প্রস্থান — ৩৪তম পর্ব।

0
490

প্রস্থান — ৩৪তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৪৪.
দরজার বাইরে সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। সুব্রত ভাইকে দেখে বলল, “সুব্রত ভাই, আজ দেরি হলো যে। আপনার জন্য সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি আমি।”
সুব্রত ভিতরে এসে বলল, “কাজ ছিল। কিছু বলবে?”
“ইয়েস।” চিত্রার চোখমুখ চকচক করতে লাগল। আনন্দ মাখা গলায় বলল, “আজ এমন একজন এসেছিল, যার নাম শুনলে আপনি ভড়কে যাবেন!”
“তাই নাকি?” চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল সুব্রত।
চিত্রা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুম। অবশ্যই চমকাবেন।”
“কে এসেছিল, সেটা তো বলো।” সুব্রত তাগাদা দিলো অধৈর্য হয়ে।
চিত্রা চোখ পিটপিট করে বলল, “জাকির ভাইয়া।”
সুব্রত হতভম্ব হয়ে গেল কথাটা শুনে! অবিশ্বাসের সুরে বলল, “তুমি ঠিক বলছ?”
“অবশ্যই।” গাঢ় স্বরে জবাব দিলো চিত্রা। আরও বলল, “তবে এই মুহূর্তে উনার সাথে আপনি যোগাযোগ করতে পারবেন না। উনি নিজের গ্রামের বাড়ি দেখতে গেছেন। কবে ফিরবেন, তা বলেনি। কিন্তু, বলেছে আবার আসবে। আপনার নম্বর আমি দিয়েছি অবশ্য। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোনকলও পেতে পারেন যেকোনো সময়।”
সুব্রত আপন ভাবনাতে নিমগ্ন হয়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি এখন ঘরে যাচ্ছি।”
“আপনার খাবারটা কী উপরে পাঠাব?
“না। আমি আজ কিছু খাব না।” কথাটা বলে সিঁড়ির দিকে এগোলো সুব্রত। কিছুটা গিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে, পিছন ফিরে বলল, “রশ্মির জন্য আমি বিরিয়ানি এনেছি। আজ ওখানে খাবার নিও না তুমি।”
চিত্রা মৃদু হেসে, কৃতজ্ঞতা ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাঙ্কিউ, সুব্রত ভাই। আপনি পাশে না থাকলে আমি একা ওকে সামলাতে পারতাম না।”
সুব্রত নিঃশব্দে হাসতে হাসতে নিচের দিকে তাকাল। বলল, “আমি এটাকে নিজের দায়িত্ব থেকেই করছি। থ্যাঙ্কিউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“দায়িত্ব! ভুরু টানটান করে তাকাল চিত্রা। আবার বলল, “কীসের দায়িত্ব, সুব্রত ভাই?”
“একজন প্রতিবেশী হওয়ার কারণে আমাকে এটা করতেই হতো।”
“কতদিন?”
সুব্রত দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “সারাজীবন।”
“শুধুমাত্র প্রতিবেশী হয়ে?” চিত্রার চোখ কপালে ওঠে গেল সুব্রত ভাইয়ের কথাতে।
সুব্রত আগের মতোই দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “আমার কাছে কনা যেমন, তেমনই রশ্মি। ওর পাশে থাকার জন্য নতুন করে কোনো সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।” চিত্রার দিকে আরও এগিয়ে এলো সুব্রত। বলল, “দেখো চিত্রা, তোমরা যা ভাবছ, তা কখনো সম্ভব না। রশ্মিকে নিয়ে আমি সেভাবে ভাবতে পারি না।”
চিত্রা প্রবল বিষণ্ণ হয়ে বলল, “তবে ওর কী হবে, সুব্রত ভাই? সারাজীবন ও আপনার করুণা কেন গ্রহণ করবে?”
সুব্রত ধমক সুরে বলল, “বললাম তো আমি করুণা করছি না৷”
সুব্রতকে থামিয়ে দিয়ে চিত্রা বলে উঠল, “এভাবে হয় না, সুব্রত ভাই। আপনি যেভাবে ওর পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন, সেটাকে করুণা-ই বলে। ওর একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। আমি ওর বন্ধু। আমি ওকে কথা দিতে পারি, সারাজীবন ওর পাশে থাকব। আপনি কীভাবে পারেন? অভিভাবক হতে হলে একটা সম্পর্কের প্রয়োজন হয়, সুব্রত ভাই। আপনার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।”
সুব্রত জবাব দিলো না।
চিত্রা কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর আবার আকুল গলায় বলল, “প্লিজ সুব্রত ভাই, একটু ভাবুন। আপনার একটা সিদ্ধান্তে কয়েকজন মানুষের জীবনে স্বস্তি মিলবে। রশ্মির যে কি ভয়াবহ অবস্থা, আপনি তা বুঝতে পারছেন না৷ ওকে নিয়ে আমার ভয় হয় সারাক্ষণ। কখন কী করে বসে!”
সুব্রত বিরক্ত হয়ে উঠল। কিছুটা উগ্র গলায় বলল, “চুপ করো, চিত্রা। আমাকে জোরাজোরি করো না এই ব্যাপারে। আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব হবে না ওকে বিয়ে করা৷ প্লিজ। আমাকে আর ফোর্স করো না।”
“কিন্তু সুব্রত ভাই..।”
সুব্রত হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। চিত্রা স্তব্ধ হয়ে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মনেমনে বলল, “আপনাকে কীভাবে বুঝাই সুব্রত ভাই! রশ্মি এভাবে বাঁচতে পারবে না। ও মরে যাবে।”

ডিনারের পূর্বে ঘরের সামনে এলো চিত্রা। দরজাটা আস্তে করে ঠেলে, ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখল, ফিরোজ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। পা দুটো লম্বা করে মেলে দিয়েছে সামনের দিকে। ল্যাপটপটা থাই এর উপর রাখা। ওর পরণে লাল টি-শার্ট আর ট্রাউজার। বাড়িতে এসেছে বিকেলে। আর বেরোয়নি ঘর থেকে।
নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে পা রাখল চিত্রা। ধীরে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। আলমারিটা খুলে ভিতরের জামা-কাপড়গুলো আওড়াতে শুরু করল, অযথাই। একটু পর আড়চোখে তাকাল ফিরোজের দিকে। কিন্তু ফিরোজের কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না।
“ডিনারের সময় হইছে। মা বলল, তোমাকে ডেকে দিতে।” বেশ কিছুক্ষণ পর ইতস্তত করে কথাটা বলল চিত্রা। আগের মতোই আলমারির জামা-কাপড় আওড়াতে লাগল।
ফিরোজ মাথা তুলল এবার। কপালে বেশ ক’টা ভাজ ফেলে বলল, “আপনি কে?”
“আমি কে?” চিত্রা বিস্ফারিত চোখে তাকাল ফিরোজের দিকে।
ফিরোজ নির্লিপ্ত। ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে বলল, “জি, সেটাই জিজ্ঞেস করছি। আপনি কে?”
“আল্লাহ!” বিছানার দিকে এগিয়ে এলো চিত্রা। তাঁর মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম! কাছে এসে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো?”
ফিরোজ একই মনোভাবে নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “ঠিকই তো মনে হচ্ছে। বোধহয় আপনি ঠিক নেই। এভাবে অপরিচিত একজনের ঘরে ঢুকে তাঁর আলমারি হাতাচ্ছেন। আবার তাকে ডিনারের জন্য ডাকছেন। তুমি বলেও সম্মোধন করছে।”
চিত্রা অস্থির হয়ে বসে পড়ল বিছানায়। একটা হাত ফিরোজের কপালে রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তাপমাত্রা তো ঠাণ্ডাই। জ্বর আসেনি। তবে হলো টা কী?” হাত সরিয়ে দূরত্ব আরও কমাল চিত্রা। মৃদু গলায় আবার বলল, “দেখো! ভালো করে দেখো আমাকে। আমি চিত্রা। তোমার বউ।”
কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল ফিরোজ, এমন বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। চিত্রা আরও বিচলিত হয়ে বলল, “তুমি মজা করছ না তো আমার সাথে? হঠাৎ আমাকে না চেনার অভিনয় করছ কেন?”
“আপনি সত্যিই আমার বউ?” ফিরোজ জানতে চাইল বোকামুখ করে!
চিত্রা ঢোক গিলে বলল, “হ্যাঁ। জানো না তুমি?”
ফিরোজ গম্ভীরমুখে বলল, “কীভাবে জানবো? আমার বউ হলে কী এই ঘরে থাকতে না? আমার পাশে ঘুমাতে না? তুমি তা করো? তুমি তো আরেক জনের ঘরে গিয়ে থাকো।”
“ওহ্! এই কথা তবে।” চিন্তামুক্ত হয়ে আবার পিছিয়ে এলো চিত্রা। সকৌতুকে বলল, “আমি ভাবলাম ভুলে যাওয়ার বিমারি-টিমারি হলো কী-না।”
ফিরোজ নির্বিঘ্নে বলল, “ক’দিন ধরে খুব চেষ্টা করছি সবকিছু ভুলে যাওয়ার। এমনকি আমাদের বিয়েটাও।”
চিত্রা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল। মুখে বলল, “বেশ তো, ভুল যাও। আমিও ভুলে যাব।”
ফিরোজ প্রবল অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। মুখে একটা-টু শব্দ করল না।
চিত্রা এক মুহূর্ত নির্বাক থেকে সহসা দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি খেতে এসো। আমি গেলাম।”
যাওয়ার জন্য পা বাড়াল চিত্রা, তখনই বাধা দিলো ফিরোজ; ওড়নার একটা অংশ মুঠি করে ধরল। সে অবাক ভঙ্গিতে ফিরোজের চোখে চোখ রেখে ভুরু নাচাল।
ফিরোজ নাক সিঁটিয়ে বলল, “একটু বসো। প্লিজ।”
চিত্রা ওড়নাটা হালকা করে টান দিয়ে বলল, “কাজ আছে তো। যাও, ডিনারের পর আর একবার আসবো। ভাবছি ক’দিন রশ্মির সাথে থাকবো। বেচারি ওই বাড়িতে একা একা আছে। বাইরে বেশ অন্ধকার। তুমি একটু দিয়ে এসো তো।”
ফিরোজ আচমকা ওড়নাটা টানল। চিত্রা টাল সামলাতে না পেরে আবার বসে পড়ল, ফিরোজের খুব কাছে। চমকিত হলো সে।
ওড়না ছেড়ে চিত্রার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল ফিরোজ। দাঁত কিড়মিড়িয়ে, ঠিক হিংস্রতম ভাবে বলল, “এত স্পর্ধা! প্রথমে এই ঘর ত্যাগ, এরপর এই বাড়ি।”
ব্যথায় সামান্য কাতরে উঠল চিত্রা। তবুও ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমরা তো এটাই চেয়েছিলে।”
“আমরা চেয়েছিলাম? ফিরোজের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
চিত্রা একই সুরে বলল, “চাওনি? তুমি আর তোমার মা?”
ফিরোজের মাথা নত হলো এবার। হাতের মুঠিটা আলগা করে মিনমিনিয়ে বলল, “এর জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, চিত্রা। আমি জানি, পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে জেনে গেছ তুমি। সেজন্যই আমার খুব অপরাধবোধ কাজ করছিল। তাই তুমি যখন ফিরে পাগলামো শুরু করলে, আমি খুব কমই রিয়্যাক্ট করেছি। দোষী আমি। আসলে মা এমনভাবে বলছিল না, আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি আর।”
চিত্রা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “মায়েরা সন্তানকে যতটা ভালোবাসে, সন্তানের সংসার জীবনকে ততটা ভালোবাসে না। তোমার মা হয়তো ভেবেছেন, আমি তোমাকে উনার থেকে আলাদা করে নিয়ে যাব। সেজন্যই উনি বলেছেন, আমাকে শায়েস্তা করতে। কিন্তু তোমার জেনে রাখা উচিত, এভাবে সম্পর্ক গাঢ় হয় না, বরং দূরত্ব তৈরি হয়।”
চিত্রার মুখোমুখি হয়ে বসল ফিরোজ। ওর হাত দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, “আমি মায়ের হয়েও ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে।”
চিত্রা বিমর্ষচিত্তে বলল, “ক্ষমা চাওয়াটা বড় কথা না। এখানে উপলব্ধি হওয়াটাই মোক্ষ বিষয়।”
চিত্রাকে আরও কাছে টেনে নিলো ফিরোজ। আদুরে গলায় বলল, “আমার উপলব্ধি হয়েছে তো। শুধু তুমি ক্ষমা করে দাও। আগের সবকিছু ভুলে যাও।”
চিত্রা রসিকতা করে বলল, “বিয়েটাও? এবার দেখো, আঘাতটা যখন নিজের লাগে, তখন কেমন বোধ হয়।”
ফিরোজ অসহায় চোখে তাকাল চিত্রার দিকে।
চিত্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আচ্ছা। বিয়ে ছাড়া বাকি সব ভুলে যাব। এবার ছাড়ো।”
“ছাড়ব। তবে তোমাকে একটা কথা দিতে হবে। আমি ক’দিন ধরেই ভাবছি কোথাও ঘুরতে যাব। দূরের যাত্রা।”
চিত্রা উজ্জ্বল বনে বলল, “সত্যি? সবাই মিলে?”
“এই মুহূর্তে আমরা দু’জনই যাব। তবে পরেরবার সবাই একসাথে যাব। প্রমিজ।”
“ওহ্।” হতাশ হলো চিত্রা। মলিন সুরে বলল, “এইরকম পরিস্থিতিতে আমরা একা একা ঘুরতে চলে যাব?”
“পরিস্থিতি সবসময়ই এমন থাকবে।”
“তবুও..।” প্রবল অনাগ্রহ ঘিরে ধরল চিত্রাকে।
ফিরোজ বুঝতে পেরে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে কিছুদিন পর। তখন ‘না’ করতে পারবে না কিন্তু।”
“কী দরকার? শুধু শুধু।”
“শুধু শুধু না। আমাদের সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করতে এটা প্রয়োজন।”
চিত্রা হাসল ফিরোজের কথা শুনে। বলল, “একবার কাছে আসলেজ যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়, সে সম্পর্ক যে আবার অস্বাভাবিক হবে না তাঁর কি নিশ্চয়তা আছে? গুরুত্বপূর্ণ হলো মনের মিল থাকা, দেহের মিলন তো ক্ষণিকের। মনের চোখটাই আসল চোখ। অন্ধরাও সুখী হয় কেন জানো? কারণ তাঁদের মনের চোখ আছে। যেদিন তুমি মনের চোখ দিয়ে আমাকে দেখতে পারবে, সেদিন এইসবের প্রয়োজন হবে না, আপনা-আপনি আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিকে পরিনত হবে।”
“আজ রাতটা অন্তত এখানে থাকো। প্লিজ।” ফিরোজ নাছোরবান্দা। হার মানতে নারাজ।
চিত্রা ওঠে দাঁড়াল এবার। বলল, “আমাকে পরিবর্তন করার আগে নিজের মনটাকে পরিবর্তন করো। অন্যের কথামতো না, তুমি নিজে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো। দেখো, আমার বিশুদ্ধতা তোমাকে মুগ্ধ করবে।”
কথাগুলো বলে চিত্রা বেরিয়ে গেলেও ডিনারের পর আবার ঘরে ফিরল। এবং সে রাতটা নিজের ঘরেই কাটাল; দীর্ঘ সময় পর।

৪৫.
ঘুম ভাঙতেই ওয়াশরুমে গেল রশ্মি। ফ্রেশ হয়ে আবার ঘরে এলো। তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে মোবাইলে দেখল, ভোর ৬টা। হঠাৎ জানালা দিয়ে চোখ পড়ল কবরস্থানে। সুব্রত মোনাজাত-রত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল সে। এরপর চোখ ফিরিয়ে রান্নাঘরে পা রাখল। গ্যাস অন করল। পাতিল রাখল। এরপর পানি ঢালল সেই পাতিলে। পানি হালকা গরম হতেই চা-পাতা দিলো। এরপর চা হওয়ার অপেক্ষা!
কিছুক্ষণ পর ঝুঁকে নাক দিয়ে বড় করে শ্বাস নিলো রশ্মি। তখনই বিপত্তি ঘটল। চায়ের সুঘ্রাণে সে এতটাই উত্তেজিত হলো যে, খালি হাতেই পাতিলটা নামাতে গেল। প্রবল উত্তাপে হাত জ্বলতেই সে পাতিল ছেড়ে দিলো। আর সাথে সাথে ফুটন্ত চা তাঁর পায়ের উপর পড়ল। ব্যথায় আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল সে। পরক্ষনেই আবার মুখ চেপে ধরল। কিন্তু যন্ত্রণা এতটা অসহ্যকর যে, তাঁর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরতে শুরু করল। রান্নাঘরেই ধপাস করে বসে পড়ল সে। বেলা হতেই চিত্রা এলো। রশ্মির মারাত্মক অবস্থা দেখে তাঁর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। ঘরে মলম ছিল না, তাই সে দ্রুত টুথপেষ্ট নিয়ে এসে ফোসকা পড়া জায়গায় লাগিয়ে দিলো। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ঝাড়ল মেয়েটাকে, “হ্যাঁ, কী দরকার ছিল একা একা চা বানাতে যাওয়ার। এইসবে অভ্যাস না থাকলে তাড়াহুড়োতেই বিপদ হয়। একটু পরই তো আমি আসতাম। তবুও কেন একা একা এই কাজ করতে হবে? বেশি বেশি হুহ!” এইসব বলে।

এর তিনদিন পরের ঘটনা।
বেলা হতেই ঘর তালা দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো রশ্মি। চারিদিকে আলোর সমারোহ। অন্ধকার শুধু তাঁর মুখশ্রী। রুমানা বেগমের মৃত্যুর আজ সপ্তম দিন। সেই ঘটনার পর আজই প্রথম খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াল সে।
সদর দরজা থেকে কিছুটা সামনে এগোতেই বেশ কয়েকটা বেড়াল দেখতে পেলো সে। ওদের দেখে তাঁর ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠল। আজ সাত দিন পর এদের সাথে দেখা। এর মধ্যে এরা কী খেয়েছে সে জানে না। সে-ই বা কী করবে? সে তো নিজেই এখন অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাঁরা আছে বলেই সুবিধা। সে প্রায়ই ভাবে, যদি চিত্রা আর সুব্রত ভাই না থাকতো, তাহলে তাঁর কী পরিনতি হতো? মৃত্যু অবধারিত!
বিড়ালগুলোকে উপেক্ষা করে হাঁটতে শুরু করল রশ্মি। কাঁধে ব্যাগ। পরণে একটা মলিন জামা। সামনে ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। সেজন্যই ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া।
আরও কিছুটা এগোতেই একটা গাড়ি নজরে এলো রশ্মির। সেই পরিচিত গাড়িটা। কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।
মিস্টার মুজিবর জানালার নামিয়ে মুখটা বের করলেন। রশ্মির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন আছো, রশ্মি?”
রশ্মি লোকটার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলল, “ভালো আছি। আপনি?”
“আমিও ভালো আছি। ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছ নিশ্চয়ই?”
রশ্মি আগের মতোই নির্লিপ্ত থেকে বলল, “জি। আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছেন? মা’র জন্য? মা তো নেই।”
চোখ নামালেন মিস্টার মুজিবর। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অভ্যাস হয়ে গেছে কী-না। তুমি এসো আমার সাথে। তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে আমি অফিসে যাব।”
মিস্টার মুজিবরের কথা শুনে নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রশ্মি। এরপর অকস্মাৎ গাড়ির দরজাটা টানল, লোকটা সরে বসতেই সে উঠে বসল, ঠিক পাশের সিটে! পরক্ষনেই গাড়ি চলতে শুরু করল।

৩৪তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=850223795922322&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here