প্রস্থান — ১৯তম পর্ব।

0
497

প্রস্থান — ১৯তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২৪.
অফিসে, নিজের ডেস্কে বসে আছে সুব্রত। ঘড়িতে প্রায় বেলা ৩টা বাজে। গতকাল রাতের ঘটনার পর থেকেই উতলা হয়ে আছে সে। ভিতরে এমন একটা অস্বস্তি জমাটা বেঁধেছে, যা তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কোথাও মনোযোগী হতে পারছে না। সারারাত ভেবেছে এই নিয়ে, এক সেকেন্ডের জন্যেও ঘুম হয়নি। বারবার মনে হয়েছে, একজন নির্দোষ মানুষকে দোষীর অপবাদ দেওয়াটা খুব বড় ভুল হয়েছে। পূর্বেই সে অনুভব করেছে এই কষ্টটা; তাঁর জানা আছে নির্দোষ ব্যক্তির দোষী সাব্যস্ত হওয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক! সব জেনেও সত্যি-মিথ্যে যাচাই না করে কাজটা করেছে সে, এই কারণে এখন ভীষণ অনুতপ্তবোধ হচ্ছে।

সুব্রতর কলিগ, জুলি পাশেই বসে আছে। সকাল থেকেই দেখছে, আজকে কাজের প্রতি স্যারের একদমই অনাগ্রহ! মন নেই একেবারে। এই মানুষটাকে কখনো প্রাণবন্ত হয়ে হাসতে দেখেনি সে। সবসময় দেখেছে গম্ভীর মুখ; আর অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসি! এছাড়া যখনই স্যারের চোখের দিকে তাকিয়েছে, সে ভীত হয়েছে। সবসময় মনে হয় মানুষটার দুই চোখে কীসের জন্য আগুন জ্বলছে! স্যারের নেশা করার অভ্যাসটা তাঁর জানা আছে। ভয়টা সেখানেও। এই ধরনের মানুষকে বুঝা বড় মুশকিল!
বেশ কিছুক্ষণ পর, জুলি একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল, “স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
সুব্রত অনাগ্রহের সাথে ফাইলটা হাতে নিয়ে গম্ভীর সুরে বলল, “আমি ঠিক আছি, জুলি। কিছু হয়নি আমার।”
বিস্মিত হলো জুলি। আর কিছু বলার সাহস দেখাল না। এতদিন ধরে কাজ করছে মানুষটার সাথে, আজ অব্দি মানুষটার সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি সে। তবে একজন মেয়ে হওয়ার কারণে সে এইটুকু বুঝতে পারে, মানুষটার ভিতরে কিছু চলছে। এমন কিছু ব্যাপার আছে, যা উনাকে সবসময় পোড়ায়! একজন পুরুষকে পর্যবেক্ষণ করার যে ক্ষমতাটি নারীর মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তা প্রয়োগ করে সে চাইলেই হয়তো অনেক কিছু জানতে পারতো, কিন্তু তা করেনি সে। আজ অব্দি এটাও বলতে পারেনি, এই গম্ভীর, এই রহস্যময় মানুষটার প্রতি সে ভীষণ দুর্বল! যখন তাঁর হৃদয়ে এই অনুভূতির জন্ম হয়েছিল, তার আগে থেকেই সে বিশ্বাস করতো, যদি মন থেকে কেউ কিছু কামনা করে, তবে সে ওই জিনিসটা ঠিক পাবে। তাঁর এই দুর্বলতার যদি সত্যিই কোনো অর্থ থেকে থাকে, তবে একদিন ঠিক উপলব্ধি হবে অপর পাশের মানুষটার অন্তরে। সে আপন করে নেবে।
জুলি খেয়াল করল, ফাইলটা হাতে নিলেও সুব্রতর ভাবনা অন্য কিছুতে। সে আকস্মিক কাছে এসে বলল, “স্যার, আপনাকে আজ খুব উদাস দেখাচ্ছে। বাড়িতে কিছু হয়েছে?”
জুলির কথা শুনে ফাইল থেকে চোখ সরাল সুব্রত। একটা পাতলা গড়নের মেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দেহে আধুনিক পোশাক। চুলগুলো সোনালি রঙের। সচরাচর ওর চোখ-মুখ উজ্জীবিত থাকে। আজ খানিকটা বিবর্ণ দেখাচ্ছে। সে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, “কিছু হয়নি আমার। আই অ্যাম ওকে।”
জুলি সাহস করে বলল, “সকাল থেকেই দেখছি আপনার মুড অফ।”
“আমার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কাজের দিকে মনোযোগ দাও।” সুব্রত কঠিন হলো বেশ। চোখে এর রেশা পাওয়া গেল। বেশ রুক্ষ চাহনি!
স্যারের প্রতিক্রিয়ায় জুলি আহত হলো। মলিন চেহারা করে ফিরে গেল নিজের টেবিলে।

কিছুক্ষণ পর যখন আর বসে থাকতে পারল না সুব্রত, অস্থিরতা বেড়েই যাচ্ছিল, বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল, তখন সে দাঁড়িয়ে গেল; জুলির উদ্দেশ্যে বলল, “জুলি, আমার মনে হচ্ছে আজ আর অফিসে বসে থেকে থেকে লাভ নেই। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না আমি।”
জুলি দাঁড়িয়ে গেল সসম্মানে। ঠোঁট টিপে বলল, “আমারও মনে হয় আজ আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনি যান, স্যার।”
“তুমি একা সামলাতে পারবে?”
জুলি মৃদু হেসে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “জি, স্যার। আমি পারব। আপনি চিন্তা করবেন না।”

অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়িতে চলে এলো সুব্রত। সদর দরজায় কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো চিত্রা। সে ভিতরে দেখল, দীপালি বেগমকে। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে চিত্রাকে পাশ কাঁটাতে চাইল নির্বিকারে!
চিত্রা পিছন থেকে বলল, “সুব্রত ভাই, আজ দুপুরেই চলে এলেন যে? আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”
সুব্রত দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ। মাথাটা শুধু সামান্য ব্যথা করছিল।”
চিত্রা দরজা আটকিয়ে, এগিয়ে গিয়ে বলল, “চা করে দিবো?”
বড্ড প্রয়োজন ছিল বোধহয়, কিন্তু দীপালি বেগম কাছেপিঠে থাকায় সরাসরি বলতে পারল না সুব্রত। নতকণ্ঠে বলল, “সুলতানা কোথায়?”
“ও আছে, নিজের ঘরে।” চিত্রা জবাব দিলো ভুরু কুঁচকে!
সুব্রত আর কিছু বলল না, সিঁড়ি দিয়ে ওঠে গেল দ্রুত। ও চলে যাওয়ার পর একইভাবে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল চিত্রা। যদি চা প্রয়োজন না হতো, তাহলে তো সরাসরি বলে দিতো। সুলতানার কথা জানতে চাইলো কেন? এরপর চলেই-বা গেল কেন, কিছু না বলে?
চিন্তা করতেই জবাবটা পেয়ে গেল চিত্রা। সে সোফায় বসল মায়ের পাশে। কিছুক্ষণ পর বলল, “মা, সুব্রত ভাইকে এক কাপ চা দিয়ে আসি বরং। আদা চা খেলে মাথা ব্যথা কমে।”
কথাটা শুনে দীপালি বেগম মুখটা বিকৃত করে বললেন, “সুলতানাকে বলো না। এগুলো ওর কাজ।”
“ও বোধহয় ঘুমোচ্ছে। ইদানীং লাঞ্চের পর তেমন কাজ থাকে না বলে ও ঘুমোয় একটু।”
দীপালি বেগম উচ্চস্বরে বললেন, “চা বানানো কী কাজ না? ডেকে তোলো।”
শাশুড়ির কথা শুনে থমকে গেল চিত্রা। সোফা থেকে ওঠে, চুপচাপ চলে গেল সুলতানার ঘরে।
ঘরে তেমন আসবাব নেই। একটা ছোট আলনা, যেখানে সুলতানার জিনিসপত্র রাখা। পাশে একটা টেবিল। কিছু বই দেখা গেল সেখানে। স্কুলের বই। অনেক দিন আগের, অথচ চকচকে। বোধহয় বইগুলোর খুব যত্ন করে মেয়েটা।
সুলতানাকে ডেকে তুলে চিত্রা বলল, “তোমার দুঃখ হয় না পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছিল বলে?”
সুলতানা বিছানা থেকে নেমে, চোখ ডলতে ডলতে বলল, “প্রথম প্রথম হয়েছিল। কিন্তু কাউকে আর বলতে পারিনি পড়াশোনার কথা। সুব্রত ভাইকেও তো বলিনি, উনি নিজেই জোর করে ভর্তি করিয়েছিল।”
“সুব্রত ভাই যখন আবার বাড়িতে এলো, তখন তো বলতে পারতে, তুমি পড়াশোনা করতে চাও।”
সুলতানা চিন্তান্বিত ভাবে, উপরের দিকে চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে বলল, “উমম, বলতে পারতাম। কিন্তু ভয় করতো তখন। উনি তো আর আগের মতো ছিল না। রাগ করো না, একটা কথা বলি।” এরপর কাছে এসে সুলতানা ফিসফিস করে বলল, “৫ বছর পর যখন সুব্রত ভাই ফিরে এলো বাড়িতে, তখন উনাকে পাক্কা দাগি আসামী বলে মতো হতো। আমার তো খুব ভয় করতো প্রথমে। খালুজানের কথায় শুধু মাঝে মাঝে খাবার দিতে যেতাম ঘরে। উনিও কখনো জিজ্ঞেস করেনি আমার পড়াশোনার কথা। আগে তুই করে বলতো। যখন ফিরে এলো, তখন থেকে তুমি বলে সম্মোধন করা শুরু করল। আমার তো মনে হতো উনি আমাকে এই প্রথম দেখল।”
সুলতানার কথা শুনে চিত্রার মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। চোখ পাকিয়ে সে বলল, “বেশ হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি যাও, সুব্রত ভাইকে চা দিয়ে এসো। আদা চা বানাবে।”
নির্দেশ অনুযায়ী সুলতানা ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেল। তবে চিত্রা বেরোলো না তৎক্ষনাৎ, সুলতানার টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে, ওর খাতা আর কলম খুঁজে কিছু লিখল তাতে।

সুলতানার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল চিত্রা, দীপালি বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
চিত্রা জবাবে বলল, “ওকে বলে আসি, চা-য়ে আদা দিতে।”
দীপালি বেগম টিভিতে মনোযোগ দিলে চিত্রা রান্নাঘরে গিয়ে সুলতানার পাশে দাঁড়াল। চা তৈরি হলে চিত্রা নিজেই একটা কাপ আর প্লেট বের করল। এরপর নিজ হাতে চা ঢালল কাপে। এর মধ্যেই সুলতানার দৃষ্টির অগোচরে কাপের নিচে কাগজটা রেখে দিলো সে। সুলতানার নজরে এলো না ঘটনাটা। সে চা নিয়ে চলে গেল সুব্রত ভাইয়ের ঘরে। চিত্রা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলল, “মা, আমি একটু ঘরে যাচ্ছি। আপনি টিভি দেখুন।”
দীপালি বেগম বললেন, “ঘরে একা একা বসে কী করবে?”
চিত্রা হাসিমুখে বলল, “মা-কে ফোন দিবো। কাল সেভাবে কথা হয়নি। সকালেও হয়নি।”
“আচ্ছা যাও।”
অনুমতি পেয়ে চিত্রার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। ঘরের দিকে যেতে লাগল সে। দীপালি বেগম বসে থেকে দেখছেন বউমাকে। সুব্রতর থেকে ওকে দূরে রাখতে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।

এরপর কেটে গেল মিনিট দুয়েক, হঠাৎ দীপালি বেগমের ফোনটা বেজে উঠল। তিনি ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখলেন, ছেলের নম্বর। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ছেলের কথা শুনতে পেলেন।
ফিরোজ বলল, “মা, চিত্রা কোথায়? তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি, রিসিভই করছে না।”
দীপালি বেগম বললেন, “ও তো এইমাত্র ঘরে গেল। ফোনটা ঘরে রেখে এসেছিল। বলছিল মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা-কে ফোন করতেই তো গেল।”
ফিরোজ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। মায়ের কথা শুনে শান্ত হয়ে বলল, “ওহ্। আচ্ছা, আমি দেখছি।”
“শোন শোন। ফিরোজ।” ছেলেকে ফোন রাখতে থামিয়ে দীপালি বেগম গম্ভীর গলায় বললেন, “মনে হচ্ছে তোর বউয়ের খুব বেশিই বাড়ির কথা মনে পড়ছে। এবার ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দে। বেশ ক’দিন থেকে আসুক। তুই মাঝে মাঝে দেখা করে এলি। মেয়ে মানুষের মন খুব জটিল, এলোমেলো। স্বামীর থেকে দূরে না গেলে মেয়ে মানুষ স্বামীর গুরুত্ব বুঝতে পারে না। যখন দূরত্বটা বুঝতে পারবে, তখন দেখবি ঠিকই তোর প্রয়োজন টের পাবে। যখন কাঁদতে কাঁদতে পা ধরে ক্ষমা চাইবে, তখন ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবি দেশের বাইরে। দেখবি, ততদিনে সুব্রতর ভূত মাথা থেকে নেমে গেছে। ফিরে এসে আর ওর নাম উচ্চারণ করবে না।”
মায়ের কথাগুলো শোনার পর ফিরোজ আড়ষ্ট হয়ে গেল। ইতস্ততভাবে বলল, “এটা কী ঠিক হবে, মা? এটা তো চিত্রার মন নিয়ে খেলা করা হবে। আমি ওকে ভালোবাসি। ওর সাথে এইরকমটা কীভাবে করব আমি?”
ছেলের কথা শুনে দীপালি বেগমের চোখ-মুখ রুক্ষ হয়ে গেল। তিনি সাথে সাথে ধমক সুরে বললেন, “একটা গাধাকে জন্ম দিছি আমি! পুরুষ মানুষকে এত দুর্বল মানায়?” এরপর গলার আওয়াজ নামালেন খানিকটা।” শোনো, মেয়ে মানুষের মতো এত আবেগী হলে চলে পুরুষদের। বউকে যদি হাতে রাখতে চাও, তবে মায়ের কথা শোনো। খুব দ্রুত বউকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাও।”
ফিরোজ অসহায় মুখ করে বলল, “কিন্তু মা, চিত্রা আমার সাথে একা কোথাও যেতে রাজি হবে না। আগেও বলেছিলাম আমি। ও বলেছে, যদি যেতে হয়, তাহলে বাড়ির সবাইকে সাথে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে।”
“তোরা কী পিকনিক করতে যাবি, যে বাড়ির সবাইকে নিয়ে যাবি?” দীপালি বেগমের গলার আওয়াজ আবার বেড়ে গেল। “শোন, চিত্রাকে বোঝা। বিয়ের পর হানিমুনে যেতে হয়। তাছাড়া সবাইকে নিয়ে ঘুরতে গেলে তোর বউ বলবে, সুব্রত ভাইকেও সাথে নিয়ে চলো। তাহলে লাভ কী? তোর বউয়ের তো আবদারের শেষ নেই।”
ফিরোজ হতাশ গলায় বলল, “আমার যে চাকরি, এতদিন ছুটি কে দিবে?”
“ছেড়ে দে চাকরি। কী দরকার পরের চাকরি করার? আমি তো বলি এটাই সময় নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করার। তোর বাবাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। ভাইপোর জন্য তাঁর যেমন দরদ! কোনদিন হয়তো ভাইপোকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলবে, তোকে অফিসের দায়িত্ব দিলাম।” এরপর নড়েচড়ে বসলেন দীপালি বেগম। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে বললেন, “শোন, এটাই সঠিক সময়। নিজের ভালোটা বুঝতে শিখ। মাথাটা কাজে লাগা। ভাই-বোন দুজনে তো হয়েছিস একেবারে বাপের মতো। নির্বোধ! আমারই যত দোষ। এত চালাকচতুর বানাতে পারলাম না একটারেও। আচ্ছা, এখন রাখছি।”

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখল ফিরোজ। দুই হাতের কনুই টেবিলের উপর রেখে, থুতনিটা রাখল হাতের তালুর উপর। এরপর গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগল মায়ের কথাগুলো। এর মধ্যেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। ভাবনা ভঙ্গ হলো তাঁর।
চিত্রার ফোন। ফিরোজ গম্ভীর মুখেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল। এরপর চুপ করে রইল।
চিত্রা-ই বলল প্রথমে, “সরি গো! মায়ের কাছে ছিলাম। ঘরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি তোমার এতগুলো ফোনকল।”
ফিরোজ মলিন গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। লাঞ্চ হয়েছে?”
“হ্যাঁ। তোমার?”
“হ্যাঁ।” এরপর কয়েক সেকেন্ড নির্বাক থাকার পর ফিরোজ আবার বলল, “আচ্ছা, বাবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না তোমার?”
চিত্রা অবাক হয়ে বলল, “করে তো। কিন্তু হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছ যে?”
ফিরোজ শ্বাস রুদ্ধ করে বলল, “বিয়ের পর অন্তত মাস দুয়েক মেয়েরা ঘনঘন বাপের বাড়িতে যায় স্বামীর সাথে। কিন্তু আমি তোমাকে সেই সময়টা দিতে পারিনি। তাই ভাবছি, এবার তোমাকে ওই বাড়িতে দিয়ে আসব। প্রতিদিন হয়তো যেতে পারব না, বাট সপ্তাহে অন্তত একদিন তোমার সাথে দেখা করে আসবো।”
চিত্রার চোখ বড় বড় করে ফিরোজের কথা শুনে। হতবিহ্বল মুখ করে বলল, “এমনভাবে বলছ, যেন সারাজীবনে জন্য আমাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছ।”
“তোমার যতদিন ইচ্ছে তুমি থাকতে পারবে।” ফিরোজের নির্বিঘ্ন কণ্ঠ!
“হঠাৎ কী হলো তোমার? সব ঠিক আছে তো?” চিত্রা ব্যাকুল হয়ে উঠল। হঠাৎ একটা অজানা কারণে তাঁর চোখে-মুখে আঁধার নেমে এলো। অজানা শঙ্কায় বুক চিনচিন করে উঠল।
চিত্রার মলিন সুর শুনে ফিরোজ হেসে বলল, “আরে বোকা, তেমন কিছু হয়নি। আসলে কাজের জন্য এই ক’দিন খুব ব্যস্ত থাকব। তোমাকে সময় দিতে পারব না। তাই ভাবলাম, এই ক’দিন তুমি ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। তোমার ভালো লাগবে। আমি বিকেলে তোমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাব। তৈরি থেকো তুমি।”
“আজ বিকেলেই?” শ্বাসরুদ্ধ হলো চিত্রার। বুঝতে পারছে না হঠাৎ কী এমন হলো, যে তাকে বাপের বাড়িতে পাঠানোর জন্য এত তাড়াহুড়ো শুরু করে দিলো ফিরোজ।
চিত্রার কথা শুনে ফিরোজ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ। আজ রাত আমি তোমাদের বাড়িতেই থাকবো। আঙ্কেল, আন্টিকে বলে দিও। রাখছি।”
চিত্রার প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিলো ফিরোজ।

২৫.
গোসল করে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো সুব্রত। আয়নার সামনে দাঁড়াল। গোসল করলে দাঁড়িগুলো লেপ্টে থাকে গালের সাথে। চাপ-ঘন দাড়িতে গাল দেখায় উপায় নেই। চুলগুলো নাক অব্দি এসে ঠেকে। গোসল শেষে কোনোদিকে তাকাতে হলে তাকে হাত দিয়ে চোখের সামনে থেকে চুল সরাতে হয়। এবার বোধহয় চুলগুলো কাটানোর সময় হয়েছে। দাড়ি আর চুলের এমন অবস্থা যে, তাকে শীঘ্রই বারীন্দ্রনাথ ভেবে ভুল করবে অনেকে!
আয়নায় নিজের উন্মুক্ত দেহখানা দেখল সুব্রত; কোমরে একটা তোয়ালে পেঁচানো শুধু। নিজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রাখল সে। হঠাৎ মনে হলো, আয়নায় থাকা তাঁর প্রতিচ্ছবিটা বলে উঠল, “এই শরীরকে জীবন্ত রেখে কী হবে, সুব্রত? জীবনে একটামাত্র নারীকে কামনা করেছিলে তুমি। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য, এই দেহের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করতে পারোনি।”
প্রতিবাদে সুব্রত দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “আমি তাকে হৃদয় দিয়ে কাছে পেতে চেয়েছিলাম, শরীর দিয়ে নয়।”
সম্বিত ফিরতেই আয়নার সামনে থেকে সরে এলো সুব্রত। ওয়্যারড্রব এর দিকে এগোতেই টেবিলের উপর চা দেখতে পেলো। সে এগিয়ে গিয়ে চা-তে হাত ডুবিয়ে দেখল, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ফোঁস করে উঠল সাথে সাথে। “ইস্টুপিট লেডি! চা দিয়েছে, আমায় ডেকে বলবে না একবার। এতক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করলাম।”
কাপটা তুলতেই একটা ভাজ করা কাগজ দেখতে পেলো সুব্রত। কৌতূহলী হয়ে ওটা তুলতেই দেখল ভিতরে কিছু লেখা। ভাজ খুলে পড়ল সে। ভিতরে লেখা, “সুব্রত ভাই, অপরাধবোধ তখক্ষণই আমাদের নিপীড়িত করে, যতক্ষণ আমরা সেখান থেকে মুক্ত না হই। ‘সরি’ শব্দটা মানুষটাকে ছোট করে না, বরং মানসিক শান্তি দেয়, অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করে।”
সুব্রত মৃদু হাসল লেখাটা পড়ে। এই ব্যাপারটা তাকে অস্থির করে তুলেছিল। এবার যা করার তাকে করতে হবে।

১৯তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=836193490658686&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here