ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু শেষ_পর্ব শেষ অংশ

0
1553

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
শেষ_পর্ব শেষ অংশ
#সুলতানা_সিমা

দুমাস পর

দেখতে দেখতে দুমাস চলে গেলো। বদলে গেলো শান্তি নীড়ের সবাই। হাসি নামক শব্দটি তাঁরা ভুলেই গেছে। দিহান কানাডা যাওয়া ক্যান্সেল করে দিয়েছে। নিজের পরিবারকে এই অবস্থায় রেখে সে বাইরে গিয়ে কিভাবে ভালো থাকতো? লুপা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। হসপিটালে যখন নার্সদের সামনে পায় তাদের মারধর করে। ডাক্তারদের বকাঝকা এমনকি মারতেও চলে যায়। মিহানের কেবিনে কাউকে ঢুকতে দেয়না। তাঁর এমন আচরণের কারণে তাকে হাসপাতালে নিতে দেয়না। ডক্টর নিষেধ করে দেয় তাকে আর হসপিটাল না নিতে। তারপর লুপাকে হসপিটাল নেওয়া বন্ধ করে দেয়। লুপা মিহানকে দেখতে চাইলে সবাই চুপ থাকে। কেউ কোনো জবাব দেয়না। ভাইকে না দেখে কান্না করতে করতে পাথরের ন্যায় বসে থাকে। এভাবে যায় দিনের পর দিন। না দেখে দেখে একসময় তাঁর মস্তিষ্ক মেনে নেয় তাঁর ভাই মারা গেছে। কোথাও মাটি দেখলে গিয়ে খুঁড়তে লাগে। বলে “এখানে আমার ভাই আছে। ওরা আমার ভাইকে লুকিয়ে দিয়েছে।” গাড়ি দেখলে দৌড়ে চলে যায় গাড়ি থামাতে। বলে,” গাড়ি চালাবে না। আমার ভাই গাড়ি চালিয়ে মারা গেছে।” কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে কেড়ে নিয়ে আসে। বলে,”সিগারেট খাবা না। আমার ভাইয়া সিগারেট খেয়ে মারা গেছে।”

লুপার সাথে সাথে নীলেরও অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। সারাদিন একবারও লুপা ঘরে থাকতে চায়না। তাঁর ভাই নাকি বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে। ঘরে থাকলে নাকি তাকে না দেখে কান্না করবে। একদিকে ছেলে কোমায় অন্যদিকে মেয়ে পাগল। সায়রা চৌধুরী ও হাসান চৌধুরীর ক্ষণে ক্ষণে উপরওয়ালার কাছে মৃত্যু কামনা করছেন। কত সয্য করবেন? ইশি তো কোনো রকম বেঁচে আছে। সারাদিন ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে তাকে। তাঁর রুম থেকে শুধু গুন গুন কান্নার আওয়াজ আসে। প্রতিদিন তাঁর মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলে,”

_আম্মু মিহান ভাই কি কোনোদিনও ভালো হবে না আম্মু?”

দিলারা চৌধুরী শুধু চোখের পানি বিসর্জন করেন। ইশির অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কবে জানি সেও লুপার মতো হয়ে যায়। মিহানের যদি কিছু হয় সত্যিই সে মরে যাবে। মিহান ভালো হবে এই আশাতেই শুধু সে বেঁচে আছে।

শান্তি চৌধুরী আর আগের মতো সংসারের খেয়াল রাখেন না। সংসার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু দেখে যান। কিছুই বলেন না। দিহান নীল শাওনকে দেখলে উনার কষ্টটা আরো উছলে পড়ে।

দিহান তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। অপরাধবোধ তাকে গলা টিপে হত্যা করছে। কেন মিহানকে শুধু শুধু মিথ্যে ভয় দেখাতে গেছিলো? এমনটা না করলে আজ মিহান ভালো থাকতো। হয়তো রোজ রোজ দু’ভাইয়ের লড়াই হতো কিন্তু ভালো তো থাকতো।

তিনমাস পরে শান্তি নীড়ে একটা সুখবর আসে। মিহানের জ্ঞান ফিরেছে। শান্তি নীড়ে খুশির বাদ ভেঙে সুখ গড়িয়ে আসে। কিন্তু ডক্টর জানায় মিহান কখনো বাবা হতে পারবে না। খবরটা শুনে সবার মন খারাপ হয়ে যায়। তবে মিহানের সুস্থ হওয়ার সুখ এই খারাপ লাগাকে আড়াল করে দিলো। উপরওয়ালা একদিন না একদিন সবকিছুর বিচার করেন৷ মিহান তিনটা বাবার সন্তান কেড়ে নিয়েছে। আল্লাহ ওর বাবা হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। জীবন যাবে তবুও বাবা ডাক শুনতে পারবে না। এর থেকে বড় শাস্তি কি হতে পারে?

আজ শুক্রবার। জুম্মা শেষে মিহানকে হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা হয়। হুইলচেয়ারে করে মিহানকে বাসায় আনা হয়েছে৷ তাঁর পায়ে সমস্যা রয়েছে। ডক্টর বলেছে পা আস্তে আস্তে ঠিক হবে। শান্তি নীড়ের প্রবেশ করতেই বাসার সবাই কেঁদে উঠে। সায়রা চৌধুরী ছেলের পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ডুকরে কেঁদে উঠেন। কত কষ্ট দেওয়ার পরেও আল্লাহ আরো কষ্ট দিচ্ছেন? এ কোন কঠিন পরিক্ষা নিচ্ছেন তিনি নাকি কোনো পাপের শাস্তি দিচ্ছেন? শান্তি চৌধুরী মিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিহান ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে। একে একে সবাই এসে মিহানের সাথে কথা বলে। দিহান মিহানের সামনে বসলো। দুবার বুক ফেটে কান্না আসছে। দিহান মিহানের হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে হাতের উপর মাথা ঠেকে বলল,”সরি মিহান।” মিহান দিহানের মাথায় হাত রেখে বলল,” আমি সরি রে।” দিহান মিহানের হাতে চুমু খেলো। তাঁদের দু’ভাইয়ের কথার আগাগোড়া কেউ বুঝতে পারছে। মিহান চারদিকে তাকিয়ে বলল,”লুপা কই আম্মু?” শান্তি চৌধুরী নীলকে ইশারা দেন লুপাকে আনতে। নীল লুপাকে নিয়ে আসে। মিহান তাঁর বোনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠে। তাঁর এতো সুন্দর বোনুটার কি অবস্থা হয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। চুল গুলো কেমন খোশকো। শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মিহানকে দেখে লুপা শুধু তাকিয়ে থাকলো। কোন কথা বলল ন। তাঁর চোখে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মিহান চেয়ারে বসা থেকে দুহাত বাড়িয়ে বোনকে বুকে ডাকে। লুপা নীলের দিকে তাকায়। নীল সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায়। লুপা মিহানের দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ গিয়ে রুমে চলে গেলো। গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো মেঝেতে।

মিহানকে তাঁর রুমে নেওয়া হয়। খাটে আধশুয়া করে বসিয়ে সবাই রুম বেরিয়ে আসে। মিহান একা থাকতে চাইছে। সবাই বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরে রুমে দৌড়ে ঢুকে ইশি। মিহান ইশিকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়। এতো শুকিয়েছে মেয়েটা দেখে চিনাই যাচ্ছে না। ধবধবে ফর্সা মেয়েটার গায়ের রং মলিন হয়ে আছে। সে কি শরীরের যত্ন নেয়না? ইশি দৌড়ে এসে মিহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। মিহান আরেকদফা অবাক হয়। ইশি ফ্যাসফ্যাস করে কান্না করছে। সে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো। জানতই না তাঁর ভালোবাসার মানুষটা চলে এসেছে। মিহান ইশিকে বলল,”

_কাঁদছিস কেন?” ইশি কেঁদে কেঁদে বলল ”
_তোমার কিছু হলে আমি মরে যেতাম মিহান ভাই।” মিহান মৃদু হেসে
ইশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”পাগলী কাঁদিস না। আমি ভালো আছি তো।” ইশি মিহানের বুকে একটা চুমু খায়। সাথে সাথে মিহানের শরীর যেন ঝাড়া দিয়ে উঠলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শীতল কিছু বউএ গেলো। ইশি এটা কি করলো? একটা যুবক আর যুবতীর জন্য এটা অন্তত বিপদজনক। মিহান চট করে নিজেকে ইশির থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিঃশ্বাসগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। তাঁর সাতাশ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো নারীর ওষ্ঠস্পর্শ পেয়েছে সে। ইশি কিঞ্চিৎ লজ্জায় পড়ে যায়। সে বিষয়টা আড়াল করতে মিহানকে বলে,
_খেয়েছো?
_আব,,,,আ আমি এখন রে রেষ্ট নিবো।” ইশি আচ্ছা বলে চলে যায়। একটু পরে প্লেট ভরে ভাত নিয়ে এসে মিহানকে বলে,”

_নাও হা করো।
_আমার পায়ে সমস্যা হাতে না। আমি নিজের হাতে খেতে পারবো।
_চুপচাপ হা করো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নিজের হাতে খাবা।
_লুপা খেয়েছে?
_নীল খাওয়াচ্ছে। তুমি হা করো।” দিশার জোরাজোরি তে মিহান খেয়ে নেয়।

খাওয়া শেষে মিহান লুপার রুমে যেতে চায় ইশি নিয়ে যায়। কিন্তু লুপা ভাইকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে নীলের পিছে লুকায়। প্রথম কয়েকদিন এভাবেই যায় সে মিহানের সামনে আসেনা। মিহানও থেমে থাকেনা নীলের থেকে চকলেট আইস্ক্রিম আনিয়ে বোনের সামনে যায়। লুপাকে আগের মতো গল্প শুনিয়ে মন ভালো করার চেষ্টা চালায়। এভাবেই চলতে থাকে দিন। ইশি খাওয়াদাওয়া সব ছেড়ে মিহানের সেবা করতে লাগে। মিহানকে খাওয়ানো হাঁটানো সব করে সে। যত দিন যায় ধীরে ধীরে লুপা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। মিহানের কাছে এসে তাঁর কোলে মাথা রেখে চুপটি করে বসে থাকে। বোনের নিরবতা মিহানকে শেষ করে দেয়। তাঁর থেকে বেশি কষ্ট দেয় তাঁর অচল দুটো পা। দিন শেষে যে বোনের জন্য পকেট ভরে চকলেট রাখতো আজ তাঁর সে বোনকে কিছু এনে দিতে পারেনা। অন্যের থেকে এনে দেওয়া নিজে এনে দেওয়ার সুখ ভিন্ন হয়।

লুপাকে বুকে জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মিহান। তাঁর বোনটা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন তাকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা লুপা। বোনের সুস্থতা দেখে সেও হয়তো সুস্থ হয়ে উঠেছে। আজ নিজের পায়ে হাঁটতে পারছে সে। একমাস পরে আজ পুরোপুরি ভাবে সুস্থতা বোধ করছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত তাঁর ভেতরের মিহান অসুস্থ হচ্ছে। অনুতপ্ততা তাঁকে ঘিরে ধরছে। বাসায় আসার পরে সে শায়লা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলো,অরিন কেন বার বার উনার কথা বলে। কি এমন করেছেন উনি? শায়লা বেগমকে আরো অনেকবার এই প্রশ্ন করেছিলো মিহান। উনি বলেছেন অরিন মিথ্যে বলছে। কিন্তু সেদিন উনি সত্যিটা শিকার করেন। মিহান ভাবে যা হওয়ার তো হয়ে গেছে অরিনের কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু মিহানের সাহস হচ্ছেনা অরিনের সামনে দাঁড়ানোর। কোন মুখে সামনে দাঁড়াবে সে? এতোটা নির্দোষ মানুষকে মেরে দিয়েছে। দিহান ঠিকই বলেছে সে ক্ষমার যোগ্যই না। দিশা দিহানের কাছে ক্ষমা চাইতে পারলেও অরিনের কাছে ক্ষমা চাইতে পারছে না। অরিনের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ নেউ তাঁর। নিজের সব পাপ গুলো মনে করতে লাগে মিহান। এতো পাপ করেছে যে উপরওয়ালার কাছেও ক্ষমা চাইতে লজ্জা লাগছে। অনুতপ্ততা তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। বাচ্চা প্রিয় ছেলেটা নাকি কোনোদিন বাবা হতে পারবে না। ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসে। তবুও উপরওয়ালার কাছে একটাই চাওয়া তাঁর। আল্লাহ তাকে যে শাস্তি দিয়েছেন তাঁর বোনকে যেন সেটা দেন না। হঠাৎ ইশির ডাক শুনে মিহানের ঘোর কাটে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো ইশি প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিহান ভ্রু নাচিয়ে বলল,কি?” ইশি বলল,”

_আসো খাবে।
“মিহান মৃদু হেসে বলল,”
_হাতে কোনো সমস্যা না থাকার পরেও এতদিন জোর করে খাইয়েছিস। এখন টেবিলে গিয়ে খেতে পারবো। তুই যা।
_এত কথা শুনবো না আসো। লুপা তুই যা তো। তোকে নীল ডাকছে।” লুপা চলে যায়। মিহান অবাক হয় ইশির একথায় লুপার চলে যাওয়ায়। ইশি ভাত মাখিয়ে বলল,”হা করো।
_ইশি যা তো। আমি এখন খাবো না।
_আমি যাবো না। তুমি খাও।
_যা তো বিরক্ত করিস না। আর তুই আমাকে এতো তুমি তুমি করিস কেন? আগে তো তুই তোকারি ছাড়া কথাই বলতি না।

ইশি মাথা নিচু করে ফেলে। মিহান ল্যাপটপ হাতে নেয়। ইশি ব্যথিত কণ্ঠে বলে,

_খাবে না?” মিহান ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” দে।” বলেই মিহান হা করে। ইশি মৃদু হেসে মিহানের মুখে ভাত তুলে দিলো। মিহান ভাত চিবুও আর তাঁর দিকে নেশাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে ইশি। ইচ্ছে করছে মিহানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত গালে একটা লম্বা চুমু এঁকে দিতে। ইশির চোখে ভাসে তিনদিন আগের কথা। যখন মিহান দাঁড়ি কাটতে বসেছিলো। ইশি দৌড়ে এসে মিহানের হাত থেকে ছু মেরে রেজার নিয়ে বলে,

_দাও আমি শেভ করে দিচ্ছি।
_আমার হাত আছে দে রেজার দে।
_দিবো না। আমি কেটে দিবো।
_উফ ইশি পাগলামো করিস নাতো দে।
_আচ্ছা দুইটা টান দিয়ে, দিয়ে দিবো। প্লিইইইইইজ।
_ওকে দে।” মিহান গাল পেতে দেয়। ইশি প্রথম টানের মিহানের গাল কেঁটে ফেলে। মিহান গাল চেপে আহহহহহহ বলে আর্তনাদ করে উঠে৷ মিহান গাল চেপে রেখে ইশির দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মন চাচ্ছে রে তোকে আমি একদম।” মিহানের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ইশি কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে রেজারটা রেখে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।”

সেদিনের ঘটনা চোখে ভাসতেই হেসে উঠে ইশি। মিহান জিজ্ঞেস করে,”পাগলের মতো ভেটকাচ্ছিস কেন?” ইশি মাথা নেড়ে বুঝায় কিছু না।

এভাবেই চলে যায় আরো কয়েকটা দিন। মিহানের সেবা করতে করতে ইশি আরো বেশি পাগল হয়ে যায় মিহানের জন্য। এখন তাঁর মন মিহানকে আরো গভীর ভাবে চায়। মিহানের ছোট ছোট ছোঁয়া গুলো বাড়াবাড়ি রকমের করে চায়।

আস্তে আস্তে মিহানের সাথে শাওনের আর দিহানের সম্পর্কটা আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যায়। শান্তি নীড়ে ফিরে আসে আগের সে সুখপাখি। মিহান অরিনের কাছে আজও ক্ষমা চাইতে পারেনি। অরিনের ধারে কাছেও যায়না সে। লজ্জা আর নিজের প্রতি ঘৃণা তাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়না।

সত্যি কখনো চাপা থাকেনা। শান্তি নীড়ে সবাই জেনে যায় অরিনের আগে বিয়ে হয়েছিলো। এটা শিলা চৌধুরী বলে দেন। উনি ভেবেছেন সবাই জানে অরিনের আগে বিয়ে হয়েছিলো। তাই কথায় কথায় বলে দিয়েছেন। তবে শুনেও কেউ কোনো রিয়েক্ট করেনি। সবাই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। বরং সবার খারাপ লাগে অরিনের বাসর রাতে স্বামী খুনের কথা শুনে। কেউ এখনো মিহানের সত্যিটা জানেনা। কিছুদিনের মধ্যে শান্তি নীড়ে খবর আসে তাঁদের বাড়ির মেয়ে দিশা মা হতে চলছে। সেদিন সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছিলো।

কিছুদিন পরে ইশির বিয়ের জন্য তাঁর পরিবার তাকে চাপ দিতে লাগে। ইশি বরাবরের মতো জানিয়ে দেয় সে বিয়ে করবে না। ইশির বাবা জোর করেন। বয়স কি তাঁর কম হয়েছে? সবার চাপে পড়ে ইশি পরিবারকে জানায় সে মিহানকে বিয়ে করতে চায়। কথাটা শুনে মিহান থেকে শুরু করে সবাই অবাক হয়। তবে ইশির বাবা মা মানেন না। যে ছেলে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না সে ছেলের হাতে কি কোনো বাবা মা তাঁর মেয়েকে তুলে দিবে? শান্তি চৌধুরী বলেন,”

_ইশির বিয়ে মিহানের সাথেই হবে। আর যেন কারো কোনো কথা না শুনি।” হারুন চৌধুরী দিলারা চৌধুরী শান্তি চৌধুরীর উপর প্রচন্ড রেগে যান কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না। উনাদের একমাত্র মেয়ে ইশি। যে ছেলে কোনোদিন বাবা হবে না সে ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবেন কি করে? উনাদের কি নানা নানী হওয়ার ইচ্ছে নাই? কিন্তু কি করার। শান্তি চৌধুরীর কথার উপর কথা বলার অধিকার যে কারোর নেই। বাধ্য হয়ে উনারা রাজি হয়ে যান। কিন্তু বাঁধ সাধে মিহান। সে আগের মতো এবারও অবাধ্য হয়। উনাকে বলে সে ইশিকে কেন কাউকেই বিয়ে করবে না। শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চায়না সে। ইশিও বলে দেয়, তাকে ছাড়া সে বিয়েই করবে না। দিহান মিহানকে বলে রাজি হয়ে যেতে। মিহান বলে সে বিয়ে করবে না। ইশি কেঁদে কেঁদে নিজের অবস্থা খারাপ করে দেয়। তবুও মিহান রাজি হয় না। একদিন ইশিকে মিহান বলে,

_ইশি।আমার মনে হয় তোর আর আমার মাঝে দূরত্ব থাকা ভালো।” ইশি কেঁদে কেঁদে চলে যায়। তারপর থেকে সে আর মিহানের সামনেই আসেনা। সারাদিন রুমে বন্দি থাকে। ইশি মিহানকে এতো সেবা করেছে যে মিহানকে একদম অলস বানিয়ে দিয়েছে। এখন এক গ্লাস পানি খেতে হলেও ভুল করে ইশি বলে ডাক দিয়ে দেয়। মিহান বড্ড ভাবে ইশিকে মিস করে। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁর নিজেকে দমাতেই হবে।

_____________
৬ মাস পর

হসপিটালের করিডোরে বসে আছে দিহান। তাঁর দুপাশে বসে আছে নীল ও মিহান। অনেক্ষণ হয়ে গেলো অরিনকে সিজারের রুমে নিয়েছে। দিহানের কলিজা শুকিয়ে আছে। আল্লাহ জানে অরিনের অবস্থা কেমন? ভয়ে দিহানের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। অরিনকে সিজারে নিয়ে যাওয়ার সময় অরিন দিহানের হাত ধরে কেঁদে বলেছে,”আমি মনে হয় মরেই যাবো। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন প্লিজ। আমি মরে গেলে আমার বাচ্চাকে কখনো কষ্ট দিয়েন না।
_তোমার কিচ্ছু হবে না বউপাখি। আমি আছি তো।
_আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি সত্যি মরে যাবো দেইখেন।
_চুপ করো। কিচ্ছু হবেনা তোমার।”

কথাগুলো মনে হতেই দিহান ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডক্টর বেরিয়ে আসলো। নার্সের কোলে একটা বাচ্চা। দিহান তৎক্ষণাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে ডাক্তারকে গিয়ে বলে,” অরিন সুস্থ আছে তো ডক্টর?” ডক্টর হেসে বলে, “Congratulations মিস্টার দিহান। আপনার মেয়ে হয়েছে।” সাথে সাথে মিহান হেসে বলে “আলহামদুলিল্লাহ।” দিহান বলে,” ডক্টর বলেন না ও সুস্থ আছে তো?
_হুম সুস্থ আছে। তবে এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
_কবে ফিরবে?” ডক্টর মৃদু হেসে বলে “কিছুক্ষণের মধ্যেই”। দিহানের চোখমুখ শুষ্ক হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লাল করে ফেলছে। হানিফ চৌধুরী সুমনা চৌধুরী দ্রুত পা এগিয়ে নার্সের সামনে দাঁড়ান। সুমনা চৌধুরী নাতনিকে কোলে নেওয়ার আগে হানিফ চৌধুরী নিয়ে নেন। নাতনির মুখ দেখে উনার চোখ জুড়িয়ে যায়। কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। সুমনা চৌধুরী কোলে নিতে হাত বাড়ালে হানিফ চৌধুরী অন্যদিকে ঘুরে যান। নাতনির থেকে চোখ সরাচ্ছেনই না তিনি। মুখে তৃপ্তির হাসি। চোখে খুশির একবিন্দু জল। সুমনা চৌধুরী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”

_আমি যদি ফোন দিয়ে বউমার অসুস্থতার খবর না দিতাম এখনো কিন্তু অফিসে বসে থাকতেন। দেন আমার কোলে দেন।” হানিফ চৌধুরী কপাল কুঁচকে তাকান। তারপর স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলেন,”এটা আমার ছোট বউ। মনে করো তোমার সিগনেচার নিয়ে ওকে বিয়ে করেছি।” সুমনা চৌধুরী নাতনিকে নিতে চাইলে হানিফ চৌধুরী আবার অন্যদিকে ঘুরে যান।

নাতনি নিয়ে উনাদের ঝগড়া দেখে বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিহান। এই সুখ সে কখনোই তাঁর বাবা মাকে দিতে পারবে না। যদি দেয় তো রুহান দিবে। কিন্তু সে পারবে না। না পারবে দিহানের মতো বাবা হওয়ার সুখটা অনুভব করতে। যা হচ্ছে সব তো তাঁরই পাপের ফল। বুকটা ভারি হয়ে এলো মিহানের।

দিহানের মনটা ছটফট করছে। অরিনের কবে জ্ঞান ফিরবে,কবে সে অরিনকে বুকে জড়াবে,কবে তাঁর ভয়টা কাটবে। অপেক্ষা করতে করতে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক্ষণ পরে অরিনের জ্ঞান ফিরে। দিহান দৌড়ে কেবিনে যায়। গিয়েই অরিনকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়। অরিন ঘাবড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তাঁর মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে তাঁর বাচ্চা ঠিক আছে তো? “দিহানকে জড়িয়ে কাঁপা গলায় বলে,”

_ক্ক ক্ক কা কাঁদেন কেন?
_আর একটাও বাচ্চা নিবো না আমরা। এই ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি আর হতে চাইনা।

_আ আ আমার বাচ্চা কই?
_বাবা কোলে।” অরিনের যেন প্রাণ ফিরে পায়। চোখ বন্ধ করে দম ছেড়ে দিহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে দিহান দু’হাতে অরিনের মুখটা তুলে ধরে বলে,” খুব কষ্ট পেয়েছো তাইনা বউপাখি?
_আমার বাচ্চা কই?
_বললাম তো বাবার কোলে।
_আনুন না গিয়ে।” দিহান অভিমানের স্বরে বলল
_বাচ্চা হতে না হতেই স্বামীকে ভুলে গেছো?
_হ্যাঁ ভুলে গেছি। যান আমার বাচ্চা আনেন গিয়ে। “দিহান পকেট থেকে ফোন বের করে বলল,” দাঁড়াও আম্মুকে ফোন দিয়ে বলছি নিয়ে আসতে।
_আর আপনি গিয়ে আনলে কি হয়?
_আমি পারবো না। একবার কোলে নিছিলাম। এতো পুচকো মনে হয় আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাবে।”

অরিন রাগি লুকে তাকাল। দিহান মুখটা ছোট করে বলে,”যাচ্ছি তো।” বলেই উঠে যায়। কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এসে কেবিনে ঢুকে৷ দিহান পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে হাঁটছে। এমনভাবে হাঁটছে যেন ফ্লোরে কেউ তেল ফেলে রাখছে। অসাবধানতায় একটা পা পড়লেই সে শেষ। বাচ্চাকে যেভাবে কোলে নিয়েছে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো বোম তাঁর কোলে আছে, একটু নড়লেই ফেটে যাবে। দিহানের অবস্থা দেখে অরিন ফিক করে হেসে উঠে। দিহান একটু জায়গা অনেক্ষণে হেঁটে এসে অরিনের কোলে বাচ্চাটা দিয়ে ফোঁস করে দম ছেড়ে বলল,”

_বাঁচলাম বাবা। আমি তো ভূমিকম্পের উপর ছিলাম।
_এখন প্রতিদিন ভূমিকম্পের উপর থাকার জন্য প্রস্তুত হন।
_এ্যা?
_জ্বি হ্যাঁ।” দিহান কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায়। অরিন ঠোঁট কামড়ে হাসে।

এক সপ্তাহ পরে বাচ্চা নিয়ে বাসায় আসা হয়। অরিনের আলাদা ভাবে সেবা করার জন্য শান্তি চৌধুরী একজন নার্স নিয়ে আসেন। অরিন বুঝেনা সে সুস্থ থাকার পরেও নার্স কেন। শায়লা চৌধুরী বাচ্চা দেখার জন্য আসেন সাথে জহুরা বেগমও আসেন। শাওন আসেনা। দিশা চার মাসের প্রেগন্যান্ট। শাওন নাকি দিশাকে ছেড়ে এক মিনিটের জন্যেও কোথাও যায় না।

কিছুদিন পরে শান্তি নীড়ে আরেকটা খুশির খবর আসে। লুপা মা হবে। খবরটা শুনার পরে মিহান প্রথম অরিনের সামনে আসে। অরিন তাঁর মেয়েকে নিয়ে বসে ছিলো। মিহান দৌড়ে রুমে ঢুকে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে অরিনকে বলেছিলো,”

_অরিন জানো আমি মামা হবো। আমার পুচকি মা হবে।” সেদিন অরিন মিহানকে এতো খুশি হতে দেখেছিলো যে আদৌ এতো খুশি হতে কাউকে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। কথাটা বলে মিহান রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলে অরিন পিছন থেকে ডাক দেয়,

_শুনুন।” মিহান দাঁড়িয়ে যায়। পিছন ঘুরে তাকিয়ে মিহান মাথা নিচু করে ফেলে। অরিন বলে,”আপনার ভাই বললেন, আপনি নাকি বলেছেন আমি যেন আপনাকে ক্ষমা করে দেই?” মিহান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। অরিন বলে,”
_যার ক্ষমা তাকে চাইতে হয় জানেন না?” মিহান শুকনো একটা ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে। অরিনকে এতো বড় বড় কথা বলার পরে,এতো খারাপ কাজ করার পরে, কোন মুখে ক্ষমা চাইবে সে?” মিহান মাথা নিচু করে ক্ষীণ গলায় বলল, “সরি অরিন। আমাকে ক্ষমা করে দিও।
_একটা শর্তে ক্ষমা করতে পারি।” মিহান চট করে মাথা তুলে বলল,”বলো আমি সব শর্ত মানতে রাজি।
_প্রমিজ করেন মানবেন।
_প্রমিজ।
_ইশি আপুকে বিয়ে করবেন?” মিহান অবাক হয়ে তাকায়। অরিন বলে,”করবেন বিয়ে?
_এসব তুমি কি বলছো অরিন?

_আপু আপনাকে কতটা ভালোবাসে একবার জানার চেষ্টা করুন। আপনি জানেন এই বাড়িতে একটা মানুষ আজ তিনদিন হলো কিছুই খাওনা? না খেয়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা তাঁর? আর সেটা শুধু আপনার জন্য। কাল আপুকে দেখতে আসবে। আপনি কিছু একটা করুন প্লিজ। এখনো সময় আছে।

_আমার অভিশপ্ত জীবনে কাউকে জড়াতে চাইনা অরিন। যে আমার জীবনে আসবে তাঁর পুরোটা জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের জীবন ধ্বংস করে আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি আর তা করবো না। আমার পুরো জীবনটাই ভুলে ভরা। কাকে এই জীবনে টানবো বলো?

_মাঝে মাঝে ভুল করা জরুরি। কোনটা ভুল কোনটা সঠিক এটা জানার জন্য। জানেন আমাদের পুরো জীবনটাই শিক্ষানীয়। আমাদের নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আমি আমার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমি আমার স্বামীর কাছে আমার অতীত লুকিয়ে যে ভুলটা করেছিলাম,সেটা ছোট খাটো কোনো ভুল ছিলো না। স্বামীর থেকে কিছু লুকাতে নেই। নয়তো এর জন্য একদিন কাঁদতে হয়। আমিও কেঁদেছিলাম। ভাগ্যিস আমার স্বামী আমায় পাগলের মতো ভালোবাসে। ওনার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো ডিভোর্স দিয়ে দিতো। তাই যার সাথে থাকবো তাকে সব জানানো উচিত। আপনার জীবিন থেকেও আপনার শিক্ষা নেওয়া উচিত। ভালোবাসলে ভালোবাসাকে সম্মান দিতে হয়। ভালোবাসাকে ছোট করে কিছু বলতে নেই। কোনো মানুষটিকে যাচাই না করে ধিক্কার জানাতে নেই। ভালোবাসার মতো চার অক্ষরের শব্দের কারণে কারো প্রাণ কেড়ে নিতে নেই। আপনি যেটা কেড়ে নিবেন আল্লাহ আপনার থেকে সেটা কেড়ে নিবেন। আপনি যদি একবার সেদিন সবকিছু যাচাই করতেন তাহলে আজ সব আপনার মনের মতো থাকতো। আর আপনার দাদীর থেকে আপনার পরিবারের শিক্ষা নেওয়া উচিত।বউনিও কম কিসে? সবার স্বাধীনতাতে উনার হুকুম চলে। এগুলা ঠিক নয়। সবাইকে সুযোগ দিতে হয় কিছু বলার জন্য। সবার অধিকার আছে নিজের মতামত প্রকাশ করার। একজনের মুখের হ্যাঁ তে সবকিছু হয়ে যায়না। উনি যদি সংসারে এমন নিয়ম না রাখতেন তাহলে হয়তো এই সংসারে যা যা হয়েছে তাঁর অনেককিছুই হতো না। ধরেন লুপা আপু আর নীল ভাইয়ের বিয়ে। সংসারে সবার কথা বলার অধিকার থাকলে আপনার বাবা মাও হয়তো সেদিন বলতে পারতেন, আমার মেয়েকে আমি পরিবার ছাড়াই বিয়ে দিবো। আর নীলের বাবাকেই দেখেন না। উনার মতো ইগোওয়ালা বাবাদের জন্যই সন্তানরা এমন ভুল করে। একবার যদি উনি ছেলেকে বুঝতেন তাহলে কি সে আপনার কথা শুনতো? এই জগতে সবাই অপরাধী। তাই ভুল করেছেন বলে নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। ভুল করেছেন বলেই সঠিকটা জানতে পারছেন।

_তারপরও অরিন ইশিকে বিয়ে করে ওর জীবনটা ধ্বংস করতে চাইনা।
_যদি মেয়েটা সত্যি সত্যি মারা যায় তখন?” মিহান কিছু বলল না। তাঁরও ভয় হচ্ছে যদি সত্যি ইশি মারা যায় তখন তো সে আরেকটা খুনের ভার বয়ে চলবে। খুনের কথা ভাবতেই মিহানের কলিজা কেঁপে উঠে। এই অপরাধগুলো বয়ে চলতে পারছে না সে আর কতো বইবে? রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে মিহান রুমে গিয়ে বসে। তখনই ইশি তাঁর রুমে আসে। মিহান বসা থেকে দাঁড়ায়। ইশি মিহানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, “কাল আমায় দেখতে আসবে মিহান ভাই। আমি সত্যি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি মরে যাবো মিহান ভাই। আমি আর পারছি না।” মিহান কিছু বলেনা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইশি চলে যায়। মিহানের মনটা ছটফট করতে লাগে। ইশি মারা যাবে শুনলে কলিজা মুচড় দিয়ে উঠে। অবশেষে মিহান শান্তি চৌধুরীর রুমে যায়। উনাকে গিয়ে বলে সে ইশিকে বিয়ে করতে রাজি। কথাটা শুনে ইশি এতো খুশি হয় যে কেঁদেই দেয়। ঘরোয়া ভাবে তাঁদের বিয়েটা দেওয়া হয়। বিয়ের দিন রাতে ইশি মিহানের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। কাগজে লেখা,মিহান তাকে খাইয়ে দিতে হবে,চুল আছড়ে দিতে হবে,প্রতিদিন বুকে নিয়ে ঘুমাতে হবে,প্রতিদিন কম হলেও দশবার কিস করতে হবে, এগুলা না করলে সে সুইসাইড করবে। সুইসাইডের কথা শুনলেই মিহানের কলিজা লাফিয়ে উঠে। কাগজের শর্ত অনুযায়ী দিন চলতে থাকে। প্রতিদিন বুকে নিয়ে ঘুমানো দশবার কিস দেওয়া সবকিছু মিহানের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। অভ্যাস থেকে আস্তে আস্তে নেশা হয়ে যায়।

এভাবে দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় ৪ বছর। অরিনের মেয়ে অজনি এখন পুরাই বুড়িদের মতো কথা বলে। দিশার ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছে অহন। নামটা শাওন রেখেছে। হয়তো অরিনের সাথে মিলিয়ে রেখেছে অথবা অজনির সাথে। লুপার মেয়ে হয়েছে। মেয়ের নাম রেখেছে মিহু। নামটা তাঁর ভাইয়ের সাথেই মিলিয়ে রেখেছে। জিহানের ছেলে হয়েছে ওর নাম রেখে আরান। সবার কোল জোড়ে বাচ্চা আছে সংসারে শান্তি আছে শুধু মিহানের নেই। তাঁর সংসারে ভালোবাসা অফুরন্ত,কিন্তু সন্তানের অভাব মনের ঘরটা খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। ইশি তাকে এতো বেশি ভালোবাসে দেয় আর কেয়ার করে যে সে ইশি ছাড়া এখন কিছুই বুঝেনা। অতীতে পাগলামোর কথা মনে পড় বড্ড হাসি পায় তাঁর। ইশি একটি অসাধারণ মেয়ে। যে সন্তান ছাড়াও স্বামীকে নিয়ে সুখী আছি বলতে পারে।

আজ অরিনের নতুন সন্তান আসার খবর পেয়েছে সবাই। শান্তি নীড়ের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে যেন সুখ এসে লেপ্টে ধরেছে। নিচে বসে সবাই মিষ্টি খাচ্ছে উপর থেকে দাঁড়িয়ে দিহানের আর অরিনের হাসি দেখছে মিহান। ইশি মিহানের বাহু জড়িয়ে বলল,

_কি দেখো?
_সুখ।” ইশির মুখটা অন্ধকারে চেয়ে যায়। হাসি মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেলো। মিহান ইশির কপালে চুমু এঁকে বলল, ”

_মন খারাপ করবি না এটা কতোদিন বলবো? জানিস সুখ দুঃখ হচ্ছে ভাই বোন। দুঃখ হচ্ছে ভাই আর সুখ বোন। আগে দুঃখ মানুষের জীবনে এসে দেখে মানুষটা তাঁর বোনের যোগ্য কিনা। তারপর যোগ্য হলে সে গিয়ে তাঁর বোনকে পাঠিয়ে দেয়। যোগ্য না হলে সে থেকে যায়। আমাদের জীবনে এতোদিন বোন ছিলো এখন ভাই এসেছে। তারপর হয়তো বোন আসতে পারে। যদি যোগ্য হই তো।” ইশি মিহানের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে একফোঁটা জল ফেললো। এই মানুষটা সন্তানের অভাবে কাঁদে তা নিজ চোখে দেখে সে। এমন হাহাকার তাঁর দেখতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু তাঁরই বা কি করার? সবই তো ভাগ্য। লুপার মেয়ে কেঁদে কেঁদে মিহানের কাছে আসে। মিহান চট করে ইশিকে ছেড়ে মিহুকে কোলে নেয়। মিহান অস্থির হয়ে বলে,”

_আম্মুটা কাঁদে কেন? কি হইছে আম্মুর?
_আম্মু আমাল তকলেত তেয়ে ফেনছে। [আম্মু আমার চকলেট খেয়ে ফেলছে]
_তুমি বসো আমি তোমার আম্মুকে বকে আসছি।” মিহান মিহুকে ইশির কোলে দিয়ে লুপার রুমে গেলো। লুপা চকলেট খেয়ে খেয়ে দিশার সাথে গল্প করছে। পাশে বসে শাওন তাঁর ছেলেকে ভাত খাওয়াচ্ছে। মিহান লুপার মাথায় চাপড় দিয়ে বলল,

_এই রাক্ষস মেয়ের হাতের চকলেট কেড়ে খাস লজ্জা করেনা?” শাওন বলল,”
_ভাই ওরা বংশগত রাক্ষস। জানিস এই মুটকি রাক্ষসের কারণে আমার ছেলের জন্য কিছু এনে রাখতে পারিনা।”দিশা শাওনের চুলে ধরে একটা টান দেয়। অহন সাথে সাথে দিশাকে তাঁর কচি হাতে একটা কিল দিলো। শাওন মিহানকে বলল,
_দেখেছিস তোর বোন আমাকে কেমনে মারে?
_তোর বাচ্চাটাও তো আমার বোনকে মারলো। আর তুই বংশ তুলে কথা বললি কেন?” শাওন কিছু বলার আগেই নীল দরজা থেকে বলল,”মিহান তোর বোনকে কিছু বলবি। ও প্রতিদিন আমার মেয়েকে কাঁদায় কেন?
_তোর মেয়ে প্রতিদিন কাঁদে কেন?
_বারে আমার মেয়ের দোষ? তোর বোনকে আমি কি এনে দেইনা বল তবুও মেয়ের হাতের খাবার কেড়ে খায়।
_আরে গাধা ওটাকে খাওয়া বলেনা। ওটাকে টেস্ট করা বলে। বাচ্চা মানুষ কিনা কি খাবার। টেস্ট করবে না? আর বাচ্চাদের এতো চকলেট খাওয়া ঠিক না দাঁতে পোকা হয়।” বলেই মিহান ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যা কিছুই হোক সে কখনোই তাঁর বোনকে দোষী বলবে না। নীল রাগী লুকে লুপার দিকে তাকালো। প্রতিদিন মেয়েকে বলে,”মামনি চকলেট খেলে দাঁতে পোকা হয় আম্মুর কাছে দাও।” বলেই নিয়ে খেয়ে ফেলে। লুপা উঠে নীলকে ধরে অন্য রুমে আসলো। নীলের রাগী লুকে তাকানো দেখলে তাঁর শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে।

অরিন আলমারিতে কাপড় গুছাচ্ছিলো। দিহান অরিনকে পিছন থেকে জড়িয়ে বলল,”
_বউপাখি।
অরিন কাপড় গুছাতে গুছাতে বলে,”
_হুম।
_তোমার ভেজা চুল দেখে প্রেম প্রেম পাচ্ছে গো।”
অরিন দিহানের দিকে ঘুরে বলে,”বুড়া হচ্ছেন। মেয়েটা বড় হচ্ছে লুচ্চামি ছাড়েন।
দিহান অরিনের গলায় মুখ ডুবিয়ে বলল,”
_এমন একটা আগুন বউ থাকলে স্বামীরা লুচ্চার গুরু হয়।”

অরিন হেসে উঠে। দিহানের চুল আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই অজনি চিল্লিয়ে বলল,”
_দিদুনি দিদুনি দেখে যাও মাম্মাম আর পাপা সাপের মতো প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ঝগড়া করছে।”

অজনির কথা শুনে দিহান আর অরিন চট করে একজন আরেকজনকে ছেড়ে ছিটকে দূরে সরে যায়। অজনি চিল্লিয়ে দাদীকে ডেকে ডেকে বাইরে দৌড়ে যাচ্ছে। দিহান দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে আটকিয়ে বলে,

_এখন তোমার পড়ার সময় মামনি আসো পড়তে বসবে।
_আমি দিদুনের কাছে যাবো।
দিহান একটু ধমক দিয়ে বলে,”
_চুপ। এখানে চুপচাপ বসো।” অজনি গাল ফুলিয়ে বসে। দিহান ইশারায় অরিনকে চুমু দেয়। অরিন মৃদু হাসে। দিহান আরেকবার ইশারায় চুমু খায়। তারপর অজনির দিকে তাকিয়ে দেখে অজনি তাঁর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

_____________________________

সকালে ঘুম থেকে উঠতে দিহানের দেরি হলো।ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে এসে দেখলো সবার খাওয়া শেষ। দিহান মাত্র একটা পরোটা খেলো। আরেকটা হাতে নিতেই অরিন অজনিকে এনে দিয়ে বলল,”

_বাইরে গিয়ে হেঁটে দেখেন তো কান্না থামায় কিনা।”
_আচ্ছা খেয়ে নেই।
_খেয়ে নেই মানে কি? আজ মামারা আসবে আমার কাজ আছে না রাখেন ওকে।
_আম্মুর কাছে দাও। দিয়া কই দিয়ার কাছে দাও। নয়তো দাদুমনির কাছে দিয়ে আসো।
_আমার কিন্তু এবার খুব রাগ হচ্ছে।”

দিহান চেয়ার থেকে উঠে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে অজনিকে কোলে নিয়ে বলে,”তুই এতো জলদি দুনিয়ায় কেন আইলি রে ভ্যাঁ ভ্যাঁর বাচ্চা? তুই আমার লাইফটাই নিরামিষ করে দিছোস। না পারি শান্তিতে একটু রোমাঞ্চ করতে না পারি খেতে।” অরিন চোখ রাঙিয়ে বলে,”লুচ্চামিতো জীবনেই ছাড়বেন না। দিন দিন যে পেটুক হচ্ছেন সেদিকে খেয়াল আছে?” দিহান কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,”হ্যাঁ খাওয়াটাই তো চোখে পড়ে। সারাদিন যে ভ্যাঁ ভ্যাঁর বাচ্চা নিয়ে বাইরে আর ঘরে দৌড়াদৌড়ি করি এটা চোখে পড়েনা। আরেকটা হচ্ছে যে ওটা মিহানকে দিয়ে দিবো দেইখো।” অজনি আরো কেঁদে উঠে। দিহান সদর দরজার দিকে যেতে যেতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,” তুই কেন আইলি মা? এতো জলদি কেন আইলি?” বাইরে আসতেই অজনি কান্না থামিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগে। প্রতিদিন এমন করে এই মেয়ে। বাইরে আসার জন্য ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে। দিহান দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ের দিকে রাগি লুকে তাকায়। বারান্দায় চোখ যেতেই দেখে অরিন তাকিয়ে আছে। দিহান অজনির দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক ছাগল মার্কা হাসি দেয়। হে হে হে হে।

সমাপ্ত।

মাত্র ৪২পার্টে এসেও অনেকে বলছে এটা স্টার জলসা টাইপ হয়ে যাচ্ছে। এতো বড় গল্প কেন? গল্পটা নিয়ে কতো চিন্তা ছিলো। কত কাহিনি ছেড়ে দিয়েছি। রুহান দিয়াকে নিয়েও দুষ্টু মিষ্টি কয়েকটা পার্ট সাজিয়ে ছিলাম। কিন্তু কিছুই করার নাই। এই গল্পে আমি আর মনই বসাতে পারছিলাম না। আমি বলেছিলাম গল্পের শেষে কেউ মরবে। কিন্তু মারলাম না।

এতোদিন ভালোবেসে যারা সাথে ছিলেন তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি নতুন গল্পের সাথে থাকবেন।

এতো কষ্ট করে লিখে শুধু গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। যারা এতদিন মন্তব্য করেননি তাঁদের কাছেও।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here