প্রস্থান — ১৪তম পর্ব।

0
667

প্রস্থান — ১৪তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৮.
মিস্টার মুজিবর বসে আছেন ড্রয়িংরুমে। রশ্মি পাশের বাড়ির এক ছেলেকে দিয়ে চা আনিয়েছে। কাপ একটা দেখে মিস্টার মুজিবর বললেন, “আপনারা খাবেন না? আমি একা খাবো?”
রুমানা বেগম কাচুমাচু হয়ে বসে আছেন লোকটার সামনে। যতটা বিব্রত তিনি, ততটাই ঘাবড়ানো। এত তাড়াতাড়ি এইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, তা ভাবেবনি। তিনি ভয় পাচ্ছেন এটা ভেবে, মিস্টার মুজিবরকে দেখে রশ্মি না আবার উল্টো-পাল্টা কিছু বলে বসে-দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দেয়! যেমন রুক্ষভাষী মেয়ে তাঁর! আগে-পরের কোনো কথা না ভেবে, যেটা মনে হবে বলে দিবে।
মেয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রুমানা বেগম বললেন, “আপনি খান। আমরা এইমাত্র খেলাম।”
দাঁত বের করে হেসে কাপটা হাতে নিলেন মিস্টার মুজিবর। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে , সহসা চোখ বুজে বললেন, “বাহ্! দারুণ চা তো। তুমি বানিয়েছ?” রশ্মির দিকে তাকালেন তিনি।
রশ্মি একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছেন তিনি। সে নিজের চেহারা মলিন করে বলল, “দোকানের চা।”
“ওহ্ আচ্ছা!” বলে আবার ছোট করে চুমুক দিয়ে হাত থেকে কাপটা নামিয়ে রাখলেন মিস্টার মুজিবর।
রশ্মির মনে হলো, ‘দোকানের চা’ কথাটা শুনে লোকটা খানিক অসন্তুষ্টই হয়েছে। হোক গে, যাকে-তাকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব তো আর সে নিয়ে রাখেনি! সম্ভব হলে তো লোকটাকে এক কাপ বিষ এনে দিতো সে! এতে লোকটা সন্তুষ্ট না হলেও সে বেশ হতো! ঈদের আনন্দ বোধ হতো তাঁর।
রশ্মি নাক-মুখ খিঁচিয়ে, পাথরের ন্যয় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পাশে, মিস্টার মুজিবর ওর দিকে ঝলমলে চেহারা করে তাকিয়ে বললেন, “মিসেস রুমানা, আপনি কিন্তু একবারও বলেননি আপনার এতবড় একটা মেয়ে আছে। আপনি বলেছেন, আপনার মেয়ে নিতান্তই বাচ্চা। কিন্তু এখানে এসে তো অন্যকিছু দেখছি।”
রশ্মি ফোঁস করে কিছু বলতে চেয়েও মায়ের করুন চাহনি দেখে নিজেকে সংযত রাখল।
বসের কথার প্রতিউত্তরে রুমানা বেগম মৃদু হেসে বললেন, “বাচ্চাই তো। সবেমাত্র ইউনিভার্সিটি জীবন শুরু হলো।”
মিস্টার মুজিবর আকস্মিক খিলখিল করে হেসে ওঠে বললেন, ” ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে যদি আপনি বাচ্চা বলেন, তাহলে মেয়েদের যুবতী হওয়ার বয়স কত? আমি তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি পাক্কা বিবাহযোগ্যা একটা মেয়ে।” বলে দাঁতগুলো বের করে নিজের সেই বিশ্রী হাসিটা দিলেন মিস্টার মুজিবর।
রশ্মির সারা শরীর হঠাৎ ঘিনঘিন করে উঠল। ক্রোধে এবার যেন চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে। আর বেশিক্ষন বোধহয় নিজেকে কন্ট্রোল করা যাবে না।
এদিকে মেয়ের অবস্থা খেয়াল করে প্রসঙ্গ পাল্টালেন রুমানা বেগম। তিনি ইতস্তত করে, ক্ষীণ গলায় বললেন, “তা স্যার, হঠাৎ আপনি আমার বাড়িতে? জরুরি কাজ হলে আমাকে একটা ফোন দিতেন। আমি অফিসে পৌঁছে যেতাম।”
“না না মিসেস রুমানা, তা হয় নাকি?” মিস্টার মুজিবর হাসছিলেন, সহসা হাসি থামিয়ে, মুখটা বিবর্ণ করে বললেন, “আসলে, অফিসে গিয়ে শুনলাম আপনি অসুস্থ, ছুটি নিয়েছেন। সেজন্যই ভাবলাম একবার দেখে যাই। বাড়িটাও দেখা হয়ে গেল, আর আপনার মেয়েটাকেও।” আবার হেসে ওঠে রশ্মির দিকে তাকালেন তিনি।
রশ্মি ঠোঁট নাড়িয়ে, বিড়বিড় করে বলল, “কুত্তার বাচ্চা।” ইচ্ছে করেই ঠোঁটটা নাড়াল সে, যেন লোকটা তাঁর গালি, তাঁর ক্ষোভ-ক্রোধ, বুঝতে পারে।
মেয়ের গালিটা রুমানা বেগমও ধরতে পারলেন। বুঝতে পেরে তিনি আরও বিব্রত বোধ করলেন বসের সামনে। অচিরেই আরও ভয়ংকর কিছু ঘটে না যায়, এই ভয়ে তিনি দ্রুত দাঁড়িয়ে বললেন, “একটু সুস্থ হলেই আমি অফিসে যাব, স্যার। আচ্ছা, সন্ধ্যা হয়ে এলো। আপনি তো বাড়িতে যাবেন এবার।”
“হ্যাঁ, বাড়িতে তো যেতেই হবে। উপায় নেই তাছাড়া।” বলে বড় একটা শ্বাস ছাড়লেন মিস্টার মুজিবর। এরপর হঠাৎ মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বললেন, “অবশ্য আজকাল বাড়িটাকে আর বাড়ি মনে হয় না, নরক মনে হয়। একদম শান্তি নেই।”
রুমানা বেগম নির্লিপ্ত থাকলেন। রশ্মি আবারও বিড়বিড় করে বলল, “শালা, তোর জায়গা তো নরকেই।”
রশ্মির গালিটা মিস্টার মুজিবর অব্দি পৌঁছাল কী-না, তা কেউ বুঝতে পারল না; কেন-না লোকটার বিমর্ষচিত্তের মুখটাতে নতুন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

মিস্টার মুজিবর চলে যেতেই সদর দরজা আটকিয়ে রুমানা বেগম বেশ ধমকের সুরে মেয়েকে বললেন, “এটা কেমন অসভ্যতামি, রশ্মি? আমি এইসব শিখিয়েছি? বাড়িতে একজন মেহমান আসলে তাঁর সাথে এমন আচরণ করতে হয়?”
রশ্মি সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠে বলল, “উনি তোমার মেহমান। তোমার বন্ধু। আমার তো কেউ না।”
“বন্ধু না, আমার অফিসের বস।” মুখ শক্ত করে প্রতিবাদ করলেন রুমানা বেগম। কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। মেয়ে নির্বাক থাকলে তিনি আবার একই সুরে বলে উঠলেন, “উনি তোমার ভালো আচরণ দেখেনি। হয়তো ভেবেছে, আমি তোমাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। এতে আমার সম্মান বাড়বে না সামান্যও, বরং কমবে। অফিসে গেলে যখন বলবে, ‘আপনার মেয়ে দেখি একটুও আপনার শিক্ষা পায়নি?’ তখন আমি কী জবাব দিবো? তাছাড়া উনি তোমাকে যেমন আচরণে দেখেছেন, এখন থেকে তোমার সম্পর্কে তাঁর মনে তেমনই ধারণা হবে। নিশ্চয়ই তুমি শোভনীয় আচরণ করোনি।”
মায়ের কথাগুলো হজম করল রশ্মি। কথায় কথা বাড়বে। তাঁর শরীর এখনো রাগে কাঁপছে। দাঁতগুলো এমন ভাবে চেপে রেখেছিল যে, এখন ব্যথা করছে। মা অসুস্থ বলেই সে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। নাহলে..
রশ্মি সোফার কাছে একটা প্যাকেট দেখল, ফল-মূলের, লোকটা এনেছিল। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে সেটা হাতে তুলে দরজার দিকে এগোলো।
রুমানা বেগম পিছন থেকে চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন, “ওগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?”
রশ্মি বলল, “কুকুর-বেড়ালকে খাওয়াতে।”
হাল ছেড়ে দিয়ে, মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘরে চলে গেলেন রুমানা বেগম।

১৯.
আজও দেরি করে বাড়িতে ফিরল ফিরোজ, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত দেহ নিয়ে। অফিস শেষ করেই বাবার ফ্যাক্টরিতে চলে গিয়েছিল, এরপর রাত ১১টার দিকে ফিরল।
চিত্রার কথা জিজ্ঞেস করতেই সুলতানা বলল, “ভাবী ডিনার শেষ করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। বলছিল মাথা ধরেছে।”
ফিরোজ কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। সুলতানা পিছন থেকে বলে উঠল, “আপনি খাবেন না, ভাইজান?”
“অফিস থেকে খেয়ে এসেছি।” জবাব দিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল সে।
দরজা ঠেলতেই ওটা খুলে গেল। ফিরোজ ভিতরে তাকিয়ে প্রথমে কিছু দেখল পেলো না; অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো ঘর! পশ্চিম আর উত্তরের জানালা খোলা। হুড়মুড়িয়ে বাসাত আসছে। চাঁদের আবছায়া আলো ঘরে প্রবেশ করেছে। বিছানার উপর চিত্রার অবয়ব অনুমান করা যাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে রইল চিত্রার অবয়বের দিকে। মেয়েটা কম হলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শতবার ফোন করেছে, সে একবারও রিসিভ করেনি। আজ ফিরতেই চায়নি সে৷ কিন্তু রাত ১০টা বাজতেই হঠাৎ প্রগাঢ় শূন্যতা অনুভব হলো। বুকের ভিতর এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের কম্পন শুরু হলো। উপলব্ধি হলো, এই সময়টা অন্তত চিত্রা তাকে আকাঙ্ক্ষা করবে! সেজন্যই এত রাতে বাড়িতে আসা। নায়তো অফিসে রাত্রিযাপনের সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছিল সে।
ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল ফিরোজ। মুহূর্তে আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল চারিদিক। চিত্রার পরণে লাল রঙের একটা জামা। মাথার এলোমেলো কেশ মুখশ্রী ঢেকে রেখেছে। তাঁর উপস্থিতি বোধহয় টের পায়নি মেয়েটা৷ সামান্যও নড়েনি। সে জামা-কাপড় আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল৷ ফ্রেশ হয়ে, জামা-কাপড় চেঞ্জ করে আবার ঘরে এসে আলো নিভিয়ে দিলো দ্রুত, যেন চিত্রার ঘুমে বিঘ্ন না ঘটে।
কিন্তু বিঘ্ন ঘটানোর প্রয়োজন পড়ল। চিত্রা একটা বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়েছে, আর একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ফিরোজ খুব সাবধানে নিজের বালিশটা টানতে গেলে বিপত্তি ঘটল!
চিত্রা জেগে ওঠে, প্রথমে আতঙ্ক ভরা গলায় বলল, “কে, কে?” পরে বুঝতে পেরে বলল, “ওহ্, তুমি। কখন এলে?”
ফিরোজ ক্ষীণ গলায় বলল, “এইতো, একটু আগে।”
“দাঁড়াও, লাইট অন করছি। রাতের খাবার খেয়েছ?”
“হুম।”
“আচ্ছা।” এই বলে উল্টো দিকে ঘুরে আবার শুয়ে পড়ল চিত্রা। লাইট অন করল না।
এরপর প্রায় আধ ঘণ্টা সবকিছু নিস্তব্ধ! চিত্রা বা ফিরোজ, কারোর মুখে কথা নেই, এমনকি নিঃশ্বাসের শব্দ-ও না! দুজনে যেন শব্দহীন থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ঘরময় নীরবতা। রাত গভীর হচ্ছে ধীরে-ধীরে। মান-অভিমান দৃঢ় হচ্ছে। বাতাস ভারী হচ্ছে, শীতলতা বাড়ছে। চাঁদের আলো আস্তে আস্তে পরিষ্কার-উজ্জল হচ্ছে। স্পষ্ট হচ্ছে ঘরের আসবাব।
ফিরোজ সহসা বলল, “চিত্রা, ঘুমিয়ে পড়েছ?”
চিত্রা নিশ্চুপ। কেন কথা বলবে সে? সারাদিন তো খুব চেষ্টা করেছে, অথচ মানুষটা তাকে এড়িয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষের আঘাত সহ্য করা যায়, কিন্তু উপেক্ষা সহ্য করা যায় না। এই সহজ কথা কী উনি বুঝে না? এত বুদ্ধু!
চিত্রার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে গায়ের উপর আলতো করে হাত রাখল ফিরোজ। নিরুত্তাপ, উদাসীন মনে হচ্ছে চিত্রাকে। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। অথচ অন্যদিন কেমন দুষ্টুমি করে বাড়ি এলে! ফিরোজের হৃদয় কোমল হয়ে এলো। রাগটুকু ভালোবাসার পরিবর্তন। অভিমান থেকে আদর জন্মাল। সে দুই হাতে চিত্রাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আহ্লাদ করে বলল, “সরি চিত্রা। আজ বড্ড বেশিই হয়ে গেল।”
চিত্রা নিজেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করল না। সেই নির্বিকার! ফিরোজ যাচাই করে দেখল, চিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছে কী-না। যেই-না নাকে চাপ দিলো, অমনি ‘আরে আরে’ বলে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল চিত্রা। ফিরোজ সাথে সাথে ওর মুখ চেপে ধরে বলল, “আস্তে। কেউ শুনলে ভাববে আমি বউ পেটাচ্ছি।”
চিত্রা ঘুরে ফিরোজের চোখে চোখ রাখল; আবছানা আলোয় সে অনুভব করল ফিরোজের অনুতপ্ত ভরা চাহনি! তাঁর অভিমান-ও খানিকটা ফিকে হলো। নাক ডালতে ডালতে, ঈষৎ রসিকতা করে বলল, “এটা বুঝি মারা নয়? সরকারি অফিসার তুমি। মামলা করলে কিন্তু ঠাস করে চাকরি চলে যাবে, খবরদার।”
ফিরোজ মৃদু হেসে বলল, “ভালোই হবে তাহলে। এই চাকরি আর ভালো লাগে না। কোনো স্বাধীনতা নেই। নিজেদের কোম্পানি থাকতে কেন ওখানে চাকরি করতে যাব? তাছাড়া কাজের এত চাপ।”
“এখন আবার বোলো না, কাজের চাপেই ফোন রিসিভ করার সময় পাওনি। আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করোনি।”
চিত্রার কথা শুনে নির্লিপ্ত থাকল ফিরোজ। চিত্রা তা দেখে, সহসা ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, “কেন করো এমন? আমার ভুলটা আমাকে ধরিয়ে দাও? দেখো, আমি ঠিক নিজেকে শুধরে নিবো। একবার বলো, আমার কোন কাজটা তোমার ভালো লাগে না। আমি সেই কাজ থেকে বিরত থাকবো। তবুও আমাকে এভাবে ইগনোর করো না। সারাটাদিন ভিতরে ভিতরে কতটা অস্বস্তিতে ভুগেছি আমি, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। প্লিজ, আমাকে একবার বলো।”
ফিরোজ বোবা বনে যায় চিত্রাকে কাঁদতে দেখে। তাঁর গলা ধরে আসে। চোখের পাতা ভারী হয়। কীভাবে সে মনের কথা বলবে? কীভাবে বলবে, নিজের ভাই আর স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মনে একটা সন্দেহের বিজ রোপণ হয়েছে। আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে সেটা। সে তো চায় না চিত্রাকে সন্দেহ করতে। ওকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবতে। কিন্তু যখনই সে মনস্থির করে, তখনই গায়েবী আওয়াজ ভেসে আসে, শয়তান কানের কাছে এসে কূমন্ত্র শুনিয়ে দেয়। ফলে সে এমনকিছু ভাবতে শুরু করে, বাস্তবিক অর্থে যা চিত্রাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করে! এই কথাটা সে সরাসরি কীভাবে বলবে?
ফিরোজের নীরবতায় চিত্রার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়৷ সে ডুকরে কাঁদতে থাকে। ফিরোজ একসময় নিজেকে সংযত করে চিত্রাকে বুকে আঁকড়ে ধরে। অপরাধীর মতো করে মিনমিনে গলায় বলে, “সরি চিত্রা। কথা দিচ্ছি, আর এমন করব না। তোমার কোনো ভুল নেই। তোমার হৃদয় নিষ্পাপ, এটা আমি মন থেকে মানি।” শেষের কথায় ফিরোজের গলা ক্ষীণ কাঁপে। কথাটা শতভাগ সত্যি না। চিত্রার হৃদয়ে কতটা শুদ্ধ, তা নিয়ে সন্দিহান সে। এ-কথা বলতে বিবেকে বাঁধে বলেই বলা হলো না সত্যিটা।
ফিরোজের আদরে চিত্রা আস্তে আস্তে শান্ত হয়। সারাদিনে যেটুকু ক্ষোভ ভিতরে জমেছিল, তা দূর করে স্বাভাবিক হয় সে।

রাত তখন ১২টা ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিল চিত্রা আর ফিরোজ। ফিরোজই কথা বলছিল। অফিসের কথা, পাশের ডেস্কের রমিজ সাহেবের কথা, কাদের সাহেবের কথা, এদের সম্পর্কে অনেক কথা-ই বলছিল সে। এরপর নিজেদের ফ্যাক্টরির কথা। ওখানের কেয়ারটেকার এর কথা, যে তাকে নিজের হাতে রান্না করে রাতের খাবার খাইয়েছে। চিত্রা শুয়ে শুয়ে শুনছিল শুধু। ভালো লাগছিল তাঁর। এর মধ্যেই ফিরোজ জানতে চাইল, সারাদিন ফোনকল দেওয়া ছাড়া আর সে কী কী করেছে!
চিত্রা নড়েচড়ে শুলো এবার। এক মুহূর্তে ভাবল, কোথা থেকে শুরু করা যায়। পরক্ষনেই সে খুব চঞ্চল হয়ে বলতে লাগল, “সুব্রত ভাইয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব বাবা আমার উপর দিয়ে গিয়েছিল। ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া, মেডিসিন দেওয়া, জলপট্টি দেওয়া, এইসব আমি করেছি। জানো, সুব্রত ভাই খুব পটে গেছে। আজ আমার সাথে একটুও খারাপ আচরণ করেনি। বকাঝকা করেনি। সেবাযত্ন করেছি না, সেজন্য!” সহসা আরও উৎফুল্ল হয়ে চিত্রা বলল, “আজ বিকেলে কী হয়েছে শুনবে? একটা কাজ করে ফেলেছি আমি। অন্যায় বটে। তবে কেন জানি লোভটা সামলাতে পারিনি।”
ফিরোজের বুক ঢিপঢিপ করছে। চোখ হলুদ হয়ে উঠছে ক্রমশ, যেন আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও চিত্রার মন রাখতে সে বলল, “কী অন্যায় করি?”
চিত্রা ওঠে বসল হঠাৎ, যেন কথাটা শুয়ে শুয়ে বললে ঠিকভাবে বোঝাতে পারবে না। সে বসে, অন্ধকারের মধ্যেই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগল, “আজ বিকেলে বোর হচ্ছিলাম একা একা। তখম গেলাম সুব্রত ভাইয়ের ঘরে। কথার ফাঁদে ফেলে উনাকে পটিয়ে ‘স্টাডি রুমে’ ঢুকে গেলাম। উনাকে বলেছি একটা ইংরেজি কবিতার বই নিবো। কিন্তু যেই না ড্রয়ার খুলেছি, অমনি দেখি একটা ডায়েরি….।”
“শাট আপ, চিত্রা।” হঠাৎ হুংকার ছাড়ল ফিরোজ। আর কত সহ্য করা যায়? নিজেকে কত সংযত করা যায়? মেয়েটা তো নির্বোধ! বুঝতেই পারছে না তাঁর সুব্রত ভাইকে এই শ্রোতা একদমই পছন্দ করে না। যে নাম শুনলে সে ক্ষিপ্ত হয়, তাঁর সামনেই সে-ই মানুষটাকে নিয়ে এত কথা! মানা যায় এইসব?
ফিরোজ রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “ওকে নিয়ে কোনো কথা শুনতে আমি আগ্রহী নই, চিত্রা। বিশেষ করে তোমার মুখে। কেন তুমি সারাক্ষণ ওকে নিয়ে কথা বলো? আর কোনো মানুষকে নিয়ে কথা বলার না থাকলে চুপচাপ থাকো।”
“তুমি কিন্তু আবার রেগে যাচ্ছ, ফিরোজ। তুমি কথা দিয়েছ আর রাগবে না।”
ফিরোজ ওঠে বসল এবার। মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি ভালো করে জানো আমি ওকে সহ্য করতে পারি না। তাহলে কেন ওর কথা বলো আমাকে? তোমাকে অসংখ্যবার আমি নিষেধ করেছি ওর ঘরে না যেতে।”
চিত্রা সাথে সাথে বলল, “প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু সুপ্ত কথা থাকে৷ আমরা তখনই ওই মানুষটাকে জানতে পারব, যখন তাঁর সাথে মিশবো। একজন মানুষের দুঃখ কমানোর জন্য দ্বিতীয় একজনের প্রয়োজন হয়৷ আমি মন থেকে চাই সুব্রত ভাইয়ের সাথে যেন তোমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঝগড়া-বিবাদ মিটে যায়।”
“তোমাকে কে দিয়েছে এই দায়িত্ব? আমি দিয়েছি? তবে কেন ওকে নিয়ে এত ভাবছ তুমি? কে ও?”
“উনি তোমার ভাই।”
“তোমার তো কেউ না। তাহলে?”
চিত্রা আহত হয়ে বলল, “আমার কেউ না? তোমার বাবা-মা যদি আমার বাবা-মা হয়, তোমার বোন যদি আমার বোন হয়, তবে তোমার ভাই আমার ভাই নয় কেন?”
ফিরোজ উগ্র গলায় বলল, “তুমি কিন্তু এবার খুব বাড়াবাড়ি করছ, চিত্রা। আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে।”
“আল্লাহ তো সব রাগ তোমাকেই দিয়ে দিয়েছে, তাই না?” কথাটা বলে আর অপেক্ষা করল না চিত্রা, বিছানা থেকে দ্রুত নেমে ব্যালকনিতে চলে এলো। সাথে চাঁদের আলো আর শীতল বাতাস কাছ থেকে স্পর্শ করল তাকে। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল সে। তাঁর মনে হচ্ছে, ফিরোজ ক্রমাগত অসুস্থের ন্যায় আচরণ করছে! ওর মস্তিষ্ক বিকৃত হতে শুরু করেছে। সাধারণ ব্যাপার নিয়ে কেউ এভাবে রিয়্যাক্ট করে?
চিত্রা গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরিয়ে বলল, “হে মালিক, আর কেউ না জানুক, আপনি তো জানেন আমি কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারি না৷ কাউকে কষ্টে দেখলে আমার প্রাণ কাঁদে! আপনিই তো দিয়েছেন এই দুর্বলতা আমাকে। আজ এই দুর্বলতার কারণে আমার সংসারে যত অশান্তি। আপনিই এর একটা বিহিত করে দিন। হয় আমাকে কঠোর বানিয়ে দিন, নাহয় আমার স্বামীকে এমন একটা ক্ষমতা দিন, যা দিয়ে সে আমার মনের সমস্ত কথা অনুভব করতে পারবে।”
আস্তে আস্তে চিত্রা বসে পড়ল ব্যালকনিতে। পিঠ ঠেকাল জানালা বরাবর নিচে, আর পা রাখল সামনে। হাঁটু জোড়া মুড়িয়ে, এর মাঝে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকল। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল ডায়েরির কথা। সারারাত আর ফিরোজের কাছে যাবে না সে। এই সময়টা ডায়েরি পড়ে কাটানো যায়। যদি মন ভালো হয়।
যেই ভাবা সেই কাজ, চুপিচুপি ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে এলো চিত্রা। ফিরোজকে দেখার চেষ্টা করেনি সে। ব্যালকনিতে এসে দরজা লাগিয়ে, লাইটটা অন করে পূর্বের ন্যায় বসে পড়ল। এরপর খুলল ডায়েরির প্রথম পাতা।

যে ডেটটা দেওয়া আছে, সেটা প্রায় সাড়ে ৬ বছর আগের। ফাল্গুনের মাঝামাঝি একটা সময়।

“প্রতি বছর ফাল্গুন আসে। তরুণ-তরুণীদের মনে বসন্তের ছোঁয়া লাগে, প্রেমের কবিতা মুখে মুখে চর্চা হয়, কানের কাছে ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’ বাজে। গাছে নতুন পাতা গজায়। চারিদিক ফুলের গন্ধে সুভাষিত হয়। মৃত-প্রায় প্রাণটাও কীভাবে যেন বেঁচে ওঠে, হেসে-খেলে জীবন বাহিত করে। কিন্তু আমার জীবন সেই একইরকম থেকে যায়। বসন্তের ছোঁয়া লাগে না আমার জীবনে। ফাল্গুনে পূর্নিমার রাত আসে না, চাঁদের আলো গায়ে মেখে কারো হাত ধরে বসা হয় না। আমার জীবনটাই যেন শুধু ভাবনা। অধিক সময় মাথায় বিজ্ঞান ঘুরে। যখন জীবন নিয়ে ভাবতে যাই, তখন মনে হয় চমকপ্রদ কিছু আবিষ্কার করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেওয়ায় নামই জীবন। অথচ যখন জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথ এর কবিতা পড়ি, তখন মনে হয়, গভীর রাতে-বদ্ধ খড়কুটোর ঘরে কোনো তরুণীর সাথে লীলাখেলায় মেতে উঠার নামই জীবন। যখন আমি জায়নামাযে পা রেখে নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়াই, তখন মনে হয় যাকে আমি জীবন বলি, সে আসলে মরিচীকা! এক ঘষাতেই যা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আসল জীবন তো অন্যখানে! এইসব ভেবেই আমার বয়স ২০ থেকে ২৫, এরপর ৩০ পেরিয়ে ৩৫ এর কাঠগোড়ায় পৌঁছে যায়৷ আমি কিছুতেই মনস্থির করতে পারি না। সেজন্যই একেবারে কোনঠাসা হয়ে বসে থাকি একটা অন্ধকার ঘরে। কখনো নিজের আবিষ্কার নিয়ে ভাবি, কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কোনো এক নাম না জানা তরুণীরর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ি, বাকি যেটুকু সময় পাই, আমি আরও ভাবি, এই জীবন নিয়ে ভেবে কাজ নেই৷ আমার টার্গেট আসল জীবনে পৌঁছানো। ওখানে একবার পৌঁছাতে পারলেই কেল্লাফতে! সব সুখ একসাথে।

ছোটবেলায় বাবা-মা ইন্তেকাল করার পর থেকেই বোধহয়, আমি ভীষণ একা! আপনজন বলতে কেউ নেই আমার। এই উপলব্ধিই আমাকে জীবন নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। আজও ভেবে চলেছি আমি। কিন্তু কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। ছাত্র জীবনের ইতি টেনে যখন গুরু পেশায় যোগদান করলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো, আজ যারা আমার শিষ্য, সারাজীবন যে তাঁরা আমাকে মনে রাখবে, তাঁর কী নিশ্চয়তা আছে? বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে সবাই চেনে। কিন্তু আমাকে ক’জন চেনে? ছাত্র জীবনের ইতি হলেই এই শিষ্যরা-ও আমাকে ভুলে যাবে। এইসব ভাবনা থেকেই গুরু পেশার সুতোটা পক্ত হওয়ার আগেই কেটে দিলাম, যেন পরবর্তীতে মায়ায় না পড়ে যাই। মায়া বড় বাজে রোগ!
এরপর শুরু হলো হলো বিশ্বের কাছে নিজেকে পরিচিত করার সংগ্রাম। মনোযোগ দিলাম কিছু আবিষ্কারে। সবই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু ওই, কিছুতেই আমি মনস্থির করতে পারছিলাম না। ‘স্টাডি রুমে’ বসে কতশত ভাবনা। আমার একজনই বন্ধু ছিল। অনার্স শেষেই বিদেশে পাড়ি জমায়। এরপর থেকে আমি আরও একা হয়ে পড়লেও প্রায় কথা হতো ওর সাথে। ও-ই আমাকে বলল, প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে। আমার মাথায় তখন একটা ব্যাপার খেলে গেল। লোকে বলে, এক ঢিলে দুই পাখিও মারা যায়, কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখলাম তিন পাখি মারার। আমি তখন ভাবতে শুরু করলাম, যদি আমার জীবনে কোনো নারীর আগমন ঘটে, তাহলে আমি সফল হবোই হবো। অন্যদিকে সুন্নত কায়েম হয়ে যাবে। পাশা আর কখনো নাম না জানা নারীকে কল্পনা করে পাপ কামাতে হবে না। হঠাৎ আমি চোখের সামনে সবকিছু উজ্জ্বল দেখতে লাগলাম। আমার মনে হলো, জীবন যেটাই হোক, পাওয়া ততটা কঠিন না।
এই পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও আমি কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলাম না। আমার আশেপাশে এমন কেউ নেই, যাকে আমি বলতে পারি, আমার একজন জীবন সঙ্গীনীর খুব দরকার। চিরকালই গুরুগম্ভীর ছিলাম আমি। কারোর সাথে হেসে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তাই ঠিকভাবে মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। এর মধ্যেই একদিন চমকপ্রাপ্ত হলাম আমি। আমার রুক্ষ হৃদয়ে হঠাৎ করে শীতলতার ছোঁয়া লাগল। প্রথমবারের মতো কোনো নারীর রূপে বিভোর হলাম আমি।

তখন দেশের একটা নামকরা গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করি আমি। একদিন দুপুরের দিকে অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন হঠাৎই দেখলাম মেয়েটাকে। রিসিপশনের ছেলেটার সাথে কথা বলছে। কখনো নারী সঙ্গতা পাইনি। মায়ের সাথে খুব স্বল্প সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। জানা নেই, কীভাবে নারীদের সাথে কথা বলতে হয়। কতটা নমনীয় হলে নারীলোক মুগ্ধ হয়, তা আমার একেবারেই অজানা। তবুও কীভাবে যেন এক অনভিজ্ঞ প্রেমিক মন নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। চোখে সানগ্লাস দিয়ে নিলাম আগেই, যেন আমার চোখের রংটা তাকে বিরক্ত না করে। কথা বলার সময় যেন তাঁর পুরো মনোযোগ আমাকে ঘিরেই থাকে।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, “কিছু হয়েছে?”
বুক ঢিপঢিপ করছিল আমার। মেয়েটা যখন তাকিয়ে বলল, “আপনি কে?” তখন আমার প্রথমবারের মতো মনে হলো, আমার জীবনে বসন্তের আগমন ঘটেছে। অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এটা ভাবতে আমার ভালো লাগছিল। এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। কল্পনায় নারীসঙ্গ আকাঙ্খা করলেও কখনো সামনাসামনি কোনো নারীর সাথে বন্ধুত্ব করা হয়নি। বাস্তবিক অর্থে আমার ধারণা ছিল, কোনো তরুণীর চোখে আমি রূপবান নই। নিজের প্রতি এই আস্থাহীনতার কারণেই আমি এমন ভাবে সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতাম, যা থেকে সবাই বুঝতে পারতো, মেয়েলোক আমার দুই চোখের বিষ!

সেদিন যখন নিজের পরিচয় দিলাম, তখন হঠাৎ মেয়েটা এমন আচরণ করল, যেন আমি তাঁর অনেকদিনের পরিচিত! সে বলতে লাগল, “প্লিজ প্লিজ, আমার একটা হেল্প করুন। আমি জানি, আমাকে সাহায্য করার জন্যই আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছে।”
মেয়েটার এমন কথা শুনে আমার হয়তো মুচকি হাসা উচিত ছিল, খানিক লাজুক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির কারণে তা করা হয়নি। আমি জানতে চাইলাম, “কী হয়েছে আপনার?”
“আমার না৷ আমার এক বন্ধুর কিছু হয়েছে। ওর আজকে সকালে এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসার কথা। ও এই অফিসে ইন্টারভিউ দিবে বলে এতটাই উত্তেজিত ছিল যে, গতকাল রাতেই ফোন বন্ধ করে রেখেছিল৷ এই কারণে, সকালে যদি ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে যায়? কিংবা কোনোভাবে যদি ফোন থেকে শব্দ হয়, যা অফিসারদের বিরক্ত করতে পারে। ভেবেছিলাম ইন্টারভিউ শেষ হতেই ফোন করবে, কিন্তু দুপুর হয়ে গেল, ওর খোঁজ খবর নাই। তাই সরাসরি এখানে এলাম ওর খোঁজ নিতে। আজ আমাদের ক্যাম্পাসে একটা পোগ্রাম আছে৷ ওকে অভিনয় করতে হবে সেখানে। দেরি হলে সব দোষ পড়বে আমার উপর।” মেয়েটা এরপর হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “আসলে ও একদম অভিনয় জানে না। তবুও আমায় এত করে বলল! তাই সবাইকে অনেক অনুরোধ করে ওকে দলে নিয়েছি। এখন ও না এলে আমার মান-ইজ্জত শেষ।”
মেয়েটা একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল, আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। আমি আগে কখনো কোনো নারীর কথাতে এতটা আকৃষ্ট হইনি। মেয়েটা যদি সেদিন সারাক্ষণ কথা বলতো, আমি তবুও নির্বিঘ্নে শুনতাম। আমার সময়ের থেকেও তখন মেয়েটার সঙ্গ অধিক মূল্যবান ছিল!
মেয়েটার অনুরোধেই আমি পাশের ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা সাথে সাথে বলল, “দেখুন না স্যার, আমি উনাকে বললাম ওই চাকরিপার্থী অফিসেই উপস্থিত আছেন, কিন্তু উনি কিছুতেই মানতে চাচ্ছেন না। হয়তো লোকটার ইন্টারভিউ লাঞ্চের পর হবে। আমি কীভাবে বাইরের একজনকে ভিতরে যেতে দিতে পারি? আমার চাকরি থাকবে?”
ছেলেটা ভুল বলেনি। এটা নিয়মের বাইরে। কিন্তু তবুও এই নিয়মের কথা মেয়েটার মুখের উপর বলতে পারিনি আমি। আমি জানতে চাইলাম, “আপনার বন্ধুটির নাম কী?”
মেয়েটা সাথে সাথে খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, “ওর নাম দীপ্ত। উচ্চতা আমার মতোই। গায়ের রং শ্যামলা। খুব ইনোসেন্ট লুক। প্রথম দেখাতেই চিনতে পারবেন।”
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “আপনি এক কাজ করুন, সোজা গিয়ে ডানদিকে যান, একটা কফিশপ দেখতে পাবেন। আপনি ওখানে গিয়ে বসুন, আমি আপনার বন্ধুকে ডেকে দিচ্ছি।”
আমার কথা বিশ্বাস করে মেয়েটা চলে গেলে আমি পাশের ছেলেটাকে বললাম, “ওই ছেলেটা এলে বলবেন, তাঁর বন্ধু কফিশপে অপেক্ষা করছে।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
হঠাৎ কী মনে হলো জানি না, আমিও কফিশপের দিকে অগ্রসর হলাম। যখন কফিশপের কাছে গেলাম, আমি বাইরে থেকে দেখলাম মেয়েটা একটা ফাঁকা টেবিলে বসে আছে। আমি তখনই ফোন বের করে ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা আমার সিনিয়র কলিগকে ফোন করলাম। ফোন রিসিভ হতেই আমি বললাম, “স্যার, দীপ্ত নামে একজন ক্যান্ডিডেট আছে, উনার কী ইন্টারভিউ নেওয়া হয়ে গেছে?”
স্যার কিছুক্ষণ পর জবাব দিলেন, “না। এখনো হয়নি। এইতো পরবর্তী পার্থী-ই উনি। কেন?”
আমি বললাম, “আমার মনে হয় ছেলেটার ইন্টারভিউ নেওয়ার প্রয়োজন নেই, স্যার। ছেলেটাকে আমার জানাশোনা আছে। খুবই অসচেতন এবং দায়িত্বহীন একটা ছেলে। প্রফেসর থাকাবস্থায় আমি ক্লাস নিয়েছিলাম। ওর খামখেয়ালির জন্য ল্যাবের ক্ষতি হয়েছিল। তাছাড়া আমাদের এখানে কাজ করার মতো মনোবল এখনো ছেলেটার হয়নি। ওর আরও পরিপক্ব হওয়া প্রয়োজন। শুধু শুধু সময়টা নষ্ট হবে।”
“আপনি ভেবে বলছেন, মিস্টার সুব্রত?” স্যার যেন খানিকটা হতচকিত হলেন।
“জি স্যার।”
এরপর আমি ফোন কেটে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ওই টেবিলটার কাছে যেতেই মেয়েটা আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটার দুই চোখে আমার জন্য খুব সম্মান। হবেই-বা না কেন, আমি তো আর সাধারণ কোনো কর্মচারী না।
আমি বললাম, “দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? বসুন।”
“না স্যার, আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন।”
“আহা! বসুন, কোনো অসুবিধা নেই। আপনার বন্ধু আসছে।”
এরপর মেয়েটা বসল চেয়ারে, খুব জড়োসড়ো হয়ে! আমিও বসলাম উল্টো দিকের চেয়ারে। তিন কাপ কফি অর্ডার দিয়ে জানতে চাইলাম, “আপনার নাম?”
মেয়েটা ইতস্ততভাবে বলল, “আমার নাম রুশা।”
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম, “আমার নাম জানতে চাইবেন না?”
“না মানে, স্যার।”
“আমার নাম স্যার না। আমার নাম সুব্রত।”
আমার কথা শুনে মেয়েটা খুব অস্বস্তিতে পড়ল বোধকরি। ঘামতে শুরু করেছে। আমার কী হয়েছিল জানি না, ২০-২২ বছরের ছেলেদের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলাম। মেয়েটার অস্বস্তি আসলে এখানে। এমন আচরণ আমার সাথে ঠিক মানতে পারছিল না সে। একজন সাইন্টিস্ট আমি। অন্তত সামান্য গাম্ভীর্য আমার মধ্যে থাকা বঞ্চনীয়। কিন্তু কাকে বোঝাবো, আমি তখন ওই তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট। তাঁর রূপের মোহতে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।

কিছুক্ষণ পর ছেলেটা এলো। খুব রাগান্বিত চেহারা করে। ওকে দেখে আমি অদ্ভুত এক ধরনের উল্লাস বোধ করলাম। ছেলেটা এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “যত্তসব ফালতু লোকজন। কোনো বিবেক নেই। ভদ্রতা নেই। অশিক্ষিত লোক। গাঁজা খেয়ে ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। সারাদিন বসিয়ে রেখে এখন কী-না বলে, আজ আর ইন্টারভিউ নেওয়া হবে না। পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। অথচ অবশিষ্ট ছিলাম শুধুমাত্র আমি একজন।”
খুব জোরে জোরে বেশ ক’টা গালিও দিলো ছেলেটা। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে ইশারায় ছেলেটাকে থামাতে চাইছে। আমাকে তাকাতে দেখেই কেমন যেন চুপসে গেল। তখনই ছেলেটার নজরে পড়লাম আমি। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কে?”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “যারা ইন্টারভিউ নিচ্ছে, আমি তাঁদেরই একজন।”
ছেলেটা এমনটা প্রত্যাশা করেনি। আমার পরিচয় জেনে একেবারে থতমত খেয়ে গেল। মেয়েটা তখন আমার দিকে বলল, “সরি স্যার৷ আসলে ও বুঝতে পারেনি। কিছু মনে করবেন না।”
রমণীর এমন ক্ষমাপ্রার্থনা আমাকে কোমল করে দিলো। এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম, কেন ইউনিভার্সিটিতে স্যারেরা মেয়েদের সাথে অত শীতল আচরণ করতো। আসলে মেয়েদের কাছে এমন একটা ক্ষমতা আছে, যার দ্বারা এরা অন্যায় করলেও সহজেই পার পেয়ে যায়।
আমি হেসে বললাম, “কোনো অসুবিধে নেই।”
মেয়েটা এবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “মন খারাপ করিস না। আবার নিশ্চয়ই ডাকবে।”
ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করে বলল, “কচু ডাকবে। তুই তো জানিস এইসময় চাকরি কতটা প্রয়োজন।”
“কী আর করার।”
মেয়েটার মুখ এমন মলিন হলো যে, আমার বড্ড মায়া হলো। হাসিমুখেই যেন তাকে দেখতে ভালো লাগে। তাঁর সাথে বিমর্ষতা বেমানান। আমি সহসা বললাম, “আপনাদের যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তাহলে আমি কিছু একটা করতে পারি।”
“সত্যি?” মেয়েটা বলল উচ্চস্বরে; উত্তেজনায় চকচক করছে তাঁর মুখ।
আমি অপলক তাকিয়ে থেকে বললাম, “সত্যি।”
আমি তখন ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এলাম। স্যারকে ফোন দিলাম আবার। ফোন রিসিভ করতেই বললাম, “স্যার, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে আমার দ্বারা একটা ভুল হয়ে গেছে। সেটা শুধরাতে চাই আমি।”
স্যার যথেষ্ট বিনয়ী হয়ে বললেন, “না না মিস্টার সুব্রত, এভাবে বলছেন কেন? আপনি নির্বিঘ্নে বলতে পারেন।”
“আসলে স্যার, ছেলেটার সাথে যখন আমার পরিচয় ছিল, তখন সে আনাড়ি ছিল। আজ দুই-তিন বছর পর তাকে দেখলাম। কথা হলো আমার সাথে। সে আগের মতো নেই। অনেক পরিবর্তন এসেছে তাঁর মধ্যে। আমার মনে হয় তাঁর একটা ইন্টারভিউ নিয়ে দেখা উচিত। অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাকে অবহেলা করা উচিত হবে না বোধহয়।”
স্যার হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন, “মিস্টার সুব্রত, আপনি হয়তো ঠিক বলছেন। কিন্তু ছেলেটাকে আমি বলে দিয়েছি, আজ আর কোনো ইন্টারভিউ নেওয়া হবে না। হয়তো ইতোমধ্যে চলে গেছেন।”
“না স্যার৷ ও নিচেই আছে৷ আপনি প্লিজ একটা ব্যবস্থা করুন। এটা আমার আপনার কাছে অনুরোধ। প্লিজ স্যার।”
স্যার ভেবে জানালেন, “ঠিক আছে। আপনি যখন বলছেন, তখন আমি দেখছি ব্যাপারটা।”
ফোন কেটে দিয়ে আমি আবার এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সেই ফাঁকা চেয়ারে বসলাম। ছেলে-মেয়ে দুজনেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মৃদু হেসে বললাম, “কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেতে থাকুন। দেখা যাক কী হয়।”
ছেলেটার প্রতিক্রিয়া দেখা হয়নি, কিন্তু মেয়েটাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করেছিলাম আমি। আনন্দে তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বিন্দুমাত্র কমতি রাখেনি।

হঠাৎ ফিরোজের পায়ের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল চিত্রা। দ্রুত ডায়েরিটা ছুড়ে মারল ব্যালকনির আরেক কোণায়, খুব অন্ধকার যেখানে। এরপর ঘুমের ভান করল সে। ফিরোজ এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে…।

১৪তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=831769791101056&id=100028041274793

বি:দ্র: ‘প্রস্থান’ এর এ পর্যন্ত পোস্টকৃত সবচেয়ে বড় পর্ব। প্রায় সারাটাদিন এখানেই চলে গেছে আমার। তবুও যখন আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারি, তখন আমার সমস্ত ক্লান্তি ভালোলাগায় রূপ নেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here