প্রস্থান — ১২তম পর্ব।

0
676

প্রস্থান — ১২তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৬.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল চিত্রার। আধো আধো ভাবে চোখ মেলে দেখল, পাশে আধোশোয়া হয়ে বসে আছে ফিরোজ, হাতে কিছু কাগজপত্র। সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। সারাদিন লোকটার ব্যস্ততা! দিনেরবেলা নিজের অফিসের কাজ, রাতেরবেলা বাবার অফিসের কাজ; বিশ্রামের অবকাশ নেই! সে ঘুম জড়ানো গলায় ডাকল ফিরোজকে, “এই, শুনছো?”
ফিরোজ তাকাল পাশে, চিত্রাকে দেখে ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি টেনে বলল, “ঘুম ভেঙে গেল বুঝি?”
“হুম।”
“সরি।”
“সরি বললেই হয়ে গেল?” ফিরোজের মতো আধোশোয়া হয়ে বসল চিত্রা। ঘুমে ক্লান্ত দেহখানি ওর কাঁধের এলিয়ে দিয়ে বলল, “সারাক্ষণ কাজ নিয়ে থাকলে হবে? বউকে সময় দিতে হবে না? এমন করলে বউ থাকবে? খুব শীঘ্রই পালাবে।” বলে হি হি করে হাসল চিত্রা।
ফিরোজ হাসল না, বিন্দু পরিমাণও না। অপলক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “বেশ তো, যাও। আটকাচ্ছে কে?”
চিত্রা ভুরু উপরে টেনে বলল, “সত্যিই আটকাবে না?”
“উঁহু।” মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো ফিরোজ।
চিত্রা বিস্ময় চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, সহসা শুয়ে পড়ল ফিরোজের কোলে মাথা রেখে। হাত দিয়ে ফাইলটা সরিয়ে, উঁকি দেওয়ার মতো করে মুখটা দেখাল।
ফিরোজ মৃদুস্বরে হাসল এবার। ফাইলটা নামিয়ে পাশে রেখে, চিত্রার চুলগুলোতে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলল, “ঘুম আসছে না?”
জবাব না দিয়ে চিত্রা বলল, “দিনদিন তুমি কেমন যেন পালটে যাচ্ছ। আগের মতো আমার সাথে অনেকটা সময় নিয়ে গল্প করো না। কেন বলোতো?”
ফিরোজ অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “কাজের চাপ বেড়েছে না, সেজন্য। আমাদের ফ্যাক্টরিটা নিয়ে এখন খুব ভাবতে হচ্ছে।”
“শুধুই এই কারণে? আর কোনো কারণ নেই তো?” চিত্রার মুখ বিবর্ণ হলো, চাহনি শান্ত-স্থির।
ফিরোজ ফিক করে হেসে বলল, “বোকা মেয়ে! আর কী কারণ হতে পারে?”
চিত্রা ঠোঁট টিপে, হুমকি দেওয়ার মতো করে বলল, “না হলেই মোঙ্গল তোমার জন্য। যদি উল্টো পাল্টা কিছু মনে থাকে না, তাহলে তোমাকে খুন করবো আমি। একেবারে মেরে দিবো।”
ফিরোজ হাসল চিত্রার কথা শুনে। হাসতে হাসতে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল আলতো করে। চিত্রা চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্বামীর একটা হাত বুকে জড়িয়ে রাখল। ফিরোজ আর ফাইলটা হাতে নিলো না এখন। অন্যহাতে চিত্রার চুলে বিলি কাঁটতে লাগল, পরম যত্নে।
শুয়ে শুয়ে চিত্রা বলল, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
ফিরোজ ম্লান হেসে বলল, “আমি কোনো স্কুলের মাস্টারমশাই নই, যে কথা বলার জন্য অনুমতি চাইতে হবে। তুমি নির্বিঘ্নে প্রশ্ন করতে পারো। আমরা ছেলেরা তো বিয়ে করি-ই বউদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য।”
“এটা কেমন কথা শুনি?” অবাক হয়ে চোখ মেলে তাকাল চিত্রা। ফিরোজের মুখের দিকে তাকিয়ে, রাগী গলায় বলল, “এমনভাবে বলছ, যেন আমরা বউরা সারাদিন তোমাদের প্রশ্ন করে বেড়াই।”
“করো না বুঝি? অফিস থেকে ফেরার পরই তো তোমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বিসিএস এর থেকেও কঠিন পরিক্ষা নেয় বউরা। আর এমন সন্দেহের চোখে তাকাও, যেন চুরি করে এসেছি। শরীরে ঘামের গন্ধের সন্ধ্যান পেলেও চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করো, এটা কোন মেয়ের পারফিউম এর ঘ্রাণ। অদ্ভুত তোমরা!”
চিত্রা মুখ শক্ত করে বলল, “বেশ করি। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো, কার কার সাথে মিশো, তা কী আমরা দেখতে যাই? বাড়িতে ফিরলে একটু পর্যবেক্ষণ না করলে হয়?”
ফিরোজ বাকা হাসি দিয়ে বলল, “আর বউরা? আমাদেরও কি উচিত না বউকে পর্যবেক্ষণ করা?”
“আশ্চর্য!” হঠাৎ ওঠে বসল চিত্রা। ফিরোজের মুখোমুখি হয়ে বলল, “মেয়ে-বউরা তো সবসময় বাড়িতেই থাকে। বাইরে গিয়ে কারোর সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে না। এদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকানোর কী আছে?”
“তাকানোর নেই? কেন, বাড়িতে কী বিপদ নেই?” জানতে চেয়ে রহস্যময় হাসি দিলো ফিরোজ। হাসিতে বিশেষ ইঙ্গিত!
ফিরোজের কথা শুনে চিত্রা জ্যোতিহীন চেহারা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কথাটা বুঝতে পারল না সে। বুঝার জন্য অদম্য চেষ্টা করলেও লাভ হলো না পরবর্তী কয়েক সেকেন্ডে! এরপর সে বড় একটা শ্বাস ফেলে, প্রসঙ্গ পাল্টাল। “আচ্ছা, তোমাদের অফিসের কিছু কাজ আমাকে শেখবে?”
ফিরোজও নিজেকে সামলে নিলো। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল, “তুমি অফিসের কাজ শিখে কী করবে? তুমি তো আর অফিসে যাচ্ছো না।”
“তাতে কী? বাড়িতে বসে কাজ করব কিছু কিছু। যেমন তুমি ফাইল দেখছ, আমিও দেখবো। বাবার কাজের প্রেশার কমে যাবে।”
চিত্রার কথা শুনে আকস্মিক ‘হো হো’ শব্দ করে হেসে উঠল ফিরোজ। হাসতে হাসতে বলল, “তোমার কী মনে হয়, কাজটি এত সোজা? তোমার ধারণা নেই, এখানে কতটা বুদ্ধি খাটাতে হয়। এত বুদ্ধি মেয়েদের আছে?”
চিত্রা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “হুহ, সব কাজ তো শুধু ছেলেরাই জানে! মেয়েরা সবাই তো অকর্মা। কিছুই জানে না।” এরপর মুখ শক্ত করে, কামিজের উপরের অংশ সামান্য তুলে গর্বের সাথে বলল, “মিস্টার ফিরোজ, হয়তো ভুলে যাচ্ছ, একজন নারীই এই দেশটা পরিচালনা করে আসছে।”
ফিরোজ চিত্রার গাল টেনে, অট্টহাসি দিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে আমি ভাবি, ভাগ্যিস দেশ পরিচালক একজন নারী, নাহলে এই উদাহরণটা কোথায় পেতো দেশের সকল নারীলোক? কত আফসোস হতো তখন!”
ফিরোজের হাতে একটা থাপ্পড় মারল চিত্রা। রাগ দেখাতেও গিয়েও পারল না। এরপর তাল মিলিয়ে হাসল নিজেও। এভাবেই চলতে লাগল দুজনের আলাপ। বেশ ক’দিন পর এতটা উল্লসিত হলো দুজনে। ঘড়ির কাটা অনুযায়ী রাত প্রায় এগারোটা, এরপর বারোটা। মাঝরাত হলে চিত্রা ঘুমে তলিয়ে যায়। ফিরোজও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।

সকালে সুলতানার ডাকে ঘুম ভাঙে দুজনের। চিত্রা প্রথমে ওঠে, ফিরোজের দিকে তাকায়। চোখ মেললেও শুয়ে আছে ফিরোজ। মুহূর্তটা আরামদায়ক, সাথে আলস্যের! সে উঠতে চাইলে, সহসা ফিরোজ ওড়না টেনে ধরল। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আরে, ছাড়ো বলছি! সুলতানা ডাকছে।”
ফিরোজ ঘুম জড়ানো, অথচ জেদি গলায় বলল, “ডাকুক। খেয়েদেয়ে কাজ নেই ওর, সক্কাল সক্কাল বিরক্ত করতে চলে এসেছে।” কথাটা হলে চিত্রাকে বুকের উপর টেনে নিলো ফিরোজ। কোমরের কাছ দিয়ে দুই হাত উপরে নিয়ে এমনভাবে ধরল চিত্রাকে, যেন ছুটতে না পারে।
চিত্রা জোড়াজুড়ি করল, তবে আহ্লাদ মাখা গলায় বলল, “আহা! ছাড়ো না। লক্ষীটি!”
ছাড়ল না ফিরোজ। চুপ থেকে এমন একটা ভান করল, যেন শুনতে পায়নি৷ চিত্রা নিজের থুতনিটা ফিরোজের বুকে ঠেকিয়ে, আলতো ব্যথা দিয়ে বলতে লাগল, “ছাড়ো বলছি। তাড়াতাড়ি। এখন একদম দুষ্টুমি চলবে না। ছাড়ো। দ্রুত। নাহলে খবর আছে।”
ফিরোজ চোখ বুজেই মুচকি হেসে বলল, “দেখি কেমন খবর করো। সাথে একটু যত্ন-আত্তিও কোরো।”
সহসা দুষ্টু হাসি দিলো চিত্রা। প্রায় এক মিনিট নির্বাক-নিশ্চুপ থাকার মতো আকস্মিক চেঁচিয়ে বলল, “হায় হায়, সর্বনাশ! ১০টা বেজে গেছে। তোমার অফিস যাওয়ায় সময় তো পেরিয়ে গেল”
চিত্রার কথাটা যেন ফিরোজকে বিদ্যুতের শক দিলো! চমকে ওঠে, চিত্রাকে ছেড়ে দিয়ে ওঠে বসল সে। এদিকে ফিরোজকে চমকাতে দেখে চিত্রার সে কী হাসি! ফিরোজ ওকে উপেক্ষা করে দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে উৎসুকভাবে সময়টা দেখল। ৮ টা বাজে। তৎক্ষনাৎ মোবাইল রেখে নজর ফিরিয়ে চিত্রার দিকে চোখ কটমট করে তাকালো সে। ফোঁসফোঁস শব্দ করল নাক দিয়ে, নিঃশ্বাসের ন্যয়!
চিত্রা অট্টহাসিতে মেতে, বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে চলতে গেল

চিত্রাকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসল সুলতানা, তাঁর মুখের সাথে সাথে দুই চোখেতেও হাসির আভা ফুটে উঠল যেন! হাতে দুটো চায়ের কাপ। সে বলল, “ভাবী, আপনাদের চা।”
চিত্রা চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “আমাকে আরও আগে ডাকবে না তুমি?”
সুলতানা সহসা ম্লান স্বরে বলল, “সেদিন ঝড়ের রাতে, সারারাত জেগে ছিলেন। এরপর সারাদিন হাসপাতালে থাকার পর রাতে একটু ঘুমিয়েছেন। আপনাকে বিরক্ত করব আমি? অত অমানবিক কিন্তু আমি না, ভাবী।”
সুলতানার কথা শুনে সশব্দে হাসল চিত্রা। চায়ের কাপ নিয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলল, “সে তো তুমিও জেগে ছিলে। যাই হোক, তুমি নিচে যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে, চা-টা শেষ করে দ্রুত আসছি। রান্না বসিয়ে দিয়েছ?”
“জি ভাবী।” জবাব দিয়ে ফেরার জন্য অগ্রসর হলো সুলতানা। কিন্তু আবার থেমে গেল।
চিত্রা চায়ের কাপ দুটো টেবিলের উপর রেখে আবার দরজার দিকে তাকাতেই দেখল, সুলতানা চলে যায়নি এখনো। সে আবার এগিয়ে গিয়ে, ভ্রু-জোড়া সামান্য কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার, সুলতানা? কিছু বলবে?”
“আসলে ভাবী।” ইতস্ততবোধ করল সুলতানা। ভিতরে ফিরোজ আছে বলেই হয়তো। মুখশ্রী অনুজ্জ্বল করে তাকিয়ে থাকল চিত্রার দিকে।
বুঝতে পেরে দরজার বাইরে এলো চিত্রা। গলা নামিয়ে আবার জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”
সুলতানা সহসা ভয়ার্ত ভাবে বলল, “আসলে ভাবী, বড় ভাইজানের কী যেন হয়েছে।”
“কী হয়েছে সুব্রত ভাইয়ের?” কৌতূহলী চোখে তাকালো চিত্রা। “সব ঠিক আছে তো, সুলতানা?”
সুলতানা বলল, “বুঝতে পারছি না, ভাবী। গতকাল দুপুরের পর, আপনাদের আগেই হঠাৎ বাড়িতে চলে আসে ভাইজান। এরপর যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে-করেছেই, আর খোলেনি। রাতে খাবার নিয়ে গেলাম ঘরে, কত ডাকলাম, কোনো সাড়াশব্দই পেলাম না। একটু আগে চা নিয়ে গেলাম, তখনও কোনো সাড়া নেই। আমি কালই দেখেছি, ভাইজান কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে হাঁটছিল। দুই চোখ ছিল লাল টকটকে-টলমল! ভালো করে তাকাতে পারছিল না। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিল। আমার খুব ভয় করছে, ভাবী। কিছু হলো না তো।”
সুলতানার কথা শুনে চিত্রার ভেতরটা কেঁপে উঠল। গতকাল চিত্রার মা, আর আজ সুব্রত ভাই; কী হচ্ছে এইসব? সে উদ্বিগ্ন হয়ে পিছন ঘুরতেই দেখল ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তাঁর দিকেই। সে অস্থির গলায় বলল, “শুনেছ শুনি?”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকাল ফিরোজ। কোনোরকম উদ্বিগ্ন বা উৎকণ্ঠা লক্ষ করা গেল না তাঁর মধ্যে। চিত্রা বিস্ময় চোখে কয়েক সেকেন্ড স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকার পর পিছন ঘুরে ছুটল।

বেশ ক’বার ডাকাডাকির পরও যখন ভেতর থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না, তখন চিত্রার হার্টবিট বেড়ে গেল। আতঙ্কে, জর্জরিত হয়ে, আকুল গলায় ডাকতে লাগল, “সুব্রত ভাই, প্লিজ দরজা খুলুন। সবার টেনশন হচ্ছে। কী হয়েছে আপনার?”
কোনো সাড়া নেই। এবার দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে চিত্রা, খুব জোরে। সুলতানাও সাহায্য করল। শক্ত কাঁঠের দরজা। তাঁদের আঘাত যেন আমলেই নিলো না। শুধু আওয়াজ হলো কিছুটা, তেমন প্রভাব ফেলল না। এদিকে চেঁচামেচি আর নানা শব্দের জন্য কনাও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে এসেছে। এসে দেখল, চিত্রা, সুলতানা খুব জোরে জোরে ডাকছে ‘সুব্রত’ ভাইকে, আর দরজা ধাকাচ্ছে। ওদের অদূরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে ফিরোজ, একটা হাত প্যান্টের পকেটে, অন্যহাতে চায়ের কাপ। ধোঁয়া উড়ছে চা থেকে। সে আরও এগিয়ে, দরজার কাছে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে ভাবী? এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?”
কনার গলার আওয়াজ পেয়ে চিত্রা দরজা ধাক্কানো থামিয়ে পিছনে ঘুরে বলল, “দেখো না, কখন থেকে ডাকছি, সুব্রত ভাই কোনো রেসপন্স করছে না।”
চিত্রার কাঁদোকাঁদো-প্রায় চেহারা আর গলার আওয়াজ শুনে কনা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলল, “দেখো গিয়ে, সারারাত মদ খেয়ে ‘স্টাডি রুমে’ পড়ে আছে।”
“কাল দুপুরের পর থেকেই উনার ঘরের দরজা বন্ধ। সুলতানা নাকি অনেক ডেকেছে।”
“বলো কী! আগে তো কখনো এমন হয়নি।” কনা যেমন আশ্চর্য হলো, তেমন ভাবান্তর হলো। কেউ এতবার ডেকেছে, আর সুব্রত ভাই সাড়া দেয়নি, এমনটা আগে হয়নি৷ ব্যস্ত থাকলেও সে ভিতর থেকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, ‘সে এই মুহূর্তে ব্যস্ত। কেউ যেন বিরক্ত না করে।’
কনা এবার আরও এগিয়ে দরজায় ধাক্কা মারল নিজেই; নিঃশব্দে ধাক্কাল কিছুক্ষণ। ফলাফল একই; নিরুত্তর! এমন সময় খালেদ সাহেব আর দীপালি বেগম এলেন। কাছে এসে জানতে চাইলেন সমস্যাটা।
সুলতানা সমস্যাটা বলতেই খালেদ সাহেব এগিয়ে, দরজায় থাপড় মেরে বললেন, “সুব্রত, দরজা খোল। কী হয়েছে তোর?”
হঠাৎ ভিতর থেকে একটা শব্দ হলো। দরজা খুলছে সুব্রত। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। দরজাটা খুলে যেতেই সবাই অবিশ্বাসের চোখে দেখতে লাগল, একটা রূগ্ন, দুর্বল দেহের লোককে। মুখ কালচে। দুই পাশের গাল একত্র হয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে যেন কাঠ! চোখ গভীরে চলে গেছে। চোখের পাতা হালকা করে মেলে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে সবার মনে হলো, এই ছেলে ৪০ বছরের কোনো যুবক না, ৭০ বছরের এক মুরুব্বি!
সুব্রত আধো আধো চোখে সবাইকে দেখার বৃথা চেষ্টা করে বলল, “কী হয়েছে সবার? এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন?”
চিত্রাই প্রথমে প্রশ্ন করল, “আপনার কী হয়েছে, সুব্রত ভাই?”
সুব্রত জবাব দিতে পারল না। তাঁর মাথাটা চক্কর দিলো আবার। হাঁটু ভেঙে, পড়ে যেতে লাগল।
চিত্রা ভিতরে ঢুকে খপ করে ধরে ফেলল সুব্রত ভাইয়ের হাতটা। তাঁর মনে হলো, সে কোনো জলন্ত কাঠ-কয়লা ধরেছে হাত দিয়ে, এত গরম! সুলতানাও এগিয়ে গিয়ে ধরল। দুজনের ধরাধরিতে বিছানা অব্দি নেওয়া গেল। ইতোমধ্যে চোখ বুজে ফেলেছে সুব্রত ভাই। বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার সময় দুজনেই বুঝতে পারল, সুব্রত ভাইয়ের সারা দেহ অসাড় হয়ে গেছে। এখন অচেতন সে।
চিত্রা উদ্বিগ্ন চোখে ফিরোজকে খুঁজলো। বাবার পাশে দেখল ওকে, কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই সে আঁতকে উঠল। সুব্রত ভাইয়ের শরীর যতটা উত্তপ্ত, ফিরোজের দুই চোখে যেন তার থেকেও হাজারগুণ ক্রোধ!
খালেদ সাহেব, কনা, এমনকি দীপালি বেগমও ঘরে ঢুকল। চিত্রা দেখল, ফিরোজ সরে গেছে দরজার সামনে থেকে। সে ওদিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সুব্রত ভাইয়ের শরীরে খুব জ্বর। ডাক্তারের প্রয়োজন।”
খালেদ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ব্যস্ত ভাবে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি। চিন্তা কোরো না।”
ডাক্তার আসার আগেই চিত্রা একটা কাজ করল, সুব্রত ভাইয়ের কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। সুলতানা ভেজা কাপড় দিয়ে হাত-পা মুছে দিতে লাগল ভালো করে। ডাক্তার এলো আধ ঘণ্টার মধ্যেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্যালাইন দিলো, কয়েকটা মেডিসিন দিয়ে, সবার উদ্দেশ্যে বলল, “পেশেন্ট এর উপর কড়া নজর রাখবেন। জ্ঞান ফিরতেই কিছু খাইয়ে দিবেন। না খাওয়ার কারণে শরীর খুব দুর্বল। আর এই জামা-কাপড় চেঞ্জ করিয়ে দিবেন। এই ভেজা জামা-কাপড়ের জন্যই জ্বর হয়েছে, শরীরের আরও অবনতি হয়েছে।”
সবাই অবাক হলো এটা দেখে, সেদিন যে জামা-কাপড় পরে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে হাসপাতালে গেছিল সুব্রত, এখনো তাঁর পরণে সেগুলোই আছে। অথচ এর মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে। প্যান্টটা এখনো ছিপছিপে হয়ে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, সুব্রত ভাই বাড়িতে এসে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ পায়নি! অথচ লোকটা চাইলেই কারোস সাহায্য পেতো!

সুব্রতর জামা-কাপড় চেঞ্জ করালেন খালেদ সাহেব। স্যালাইন চলছে তখনো। তিনি ওকে শুকনো জামা-কাপড় পরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলেন। তখন রুমে গেল চিত্রা আর কনা। সুলতানা স্যুপ বানাতে গেছে। জ্ঞান ফিরেছে সুব্রত ভাইয়ের। কথা না বললেও চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
চিত্রা পাশে বসে, খুব অভিমান নিয়ে বলল, “এটা কেমন হলো সুব্রত ভাই? আপনার শরীর অত খারাপ ছিল, আপনি কাউকে বলবেন না?”
সুব্রত জানালা দিয়ে বাইরের ঝকঝকে আলো দেখছিল। মধ্য দুপুরে শান্ত হয়ে ছিল চারিদিক৷ দূর থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছিল, তা-ই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। চিত্রার কথা শুনে দৃষ্টি ফিরিয়ে, ধীর গলায় বলল, “কাকে বলতাম? কে শুনতো আমার কথা?”
“কেন? আমাদের কী বলা যেতো না? আমরা কী কেউ আপনার কাছের লোক না?”
সুব্রত হাসল। বিমর্ষ চেহারায় হাসিটা বড্ড বেমানান লাগল। কয়েক সেকেন্ড হেসে সে বলল, “এই পৃথিবীতে আমি একা, বাবা-মা মারা যাওয়ায় পর থেকেই। পূর্বেও আমার কেউ ছিল না, আজও নেই। আমার কোনো আপনজন বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। তাই কাউকে বলারও নেই। আমি এমন একজন মানুষ, যে মরে গেলেও এই পৃথিবীর, বা এই পৃথিবীর কারোর কিছু আসবে-যাবে না। আর বেশিদিন তো নেই। একদিন হঠাৎ বাবা-মায়ের কাছে চলে যাব। শেষ মুহূর্তে এসে অযথা তোমাদের বিরক্ত করতে যাব কেন? তোমরা নিজেদের মতো থাকো, আনন্দ করো।”
সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে চিত্রার গলার কাছে কিছু একটা জমাট বেঁধে গেল। তাঁর চোখের পাতা ভার হয়ে এলো। কনা দাঁড়িয়ে থাকল না আর। এমনিতেই মন খারাপ ছিল তাঁর, সুব্রত ভাইয়ের এই কথাটা যেন তাঁর হৃদয়কে আরও ব্যথিত করল, কষ্ট দিলো। ঘর থেকে বেরিয়ে, নিজের ঘরে যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল, “সুব্রত ভাইয়ের এই পরিনতির জন্য কে দায়ী? সে নিজেই দোষী। আমি তো আগে কখনো আমার দুই ভাইকে আলাদা নজরে দেখিনি। তাহলে আজ দেখতে হচ্ছে কেন? আজ কেন ওকে ভাই বলতে আমার বিবেচিত মন বিরোধিতা করছে? এই সবকিছুই হয়েছে ওর কর্মের কারণে। এটাই ওর কর্মফল।”

১২তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=829941347950567&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here