়ে বেরোতেই সে ছুটে গেল, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখল, ধীর পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে সুব্রত ভাই। একটু পর আর দেখা গেল না তাকে। তাঁর মনটা আরও হাহাকার করে উঠল!
৩৩তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=847691942842174&id=100028041274793