প্রস্থান — ১৩তম পর্ব।

0
594

প্রস্থান — ১৩তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৭.
মায়ের ঘরে এলো রশ্মি, আঁদা দেওয়া চা নিয়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে সবেমাত্র, পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে সুর্য-ক্লান্ত হয়ে! বাইরে থমথমে ভাব, তাপটাও কেমন অস্বস্তিকর। ঘামে রশ্মির মুখ চিকচিক করছে। সে মায়ের দিকে একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসল।
চা দেখে উল্লসিত ভঙ্গিতে রুমানা বেগম প্রশ্ন করলেন, “চা কোথায় পেলি?”
রশ্মি মুখ গোমড়া করে বলল, “রাস্তায়। দেখলাম পড়ে আছে, আমায় ডাকছে নেওয়ার জন্য। তাই তুলে আনলাম।”
রুমানা বেগম রাগ করে বললেন, “অসুস্থ মায়ের সাথে মজা নিচ্ছিস?”
রশ্মি ঠোঁট কামড়ে হাতের চায়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলল, “এটা বিশ্বাস না করলে দ্বিতীয়টা করো। আমি বানিয়েছি চা।”
মুখ টিপে হাসলেন রুমানা বেগম। দেখে রশ্মি ঈষৎ রাগী গলায় বলল, “তুমিও না, হাজারটা প্রশ্ন করো। দোকান থেকে এনিয়েছি। হয়েছে এবার?”
“তাই বল।” বলে আস্তে করে চায়ে চুমুক দিলেন রুমানা বেগম। আবার কাপটা নামিয়ে বললেন, “বাজারও তেমন নেই ঘরে। রাতের জন্য রান্না করতে হবে তো।”
রশ্মি নিচের দিকে তাকিয়ে, মলিন গলায় বলল, “চিত্রা এসেছিল, সন্ধ্যাবেলা রাতের খাবার দিয়ে যাবে বলেছে।”
“ধুর! এভাবে ক’দিন? রোজ রোজ আরেক বাড়ি থেকে খাবার আনা যায় নাকি? আমাকেই রান্না করতে হবে। তাছাড়া শরীর তো এখন আগের মতো খারাপ না। সুস্থ আছি।”
“সে পরে দেখা যাবে।” বিছানা থেকে ওঠে, ড্রেসিং টেবিলের কাছের একটা টুলে গিয়ে বসল রশ্মি। বিবর্ণমুখে, ক্ষীণ আওয়াজে বলল, “শুনেছি সুব্রত ভাইয়ের খুব শরীর খারাপ। মারাত্মক জ্বর। অজ্ঞান হয়ে গেছিল। ডাক্তার স্যালাইন দিলে চেতনা ফিরে।”
“বলিস কীরে?” ভড়কে গেলেন রুমানা বেগম। তাঁর চেহারা মলিন হয়ে গেল খুব।
রশ্মি আবার বলল, “চিত্রা বলছিল, এখন আগের থেকে সুস্থ।”
রুমানা বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “আমার উচিত একবার ওকে দেখে আসা।”
“কোনো দরকার নেই। নিজে অসুস্থ, উনি যাবেন আরেক রোগীকে দেখতে।” মুখ শক্ত করে, টুল থেকে ওঠে আবার মায়ের কাছে এসে বসল সে।
রুমানা বেগম বললেন, “তাহলে তুই যা৷ একবার দেখে আয়। বেচারা আমাদের সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়ল। অন্তত ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে আয়।”
রশ্মি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “কোনো দরকার নেই।”
“কেন? বড্ড অমানবিক হবে না? আল্লাহ মাফ করবেন?”
“জানি না। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না।” ঠোঁট কামড়াল রশ্মি। আবার আলতো করে ছেড়ে দিয়ে বলল, “কেন জানি উনাকে ভালো লাগে না আমার।”
“এটা আবার কেমন কথা? মানুষ হয়ে মানুষকে অপছন্দ করলে আল্লাহও তোকে অপছন্দ করবেন।”
“ঠিক অপছন্দ না, মা।” মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল রশ্মি, ভিতরের অস্থিরতা ভাষার প্রকাশ করতে না পারায়। আবার বলল, “আসলে উনার সামনে গেলে আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়! মাসে একদিন পর্যন্ত আমাদের কথা হয় না, অথচ মনে হয় আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত কানেকশন আছে। মনে হয় একই সুতোর দুই প্রান্তে বসবাস করছি আমরা। একপাশে বাতাস লাগলে অন্যপাশটাও হেলে উঠে! এই কারণেই আমার অস্বস্তি হয়। উনার সামনে আমি ঠিকভাবে কথা বলতে পারি না। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি হয়, সব কেমন গুলিয়ে যায়। আমার ভালো লাগে না এইসব। ভয় করে।”
মেয়ের কথার পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারেন না রুমানা বেগম। যেটুকু বুঝলেন, তাতে তারই অস্বস্তি বোধ হলো!
মা-কে নীরব থেকে রশ্মি আবার বলল, “অনেক আগে থেকেই এমনটা হচ্ছে। উনি আশেপাশে থাকলে অদ্ভুত আচরণ করি আমি। এমনকিছু বলে ফেলি, যা আমি সচেতন অবস্থায় বলতে চাই না। আমার মাথায় এলোমেলো চিন্তা এসে যায়। ঘুমাতে গেলে আমি এমন স্বপ্ন দেখি, যা আমি জীবনেও কাউকে বলতে পারব না। লজ্জায় মরতে হবে! সেজন্যই আমি উনার কাছে যাবো না৷ সেদিন রাতে চিত্রাকে ডাকতে গিয়ে দেখি উনি সামনে। তাই উনার সাহায্য নিয়েছিলাম। নাহলে..।”
রুমানা বেগম থতমত খেয়ে বললেন, “থাক, তাহলে যেতে হবে না। আজকের দিনটা থাক, কালকে বরং আমি গিয়ে একবার দেখা করে আসবো। বিপদে আমাদের পাশে ছিল। এখন আমরা এড়িয়ে গেলে চলবে?”

চা শেষ করে রশ্মি নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, তোমাকে কিছু কথা বলব ভাবছি।”
“কী কথা?” চা শেষ করে শোয়ায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রুমানা বেগম। বালিশটা ঠিক করতে করতে মেয়ের দিকে তাকালেন। ওই ঘটনার পর থেকেই মেয়ের ভিন্ন রূপ দেখছেন তিনি। তাই শান্তি।
চিত্রা মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, “এটাই সঠিক সময় এই বিষয়ে কথা বলার। আর দেরি করা যাবে না।”
“হ্যাঁ, বল।” মেয়ের কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হলেন রুমানা বেগম।
রশ্মি সহসা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, ইতস্ততভাবে বলল, “বলতেই তো চাচ্ছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কেউ মায়ের সাথে এই বিষয়ে কীভাবে আলোচনা করতে পারে!”
“মায়ের সাথে সব বিষয়েই আলোচনা করা যায়। তুই আগে কখনো চেষ্টা করিসনি, তাই আজ সংকোচ হচ্ছে। বলে ফেল চটপট।”
“যেটুকু বলব, পরিষ্কার করে বলব। আশা করি তুমিও আমার প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দিবে। ব্যাপারটার ইতি টানা দরকার। পরিষ্কার জবাব দিবে তো?”
এমনসময় হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেল। রুমানা বেগম মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে, দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন কে এলো?”
“বোধহয় চিত্রা। তুমি বসো, আমি দেখে আসি।”
বসা থেকে দাঁড়িয়ে, সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল রশ্মি। কিন্তু দরজা খুলতেই এমন একটা মুখ সম্মুখে দেখতে পেলো, যা তাঁর মাথায় রক্ত তুলে দিলো। ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠল তাঁর সারা শরীর। দম খিঁচে তাকিয়ে রইল সে।

১৮.
বিকেলে যখন সুব্রত ভাইয়ের ঘরে এলো চিত্রা, তখন দেখল সুব্রত ভাই শুয়ে আছেন। দরজা ভেড়ানো। সে বাইরে থেকে বলল, “সুব্রত ভাই, জেগে আছেন?”
জেগে আছে সুব্রত। শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। চিত্রার গলার আওয়াজ পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি আবার কেন এসেছ?”
চিত্রা বলল, “আপনি এখন কেমন আছেন, সেটা জানতে।”
“আমি ভালো আছি।”
“একবার ভিতরে আসি?”
“হুম।” গম্ভীরমুখে সম্মতি দিয়ে মনোযোগ পুরোপুরি বইতে দিলো সুব্রত।
অনুমতি পেয়ে চিত্রার চোখ-মুখ উজ্জল-দীপ্ত হলো! দরজা ঠেলে, ভিতরে প্রবেশ করে সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলতে লাগল, “একা একা বিরক্ত বোধ হচ্ছিল। আপনার ছোট ভাই অফিসে। কনাও বাড়িতে নেই৷ মা নিজের ঘরে। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু গল্প করতে আসি।”
সুব্রত বইয়ের পাতা থেকে মুখ সরিয়ে বলল, “আমি এখন খুব ব্যস্ত, চিত্রা। দেখছ তো বই পড়ছি। আর বই পড়ার সময় আমি কারোর সাথে গল্প করি না।”
“কিন্তু আমার হাতে অঢেল সময়। কোথায় নষ্ট করব? সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে? সেজন্য আপনার কাছে এলাম। একটা ইন্টারেস্টিং মানুষ আপনি। আপনাকে আমার সেই লাগে!”
সুব্রত হকচকিয়ে ওঠে বলল, “মানে? আমার মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী দেখলে?”
একটা টুল টেনে সুব্রত ভাইয়ের সামনে বসল চিত্রা। চুলগুলোতে সামান্য ঢেউ খেলিয়ে পিঠের উপর দিয়ে এলিয়ে দিয়ে, সহজ হয়ে বসে বলল, “প্রথম যেদিন আপনার ঘরে এলাম, সেদিন না জেনেই এসেছিলাম, এরপর যখন জানলাম এটা আপনার ঘর, তখন খুব ঘাবড়ে গেছিলাম। এরপর যা হয়েছিল, আপনার সামনেই তো হয়েছিল। সেইদিনটা আমি জীবনেও ভুলবো না। এরপর যখন আপনার সম্পর্কে জানলাম, তখন ভয় পেতে লাগলাম আপনাকে, ঘৃণাও হতো প্রথমে, অথচ আপনার সামনে দাঁড়ালে মনে হতো, আপনি মানুষটা অতটাও খারাপ না! কোনো ব্যাপার তো আছেই এখানে। বরং আপনি ইন্টারেস্টিং। ইন্টেলিজেন্টও। জানেন সুব্রত ভাই, আপনি যখন বই পড়েন, তখন আমার মনে হয় আমি নিজের বাবাকে দেখছি। আমার বাবাও ঠিক আপনার মতো, অনেক বই পড়েন, আর যখন পড়েন, তখন অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেন না। বরং কেউ শব্দ করায় তাঁর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে খুব বিরক্ত হন। অনেক বকাঝকা করতেন আমাকে, ঠিক আপনার মতো।” কথাগুলো বলে সরল মুখে হাসল চিত্রা।
সুব্রত বইটা বন্ধ করে, পাশে রেখে তাকালো চিত্রার দিকে। এরপর চোখ নামিয়ে, মৃদু হেসে বলল, “তোমার বাবা নিশ্চয়ই বেশি পড়েন, আর কম কথা বলেন?”
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকালো চিত্রা। সত্যিই তাঁর বাবা কম কথা বলেন। বইও পড়েন বিনা শব্দে!
সুব্রত সোজা হয়ে বসে বলল, “তাহলে তুমি এত বকবক শিখেছ কোথা থেকে? তোমার মায়ের কাছ থেকে?”
সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল চিত্রা। হাসতে হাসতে বলল, “এটা ঠিক বলেছেন। তবে আমাদের বাড়িতে, আমার বাবা ব্যতীত বাকি সবাই-ই অনেক কথা বলতে পারে৷ এমনকি আমার কাজিনরাও। আপনাদের মতো সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকি না আমরা।” কথাগুলো খুব গর্বের সাথে বলল চিত্রা, যেন বাচালতা খুব গৌরবের!
সুব্রত আর কিছু না বলে বইটা হাতে নিলো আবার। কিন্তু একটা শব্দও পড়তে পারল না। তাকিয়ে রইল শুধু।
চিত্রা মিনিট খানিক নীরব থাকার পর আবার বলল, “আচ্ছা সুব্রত ভাই, আপনাদের বাড়িতে সবাই কী এমন, কম কথা বলে, খুব রাগী।”
“আমি জানি না।” সংক্ষিপ্ত করে জবাব দিলো সুব্রত।
চিত্রা কৌতূহলী হয়ে আবার জানতে চাইল, “ফিরোজ সাহেব কী ছোটবেলা থেকেই এত রাগী? নাকি বড় হওয়ার পর রাগ বেশি হয়েছে?”
এবারও গম্ভীরমুখে জবাব দিলো সুব্রত। “আমি জানি না।”
“জানেন, আজ সকালে হঠাৎ কী হলো কে জানে, উনি রাগ করলেন খুব। আপনার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, উনি অফিসে চলে গেছে। কিছু খেয়েও যায়নি। কতবার করে ফোন করলাম, রিসিভ করল না। এত রাগ লোকটার। কী করেছি আমি? বললেই তো আমি আর একই ভুল বারবার করতাম না। গাধাটা কিছু না বলে শুধু রাগ করে।”
সুব্রত কিছু বলতে পারল না। এ-ব্যাপারে তাঁর কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই।
চিত্রা সহসা দাঁড়িয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার দিকে গিয়ে বলল, “আচ্ছা সুব্রত ভাই, আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো, দিবেন?”
সুব্রত বড় শ্বাস ফেলে বলল, “আমার কাছে এমন কিছু নেই, যা তোমার প্রয়োজন হতে পারে।”
“আছে তো। বই। বিয়ের আগে যখন এসেছিলাম, তখন একটা বই দেখেছিলাম। ইংরেজি কবিতার বই। ভাবছি এখন থেকে বই পড়ে সময় কাঁটাবো। প্রথমে ওই বইটা পড়ার জন্য খুব লোভ হচ্ছে। ধার দিবেন? কালকেই ফেরত দিয়ে দিবো, কথা দিচ্ছি। না দিলে জরিমানা করবেন না-হয়।”
সুব্রত হাতের বই আবার নামিয়ে রেখে, চিত্রার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “যদি আমিই না দিই?”
“‘না’ করলেই মানছি নাকি?” বলতে বলতে বারান্দায় থেকে ফিরে এলো চিত্রা। “এত সেবাযত্ন করছি। সময়মতো খাবার দিয়ে যাচ্ছি, মেডিসিন দিচ্ছি; বিনিময়ে এইটুকু তো চাইতেই পারি।”
অবাক হয়ে, চোখ বড় বড় করে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল সুব্রত। চিত্রা চোখের পাতা নামিয়ে, অনুনয় করে, কাতর গলায় বলল, “প্লিজ। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ যেন ভুলিয়ে দিলো সুব্রতকে। সে চোখ নামিয়ে, ধীর গলায় বলল, “ঠিক আছে। নামটা বলো, আমি এনে দিচ্ছি৷”
সুব্রত ভাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই চিত্রা দৌড়ে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। দু’দিকে পাখির মতো ডানা মেলে, সরাসরি বাঁধা দিয়ে বলল, “আপনি কেন খামোখা অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠতে যাবেন? আমি তো আছি।”
“ঠিক বলছ?” বিস্মিত হয়ে, চিত্রার পা-মাথা পর্যন্ত একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে সুব্রত আবার বলল, “তুমি কি জানো না, আমি ওই ঘরে কাউকে ঢুকতে দিই না?”
চিত্রা হাত নামিয়ে, আবার আকুল গলায় বলল, “প্লিজ। দিন না যেতে। কথা দিচ্ছি, অন্য কিছুতে হাত দিবো না।”
কিছুক্ষণ আপনমনে ভাবল সুব্রত। আর আড়চোখে চিত্রাকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বলল, “ঠিক আছে। তবে খবরদার, কোনো ব্যক্তিগত জিনিস ধরবে না। তাকাবেও না। বইটা নিয়ে বেরিয়ে যাবে। আর এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ।”
চিত্রার মুখে হাসি ফুটলো। সে আপ্লুত হয়ে বলল, “থ্যাঙ্কিউ সুব্রত ভাই।”

দরজায় তালা ছিল না, ছিটকিনিটা খুলে ভিতরে ঢুকল সে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারিদিকে। বেডরুমের আলোয় যেটুকু চোখের সামনে সাদৃশ্য হলো, তাতে সে কোনো রকমে সুইচবোর্ড খুঁজে পেলো। এরপর আলো জ্বালাতেই দ্বিতীয় বারের মতো স্পষ্ট হলো, চোখের সামনে ভেসে উঠল অপূর্ব দৃশ্যটা। কী পরিবেশ, কী সুন্দর চারিদিক; যেন ভিন্ন এক জগৎ! চারিদিকে শুধু বই আর বই। ডান দিকের উপরে তাকিয়ে, একটা ফ্রেমে পাশাপাশি দুটো ছবি দেখতে পেলো সে। চেহারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবুও সে বুঝতে পারল, এনারাই সুব্রত ভাইয়ের বাবা-মা। বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে সুব্রত ভাই নিজের একান্ত আপনজন-ব্যক্তিগত জিনিসের সাথে এত যত্ন সহকারে রাখবে না। আরও একজন আছে, যার স্পর্শ আছে এই ঘরে! ছবি দেখেছিল সে, রুশা! সুশ্রী রূপের একটা মেয়ে। ছবিতে দেহের গড়ন যেটুকু বোঝা গেছে, তাতে মনে হয়নি স্বাস্থবতী বা রূগ্ন! চোখ দুটো ছিল টানাটানা। বয়সটা হয়তো তাঁরই মতো। মুখ দেখে খুব সরল মেয়ে মনে হয়। মনে হয় খুব গুনবতীও।
বইটা খোঁজার ফাঁকে ছবিটাও খুঁজতে লাগল চিত্রা। কিন্তু পাচ্ছে না। হঠাৎ টেবিলের ড্রয়ারটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা ডায়েরি। তাঁর চোখ ঝুঁকে পড়ল সাথে সাথে। নিচু হয়ে দেখতে লাগল ডায়েরিটা। আচমকা সে বলে উঠল, “সুব্রত ভাই, আপনি ডায়েরি লিখেন?” প্রশ্নটা করেই তাঁর মনে হলো, একটা বোকামি সে করে ফেলেছে। সুব্রত ভাই নিশ্চয়ই এবার রেগে গিয়ে বলবে, বই তো বুকশেলফ-এ, তুমি ড্রয়ার খুলেছ কেন?
চিত্রার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। সুব্রত ভাই রাগ-ও করল না, কোনো প্রশ্নও করল না। সে ভেতর থেকে শান্ত গলায় জবাব দিলো। “আগে লিখতাম। এখন লিখি না।”
চিত্রা ঢোক গিলে বলল, “কেন?”
“এখন লেখার মতো কিছু নেই। সেজন্য। একঘেয়েমি জীবন। কী লিখবো?”
চিত্রাকে সহসা ভীষণ উত্তেজিত দেখালো! ডায়েরিটা দেখার প্রগাঢ় ইচ্ছা জন্মাল তাঁর। হাত বাড়িয়ে ধরতে যাবে, তখন বজ্রপাতের মতো হঠাৎ ঘর থেকে হুঙ্কার ভেসে এলো। “খবরদার, ওটা ধরবে না। ধরলে তোমার খবর আছে।”
এমন হুঙ্কারে কম্পিত হলো চিত্রা। বিন্দুমাত্র দুঃসাহসিক সে নয়। তাই দ্রুত নিজেকে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে, বই দেখতে লাগল। পেয়েও গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়ে, ডায়েরির প্রতি কৌতূহল জন্মাতে শুরু করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য তাঁর ভিতরের আত্মা ব্যাকুলতা অনুভব করতে শুরু করেছে। শেষমেশ ‘স্টাডি রুম’ থেকে বেরোনোর সময় অন্যায়টা করে ফেলল সে!

সুব্রত আড়চোখে দেখল, চিত্রা ‘স্টাডি রুম’ থেকে বেরিয়েই কেমন চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে ডাকল চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে, “চিত্রা।”
থমকে গিয়ে জবাব দিলো চিত্রা, ভয়ার্ত গলায়, “বলুন সুব্রত ভাই।”
“চলে যাচ্ছ?”
“জি৷ ঘরে গিয়ে বইটা পড়ব। কালকে ফেরত দিতে হবে কী-না!”
“বেশ। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাও। আর দেখো, বইয়ের যেন ক্ষতি না হয়। তোমাদের থেকেও এরা আমার কাছের।”
প্রতিবাদ করতে মন চাইলো চিত্রার, কিন্তু রিস্ক নিতে চাইল না। বাইরে এসে, দ্রুত দরজাটা ভিড়িয়ে ঠিক চোরের মতোই পালাল সে।

১৩তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=831135221164513&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here