#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Irini Ori
#পর্ব:১৯
(৭০)
শীতের কুয়াশায় ভেজা সকালটা সবার ভালো লাগে।এক এক ফোঁটা শিশির যখন নরম ঘাসের উপর জমা হয়,পূর্বদিকের সূর্যটা যখন রক্তির আভা ছড়িয়ে পরে সেই ঘাসের উপর তখন প্রকৃতি যেনো এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়।দূর থেকে মনে হয় সোনায় পরিপুর্ন হয়ে আছে চারপাশটা।সেই ভোরের হালকা কুয়াশার মধ্যে আবরার জগিং করতে বেরিয়েছে।সেখানে ইমন,শাহরিয়ার,নিলয় ইফাজ,শুভ ও উপস্থিত আছে।হঠাৎ ইমন আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ফড়িং কী ঘুমাচ্ছে, নাকী উঠে পরেছে?”
আবরার হেসে বলে,
-“নামায পড়ে আবার ঘুমাচ্ছে।বাট্ তুমি ওকে ফড়িং বলো কেন?”
-“ছোটবেলায় ফড়িং দেখলে ওটাকে ধরার জন্য পিছু পিছু দৌড়াতো।”
-“তাই,বাচ্চারা এমনটা একটু করবে।আচ্ছা,ওর চাইল্ডহুডটা একটু বলবে।”
ইমন ওর মাথার হুন্ডিটা খুলে বলে,
-“বন্ধুতো পাশে দাঁড়িয়ে আছে…”
আবরার ইমনের কথা শুনে হাসতে থাকে।শাহরিয়ার আবরারের পিঠে হাত রেখে বলে,
-“ভাইয়া,আপনি এখনো ইয়ারাবীকে সত্যিটা বলেননি।ইনফ্যাক্ট,কাল আপনার ব্যবহারে সত্যিই খুব অবাক হয়েছি।”
ইফাজ একটা বড়গাছের চারিপাশে শান বাধানো উঁচু জায়গায় বসে বলে,
-“সবটা শুনলে ওর মনে হবে করুণা করেছি,তাছাড়া ওকে পরোটা সুস্থ না করে সত্যিটা বলা যাবেনা।আর আমি চাই তুমিও আমাদের হেল্প করবে।”
-“তাতো করবো,কিন্তু কথা হলো যাকে সারা জীবন
আপনি বলে এসেছি তাকে তুমি বলতে হবে।”
ইমনের কথা শুনে সবাই হাসতে থাকে,নিলয় হাসি থামিয়ে বলে,
-“ভাইয়া এটা সেই পুকুর না যেখানে আপু পরে গেছিলো।”
ইফাজ পানি খেতে খেতে বলে,
-“হুম,তবে ওকে আর মনে করিয়ে দিসনা যেন।”
আবরার এগিয়ে যেয়ে বলে,
-“কী হয়েছিলো?”
-“আর বলিসনা,তোর বৌ হলো এক নাম্বারের ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে।শুধু ইরাক আর ইমনকে একটু ভয় পায়,আর আমাকে তো ধরতে পারলে ছাড়েনা।গরমের ছুটিতে সবাই এখানে আসছিলাম।তখন ম্যাডামের ছিলো মাত্র দশ বছর বয়স।
সেদিন জারিকারা এই পুকুরে গোসল করছিলো।তোকে আগেও বলেছিলাম ও চুপচাপ স্বভাবের, বেশি কথা বলেনা।খুব জ্বর ছিলো ওর,তবুও আমাদের সাথে বের হবে।তো ভাইয়া ওকে কোলে নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো।বোনের গোসল করছে বলে আমরা পুকুরের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।
ইমন বললোনা তোকে,ফড়িং দেখলে ধরার জন্য দৌঁড়াতো।তো ভাইয়ার কাধে মাথা দিয়ে ছিলো।হঠাৎ একটা ফড়িং দেখেই ওর কোল থেকে নেমে ওর পিছু ধরার জন্য যায়।ফড়িংটা আবার উড়তে উড়তে পুকুরপাড়ে চলে এসেছিলো।কিন্তু ও তো আর সাঁতার পারেনা,তাছাড়া ওর পুকুরে নামা বারন।এই কথা বাড়ির সবার জানা আছে,কিন্তু ওইদিন জারিকারা ও সাঁতার পারেনা বলে ওকে টিজ করে।ছোট মানুষ আর ঘাড়ত্যাড়া,ওর আর এসব সহ্য হয়নি।তখন এখানে ওভাবে সিড়ি দেওয়া ছিলোনা,জায়গাটা পিছ্লা ছিলো।যেই পা রেখেছে,ওমনি জুতা স্লিপ খেয়ে পরে গেছে।ভাগ্যিস য়ুহার ছিলো,নয়তো ডুবে যেতো ওইদিন।”
আবরার ওর পাশে বসে বলে,
-“বুঝা যাচ্ছে,খুব ঘাড়ত্যাড়া।এসব নিয়ে আর কিছু হয়নি?”
-“জানিস তো খালা কেমন?খালাতো সব শুনার পর ইয়ারাবীকে বকছিলো।জারিকারাও বলে ওদের কোনো দোষ নেই।তবে য়ুহার ছিলো,আর সব সত্যিটা বলে।আম্মু জারিকাদের তিন বোনকে খুব বকেছিলো এটা নিয়ে।আবরার জারিকার থেকে সাবধানে থাকিস।সরি শুভ বাট্ তোর বোন কেমন সেটা জানিস?”
শুভ ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“জানি ভাইয়া,সরি কেন বলছেন।ওদেরকে নিজের বোন বলতেও লজ্জা করে।”
-“জানি ওর চোখের চাহনি খুব ভয়ংকর।”
শুভ পুকুরে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে বলে,
-“কাল রাতে কী হয়েছিল?বাড়ির পাশ থেকে চিল্লানোর আওয়াজ শুনছিলাম।তার কিছুক্ষণ পরে শুনলাম আক্কাস চাচার হাত ভেঙে গেছে।বেচারা বুড়ো বয়সে দু’হাত হারালো।ইমন ভাইয়া আপনি কিছু কী জানেন?”
ইফাজ ইমনের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছিলো ইমু?চুপ করে আছিস ক্যান,আবার লেগেছিলি নাকী তুই ওই বুড়োর সাথে?”
-“ছ্ ছোট ভাইয়া,আমি ক্ কী করে জানবো?”
কথাটা বলে মেকি একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে ইমন।ইফাজ কাল রাতের ঘটনাটা জানেনা।আর আবরারও চাইনা এটা নিয়ে কোনো কথা হোক।কেননা এখানে ইয়ারাবী জড়িয়ে আছে,আর ওর পরিবারের লোকজন কেমন সেটা ওর জানা আছে।
-“তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”
-“আমি মানে কী ঠান্ডা পরছে,চলো ব্যাক করি..”
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বাড়ির মধ্যে ঢোকে।গ্রামের বাড়ি সেহেতু আশেপাশের মানুষেরা বাড়িতে আসছে।আর যখন শুনেছে ইয়ারাবীর বর আসছে,তাকে দেখতে আসবে সেটাই স্বাভাবিক।আসলে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষগুলো খুব সহজ-সরল হয়।শহরের মানুষগুলোকে এমন ভাবে সম্মান করে যেনো তারা বিদেশী লোক।গ্রামের কিছু মুরুব্বি মানুষ আর মহিলারা আবরারের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলছে।মিসেস ইশানির এক চাচী আছেন সম্পর্কে ইয়ারাবীর নানী হয়।উনি ইয়ারাবীকে খুব ভালোবাসেন।
যেহেতু শীতকাল বিভিন্ন পিঠা-পায়েস,খেজুরের রস করা হয়েছে।হাসান,রোহিত,স্পন্দন,সমীর এরা আগের থেকে উঠানে বসে সেই নানীর সাথে কথা বলছে।ইফাজ পিছন থেকে মিসেস দোলার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-“কেমন আছো গিন্নী?আমাদের মতো এমন ইয়াং বর কী চোখে পরেনা।”
মিসেস দোলা ওনার লাঠি উঠিয়ে দু’টা বারি দিয়ে বলেন,
-“রাখ তোর ইয়াং বর,আমার বুড়ো বরই ভালো আছে।বয়স কত হলো খেয়াল আছে,অথচ সতীনের মুখ দেখতে পারলাম না।”
ইফাজ চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
-“তোমার বুড়োর ছোট বৌ যা শুরু করছে,মনে হয় এই বছরেই বিয়ে হয়ে যাবে।তার তো আবার আমার শান্তি সহ্য হয়না।ভাইয়াতো ক্যাম্পে আছে তাই বেঁচে যায়।”
-“ঠিক কাজ করছে,তোদের বিয়ে না দিলে বাদরে পরিনত হবি।যাইহোক আমার বোনটা কইরে, আদিবাদের সবার তো দেখছি কিন্তু ওরে তো দেখলাম না।”
-“মনে হয় ঘুমাচ্ছে,আসলে কাল জার্নি করে এসেছে,শরীরটাও ভালো নেই।”
আবরার একগ্লাস খেজুরের জুস খেতে খেতে কথাটা বলে।মিসেস দোলা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“তো আমার নাত জামাইরা,নতুন মেহমানের আগমনের খবর কবে পাবো?”
সমীর আর স্পন্দন একসাথেই বলে উঠে,
-“যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট,আর চাইনা।”
মিসেস দোলা ওদের কথা শুনে হেসে বলে,
-“মাত্র একটা নিয়ে এই অবস্থা আমার যে পুরো ১৩টা বাচ্চা ছিলো,তোমার নানাশ্বশুড়ের সাতটা তাহলে।তোমরা বাপু এ যুগের মানুষ কত কিছু হিসেব করে চলো।যাইহোক তো তোমরা তিনজন কবে খবর দিবে।”
হাসানের তো কথাটা শুনে বিষম উঠে যায়,রোহিত ও লজ্জায় কিছু বলতে পারেনা।আবরার একটা পুলি পিঠা মুখে পুরে দিয়ে বলে,
-“আমার বৌটা পুরো বাচ্চা,আগে বড় হোক।তারপর দেখবো।”
কথাটা বলতে আবরারের খুব কষ্ট হয় কিন্তু উপায় নেই।কেননা ইয়ারাবীর এই দুর্বলতা কাউকে জানাতে চায়না এমনকি স্বয়ং ইয়ারাবীকেও নয়।একারনে রোজ মিথ্যা বাহানা দিয়ে মেডিসিন দেয় ওকে।ইফাজ ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওর হাটুর উপর হাত রাখে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়।হঠাৎ ওর চোখ পরে সিড়ি দিয়ে নামা মেয়েটার উপর।পরনে হালকা-আকাশী রঙের গাউন,ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া,চোখে একটা চশমা,হাতে আর গলার জুয়েলারিগুলো দুর থেকে জ্বলজ্বল করছে,মেকাবহীন চেহারাটা ভেজা চুলের সাথে অনেক সুন্দর ফুটে উঠেছে।যেমন ভোরের কয়াশা মিশ্রিত ঘাসগুলো যতোটা সতেজ দেখায়,ঠিক তেমনি ইয়ারাবীকে লাগছে।হঠাৎ আবরারের মেজাজটা গরম হয়ে যায়,ইচ্ছা করছে ওকে ঠাটিয়ে দু’টা চড় মারতে।
ইয়ারাবী সিড়ি দিয়ে নেমে ওর নানীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“কেমন আছো নানী?”
-“এই বুড়ির কথা কী মনে আছে নাকী তোর?কাল এসে একবারও দেখা করেছিস।”
-“আরে বাবা কাল আসছি প্রায় মাগরিবের সময়,তাছাড়া জার্নিতে টায়ার্ড ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পরছিলাম।”
-“বুজেছিরে বু,তোর আর বলতি হবেনা।”
আবরার ইয়ারাবীর গায়ে চাদরটা ঠিকমত জড়িয়ে দিয়ে বলে,
-“ঠান্ডায় কী হাইপোথারমিয়া বাধানোর ইচ্ছা হয়েছে নাকী।এই সকালে শাওয়ার নিয়েছো কেন?আর নিলেও মোটা কোনো জ্যাকেট না পরে পাতলা চাদর পরছো।ইউ্ নো গ্রামে কত ঠান্ডা পরে।”
-“ভাইয়া বকছে,কিছু বলো।”
ইফাজ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
-“ও তো তাও তোকে বকছে,আমি হলে আগে চড় মেরে কথা বলতাম।ভুল কিছু বলেছে নাকী,এক সপ্তাহ আগে সেরে উঠলি,আবার বিছানায় পরতে ভালো লাগবে।”
-“তোমরা থামবে,আমার তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে।”
ইমন একটা কাটাপাকান পিঠা মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,
-“খেতে থাক,রান্না হতে টাইম লাগবে।”
-“এখন এসব খেলে সারাদিন কিছু খেতে পারবোনা।”
-“আমার হাতের মার কয়দিন খাসনা,চুপচাপ ফিনিস কর।”
-“বোনতো আরো আছে,কই তাদের উপর টর্চার করনাতো।”
-“তোর যদি টর্চার মনে হয় তবে এটা টর্চারই।আর বাকীরা নিজেদের খেয়াল রাখতে পারে তোর মতো গবেট না।”
-“দেখো তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো,ভালো হচ্ছেনা বলে দিলাম।”
আবরার পিঠা খেতে খেতে ইয়ারাবীকে বলে,
-“তোমার ভাই তো কোথাও ভুল বলেনি।তাছাড়া একটু পর মেডিসিন নিতে হবে,খেয়ে নাও।”
-“ডাক্তার বিয়ে করলে এমনি হয়,সব ডাক্তারগিরি বৌ এর উপর করে।আর এরা ধরে বেঁধে ডাক্তারকে গলায় ঝুলালো।”
ইয়ারাবী কথাটা আস্তে বললেও আবরার শুনে ফেলে হাসে।ইয়ারাবী ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া জারা কোথায়?”
-“আমার কী বিয়ে করা বৌ নাকী যে সব সময় আমার কাছে শুনিস।”
শাহরিয়ার ওর কথা শুনে বিষম খেয়ে বলে,
-“হয়নি বাট্ হতে কতক্ষণ।”
-“হ্যাঁ,তাইতো এবার বলো কোথায় ও।দিঘীতে যাবো।আগেই বলছি কেউ মানা করতে পারবেনা।”
রোহিত ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
-“একটু আগে য়ুহার সাথে ছিলো,মনে হয় কোথাও বসে গল্প করছে।”
-“য়ুহার আপু আসছে,কই দেখলাম নাতো।”
নিলয় চেয়ার থেকে উঠতে বলে,
-“কাল সকালে এসে প্রানো আপুর বাসায় গিয়েছিলো।আজ তোমাকে ডাকতে যেয়ে দেখে তুমি ঘুম।”
-“আমার কাজ আছে আপুর সাথে।তো হাসান ভাইয়া আপনার সাথে তেমন কোনো কথা হয়নি,কেমন আছেন আপনি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই।”
-“আমি তো বারো মাসই সিক থাকি।আপনার কথা বলুন আমি আসি..”
ও উঠতে গেলে আবরার ওর হাত ধরে বলে,
-“কোথায় যাও?”
-“খালামনির কাছে,য়ুহার আপু,জারাতো নাই।তাই আর কোথাও যাওয়া হবেনা।আপনার কী কিছু লাগবে?”
-“আমার কিছু লাগবেনা।যেখানে যাও না কেন,চাদর রেখে জ্যাকেট পরে নাও।আর ব্যাগের ফাস্ট চেনের ওখানে মেডিসিন আছে,যেয়ে নিয়ে নাও।”
-“যাচ্ছি…”
আবরার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসে।মাঝে মাঝে ও যখন রেগে মুখ ফুলিয়ে রাখে তখন পুরোটা বাচ্চা বাচ্চা লাগে।ওর জানা নেই,এই বাচ্চার মাঝে এমন কী আছে যেটাতে বারবার ও হারিয়ে যায়।মৌমাছির যেমন ফুলের প্রতি মধুর জন্য এক অজানা আকর্ষন থাকে ঠিক তেমনি ওর ইয়ারাবীর প্রতি।ইয়ারাবীর প্রতিবার প্রতি রুপে এক পবিত্রা কাজ করে।
যেসব পরিবারের সন্তানেরা অবহেলায় দিন পার করে তারা কিছু উগ্র স্বভাবের হয়,ভদ্রতা বজায় রাখতে পারেনা কিন্তু ইয়ারাবী তা নয়।ও নিজেকে পার্ফেক্ট করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।আজকালকের মেয়েরা স্বামীর প্রতিটা নিষেধাজ্ঞা তেমন মানেনা কিন্তু ও আবরারের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করে।আবরারের উপর হাজার হাজার মেয়ে ক্রাশ তবুও ওর এই সাধারন বাচ্চা মেয়েটাকে ভালো লাগে।মিসেস দোলা আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী গো নাত জামাই,বৌয়ের প্রতিতো খুব ভালোবাসা।সত্যিই কী আগে তোমরা একে অপরকে চিনতে না?কিন্তু তোমার কেয়ার দেখেতো মনে হয়না।”
আবরার হালকা হেসে বলে,
-“এমনটা নয় যে শুধু লাভ ম্যারেজ করলেই ভালোবাসা হয়,এরেন্জ ম্যারেজে না।তাছাড়া আপনার নাতনির এসব প্রেম,ভালোবাসা বিয়ের আগে পছন্দ ছিলোনা।আর বৌয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকা ইবাদাতের অংশ বিশেষ।
স্ত্রীকে ভালোবাসা প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’-(তিরমিজি)”
হাসান ওর কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি কী কোরআনে হাফেজ?সরি তুমি বলে ফেললাম।”
-“না ভাইয়া,কিন্তু আমার এগুলো পড়তে ভালো লাগে।কিন্তু আপনিতো কোরআনের হাফেজ,এম আই রাইট?আর সরি বলার কোনো প্রয়োজন নেই ইয়ারাবী আপনার শ্যালিকা,সেই সম্পর্কে আমি আপনার ছোট।”
-“তুমি জানলে কী করে?”
-“আপনার কথা বলার ধরন আর ব্যবহার ইসলামি স্কলারদের মতো কিছুটা।তাছাড়া কাল আপনি যখন ওই মুরুব্বির সাথে কথা বলছিলেন তখনি আমার মনে হলো।”
-“তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা একদমি সঠিক।”
-“কী জানি?আচ্ছা রোহিত ভাইয়া আপনি কী করেন?”
-“তোমাদের মতো এত বড় কিছু নয়,একটা কম্পানিতে ডেপুটি ম্যানেজারের পোষ্টে আছি।”
-“ভাইয়া কাজ কখনো ছোট বড় হয়না।তাছাড়া ডেপুটি ম্যানেজারের পদটা অনেক ভালো।”
-“তা তো ঠিকই,আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি দেখি রিচিকা কোথায়।”
রোহিত ছেলেটা ছোট থেকেই খুবই ভদ্র এবং সভ্য ছেলে।তবে রিচিকা খুব উগ্র,রগচটা আর উড়নচণ্ডী টাইপের মেয়ে ছিলো।নিজের ইচ্ছাকে সব সসময় প্রধান্য দিতো,কারো ধার ধারতোনা।বাবাকে কখনো সম্মানতো দূরে পরে থাকে মায়ের মতো যেখানে সেখানে হেয় করতো।কথায় আছেনা,”বৃক্ষ তোমার নাম কী,ফলে পরিচয়।”এরা তিন বোনও তেমন,এরা পুরোটা ওর মায়ের মতো হয়েছে।কলেজে ছেলে মেয়েদের টিজ করা ছিলো রিচিকার প্রধান কাজ।তবে কলেজে রোহিতে সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে কিছুটা বদলে যেতে থাকে।রিচিকার বাবা মেয়ের পরিবর্তন দেখে রোহিতকে মেয়ের জামাই হিসেবে বেছে নেন।ওনার ধারনা একমাত্র রোহিত পারবে ওনার মেয়েকে পুরোপুরি শুধরাতে।রিচিকা কখনো ঝগড়া বা রাগারাগি করলে রোহিত চুপ করে থাকে।কখনো ওর সাথে তর্ক করেনা,ওর ধারনা দু’পক্ষ যদি কথা কাটাকাটি করে তবে সমস্যা কমার বদলে আরো বেরে যায়।
(৭১)
বাড়ির দক্ষিণের পাশে পুকুর পাড়ের এক হিজল গাছের সাথে হেলান দিয়ে শুন্যে দৃষ্টি মেলিয়ে রেখেছে য়ুহার।এই চাহনি আছে আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আত্মনার্দ,কিছু বিভিষিকাময় দিনগুলোকে পার করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা।শূন্যে দৃষ্টি রাখলেও মনের এক কোনের দুঃখগুলো জল হয়ে বের হতে চাইছে চোখ থেকে।বাতাবি লেবুর রসের মতো টুপটুপ করে ঝড়ে যাচ্ছে দু’চোখ থেকে।ও আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু হয়ে উঠছেনা।হৃদয়ের কোনের আকাশটা যখন মেঘলা থাকে তখন আর কিছুই ভালো লাগেনা।
য়ুহার মি.তিয়াজ অর্থাৎ ইয়ারাবীর ছোট মামার মেয়ে।য়ুহার ইয়ারাবীর সাত বছরের বড়ো।একজন ভালো মানের উকিল,আজ পর্যন্ত যতগুলো কেস ছিলো একটাতেও হারেনি।তবে হেরে গেছে জীবনের কাছে।নিজের মনে মাকড়সার জালের মতো বুনা প্রতিটা স্বপ্নের কাছে।মাকড়সার বুনা জালটা বলে তার ভার রাখার মতো শক্ত হয়।তাহলে য়ুহার স্বপ্নগুলোর ভার কেনো সহ্য হলোনা,মাঝরাস্তায় সব সুঁতা কেটে কেন পরে গেলো?হেরে গেল ,হাসির পাত্র হলো তার কাছে যাকে নিয়ে নিজের ভুবনে এক একটা সুঁতা দিয়ে জাল বুনেছিলো।
য়ুহার নিজের অতীতকে পিছু তাড়ানোর জন্য রংপুরে তেমন আসেনা।যখন শুনলো ইয়ারাবী চার বছর পরে রংপুরে আসছে তার ওর মনের সব যন্ত্রনা একপাশে রেখে নিজের বাচ্চাকে দেখতে চলে এলো,কেননা বিয়ের সময় ও অস্ট্রেলিয়া ছিলো।বাচ্চা কেন বললাম সেটা না হয় পরেই জানা যাবে।
রংপুরকে ঘিরে ওর জীবনের কতগুলো অতীত দাঁড়িয়েছে,যা ওকে সব সময় পীড়া দেয়।রংপুরের মাটি থেকে শুরু করে প্রতিটা রাস্তা ওকে ওর অতীত মনে করিয়ে দেয়।অতীতের কষ্টগুলো অনেক গভীর যন্ত্রনা দেয়….অনেক বড়ো যন্ত্রনা।নিঃস্বাস নিতে কষ্ট হয়…চাতক পাখির মতো শুধু আশায় থাকতে হয় কখন এই কষ্টের অংক থেকে মুক্তি মিলবে…সব হিসাব মিলে জীবন পাতাটা উল্টাবে।
কাল সকালে ও প্রানোর বাড়িতে গেছিলো ওর সাথে দেখা করতে।গত সাত-আট বছর ও প্রানোর সাথে শুধু ফোনে হাই-হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলেনা।এক সময় ছিলো যারা প্রানের বন্ধু আজ তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তির উপস্থিতে অনেকটা দূরত্ব বেড়ে গেছে।জীবনের নামের খেয়া-তরী খেলায় ও অনেকটা ক্লান্ত।প্রানোর সাথে দেখা হওয়ার পর দুই বান্ধবী মিলে অনেকটা কান্না করেছে।প্রানোর মা অাকৃতি ওদের নাস্তা দিয়ে কথা বলে পাকঘরে চলে গেলেন।অনেকদিন পরে দেখা হওয়া দু’বান্ধবী মিলে গল্প করতে করতে একপর্যায়ে প্রানো বলে উঠে,
-“য়ুহার অর্কভের সাথে তোর আর কোনো কথা হয়েছে?”
-“অতীত বড়ো পীড়া দায়ক,আমি চাইনি কোনো যোগাযোগ রাখতে।”
-“ভালো তো বাসিস তাইনা?”
-“সত্যি কথা কী জানিস?রোজ রাতে নিয়ম করে দুইবার কান্না করি ওর জন্য,দোয়া করি যার সাথে আছে তাকে যেনো ধোঁকা না দেয়।”
-“অর্কভের ডান-পা পুরো প্যারালাইজড হয়ে গেছে,শুনেছি হুইলচেয়ারে যাতায়াত করে।”
-“পাপ কখনো বাপকে ছাড়েনা,নিজের হাতে নেশা ধরিয়ে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।একটা সুঁতা গড়তে সময় লাগে কিন্তু ছিড়তে না।টাকার পিছু করে ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমান নিয়ে পরে ছিলো।”
-“একটা কথা বললো য়ুহার?”
-“এতটাই দূরত্ব বেড়ে গেছে যে অনুমতি চাইছিস?”
-“না আসলে কথাটা হলো,শৈল ভাইয়াকে নিয়ে…উনি এখনো তোকে ভালোবাসে।”
-“জীবনের প্রতিটা ধাপ অনেকটা সমুদ্রের স্রোতের মতো,কখন কোন আঘাতটা তীরে আছরে পরবে কী ভাঙবে,কী গড়বে কেউ জানেনা।যদি সেই স্রোতের কেউ সাথী হতে চাই,তবে তার জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে যেতে হয়।কেন জানিস?কারন, একবার স্রোতের মাঝে পরে গেলে বেঁচে ফেরা খুব মুশকিল।”
-“তোকে কী বললাম আর তুই কী বললি?”
য়ুহার প্রানোর বোকা বোকা কথা শুনে হেসে দেয়।প্রানো ওর দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করে,
-“তুই হাসছিস কেন?”
-“না হেসে কী করবো,তুই এখনো আগের মতো আছিস।”
-“তুই বুঝি খুব বদলে গেছিস?”
প্রানোর প্রশ্ন শুনে য়ুহার হাসি থেমে যায়।মুখে কিছুটা গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“শৈল ভাইয়াকে আমি ভাইয়ের নজরে দেখি,তাই অন্যকিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তাছাড়া তোর ওই ভাইকে আমার জিন জিন লাগে।”
য়ুহার কথা শুনে প্রানোর মুখে ভয় ফুটে উঠে।ও নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলে বলে,
-“জিন উপাধি তো তুই দিয়েছিস?”
য়ুহার একটা মিষ্টি মুখে ঢুকিয়ে বলে,
-“না দিয়ে কী করবো বল?যখনি কোনো বিপদে পড়তাম উনি সুপারম্যানের মতো প্রকট হতো।বাস্তবে তো সুপারম্যান নেই জিন আছে…তাই জিনের সাথে তুলনা করেছি।তোর মনে নেই,একদিন রাতে জিন দেখবো বলে পুরাবাড়িতে গিয়েছিলাম।কিন্তু ওখানে জিন তো দেখা দূরে পরে থাক কয়টা মাতাল ছেলে আমাদের আটকে রেখেছিলো।”
-“তা আর মনে নেই,একটা রুমে আটকে রেখেছিলো,ভয়ে তো আমার জান যায় যায় য়ুহার।ভাইয়া না আসলে নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক করতাম।”
-“ভাইয়া কত সুন্দর করে আমাদেরকে ওদের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে বের করে এনেছিলো।তখন থেকে ওনার নাম জিন দিয়েছি।দেখ অর্কভের পর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনা রে।আমাকে ক্ষমা করিস।”
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে ও নিজের চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের ব্যাক্তিকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়।একে দেখলে ওর মনের মধ্যে এক ধরনের শান্তি কাজ করে।
-“কখন উঠলি তুই?”
-“অনেক আগে…তুমি এসে ডাকনি কেন?”
-“ঘুমাচ্ছিলি তাই ডাকিনি..জানিস তোকে ঘুমালে কত সুন্দর লাগে।ছোট একটা বিড়াল ছানা মনে হয়।কিন্তু তুই না ঘুমিয়ে চোখের নিজে কালো করে ফেলেছিস।”
-“তুমিও তো করেছো,নিজেরটাও দেখো..শুধু আমারটা দেখলে চলে।”
-“তুই তো আমার বাচ্চা..তোরটা না দেখলে কারটা দেখবো বল।আঠারো বছর আগে ফুপিকে বলেছিলাম তুই আমার বোন না,বিড়াল ছানার মতো আমার বাচ্চা।আর ফুপিও সেদিন হেসে বলেছিলো,”হ্যাঁ,এটা তোরই বাচ্চা..”আমার বিড়ালটা মারা যাওয়ায় খুব কেঁদেছিলাম।আর ওই দিন তুই হলি।তোকে যখন কোলে নিয়ে ছিলাম তুই অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়েছিলি। সেদিন তোকে পেয়ে সবাইকে বলেছিলাম তুই আমার বাচ্চা।”
ইয়ারাবী য়ুহারের কথা শুনে হেসে দেয়।এই আঠারো বছরে অনেকবার গল্পটা শুনেছে ও।তবুও য়ুহারের সাথে দেখা হলে,য়ুহার বারবার গল্পটা বলে।ইয়ারাবী য়ুহারের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বলে,
-“তোমার কীসের কষ্ট একটু বলবে আমার?আমিতো এখন বড় হয়ে গেছি…”
-“আমাদের কষ্টের কারণটা ভিন্ন হলেও পরিমানটা এক…না না এক না,তোরটার সমান আর কারো নেই।ঠিক চারা গাছের মতো..যেমন প্রতিটা গাছের জীবনের আলাদা আলাদা কাহিনি হয় তেমন মানুষেরও।”
-“আপু খাবেনা?”
-“না রে সকালে নাস্তা করে পেট ভরে গেছে”
-“তুমি না খেলে আমিও খাবোনা…আমার তো অতো ভাগ্য নেই যে মিসেস ইশানি আমাকে খাইয়ে দিবে।কালরাতে কীভাবে জানি হাতটা কেটে গেছে।তাই ভাবছিলাম তোমার কাছে খাবো”
-“তোর হাত কেটেছে আর তুই জানিস না।”
ইয়ারাবী নিজের ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“না আপি,রাতে ঠিকভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম।সকালে নামায পরতে উঠে দেখি হাতে ব্যান্ডেজ করা।”
য়ুহার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-“চল তোকে খাইয়ে দিবো।”
-“না থাক তুমি না খেলে খাবোনা।আমি না খেলে ভাইয়া,খালামনি আর আবরারের বকা থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।আবার কীসের যেনো মেডিসিন নিতে হয়…ভালো লাগেনা এসব।”
য়ুহার ইয়ারাবী মুখটা উচু করে বলে,
-“হ্যাঁ রে,আবরার ভালোবাসে তো তোকে?”
-“জানিনা,আমার মতো মেয়েকে কে ভালোবাসবে?”
-“বুদ্ধু ওর কেয়ার নেওয়া তোর প্রতি ভালোবাসা,ওর শাষন করা,ওর বকা দেওয়া হলো ভালোবাসা।”
-“চলোতো…”
ইয়ারাবীদের গ্রামের বাড়ির ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড় আর অনেক পুরানো আমলের।১৫ জন একসাথে বসে খেতে পারবে এই টেবিলে।ইয়ারাবীর নানারা ছিলো যৌথ ফ্যামিলি,তাই সবাই একত্রে বসে খাবার খেতো।প্রথমে বাড়ির জামাইদের একসাথে বসানো হয়েছে।ইয়ারাবীর হাত কেটে গেছে তাই য়ুহারের সাথে বসবে বলে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেক কিছু আয়োজন করা হয়েছে,দুধ দিয়ে হাঁসের মাংস,চালের রুটি,ভুরি ভাজি,রুই মাছ মুড়ি ঘন্টো,নারিকেল দিয়ে ভুনা খাসির মাংস, কষানো গরুর মাংস,মুরগির মাংসের চপ,চিংড়ি মাসের মালাই কারী,সবজি আর রংপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘শোলকা’।আবরার অনেকদিন যাবৎ দেশের বাইরে ছিলো।তাই খাওয়ার সময় একটু সমস্যা হলো।বিশেষ করে যখন মিসেস ইশানি ওর প্লেটে ‘শোলকা’ দেয়।ও কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“আম্মু এটা কী?”
-“‘শোলকা’এখানকার জনপ্রিয় একটা খাবার।”
-“একটু বলবেন এটা কীভাবে বানায়?”
মিসেস ইশানি হেসে বলেন,
-“শাক দিয়ে শোলকা রান্না করা হলেও ভিন্ন স্বাদের এই খাবার তৈরির প্রক্রিয়াটা একটু জটিল। এই খাবার রান্না করতে পাটশাকের পাতা,খাবার সোডা,পাঁচ থেকে সাত প্রকারের শাকের পাতা,গরম পানি,লবণ,কাঁচা মরিচ,রসুন,আদা কুচি লাগে।শোলকা রান্নার প্রধান উপকরণ পাটশাকের পাতা। এই পাতা কাটার ধরনটা একটু ভিন্ন। পাটশাকের পাতা গুছিয়ে হাতের মুঠো ভর্তি করে নিয়ে কুচি কুচি করে কাটতে হয়।পাটশাক যেহেতু একটু তিতে হয় তাই এর তিতেভাব কাটানোর জন্য আরও পাঁচ থেকে সাত প্রকারের শাকের পাতা একটু করে দেয়া হয় শোলকার উপকরণ হিসেবে। এতে লাউ শাকের পাতা, কুমড়া শাকের পাতা, পুঁইশাকের পাতা, কচু পাতা, সজনে ডাটার পাতা, নাপা শাকের পাতাসহ হাতের নাগালে যা পাওয়া যাবে সেই শাকের পাতা কুচি কুচি করে এতে দেয়া যাবে।
প্রথমে অল্প পরিমাণে পানি গরম করে সেখানে পরিমাণ মতো লবণ, কাঁচা মরিচ, রসুন এবং সোডা দিয়ে নেড়ে,মূলত শোলকাকে পিচ্ছিল করার জন্য এক চিমটি খাবার সোডা দেয়া হয়। এবার কেটে রাখা পাটশাকসহ অন্য শাক দিয়ে , একটু সিদ্ধ হলে দিয়ে অল্প একটু আদা কুচি। ১০ থেকে ১৫ মিনিট হালকা আচে নাড়ুন। ব্যাস হয়ে গেল প্রিয় ‘শোলকা’। আর শোলকার মধ্যে কাঁঠালের বিচি দিলে তো কথাই নাই। এর স্বাদ হয় আরও অসাধারণ।কিন্তু এখন তো কাঁঠালের বিচি নেই তাই আর দেওয়া হয়নি।ভালো লাগবে একবার খেয়ে দেখো।”
আবরার জীবনে কোনোদিন পাটশাক খায়নি।ও খাবারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।ইয়ারাবী আবরারের চেহারা দেখে হেসে দিয়ে বলে,
-“খেয়ে নিন,ভালো লাগবে আপনার।”
-“এইতো খাচ্ছি….”
বলেই রুটির টুকরা ছিড়ে গালে দিয়ে বলে,
-“জাস্ট ওসাম,আমি আগে কখনো খায়নি।”
-“তো এবার খেতে থাকুন।”
-“তুমিও খেয়ে নাও…দেরি করলে সমস্যা হবে”
ইমন খেতে খেতে বলে,
-“আমার কাছে আয় খাইয়ে দি।”
য়ুহার ইমনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে,
-“তুই খা,ওকে আমি খাইয়ে দিবো। আমার রুমে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
ইয়ারাবী যেতেই ইফাজ য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই খাইয়ে দিবি ভালো কথা,ওকে গরুর মাংস,শোলকা আর নারিকেল দেওয়া কিছু দিসনা।”
-“জানি আমি, বলতে হবেনা তোমার।”
য়ুহার ওর আর ইয়ারাবীর খাবার নিয়ে রুমে চলে যেতেই আবরার অনুভব করে টেবিলের নিচে কেউ ওর পায়ের সাথে পা দিয়ে স্পর্শ করে বাজে কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।আবরার জারিকার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ওর পায়ে জুতা দিয়ে জোরে একটা পারা দেয়।জারিকা ব্যাথায় অনেক জোরে চিল্লিয়ে উঠে।সমীর জারিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে তোমার?”
জারিকা নিজেকে সামলে বলে,
-“না আসলে চ্ চেয়ারের সাথে গুতা খেয়েছি।”
(৭২)
-“জানো হিউম্যান সাইকোলোজি কি বলে?”
-“আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়ি নাকী?”
আবরার ইয়ারাবীর কথা শুনে হেসে বলে,
-” যদি কোনো মানুষ ঘুমায় না,তবে তার মনের মধ্যে একপ্রকার ভয় বাসা বেঁধেছে।যদি কোনো মানুষ সবসময় কম কথা বলে আর যখন কথা বলে তখন খুব দ্রুত বলে,তবে সে কিছু লুকাতে চায়।কখোনো না কাঁদে বা কাঁদতে না জানে তবে,সে জীবনে অনেক বড় কোনো ব্যথা পেয়েছে।আর জানো এই সবগুলো তোমার মধ্যে আছে।”
ইয়ারাবী রেলিংএর উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলো এতক্ষণ।আবরারের কথা শুনে নিচে নেমে বলে,
-“কখনো না,আমি তো ঘুমায়…এক ঘুমে রাত কভার করেদি।আর আমি এমনিতে কম কথা বলি।”
আবরার ওর কথা শুনে হেসে বলে,
-“তোমার কী সত্যি মনে হয় তুমি এক ঘুমে রাত কভার করো?”
-“মানে?আমিতো ঘুমাই…”
এর মধ্য য়ুহার দিঘীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য ডাক দেয় ইয়ারাবীকে।ও আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু ডাকছে,যাবো আমি?”
-“কোথায়?”
-“দিঘীর পাশে,শীতের সময় অনেক সুন্দর লাগে দিঘীটা।”
-“না গেলে হয়না…ভয় পাবেনা একা গেলে?”
-“আপুতো আছে,আপনি নিষেধ করলে যাচ্ছিনা।”
আবরার হেসে ওর চশমাটা হাতে দিয়ে বলে,
-“যাও ঘুরে এসো,..সাবধানে যাবে আর আপুর সাথেই থাকবে। আই থিন্ক একটু পরে বাড়িতে প্রচুর লোক হবে,তাই তাড়াতাড়ি এসে গুছিয়ে নিবে।”
-“আচ্ছা।”
ইয়ারাবী সিড়ি দিয়ে নেমে দৌঁড়ে নিচে চলে যায়।আবরার রুমে ঢুকে ওর জ্যাকেটটা খুলে কাবার্ড থেকে ওর জামা বের করছে।জ্যাকেটের নিচে ওর হাফ হাতার কালো রঙের টি-শার্ট পরা ছিলো।জিম করা বডি এই রঙে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।হঠাৎ কেউ ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলে আবরার না ঘুরেই বলে,
-“আমার রাগের শিকার না হতে চাইলে,এখান থেকে চলে যাও জারিকা।সম্পর্কে তুমি আমার বড়ো।তাই আমি চাইনা কোনো সিনক্রেট করতে।”
জারিকা ওকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“কামঅন,আবরার আমি জানি তুমি এতটাও শুদ্ধ ব্যক্তি নও…এতদিন বিদেশে ছিলে,বললেও তো বিশ্বাস হয়না।আর বয়সে আমি তোমার ছোট..”
আবরার বাঁকা হেসে বলে,
-“আরে বাহ্,তুমি তো দেখছি সবটাই বুঝতে পারো।বাট্ আই এম্ সো সরি,আমি কোনো রাফ ইউজ্ প্রোডাক্ট ইউজ্ করিনা।”
-“তাহলে স্বীকার করছো,তুমিও সরেশ ব্যাক্তি নও।”
আবরার ওর পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে,
-“তো কাকে আমার আগে তুমি নিজের শিকার বানিয়েছো?নিশ্চয়ই সে তোমার সম্পর্কে দোলাভাই হবে,এম আই রাইট?”
ওর কথা শুনে জারিকা কিছুটা চমকে যায়।কেননা কারোর ধারনা বাইরে যে ও পরিবারের ভিতরে কাউকে নিজের বশে করেছে।আর এক মুহুর্তে আবরার ওকে সবটা বলে দিচ্ছে।জারিকা নিজেকে সামলে বলে,
-“এমন কাউকে নয় আবরার,”
-“লিসেন্ জারিকা,ডোন্ট ইউ্ নো মি?মানুষের চোখের ভাষা দেখে সবটা বুঝতে পারি।”
জারিকা বিছানার উপর বসে হঠাৎ ওর চোখ একটা প্লাজু আর গেন্জিতে আটকে যায়।দু’টাই খুব দামী আর ডিজাইনার।জারিকা ওই দু’টা হাতে নিয়ে বলে,
-“তুমি ইয়ারাবীকে এগুলো পরতে দাও?”
আবরার ওর কথা শুনে ওর দিকে ঘুরে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কেন?”
-“না বিয়ের আগে দেখতাম,বাট্ এতো দামী নয়।আর এখন তো এসে ধরে লং ড্রেস পরছে।”
-“আমার স্ত্রীর সৌন্দর্য শুধু আমার দেখার অধিকার আছ,তাছাড়া ও কমফোর্টেবল ফিল করে এগুলো পরে এজন্য কিনে দিয়েছি।”
-“রাতে ঘুমানোর জন্য এতো দামী পোশাষ কিনে দিয়েছো?”
-“শুধু এটাই দেখলে,ও যে নরমাল ড্রেসটা বর্তমানে পরে আছে কমপক্ষে ওটার দাম সাত হাজার টাকা।ও শাড়ি পরতে পারেনা বলে এগুলো কিনে দিয়েছি।”
-“এতো খরচ কেন করছো ওর পিছনে?”
-“আমার বৌ আর আমি করবোনা তো কে করবে?”
-” আমি কিন্তু জানি ইয়ারাবীর প্রবলেমটা,যতই তুমি ধামাচাপা দিতে চাওনা কেন?”
আবরার ওর হাত থেকে ড্রেসটা নিয়ে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বলে,
-“কী জানো তুমি?”
-“ওটাই যেটা কাল রাতে হয়েছি।আসলে কী বলতো তোমাকে দেখার পর ঘুম আসছিলোনা তাই এখানে এসেছিলাম কিন্তু রাতে যা শুনলাম…”
-“তোমার মনে হয়না তুমি খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে,কেননা কেউ আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করুক সেটা আমার একদম পছন্দ নয়।”
জারিকা তাসছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-“তুমি আগে জানতে তো ও মেন্টালি সিক।”
-“তুমি জানো,তুমি এক…থাক বাজে উচ্চারন করতে ভালো লাগছেনা এখন।বাট্ ট্রিটমেন্ট সবার প্রথমে তোমার দরকার।”
জারিকা রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে কী বলতে চাও?”
-“এটাই যে এটা তোমার নেশাতে পরিনত হয়েছে,এখন ভালোই ভালোই এখান থেকে বেরিয়ে যাও।আমার রাগ খুব মারাত্মক,যারা দেখেছে তারা জানে।তাছাড়া আমি চাইনা ইয়ারাবী তোমাকে এখানে দেখুক।”
-“যাচ্ছি যাচ্ছি…”
জারিকা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়।এর মধ্যে দরজায় কেউ নক করে,ও মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ইফাজ।
-“ম্যাডাম ঘরে নেই,য়ুহার আপুর সাথে দিঘীতে গেছে।”.
-“ওহ্,জারিকাকে দেখলাম।ও রুমে এসেছিলো নাকী?”
-“হামম,যা বলার দরকার তাই বললো”
-“ও তোকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে।”
-“তোর কী মনে হয়?”
-“ও যদি ডালে ডালে চলে তবে তুই চলিস পাতায় পাতায়।আচ্ছা,ইয়ারাবীর হাতে ব্যান্ডেজ দেখলাম, জিজ্ঞাস করবো মনে ছিলোনা…কী হয়েছে?”
আবরার ইফাজদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কাল রাতে প্রচুর হাইপার হয়ে গেছিলো,তবে অবাক ব্যাপার হলো সকালে ওর কিছু মনে নেই।
কাল রাতে আমরা রুমে এসে শুয়ে পরছিলাম।রাত দু’টার দিকে ও ভয় পাচ্ছিলো আর ঘুমের ঘোরে বারবার বলছিলো,”আমি কিছু করিনি,আমাকে মারছো কেন?”ওকে জাগিয়ে দেওয়ার পর ও আমাকে দেখেও ভয় পাচ্ছিলো,হাতে যা পাচ্ছিলো সেটাই আমার দিকে ছুরে মারার চেষ্টা করছিলো।খাটের এই ধারালো কর্ণারের সাথে ডানহাত টা লেগে কেটে যায়।অনেক টাইম লেগেছিলো ওকে কন্ট্রোল করতে।”
ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে গুছাতে শুরু করে।এর মধ্য ইয়ারাবীরাও ফিরে আসে।ওর রুমে ঢুকতেই আবরার ওর দিকে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে,
-“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও…”
ইয়ারাবী প্যাকেটটা খুলে দেখে পেস্ট কালারের অনেক সুন্দর আর দামী একটা গাউন।ওর সাথে ওড়নাটাও অনেক সুন্দর।তবে ও দূর থেকে ওদের এই খুশি জারিকার সহ্য হচ্ছেনা।আজ জারিকা একটা শারি পরেছে ব্লু-কালারের,সামীর এখানে আসার আগে কিনে দিয়েছিলো।এই শাড়ি ওই গাউনের কাছে খুব নগন্য।ইয়ারাবী ফুল হাতার জ্যাকেটটা খুললে জারিকার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে,কেননা ইয়ারাবীর গলায় আর হাতে ডায়মন্ডের জুয়েলারি দেখে।জারিকা মনে মনে এক অংক কষে নেয়,ভাবতে থাকে ও যদি আবরারকে হাত করতে পারে তবে সোনায় সোহাগা।
#চলবে_____