প্রস্থান — ২৩তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
২৭.
সন্ধ্যেবেলা ঘুম ভাঙল চিত্রার। দুপুরের শেষ দিকে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল, তখন দুই চোখে আঁধার নেমে এসেছিল। সেই ঘুম ভাঙল এখন। বিছানা থেকে নেমে, হাই তুলতে তুলতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পশ্চিমের আকাশটা লালচে হয়ে আছে। কিছু মেঘ দলা বেঁধে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। চারিদিক মৃদু কালো। সূর্যটা হয়েছে একটা ডিমের কুসুমের ন্যয়। হঠাৎ দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসতেই চোখ তাঁর ঘুম পুরোপুরি ভাবে চলে গেল। মাগরিবের আজান হচ্ছে!
জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল চিত্রা। ফ্রেশ হয়ে, অজু করে নামাজটা পড়ে নিলো।
নামাজ শেষ করে যখন ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়াল, তখনই বাবা-মায়ের কথপোকথন শুনতে পেলো সে। থমকে দাঁড়াল আলোচনায় নিজের নামটা শুনে।
চিত্রার মা বলছেন, “মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি থেকে এলো প্রায় ২ সপ্তাহ হয়ে এলো। এর মধ্যে একটা বারও জামাই এলো না। কতবার জিজ্ঞেস করলাম ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে কী-না, কিন্তু সে তো প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে, কিছু বলবে না! অথচ সারাদিন মুখ ভার করে ঘরে বসে থাকে।”
চিত্রার মায়ের কথার জবাবে চিত্রার বাবা বলল, “আহা! কী আবার হবে? বিয়ে হয়ে গেছে বলে কী বাবার বাড়ি আসার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে মেয়ে?”
“কথা অধিকার নিয়ে না। কথা হলো, তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই ওই বাড়িতে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে।”
চিত্রার বাবা কণ্ঠটা চাপা করে বলল, “চুপ। কী যা-তা বলছ? আমাদের মেয়ে এমন নাকি? ওকে দেখেছ কারোর সাথে ঝগড়া করতে?”
“আহা! আমি তো বলছি না আমাদের মেয়েরই দোষ। বলছি, ওই বাড়িতে বড়সড় কোনো ঘটনা ঘটেছে। না-হলে ২ সপ্তাহ ধরে মেয়েটা এখানে আছে, অথচ জামাইয়ের দেখা নেই। এটা কেমন কথা ভাই?”
“তুমি এত ভেবো না তো। জামাই তো বলেছে সে ব্যস্ত থাকবে বেশ ক’দিন। সেজন্যই হয়তো আসতে পারছে না। তাছাড়া চিত্রা তো বলছে ওর সাথে প্রতিদিন কথা হয় ফিরোজের।”
“সেটা তো চিত্রার মুখের কথা। আমরা কখনো দেখেছি, বা শুনেছি? আল্লাহ জানে, কী হয়েছে ওই বাড়িতে। তোমাকে কতবার বললাম একবার ফিরোজের বাবা অথবা মা-কে ফোন করো। তুমি করলে না। বললে, ‘আরে, এভাবে জিজ্ঞেস করা যায় নাকি?’ যদি বড় কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা সমাধান তো করা জরুরি। এভাবে আর কতদিন এই বাড়িতে থাকবে ও? আমি তো নিশ্চিত, কিছু না কিছু অস্বাভাবিক আছে।”
চিত্রার বাবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তুমিও না। ও এখানে আছে, তাতে তোমার কী অসুবিধা হচ্ছে?”
“অসুবিধে তো আমার নেই। আমার মেয়ে আমার বাড়িতে আছে, এতে আমার সমস্যা থাকবে কেন? কিন্তু প্রতিবেশীরা তো প্রশ্ন করে করে মাখা খাচ্ছে! এইসব আর ক’দিন সহ্য করতে হবে?”
“তুমি এমন ভাবে কথা বলছ, যেন বিয়ে হয়ে গেছে বলে ও আমাদের পর হয়ে গেছে। কেন সহ্য করবে লোকের কথা? জবাব দিয়ে দিবে। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে এসেছে, তাতে উনাদের কী? যত্তসব ফাউল লোকজন।” কড়া ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি।
“উঁহু! তুমি আমার কথার ভুল অর্থ বের করছ। চিত্রা থাকাতে আমার সমস্যা নেই। আমার সমস্যা হলো, ওর এমন দুঃখী দুঃখী হয়ে বসে থাকা নিয়ে! এটা আমার ভালো লাগছে না। বিয়ের আগে কত হাসিখুশি ছিল আমাদের মেয়ে। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর এত দ্রুত চেঞ্জ হয়ে গেল? আমি নিশ্চিত ও ওই বাড়িতে একটুও সুখে নেই।”
চিত্রার বাবা এবার রাগ দেখিয়ে বলল, “তুমি কীভাবে এত নিশ্চিত ভাবে এ-কথা বলছ? সবটা পজিটিভলি চিন্তা করো না একটু। ফিরোজের ব্যস্ততা শেষ হলেই ওকে নিতে আসবে।”
দরজার কাছ থেকে সরে এলো চিত্রা। আর ভালো লাগছে না এইসব শুনতে। গত ৭দিন ধরে চলছে এইসব। প্রথম সপ্তাহে ফিরোজ না আসাটা তাঁদের বিচলিত না করলেও আজ দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর উনারা একেবারে চিন্তায় পড়ে গেছে তাকে নিয়ে। সারাক্ষণ এক কথা, মেয়ে আর ক’দিন এখানে পড়ে থাকবে, জামাই কেন নিতে আসছে না, ঝগড়া-ঝাটি হলো কী-না; এইসব। ইদানীং তাঁর মনে হচ্ছে, সে সত্যিই বিয়ের পর এই বাড়ির বাইরের একজন হয়ে গেছে। এখানে থাকতে গেলেও শক্তপোক্ত কারণ চাই। অবস্থাটা এমন যে, মেয়েকে ৭দিন রাখার পর যেন তাঁরা হয়রান হয়ে গেছে। বোঝা মনে হচ্ছে এখন।
এভাবে কেটে গেল আরও দু’দিন, ফিরোজ এলো না এর মধ্যে। আজকাল তাকে ফোনেও পাওয়া যায় না দুই মিনিটের জন্য। প্রায় সময়ই ওপাশ থেকে ব্যস্ত বলে। কখনো অফ থাকে, কখনো আবার ফোন রিসিভ হওয়ার পর নেটওয়ার্ক খারাপের এর কথা বলে ফিরোজ ফোন কেটে দেয়। কখনো কখনো তো ‘কেমন আছো’ বলার সময়টুকুও পাওয়া যায় না, এত ব্যস্ত উনি! এই দুই সপ্তাহে বেশ শুকিয়ে গেছে চিত্রা। খাওয়াতে ভীষণ অনিয়ম। বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করে না তাঁর, খেতে। প্রায়ই শুয়ে থাকতে হয় তাকে। এছাড়া আর কাজ নেই। বাড়ির কারোর সাথেও কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ একই প্রশ্ন শুনতে কার ভালো লাগে? লোকগুলো যেন খাওয়াদাওয়া বিসর্জন দিয়ে তাঁর পিছনে পড়েছে। ভালো-মন্দ যা হোক, ঘটনা তাঁদের জানতে হবে। তাঁর অবস্থাটা এখন এমন যে, যতক্ষণ নিবিড় ঘুমে আবদ্ধ থাকা যায়, ততক্ষণই শান্তি। জীবনের গত হওয়া বছরগুলোতে এতটা কষ্ট সে পায়নি, যতটা গত ২ সপ্তাহে তাকে পেতে হয়েছে। চোখের জল তো যেন প্রস্তুত থাকে সবসময়, যখন-তখন টুপটাপ করে পড়ে; যা প্রচণ্ড অস্বস্তিকর!
চিত্রা মোবাইল বের করে ম্যাসেজে ফিরোজকে লিখল, “প্লিজ ফিরোজ, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। এভাবে আর বেশিদিন বাঁচবো না আমি।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করতে যাবে, তখনই যেন গায়েবি আওয়াজে কেউ তাকে উস্কিয়ে দিলো।
“আর কত বেহায়া হবি তুই, চিত্রা?”
চিত্রা ভাবল কয়েক মুহূর্ত, সত্যিই সে বড্ড নির্লিজ্জ হয়ে গেছে এই ক’দিনে। এতবার ম্যাসেজ দিয়েছে ফিরোজকে। একটাও রিপ্লাই দেয়নি। তবুও সে বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছে, যেন নাছোড়বান্দা! আর ফিরোজ যেন আল্লাহর কসম খেয়ে নিয়েছে, তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখবে না আর। তাকে এভাবেই শায়েস্তা করে যাবে।
মোবাইলে টাইপ করা লেখাটুকু মুছে ফেলল চিত্রা।
একদিন বিকেলে বোনের সাথে বেরোলো চিত্রা। বোনই জোড়াজুড়ি করল, কিছু কেনাকাটা করবে সে, সাথে তাঁর থাকাটা খুবই জরুরি। অনেকক্ষণ পর চিত্রা হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হলো ওর সাথে শপিং মলে যেতে। নাহলে কানে পোকা ধরিয়ে দিতো।
হ্যাপি জামা-কাপড় কিনল কয়েকটা, চিত্রার মন নেই কেনাকাটায়, তবুও একটা শাড়ি কিনল, পছন্দ করে দিলো হ্যাপি। ফিরোজের জন্য একটা “ডার্ক-রেড” শার্ট কিনল। জামা-কাপড় কেনা শেষে যখন কসমেটিকস কেনার জন্য গেল ওরা দু’জন, তখন একটা দোকানে হ্যাপির চোখ গেল; একটা মুখ দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল, “আপু, দেখো কে। কনা। তোমার ননদ।”
চিত্রা উৎসুকভাবে তোকাল সেদিকে, সত্যিই কনা। কয়েকটা মেয়ে ওর পাশে, হেসে হেসে কথা বলছে ওদের সাথে, আর কসমেটিকস দেখছে। এগিয়ে গেল সে, দ্রুত পায়ে।
“কনা।” পিছনে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠল চিত্রা।
কনা চমকে ওঠে পিছনে তাকাতেই চিত্রাকে দেখল, চোখ গোল গোল করে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আরে ভাবি, তুমি এখানে? কী আজব!”
চিত্রা আরও কাছে গিয়ে কনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “আমিও খুব অবাক হয়েছি তোমাকে দেখে। তবে বেশ ভালো লাগছে। কতদিন দেখি না তোমাকে।”
“হ্যাঁ। এইতো ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে এলাম। কেমন আছো তুমি?”
চিত্রা জবাবে বলল, “আমি ভালো আছি। তুমি তোমার কথা বলো। বাড়ির সবার কথা বলো। কেমন আছে সবাই?”
কনা ঠোঁট টিপে, ভাবির কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, “তোমাকে ছাড়া সবাই ভালো থাকতে পারে? বাবা তো রোজ ভাইয়াকে বকাঝকা করে, কেন তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে না। আমিও বড্ড একা হয়ে গেছি বাড়িতে। মা-কে তো জানো; উনার সাথে যে আমার খুব ভাব, তেমন তো না। ভাইয়া আর বাবা তো অফিসে চলে যায়। পড়ে থাকি আমি আর সুলতানা। সে বেচারিরও খুব মন খারাপ। বলে, ‘ভাবি থাকলে কোথা দিয়ে সময় চলে যায় বুঝতেই পারি না। কাজ করতেও ভালো লাগে। এখন দুপুরে যখন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, সূর্যটা তো নড়তেই চায় না।’ রাতেও নাকি ঘুম আসে না ওর। আসলে তুমি আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছ। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার বকবকানি না শুনলে মনে হয়, ভেতরটা বড্ড তৃষ্ণাদগ্ধ হয়ে আছে!”
চিত্রার দুই চোখ ভিজে এলো জলে। বাড়ির সবাই তাকে এতটা মিস করবে, এই অল্প ক’দিনে তাকে এতটা আপন করে নিবে, তা সে বুঝতে পারেনি। আজ তাকে সবার বড্ড প্রয়োজন।
চিত্রাকে আবেগের শোকে দেখে কনা ওর একটা হাত মৃদু চাপ দিয়ে অনুনয় করে বলল, “তুমি প্লিজ ফিরে চলো বাড়িতে।”
চিত্রা বিমর্ষ কণ্ঠে জবাব দিলো, “আমি তো যেতেই চাই। কিন্তু একা কীভাবে চলে যেতে পারি? এসেছিলাম তো তোমার ভাইয়ের সাথে। ও না নিলে আমি যাই কীভাবে বলো?”
কনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি তো আছি। তুমি আমার সাথে চলো, এক্ষুণি।”
“তা হয় না, কনা।” চিত্রার কণ্ঠে নিরুপায় সুর! সে বলল, “তোমার ভাই যদি আবার রাগ করে?”
“এতে রাগ করার কী আছে? বাড়ির বউ বাড়িতে যাবে না? অদ্ভুত কথা!” হতবিহ্বল হয়ে, চোখ বড় বড় তাকিয়ে থাকল কনা; জবাবের আশায়।
চিত্রা বিবর্ণ মুখে সহসা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি টেনে বলল, “এতগুলো বছরেও তুমি যখন তোমার ভাইকে বুঝতে পারোনি, তখন এই ক’টা মাসে আমি কীভাবে বুঝতে পারব? আমি তো এখনো বুঝতে পারিনি, কোন ব্যাপারে ও খুশি হয়, আর কোন ব্যাপারে নারাজ হয়। শুধু বুঝতে পারি, ও অন্যের আবেগ দিয়ে খেলা করতে খুব পছন্দ করে।” শেষের কথাটা বড্ড ভার কণ্ঠ আর হৃদয়াবেগ থেকে বলল সে।
“মন খারাপ করো না, ভাবি। চলো, আমরা কোথাও বসে কথা বলি।” চিত্রাকে সান্ত্বনা দিয়ে কনা নিজের বন্ধুদের দিকে তাকাল আবার। বলল, “এই, যা কেনাকাটা করার কর তোরা। আমি আসছি একটু পর।”
সবাই মাথা ঝাঁকাতেই কনা, চিত্রা আর হ্যাপি একটা কফি-শপে গিয়ে বসল।
কফি অর্ডার দিয়ে কনা মুখে হাসি টেনে বলল, “ওদিকে বাড়িতে কী ঘটনা ঘটেছে জানো? শুনলে একেবারে চমকে যাবে তুমি।”
“কী ঘটেছে?” জানতে চেয়ে কৌতূহল ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চিত্রা।
কনা চোখ পিটপিট করে বলল, “বাবা রশ্মিদের বাড়িতে গেছিল, রশ্মি আর সুব্রত ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”
চিত্রা তাজ্জব বনে গেল কথাটা শুনে। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “বলো কী!”
কনা দৃঢ় গলায় বলল, “অবশ্যই সত্যি।” এরপর গলার আওয়াজ কিছুটা নামিয়ে বলল, “তবে রশ্মির মা কড়া অসম্মতি জানিয়েছেন। সুব্রত ভাইয়ের সাথে উনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। প্রথমে ঘটনাটা শুনে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। সত্যতা জানার জন্য আমি রশ্মির কাছে গেলাম, ও বলল, আমি যেটুকু শুনেছি, ও নিজেও সেটুকু শুনেছে। ওর কথা শুনে, তবে সুনিশ্চিত হলাম। একবার জাস্ট ভাবো, সুব্রত ভাইয়ের সাথে রশ্মির কীভাবে মিল হতে পারে?”
চিত্রা রসিকতা করে বলল, “আমি কিন্তু খারাপ দেখছি না ব্যাপারটা। দুজনেরই দেবদাস টাইপ হাবভাব। জুটি চমৎকার! কাহিনি ব্লকবাস্টার হবে।”
কনা হাসল সশব্দে। চিত্রাও। একটু পর হাসি থামিয়ে সে বলল, “একবার শুধু বাড়িতে ফিরতে দাও, এরপর দেখবে তুড়ি মেরে সব ঠিক করে দিবো।” আরও কিছুটা তীক্ষ্ণ চাহনি রেখে চিত্রা জানতে চাইল, “আচ্ছা, সুব্রত ভাই জানে, যে উনার সাথে রশ্মির বিয়ের চিন্তাভাবনা করেছেন বাবা?”
“নাহ্! পাগল নাকি? কে বলতে যাবে উনাকে? এক্ষেত্রে তুমিই একমাত্র ভরসা। যা রাগ ওর। তুমিই সামলাতে পারো। তোমার সাথে ভালো সম্পর্ক কী-না।”
চিত্রা হঠাৎ চোখ-মুখ শক্ত করে তীব্র রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “তোমার দুটো ভাই-ই একরকম। এত রাগ শরীরে।! কোত্থেকে অর্জন করল এই রাগ?”
কনা হাসল চিত্রার কথা শুনে। মুখে বলল, “তোমার উপরও কিন্তু আমার কিছুটা রাগ আছে। বাপের বাড়ি গিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকদের একেবারে ভুলেই গেছ তুমি এই ননদিনীকে আর মনে পড়েনি, তাই না? কতদিন ফোন করলাম, রিসিভ করলে না।”
চিত্রা কিছু বলল না। কনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
কনা আবার বলল, “রশ্মিও তোমার খোঁজে বেশ ক’বার এসেছিল। বেচারির একমাত্র ভালো বন্ধু তুমি। আমার সাথে তো প্রতিবেশী সম্পর্ক।”
চিত্রার মন খারাপ হলো আরও। এতকিছুর মধ্যে তাঁর একবারও মনে হয়নি, রশ্মিকে ফোন দেওয়া উচিত। সে বলল, “ওকে বলতে পারতে, আমাকে একটা ফোন দিতে। আমার নম্বর তো ছিল ওর কাছে।”
“হয়তো অভিমান হয়েছে। প্রথমত ওকে না বলেই চলে গেছিলে। আবার যাওয়ার পর নিজে থেকে একটা ফোন পর্যন্ত দাও নি। তবুও এর মধ্যে চার-পাঁচ বার এসেছিল তোমার খোঁজে। কবে আসবে তুমি, কেমন আছো, ফোন করেছিলে কী-না, এইসব খোঁজ নিতে।”
চিত্রা মলিন কণ্ঠে বলল, “কী করব বলো, মনটা একেবারেই বিতৃষ্ণায় ডুবে আছে। কিছু ভালো লাগছে না। জীবনটা এমন জায়গায় থমকে গেছে যে, মনে হচ্ছে ঘড়ির কাটাটাও বোধহয় আর ঘুরছে না।”
“তুমি একবার অন্তত ফোন কোরো ওকে।”
চিত্রা মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করে বলল, “না। ফোন করব না। যেদিন ওই বাড়িতে যাব, সেদিন সামনাসামনি অভিমান ভাঙাব।”
কফি এসেছে। সবাই কফি খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল। শেষ বন্ধুদের ফোন পেয়ে কনা উঠতে চাইলে চিত্রা বলল, “আচ্ছা, সুব্রত ভাইয়ের নম্বর আছে তোমার কাছে?”
কনা গম্ভীর গলায় বলল, “আছে তো। কেন, তোমার কাছে নেই?”
“না। আগে তো প্রয়োজন পড়েনি। একটু দাও তো। কবে ওই বাড়িতে যাই, তার ঠিক নেই। একটা অন্যায় করেছিলাম। ক্ষমা চেয়ে নিবো। যদি পরে সুযোগ না পাই।”
চিত্রার কথাগুলো বুঝতে পারল না কনা, কিন্তু তাড়া আছে বলে আর প্রশ্ন করল না। মোবাইল বের করে নম্বরটা দিলো সে।
চিত্রা নম্বরটা নিজের মোবাইলে সেভ করে বলল, “আমি যে তোমার থেকে সুব্রত ভাইয়ের নম্বর নিয়েছি, সেটা কাউকে বলো না। ফিরোজ শুনলে আবার রাগ করবে। সুব্রত ভাই তো ওর দুই চোখের বিষ। তবুও ভালো তুমি ওর মতো উগ্র স্বভাবের না। নইলে নম্বর কই পেতাম?”
মৃদু হাসল কনা। আরও একবার আলিঙ্গন করে বিদায় নিলো।
সেদিন আর কসমেটিকস কিনল না ওরা, যে জামা-কাপড়গুলো কিনেছে, সেগুলো নিয়েই বাড়িতে ফিরে এলো।
ড্রয়িংরুমে পেরিয়ে ঘরে গিয়ে চিত্রা দেখল, পুরো ঘর অন্ধকার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অথচ কেউ আলো জ্বালায়নি এখন পর্যন্ত। বিরক্ত হয়ে সে হাতের প্যাকেটটা মেঝেতে ফেলে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। তখনই ঘটল তাজ্জব ঘটনাটা!
আচমকাই কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল চিত্রার উপর। অন্ধকারে কারোর মুখ দেখার উপায় নেই। তবে যেটুকু অনুমান করা যায়, চার-পাঁচ জন হবে নিশ্চিত। অতর্কিত হামলায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ল চিত্রা! আত্মরক্ষার জন্য শুধু মাথাটা চেপে ধরে বসল পড়ল। চোখ বন্ধ করে ফেলল ভয়ে।
হঠাৎ থেমে গেল তাণ্ডব! ঘরে আলো জ্বলল। এরপর খিলখিল হাসির আওয়াজ। চিত্রা মাথাটা সামান্য তুলে আতঙ্কে ভরা চাহনিতে তাকাতেই দেখতে পেলো, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ছেলে-মেয়ে বাঁদর। সবার মুখেই উল্লাসের হাসি। হাসি দেখে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
যে একমাত্র ভাইটা ছিল, সবচেয়ে ছোট বয়সে, চিত্রা দাঁড়িয়ে প্রথমে ওর কানটাই চেপে ধরল। বলল, “এত দুষ্টুমি! আর একটু হলে মরেই যেতাম, এত ভয় পাইছি।”
কারোর মধ্যে সামান্য অনুশোচনা দেখা গেল না। চিত্রা কানটা আরও জোরে মলে দিয়ে বলল, “দেবো নাকি কানটা ছিড়ে? ফাজিল কোথাকার। চোরের মতো ঘরে এসে লুকিয়ে ছিল সবগুলো।”
ছেলেটা মুখে ‘উউ’ আওয়াজ করে চেঁচিয়ে বলল, “ছাড়ো বলছি। আমরা চোর না।”
“তবে কী?”
অন্য একজন এগিয়ে এসে জবাব দিলো, “আমরা ছিনতাইকারী। যা শপিং করেছ, জলদি বের করে, আমরা দেখব; রাইট নাও।” মেয়েটা হাতের একটা আঙ্গুল সামনে এগিয়ে ধরল ছুরির মতো করে।
চিত্রা ছেলেটার কান ছেড়ে দিয়ে এবার মেয়েটার আঙ্গুল মুচড়িয়ে ধরল। ব্যথা দিয়ে বলল, “আমার জিনিসপত্র ছিনতাই করার খুব শখ, তাই না? দাঁড়া, জন্মের মতো ছিনতাই করার শখ মিটিয়ে দিচ্ছি।”
মেয়েটা ব্যথায় চিৎকার করে বলল, “আরে আপু, আমাকে ছাড়ো, ওদিকে দেখ। মুহূর্তেই সামনে ডাকাতি হয়ে গেল।”
চিত্রা ওর হাতের আঙ্গুল ছেড়ে পিছনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল! ইতোমধ্যে তাঁর শাড়ি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে বোনদের মধ্যে। সবাই চাচ্ছে শাড়িটা একটু গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখবে, কিন্তু সেই সময়টুকু বাকিরা অপেক্ষা করবে কেন? মোটকথা সবাই শাড়িটা প্রথমে গায়ে জড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু ওটা আস্ত থাকা অব্দি তা তো সম্ভব না, তাই এই টানাটানি! শার্টটা ভাইয়ের হাতে।
চিত্রাকে তাকাতে দেখেই ছেলেটা চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “আপু, এটা আমার, তাই না? আমি জানি এটা আমার। থ্যাঙ্কিউ।”
চিত্রা মুখটা বাঁকা করে সকৌতুকে বলল, “মোটেই না। এটা আমি ফিরোজ সাহেবের জন্য এনেছি।”
ছেলেটার ঝলমলে চেহারায় মুহূর্তে ঘন মেঘ বয়ে গেল। চট করে মলিন হয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “ও, তাই বলো।” এরপর মাথাটা ঝাঁকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আফসোসের ব্যাপার এই যে, সেদিন তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে আজ শার্টটা আমার হতো। যাই হোক, তোমার জন্য আফসোসের ব্যাপার এই যে, সবার ভাগ্যে ভালো বর জোটে না।”
চিত্রা ফিক করে হেসে, ওকে মারার জন্য এগোতেই ও দৌড়ে পালাল। সে হাসতে হাসতে আবার বোনদের দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই শান্ত হয়ে গেছে। শাড়ি গায়ে জড়ানো হচ্ছে পালাক্রমে, বড় থেকে ছোটর দিকে আসছে।
চিত্রার সে খালাতো বোনটা, যে তাঁর থেকে সামান্যই ছোট, সে এগিয়ে এসে বলল, “শাড়িটা খুব সুন্দর হইছে। কে পছন্দ করে দিলো?”
চিত্রা মৃদু হেসে বলল, “কে আবার, হ্যাপি। ওর পছন্দ দারুণ।”
মেয়েটা সমর্থন করে বলল, “হুম। একটু পরিশ্রম করলে নিশ্চিত ফ্যাশন ডিজাইনার হতে পারবে। মাথায় প্রভিতা গিজগিজ করছে।”
চিত্রা হেসে উঠল বোনের কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর সবার শাড়ি টেস্ট করা হলে সে জানতে চাইল, “হঠাৎ কিছু না বলে তোরা চলে এলি যে? আর কেউ আসেনি?”
একজন কাছে এসে পরম ভালোবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, “সব্বাই এসেছে। তুমি এসেছ শুনে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলাম। সবার একসাথে সময় হচ্ছিল না বলেই এতদিন আসতে পারিনি। আজ এলাম। কাল শুক্রবার, এরপর শনিবার, এখানেই থাকব দু’দিন।”
এরপর অন্যজন এগিয়ে এলো। কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলল, “তা শুনলাম এই বাড়িতে তোমার আজকাল মন টিকছে না। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য একেবারে উদগ্রীব হয়ে পড়েছ। ব্যাপার কী, হ্যাঁ? এই ক’মাসেই এই অবস্থা? বছর পেরোলে তো আমাদের নামই ভুলে যাবে।”
“তোরাও না।” বলে বাহুডোরে যে মেয়েটা আশ্রয় নিয়েছিল, ওর মাথায় একটা চুমু দিলো চিত্রা৷ বোনদের মধ্যে মেজো ও। আদুরে চেহারা।
অন্য একজন এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা, দুলাভাইয়ের নম্বরটা দাও তো। একটা ফোন দিয়ে বলি, তাড়াতাড়ি এই বাড়িতে চলে আসতে। এতগুলো শালি এসেছে শুনলে ছুটে চলে আসবে।”
ভাই-বোনদের আগমনে চিত্রা এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল দুনিয়াতে তাঁর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। কিন্তু আকস্মিক ফিরোজের নাম শুনেই গম্ভীর হয়ে গেল সে। বিছানায় বসতে বসতে অনুজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, “এর কোনো প্রয়োজন নেই। ও খুবই ব্যস্ত এখন। বললেই আসতে পারবে না। এতদিনে একবারের জন্যেও আসতে পারিনি। আজ বললেই চলে আসবে?”
যে মেয়েটা বলেছিল কথাটা, সেই আবার বলল, “বাইরে থেকে দেখতে তো ঠিকঠাকই মনে হয়। মহাপুরুষ লাগে। বউকে ছাড়া এতদিন ধরে আছে কীভাবে?”
চিত্রা চোখ গোল গোল করে তাকাল ওর কথা শুনে।
অন্য একজন ভীষণ চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে, থুতনিতে হাতের আঙ্গুল বুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, ভেতরে সব ঠিকঠাক আছে তো?”
চমকে ওঠে ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো চিত্রা। সাথে সাথে আগের জন্য বলে উঠল, “তুমি বরং উনার অফিসের ঠিকানা দাও আমাদের। ব্যাটাকে বেঁধে নিয়ে আসবো। সাথে এটারও খোঁজ নিবো, কর্মস্থলে কোনো বিকল্প রেখে দিয়েছে কী-না!”
“তবে রে!”
এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁটা খুজতে লাগল চিত্রা; এদিক-ওদিক খুঁজে খাটের পাশে ওটাকে পেয়ে হাতে নিতেই ঘর ফাঁকা হয়ে গেল মুহূর্তে। তখনই হ্যাপির চিৎকার শুনতে পেলো সে। কৌতূহলী হয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে হ্যাপি বলল, “ভাইয়া এসে গেছে।”
চিত্রা অবাক চোখ করে বলল, “কোন ভাইয়া এসেছে?”
হ্যাপি উত্তেজনায় যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। কোনোরমকে সে বোঝাল, ফিরোজ এসেছে। ও ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছে, ফিরোজ ভাইয়ের বাইকটা বাড়ির সামনেই থামল।
হ্যাপি মা-বাবাকে খবরটা দিতে চলে গেল সাথে সাথে। এদিকে বাকরুদ্ধ চিত্রা পিছিয়ে এলো ধীর পায়ে। তাঁর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। এতগুলো দিন পর আসছে মানুষটা! কীভাবে কথা শুরু করবে সে? কীভাবে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াবে? লজ্জা করবে তো, নববধূর মতো!
২৩তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=838816500396385&id=100028041274793