শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৪
#আমিনা আফরোজ
শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ছুটে চলছে নেহালদের বাইক। শহরের কংক্রিটের ইট পাথরে গড়া দালান-কোঠা -গুলোকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলছে ওরা। হঠাৎ কোথায় থেকে যেন একমুঠো অবাধ্য হওয়া এসে এলোমেলো করে দিয়ে গেল রোদের চুলোগুলো। রোদও ওর অবাধ্য চুলগুলো উড়িয়ে দিল মুঠো হাওয়ার তরে। আজ না হয় খোলা থাক অবাধ্য চুলগুলো, নিজের সুরে সুর মিলিয়ে গোধূলির লাল আলোয় জাল বুনে নিক নিজেই। স্মৃতির পাতায় জমা হোক আরো একটি গোধূলি বিকেলের আনন্দঘন কিছু মুহূর্ত।
দোতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ির সামনে এসে থামল নেহালদের বাইক। বাড়িটিকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ কয়েক বছর আগের পুরোনো বাড়ি । দেয়ালের রংগুলো প্রায় ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে , বৃষ্টির পানির ছাট দেয়ালে এসে পড়ায় দেয়ালের মাঝে মাঝে সবুজ রঙের আস্তরনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সেই সাথে।
এদিকে নেহালকে একটি বাড়ির সামনে এসে থামতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল রোদের। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো নেহাল ঠিক কোথায় নিয়ে এসেছে ওকে। রোদ ভেবেছিল নেহাল হয়তো ওকে কোন রেস্টুরেন্টে যাবে কিন্তু এটাতো কোন রেস্টুরেন্ট নয় ? এ তো কোন ভদ্রলোকের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে রোদের কাছে? এ কোন বাড়িতে ওকে নিয়ে এলো নেহাল? আর কেনই বা নিয়ে এলো? তাহলে কি সত্যিই নেহাল ওকে মেরে ফেলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে? এই বদরাগী লোকটা যে ওর সাথে এত বড় ছলনা করবে তা কে জানতো ? সারপ্রাইজের কথা বলে শেষে কি না মেরে ফেলতে নিয়ে এসেছে ওকে। আগে জানলে হয়তো এই বদ লোকটাকে রোদ ঠুসঠুস করে গুলি করতো কিন্তু হায় এখন কি করবে ও? হায় হায় নাতি-নাতনির মুখ না দেখেই কি শেষ পর্যন্ত মরতে হবে ওকে?
রোদকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল নেহালের। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–” এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ভিতরে চলো।”
নেহালের কথা শুনে রোদ ভয় পেয়ে মনে মনে বলল,
–” এ ব্যাটার তো দেখে আমাকে মেরে ফেলার খুব তাড়া আছে। ব্যাটা খাটাশ একটা । আমার মত নিষ্পাপ মেয়েকে মেরে ফেলতে নিয়ে আসছে। আল্লাহ বাঁচাও আমারে, এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না আমি।”
–“কি ব্যাপার আবার কি ভাবতে বসলে?”
নেহালের প্রশ্ন শুনে রোদ স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে বলল,
–” আমি এ বাড়িতে যাব না , চলে যাব এখান থেকে।”
রোদের এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভ্রু-কুচকে গেল নেহালের। কিছুক্ষণ আগেই তো ঠিক ছিল মেয়েটা। এই অল্প সময়ের মধ্যে কি বা হলো ওর? তাই গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাস করল,
–” কেন যাবে না?”
–” আমি যদি এ বাড়িতে যাই তবে আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন। আমার এত আগে মরার শখ নেই। আগে নাতি-নাতনীর মুখ দেখি তারপর তখন না হয় কথা আপনি আমাকে মেরে ফেলেন।”
রোদের এমন উদ্ভট কথায় রেগে গেল নেহাল। ভেবেছিল আজ অন্তত রোদের ওপর রাগ দেখাবে না ও কিন্তু এই মেয়েটা যে আগে থেকেই তার ছেড়া তা মনে ছিল না নেহালের। নিজেকে যথা সম্ভব কন্ট্রোলে রেখে রোদকে বলল,
–” কি সব আবোল তাবোল কথা বলেছো তুমি? সারাদিন কি তোমার মাথায় এইসব ফালতু চিন্তা ঘোরে নাকি? অনেক হয়েছে, চলো এবার।”
–” না না আমি যাব না । আমি বাড়ি যাব।”
কথাটা বলেই রোদ পিছন ফিরে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো নেহালও দৌড়ে রোদের সামনে এসে দাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলল,
–“শেষবারের মতো বলছি, যাবে কি যাবে না ?”
–” যাব না আমি ।”
রোদের কথা শুনে নেহাল ভ্রু কুঁচকে বলল,
–” আমি তো ভুলেই গেয়েছিলাম যে তুমি ভালো কথার মানুষ না। তোমাকে তোমার ভাষাতেই বুঝাতে হবে আমায়।”
কথাটা বলেই নেহাল আচমকা রোদকে কোলে তুলে নিয়ে দোতলা বাড়িটির দিকে যেতে লাগল।
আচমকা এমন কান্ডে রোদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নেহালের দিকে। ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটেছে যে রোদের কাছে এখনো সবটা ঘোর ঘোর লাগছে। সত্যিই কি ও লোকটার এতটা কাছে আছে? নাকি সবটাই কল্পনা। এমন হাজারো কল্পনা বুনেছে ও এই লোকটাকে নিয়ে। এই তো লোকটির হৃদ স্পন্দনের টিপটিপ আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রোদ। আচ্ছা কল্পনায় কি কারো হৃদ স্পন্দনের আওয়াজ শোনা যায়? রোদ মোহাবিষ্ট হয়ে নেহালের বুকে মাথা রেখে হৃদ স্পন্দনের টিপটিপ আওয়াজ শোনায় মত্ত হয়ে রইল।
সময় বিকেল পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিট । আজ বাসায় আসতে একটু দেরি হয়েছে সন্ধ্যার। রাস্তায় আজ যানজট ছিল অনেক। সারি সারি গাড়ি থমকে ছিল এক জায়গায়। সে এক বিরক্তির অবস্থা। এত যানজটের কারণে সন্ধ্যাদের গাড়ি কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে বাড়ি অব্দি এসেছে।
সন্ধ্যা বাড়িতে ঢুকতেই সর্বপ্রথম দেখা হয় মনোয়ারা বেগমের সাথে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন তিনি। দেখেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যার জন্য এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন । সন্ধ্যাকে দেখে পাশে রাখা রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন,
–” কয়টা বাজে এখন ?”
মনোয়ারা বেগমের ধমক শুনে সন্ধ্যা মৃদু স্বরে বলল,
–“5:30 বাজে ফুপু।”
–” এই তোমার আসার সময় হলো? কলেজ ছুটি হয় চারটায়। পাঁচটার আগেই বাসায় আসার কথা তোমার কিন্তু তুমি এলে সাড়ে পাঁচটারো পরে। এই মেয়ে সত্যি করে বলো, কোথায় ছিলে এতোক্ষন?”
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সন্ধ্যা। এ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন উনি। থতমত খেয়ে কোন রকমে বলে উঠলো,
–” আপনার কথা বুঝলাম না ফুপি? আসলে আজ রাস্তায় খুব যানজট ছিল তাই বাসায় আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
–“ন্যাকা ষষ্ঠী ,এমন ভাব করছো যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতেও জানো না কিন্তু তুমি যে কি জিনিস তা আমি আমার বুঝতে দেরি নেই। তোমার কুকীর্তি সব জেনে গেছি আমি বুঝলে।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে চোখে পানি এল সন্ধ্যার। এতো দিন অনেক কটু বলেছেন তিনি। সন্ধ্যাও মুখ বুঝে সহ্য করে গেছে সবটা কিন্তু আজ তো ওর চরিত্রেই দাগ লাগিয়ে দিলো এইটা কিভাবে সহ্য করবে ও। অশ্রুসিক্ত নয়নে মনে মনে ভাবল ভাবল ,
–“একজন বয়জ্যেষ্ঠ মানুষের চিন্তা-ভাবনা একটা নিচু হয় কিভাবে?”
মনোয়ারা বেগমের হট্টগোল শুনে দোতলা থেকে বের হয়ে আসলো তুলি আর রাবেয়া বেগম। মিসেস রাবেয়া বেগম আসরের নামাজ পড়ছিলেন। অনেকক্ষণ থেকেই চেঁচামেচি শুনছিলেন নিচ থেকে কিন্তু নামাজের কারণে উঠে আসতে পারছিলেন না তিনি। তাই নামাজ শেষ হতেই দ্রুত নিচে চলে আসলেন। এদিকে তুলিও আজ অসুস্থ থাকার কারণে স্কুলে যায়নি তাই ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো সারাদিন। সন্ধ্যা, রোদ কেউ না থাকায় সারাদিন কারো সাথে কথা হয়নি তেমন। এই বিকেলবেলায় মায়ের চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে তড়িঘড়ি করে তুলিও নিচে নেমে এলো।
ড্রয়িংরুমে এসে তুলি ও রাবেয়া বেগম দেখলেন মনোয়ারা বেগম অগ্নিশর্মা হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছেন আর সন্ধ্যা অশ্রুসিক্ত নয়নে নিচের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। সন্ধ্যাকে কান্না দেখে তুলির বুক কেঁপে উঠলো। না জানি ওর মা কোন অঘটন নাই ঘটিয়েছে? ইস্ তুলি যদি আগে জানতো তবে মাকে চোখে চোখে রাখতো । তুলি ও রাবেয়া বেগম দুজনে অবাক দৃষ্টিতে মনোয়ারা বেগমের দিকে তাকালো। তারপর রাবেয়া বেগম নিজেই বলে ওঠলেন,
–“কি হয়েছে মনু? তুমি সন্ধ্যার ওপর এভাবে চিৎকার করছো কেন?”
রাবেয়া বেগমের কথা শুনে সেদিকে তাকালো মনোয়ারা বেগম। ইদানিং রাবেয়া বেগমকেও সহ্য করতে পারেন না ওনি। ছেলের বউয়ের জন্য যেন দরদ উঠলে পরে সবসময় রাবেয়া বেগমের। মনোয়ারা বেগম রাবেয়া বেগমের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ সুরে বলে উঠলেন ,
–“কি হয়েছে তা তোমার আদরের ছেলে বউকে জিজ্ঞেস করো না , আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো?”
মিসেস রাবেয়া বেগম মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে বুঝতে পারলেন ওনার কাছ থেকে কোন কথা জানতে পারবেন না তিনি। তাই সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বললেন,
–” কি হয়েছে মা? মনু এভাবে চিৎকার করছে কেন? আর তুমিই বা ঘরে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
রাবেয়া বেগমের কথা শুনে সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল।এতটা অপমান এর আগে কখনো হয় নি ও। সন্ধ্যাকে কাঁদতে দেখে এবার তুলি বলে ওঠল,
–“ভাবিকে তুমি কি বলেছো মা? এমনিতেই কাঁদার মেয়ে তো ভাবি নয়?”
মেয়ের কথা শুনে যেন আরো বেশি রেগে গেলেন মনোয়ারা বেগম। এই মেয়ের জন্য কত কিছুই না করছেন তিনি অথচ তার মেয়েই তাকে চোখ রাঙাচ্ছে। আজ যদি ওর এই চোখ রাঙানো না কমিয়েছে তবে ওনার নামও মনোয়ারা বেগম নয়।
মনোয়ারা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে আরো বেশি সন্দেহ হলো তুলির। তাই আগের চাইতেও জোরে বলে ওঠলো,
–“কি হলো কথা বলছো না কেন ? উত্তর দাও আমার প্রশ্নের?”
তুলির কথা শেষ না হতেই মনোয়ারা বেগম তুলির দিকে তেড়ে এসেই চড় দিলেন তুলির গালে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন,
–“একটা বাহিরের খারাপ মেয়ের জন্য আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস তুই? এই তুই চিনিস আমাকে? একদম জানে মেরে ফেলবো।”
আকশ্মিক মায়ের হাতে চড় খেয়ে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল তুলি। এর আগে কখনো মায়ের হাতে চড় খায় নি ও।
এদিকে রাবেয়া বেগম মনোয়ারা বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
–” কি হয়েছে আমাকে একটু স্পষ্ট করে বলবে আর সন্ধ্যাকেই বা তুমি খারাপ মেয়ে বলছো কেন?”
মনোয়ারা বেগম তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে বলল,
–“খারাপ মেয়েকে খারাপ বলবো না তো ভালো মেয়ে বলব। এই মেয়ের জন্মেরই তো ঠিক নেই।”
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে রাবেয়া বেগম চিৎকার করে বলে ওঠলেন,
–“মনু। চুপ করে থাকো তুমি। অনেক বলে ফেলেছো ।”
–” আমাকে চুপ করালেই তো আর সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না ভাবি।”
–“চুপ । ও আমাদের আশরাফ ভাইয়ের মেয়ে আর এটাই সত্যি।”
–“ভুল বললে ভাবি । ও আশরাফ ভাইয়ের মেয়ে না ও পরির মেয়ে যার বাবা কে আজো কেউ জানে না। পিতৃহীন মেয়েকে কি বলে জানো তো?”
–“মনু আমি তোমাকে চুপ করতে বলেছি। তোমার ভাই এসব জানলে কষ্ট পাবে । দোহাই তোমার চুপ করো।”
রাবেয়া বেগমের কথা শুনে মনোয়ারা বেগম মুখ বেঁকিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। পিছনে রেখে গেলেন অশ্রুসিক্ত দুইটি চোখ যাদের নিজেদের মনে উদয় হয়েছে অনেক প্রশ্নের। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি মিলবে তাদের নাকি ধোঁয়াশার অন্তরালেই রয়ে যাবে উত্তরগুলো।
চলবে
(আসসালামুয়ালাইকুম। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ইনশাআল্লাহ আজ সন্ধ্যার বিষয়ে অনেকটাই জট খুলেছে বলে আমি মনে করি। ধীরে ধীরে আরো জট খুলবে। আর বেশি পর্ব লিখবো না। এমনিতেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে গল্পটা । তাই তিন-চার পর্বের মধ্যেই শেষ করতে চাই গল্পটা। আশা করি শেষ অব্দি সবাইকে পাশে পাবো। আর গল্পের আপডেড পেতে পেইজে লাইক দিয়ে রাখবেন। নিচে পেইজের লিঙ্ক দিয়ে দিবো। ভালো থাকবেন সবাই। আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ।)
https://www.facebook.com/আফরোজের-গল্পকথন-101560512132229/