ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_৩৩

0
1030

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৩৩
#সুলতানা_সিমা

অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। এখনো শাওনের খোঁজ নেই। দিশা পার্কিংয়ের দিকে গিয়ে দেখলো শাওন একা দাঁড়িয়ে আছে৷ পিছন থেকে দেখে বুঝা যাচ্ছে শাওন সিগারেট খাচ্ছে। দিশা গাউন তুলে হেঁটে হেঁটে শাওনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শাওন টের পায়নি তাঁর পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। দিশা শাওনের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আকস্মিক ঘটনায় শাওন হচকচিয়ে উঠে। দিশাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার তার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। দিশা শাসনের গলায় বলল,”তোকে না আমি অনেকবার বলেছি তুই সিগারেট খাবি না। তবুও কেন খেলি? এই ছাইপাঁশ খেয়ে কি মজাটা পাস শুনি?” শাওন গম্ভীর গলায় বলল, “দিশা এখান থেকে যা।
_কেন যাবো? এখানে দাঁড়িয়ে তুই কি করছিস? সবাই ওখানে নাচানাচি করছে। জানিস তোর জন্য আমিও নাচিনি? কতো মজা করছে সবাই আর আমাকে দেখ? তোকে পাগলা কুত্তার মতো খুঁজে যাচ্ছি।
_দিশা প্লিজ যা এখান থেকে।
_তুই বললেই চলে যাবো? যাবো না আমি।” শাওন কিছু না বলে অন্যদিকে চলে গেলো। দিশাও শাওনের পিছু পিছু দৌড়ে গেলো। শাওনের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,”এই কুত্তা কি হয়েছে তোর? এভাবে গোমড়া মুখো হয়ে আছিস কেন? আয় তোর সাথে নাচবো।” শাওন আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “হাত ছাড়।”
_ছাড়বো না।
_হাত ছাড় দিশা।
_ওকে ছাড়লাম।” বলেই দিশা শাওনের বাহু জড়িয়ে ধরলো। শাওন ধাক্কা দিয়ে দিশাকে ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, “বলছি না হাত ছাড়তে?” দিশা অবাক হয়ে তাকায়। শাওন হঠাৎ এভাবে রেগে কথা বলছে কেন? দিশার মুখটা মুখটা মলিন হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণে জোরপূর্বক হেসে বলে,”তুই বললেই হলো নাকি? আমি ধরবো তোর হাত।” দিশা আবার হাত ধরতে গেলে শাওন চেঁচিয়ে বলল,”কেন ধরবি? বলবি আমায়, কেন ধরবি? [একটু থেমে রাগে ফোঁস ফোঁস করে শান্ত গলায় বলল] তুই মামাকে কি বলেছিস?” দিশার বুকটা ধুক করে উঠলো। কাল রাতে তাঁর বাবা তাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন তাঁর জন্য একটা ছেলে দেখেছেন। সে উনাকে বলে দিয়েছে, সে শাওনকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। শাওনকে সে ভালোবাসে। উনি যেন রাজি হয়ে যান সে জন্য বলেছে শাওনের সাথে তাঁর রিলেশন ক্লাস এইট থেকে। এটাও বলেছে তাঁর ফুপির সাথে যেন উনি তাদের বিয়ের বিষয়ে কথা বলেন। দিশার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে শাওন বলল,”তোর কি কমনসেন্স বলতে কিছু নেই? তুই মামাকে বলেছিস তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস? তোর সাথে আমি রিলেশনে আছি? তোর লজ্জা থাকা উচিত দিশা। একটা ছেলে তোকে ভালোবাসে নাকি বাসে না সেটা খুঁজ নেওয়ার আগে তুই ঢাকঢোল বাজানো শুরু করে দিলি? আচ্ছা একবারও কি তোর মনে হয়নি আমি অন্যকাউকে ভালোবাসতে পারি? আমার মনে কারো বসবাস থাকতে পারে? হ্যাঁ তোর সাথে ছোট বেলায় আমার একটু ভালো লাগালাগি ছিলো। কিন্তু এটাকে তো প্রেম বা ভালোবাসা বলা যায়না, তাইনা? তোর সাথে তো আমার প্রেম ছিলোনা। আমি শুধু প্রপোজ করেছিলাম তোকে। তুই না বলে দিয়েছিলি। যদি তোকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম তাহলে তো বড় হয়ে তোকে আমি আবার প্রপোজ করতাম। এভাবে বিয়ের কথা বলে দিতে তোর লজ্জায় বাধলো না? লজ্জা করলো না তোর? আমার ভাবতেই লজ্জা লাগছে যে তুই এতোটাই নির্লজ্জ। ছিঃ।”

শাওনের কথাগুলো দিশার কলিজায় ধারালো ছুরি মতো গেঁথছে। কষ্ট অভিমানে দিশার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। শাওনের তীক্ষ্ণ চোখ থেকে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো সে। শাওন আবার বলল,”আসলে দোষ কার জানিস? আমার। আমিই তোকে প্রশ্রয় দিয়েছি। না আমি তোর সাথে এতো মিশতাম আর না তুই এসব বলার সাহস পেতি। এখন তো তোর সাহস এতো বেড়ে গেছে যে তুই তোর নিজের অবস্থানটাও ভুলে গেছিস।” দিশা ছলছল চোখে শাওনের দিকে তাকালো। অবস্থান বলতে শাওন কি বুঝাচ্ছে? সে শাওনের যোগ্য নয়? নাকি সে খুব খারাপ? নাকি দেখতে খারাপ? চোখটা মুছে ম্লান হেসে বলল,”আমি বুঝিনি শাওন ভাই। সরি।”
_কেন বুঝবি না? তুই ছোট? প্রথমে তোর ভাই আমার কলিজায় ছুরি চালালো এখন এসেছিস তুই সেই ক্ষতবিক্ষত কলিজাটা পুড়িয়ে দিতে? কেন রে আমার বেঁচে থাকাটা সয্য হয়না তোদের? তাহলে বলে দে মরে যাবো আমি। [হাত জোড় করে] প্লিজ দিশা। হাত জোড় করে বলছি তুই আমার থেকে দূরে থাকবি। আর তোর বাবাকে বলে দিবি আমার বাবা মায়ের সাথে যেন এ নিয়ে কথায় না বসে। আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না।” বলেই শাওন চলে যায়। দিশা চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। কয়েকটা অচেনা চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। দিশা চোখ মুছতে মুছতে হলের ভিতর না ঢুকে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। গাড়ির দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷ শাওন তাকে এতোই ঘৃণা করে? এতো বেশি? সে কি এতোই খারাপ যে শাওন তাকে ভালোবাসে না? দু’হাতে চুল টেনে ছিড়তে লাগলো দিশা। হাতে কামড়ে ধরে। তবুও নিজের কষ্টটা কমছে না। শাওনের বলা কথাগুলা কানে বাজছে। শাওনের ধিক্কার দেওয়া ছিঃ বলাটা বিকট শব্দ হয়ে কানে বাজছে। অনেক্ষণ কান্নাকাটি করার পর চোখ মুছে চুল ঠিক করে হলের ভেতর গেলো। দিশা ঢুকার পরে দেখলো নীল শাওন আর দিহান বসে কথা বলছে। দিশা মাথা নিচু করে ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। শাওন এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে আবার দিহানের সাথে কথা বলতে লাগলো। একটু পরে বাসায় চলে গেলো সবাই। ততক্ষণ আর শাওন দিশার দেখা হলো না। দিশা বাসায় গিয়েই নিজের রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লো। তখন রাত ৪টা বাজে। সবাই টায়ার্ড হওয়ায় কেউ কারো খোঁজ নিলো না যে যার মতো ঘুমিয়ে যায়।

দুপুরে ঘুম থেকে উঠে সবাই নিজের কাপড় চোপড় গুছাতে লাগলো। হলুদে বিয়েতে যা যা পড়বে সেগুলো যে যার লাগেজে ঢুকিয়ে নিলো। আজ হলুদ হবে কাল বিয়ে। আজ রিসোর্ট থেকে আসবে না কেউ। সবাই রিসোর্টে থেকে যাবে। তারপর বিয়ে শেষে আসবে। সুমনা চৌধুরী রান্না করেছেন। সবাই বলছে রিসোর্টে গিয়ে লাঞ্চ সেড়ে নিবে। কিন্তু উনার বাইরের খাবার কখনোই পছন্দ না। খাবার রেডি করে সবাইকে খেতে ডাকলেন। খাওয়াদাওয়া শেষে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাবে। রুহান দিয়া শাঞ্জু আগেই খেয়ে নিয়েছে হানিফ চৌধুরীদের সাথে। এখন দিহান,জিহান,ইশি,মিহান,নীল, লুপা, শাওন শান্তি চৌধুরী খেতে বসেছেন। জহুরা বেগম শায়লা চৌধুরী ও শিলা চৌধুরী তাদের ভাবিদের সাথে খাবেন। অরিন বসলো না। দিহান বাদে কেউ তাকে বসতে বলেনি। তাছাড়া বাড়ির বউ সে। এভাবে শাশুড়ীদের রেখে খাওয়াটা ঠিক দেখায় না।

অরিন দিহানকে খাবার বেড়ে দিলো। দিহান আস্তে করে বলল,”খেয়ে নাওনা।”
_পরে খাবো। আপনি খান।” দিহানের মুখটা মলিন হয়ে যায়। কিন্তু কিছুই তো করার নাই। তাঁর মা চাচি ফুপি জহুরা সবাই রয়েছেন এখন অরিনের বসাটাও ঠিক হবে না। কিন্তু দিহানের গলা দিয়ে যেন খাবার নামেনা অরিন সাথে না খেলে।

সুমনা চৌধুরী শান্তি চৌধুরীর প্লেটে ভাত বাড়তে লাগলে। শান্তি চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,”বউমা দিশা কই?” শান্তি চৌধুরীর কথা কানে যেতেই শাওন মাথা তুলে তাকায়। সব চেয়ারে তাকিয়ে দেখে দিশা নেই। এতোক্ষণ সে এটা খেয়ালই করনি। দিহান বলে,”হ্যাঁ দিশা কই গেলো। ওকে তো কাল রিসোর্ট থেকে আমি দেখছি না। “দিলারা চৌধুরী ডেকে আসছি বলে উপরে গেলেন। দিশা তার রুমে বসে ছিলো। দিলারা বললেন,” দিশা খাবিনা?” দিশা চমকে উঠে। তৎক্ষণাৎ চোখের পানি মুছে বলল,”আ আ আসছি।”
_আসছি কি আমার সাথে আয়।” দিশা কথা না বারিয়ে উঠে আসলো। নিচে নামার সময় সবার আগে তাঁর চোখ গেলো টেবিলে বসা শাওনের উপর। মিহানের সাথে কি নিয়ে যেন হেসে হেসে কথা বলছে। দিশার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। খুব সাবধানে চোখ মুছে টেবিলে গিয়ে বসলো। দিহান বলল, “কি রে কি হইছে তোর?” দিহানের কথায় শাওন সামনে তাকায়। তাকিয়ে দেখে দিশা এসেছে। দিশার মুখটা একদম শুকিয়ে আছে। চোখ দুটো অনেকটা ফোলা। নাক গাল চোখের চারপাশ লাল হয়ে আছে। দিশা যে অনেক পরিমাণে কান্না করেছে তা বুঝাই যাচ্ছে। কেন জানি শাওনের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো৷ দিহান আবার বলল,”কি হয়েছে তোর? চোখ মুখের অবস্থা এমন কেন?
_ঘুম হয়নি বলে হয়তো।” প্লেটের দিকে চোখ রেখে বলল দিশা। তার কণ্ঠ ভেজা। অরিন দিহানের দিকে ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলল,”ওদের মাঝে কি কিছু হয়েছে নাকি?” দিহান কিছু বলল না। তাঁর চেহারায় চিন্তা রেখা ফুটে ওঠেছে। শান্তি চৌধুরী বলেন,”কাল যা মজা হয়েছে। আমি জীবিনেই ভুলবো না। এই শুন না। আমার নাচ কেমন হয়েছে,কেউ ভিডিও করেছিস?” মিহান বলল,”তোমার নাচের কাছে নোরা ফাতেহি জিরো।
_ওটা আবার কে?” ইশি বলল,”কে আবার তোমার নাত বউ।” শান্তি চৌধুরী থেকে শুরু করে উনার তিন বউ যেন বড়সড় ঝাটকা খেলেন। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসুক চোখে মিহানের দিকে তাকালেন। মিহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খেতে থাকে। শান্তি চৌধুরী বললেন,”নাত বউ মানে? মিহান বিয়ে করেছে?” শান্তি চৌধুরীর কথায় সবাই হেসে উঠে। ইশি বলে না গো দাদুমনি এটা এক্ট্রেস।” শান্তি চৌধুরী ভেংচি কাটেন। তারপর বলেন,”আচ্ছা কাল সবাই এতো মজা করলাম কিন্তু দিশাকে তো দেখলাম না।” ইশি বলল”দেখবে কেমনে সে-তো একটা ভীতু। ভয়ে পালিয়ে ছিলো। জানো দাদুমনি তোমার নাতনি আমার সাথে চ্যালেঞ্জ নিছিলো সে নাকি আমার থেকে ভালো নেচে দেখাবে। ছোট আম্মুও দিশার পক্ষে ছিলো। এখন বলে দেই ছোট আম্মু, তোমার দিশা কিন্তু আমার ভয়ে নাচে নি। নাচবে কি ও তো ভয়ে ডান্স ফ্লোরের ধারে কাছেও আসেনি। তবে যাই বলিস দিশা মজাটা কিন্তু খুব মিস করলি তুই।” ইশির কথা গুলা শুনা মাত্রই শাওনের মনে পড়ে গেলো,”[এখানে দাঁড়িয়ে তুই কি করছিস শুনি? সবাই ওখানে নাচানাচি করছে। জানিস তোর জন্য আমিও নাচিনি ? কতো মজা করছে সবাই আর আমাকে দেখ, তোকে পাগলা কুত্তার মতো খুঁজে যাচ্ছি।] “শাওনের খুব খারাপ লাগলো। দিশা তাঁর জন্য এতোকিছু থেকে দূরে ছিলো? দিশার মুখটার দিকে তাকালো সে। খুব শান্ত ভাবে মাথা নিচু করে আছে। ভাত একটাও মুখে তুলছে না। অরিন দিশার প্লেটে ভাত দিতে গেলে দিশা বাঁধা দেয়। অরিনকে দেখে শাওনের বুকটা আবারও জ্বলে উঠলো। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে মন দিলো সে।

শান্তি চৌধুরী বললেন,” আমাদের অরিনও দেখি নাচতে পারে।” নীল বলল,”নাচার থেকে অন্যটা বেশি করে নানুমনি।”মিহান বলল,”ডান্স ফ্লোরে তোরটাও আমি দেখেছি।”মিহানের কথায় লুপা নীল এক সাথে বিষম খায়। অরিন লুপাকে আর জিহান নীলকে পানি খেতে দেয়। লুপা পানি খেয়ে ভিতু চোখে তাঁর ভাইয়ের দিকে তাকায়। মিহান কি সব জানে? আর জানলেও এসব জানালো কে? নীল নয়তো? যে কেউ জানাক এতো স্বাভাবিক কেন? মূহুর্তেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন মাথায় ঝেঁকে বসলো তাঁর। শিলা চৌধুরীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। উনার এই হাসিটা যেমন কারো চোখে পরেনি তেমনি তাঁর কারণটাও কেউ জানবেনা। শান্তি চৌধুরী বলেন,”তোদের দুটোর আবার কি হলো?” দিহান বলে,”কি রে মিহান তুই কি দেখছিস ওর?” মিহান মুখ পোড়ে ভাত নিয়ে বলে,”খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।
_কোন বইয়ে লেখা আছে যে খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই?
_বলবো?
_হ্যাঁ বল।
_দাদুমনি তুমি যখন দিহানকে ডাকতে পাঠিয়েছিলে। আমি ওদের ডাকতে গিয়ে রুমে ঢুকে দেখি,,,মিহান আর কিছু বলার আগে দিহান মিহানের মুখ চেপে ধরে বলে,”খাওয়ার সময় এতো কথা বলিস কেন? চুপচাপ খেতে পারিস না?” দিহানের কান্ডে জিহান শাওন নীল ইশি লুপা সজোরে হেসে উঠে। অরিন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। দিলারা চৌধুরী ধমক দিয়ে বলেন,”ওই দিহান। ওর মুখ ছাড়। আর চুপচাপ খাও সবাই।” উনার ধমকে সবাই হাসি থামিয়ে দেয়। শাওন তাকিয়ে দেখে দিশা মাথা নিচু করে শুধু ভাত নাড়াচাড়া করছে৷ খুব অল্প ভাত নিয়েছে। এখনো হয়তো এক লোকমাও খায়নি। সবাই এতো কথা বলছে এতো হাসাহাসি করছে অথচ দিশা চুপ। শাওন বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খেতে লাগলো। কিন্তু বার বার তাঁর চোখ দিশার দিকে চলে যাচ্ছে। ভেতর থেকে মনটা যেন চাচ্ছে দিশা তাকে একটা খোঁচা মারোক। সে ঝগড়া করুক।

খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই সবকিছু গুছাতে লাগলো। অরিন কিচেনে ছিলো। দিলারা চৌধুরী প্লেটগুলো বেচিনে রাখতে রাখতে অরিনের উদ্দেশ্যে বললেন,”তোমার মাকে বলে দিও আমার কোনো মেহমানের সামনে যেন উনি কথা না বলেন। আর যদি বলেন উনার এই গ্রাম্য ভাষায় মূর্খদের মতো যেন কিছু না বলেন। আর কেমন চলাফেরা উনার? আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে এসব ভাষায় কথা বলেন। লজ্জায় কি অবস্থা হয় আমার ভাবতে পারছো?” উনার কথা বলা হলে উনি চলে যেতে পা বাড়ান। কিচেন থেকে বের হতে দেখেন জহুরা দাঁড়িয়ে আছেন। উনি জহুরার পাশ কেটে চলে যান। অরিনের চোখ দুটো অপমানের অশ্রুতে ভরে যায়। হঠাৎ কারো হাতের ছোঁয়া ঘাড়ে পেতেই চোখ মুছে পিছন ঘুরে তাকায়। জহুরা বেগম একটা আঙুল দিয়ে অরিনের বাম চোখের কোণেটা মুছে বললেন,”কানতাছোস কেন? এগুলা কিছু না রে। ” অরিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। জহুরা বেগমের ভিজে আসা চোখটা আঁচলে মুছে বললেন,”মনে কর উনি কিছু কয় নাই। তুইও কিছু হুনস নাই। আমিও কিছু কিছু হুনি নাই।” অরিনের চোখটা মুছে দিয়ে বললেন, “কানদিস না। শ্বশুর বাড়ি অনেক মাইনষের কথা হুইনা ও না হুনার ভান কইরা থাহন লাগে। নইলে যে ঘরের লক্ষী হওয়া যায়না রে মা।”বলেই উনি কিচেন থেকে বেরিয়ে চলে যায়। অরিন চোখ মুছে রুমে গেলো। রুমে গিয়ে দেখলো দিহান খাটে বসে আছে। তাকে দেখে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। অরিন দিহানের কোলে বসে তার গলায় মুখ লুকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। দিহান অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল,” খাইছো সোনা?” অরিন জবাব দিলো না। দিহানের গলায় তরল কিছু পড়লো। দিহান অরিনকে ছাড়িয়ে বললো।,”বউপাখি তুমি কাঁদছো?” অরিন ঠোঁট কামড়ে কাঁদে। দিহান হন্তদন্ত হয়ে বলে,”কি হইছে বউপাখি বলো? কষ্ট হচ্ছে তোমার? পেট ব্যথা করছে সোনা? বলো? তোমায় কেউ কিছু বলছে?” অরিন আবার দিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।
_তুমি কাঁদছো কেন বউপাখি?
_একটু জড়িয়ে ধরুন না প্লিজ। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবেন না।” দিহান আর কথা বাড়ালো না। অরিনকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো। অনেক্ষণ পরে শান্তি চৌধুরী এসে বলে গেলেন,”অরিন রেডি হ। তুই আমার সাথে যাবি।” বলেই তিনি চলছে যান। দিহান অরিনের কপালে চুমু এঁকে বলে,”যাওয়ার আগে অনেকগুলা কিস দিয়ে যেতে হবে কিন্তু।” অরিন মুচকি হেসে ওয়াসরুমে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পরে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা না করে যে যখন পারে তখনই বেরিয়ে গেলো রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। প্রথমে গেলেন হানিফ চৌধুরী তিনভাই ও রুহান দিয়া শাঞ্জু। তারপর গেলেন শান্তি ইশি লুপা অরিন উনার দুই মেয়ে। দিহান জিহান মিহান শাওন ও নীল তারা পাঁচ জন এক সাথে গেলো। সব শেষে গেলেন দিলারা চৌধুরীরা তিন জা ও জহুরা বেগম। কেউ খেয়ালও করলো না দিশা যে যায়নি। সবাই ভাবলো হয়তো চলে গেছে কারো সাথে। রিসোর্টে গিয়ে সবাই রেডি হতে লাগে। হলুদ রংয়ের লেহেঙ্গা পড়বে সবাই। লেহেঙ্গা বের করে দিশাকে খোঁজে দেখা যায় দিশা রিসোর্টে নাই। সবাইকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায় কারো সাথে দিশা আসেনি। শান্তি চৌধুরী রেগে অরিনকে খোচা মেরে বলেন,”বাড়ির বউদের এসবে দ্বায়িত্ব থাকতে হয়। আমার বাড়ির বউদের কোনো দ্বায়িত্ব নাই নিজের মতো চলাফেরা করে। কে খেলো না কে খেলো এটা পর্যন্ত খোঁজ করেনা।” অরিনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। দিহান বা অন্য কেউ বুঝেনি শান্তি চৌধুরীর খোঁচা মেরে কথা বলাটা। শুধু সুমনা চৌধুরী বুঝলেন। উনি ইশারায় অরিনকে স্বান্তনা দিলেন। দিহান শাওনকে বলল,”শাওন তুই বাসায় যা দিশাকে নিয়ে আয়।” জিহান বলল,”দিচ্ছিস আরেক বাদরকে। ঝগড়া করে রাস্তায় শহিদ হয়ে যাবে দুজন।
_তাহলে তুমি যাও।
_ভাই আমার হলুদ আজ।”
_দিহান আমার ভালো লাগছে না আবার বাসায় যেতে আসতে। তুই অন্য কাউকে পাঠিয়ে দে।” শাওনের কথা শুনেই নীল মিহান চুপিচুপি জায়গা ত্যাগ করে। অবশেষে দিহান ও সবার জোরাজোরিতে শাওনকে যেতে হয়।

শান্তি নীড় পৌঁছে শাওন দিশাকে খুঁজতে লাগলো। দিশার রুমে দিশা নেই। শাওন দিশার ড্রেসিংটেবিলের উপর একটা ডাইরি পায়। ডাইরিটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে ডাইরির প্রতিটি পৃষ্ঠা ছেঁড়া। শেষের একটা পৃষ্ঠা শুধু রয়েছে যেখানে লেখা,”হুম আমি নির্লজ্জ। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।” শাওন ডাইরিটা বন্ধ করে দেয়। বুকে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সব রুম খোঁজেও দিশাকে পেলোনা। শাওন তাঁর রুমে গেলো। এসেছে থেকে সে আর নীল যে রুমে থাকছে সে রুমে। রুমে ঢুকে শাওন থমকে যায়। দিশা শাওনের একটা শার্ট জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে। সাধারণ কোনো কান্না নয়। পাগলের মতো কাঁদছে। শাওনের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। দিশা তাকে এতো ভালোবাসে? শাওন দু পা পিছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দিশার সামনে এমন একটা অবস্থায় সম্মুখীন হতে চায়না সে। বুকটা ভারি লাগছে তাঁর। নিঃশ্বাসের সাথেও যেন ছুরি গেঁথে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে গেলে কলিজা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। শাওন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো “দিশা।”

শাওনের গলা কানে আসতেই দিশা চট করে চোখের পানি মুছে তড়িঘড়ি করে শার্ট খাটের নিচে লুকিয়ে রাখলো। শাওন আবার বলল,”দিশা আছিস?” দিশা চোখ মুছে চুল ঠিক করে দরজা খুলল। অবাক হলো দরজা খুলা থাকার পরেও শাওন ঘরে ঢুকেনি। আবার না ঢুকে দিশা ভেতরে আছে বলে জানে সে। দিশা বের হয়ে এসে শাওনের চোখের দিকে তাকালো। দিশা তাকাতেই শাওন চোখ নামিয়ে নেয়। দিশা কিছুক্ষণ বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে। শাওনকে জড়িয়ে ধরে গলা ছিঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর বিশাল পাথরটা সরে যাবে যদি একবার শাওন তাকে ছুঁয়ে দেয়। একবার যদি শাওনের বুকে মাথা রাখে তাহলে যেন সব কষ্ট বাতাসের সাথে মিশে যাবে। উড়ে উড়ে চলে যাবে তাঁর জগত ছেড়ে অন্য জগতে। খুব ইচ্ছে করছে একবার বেহায়া হতে। দিশা মনটা খুব করে চাইলো একবার শুধু একবার শাওনের বুকে মাথা রাখতে। একটা পা এগিয়ে আসে তাঁর। ঠিক তখনই চোখের তারায় ভাসে,[এভাবে বিয়ের কথা বলে দিতে তোর লজ্জায় বাধলো না? লজ্জা করলো না তোর? আমার ভাবতেই লজ্জা লাগছে যে তুই এতোটাই নির্লজ্জ। ছিঃ।”] দিশার পা নিজে থেকেই পিছিয়ে যায়। কিছু না বলে শাওনের পাশ কেটে নিজের রুমে চলে যায় সে। শাওন দিশার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। দিশা খাটের উপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। শাওন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”আব,,,,,তো তোকে নিতে বলেছে। চ চল।” দিশা মুখ তুলে চোখটা মুছে ক্ষীণ গলায় বলল, “আমি যাবো না ভাইয়া তুমি চলে যাও।” শাওন অবাক হয়। দিশা তাকে তুমি করে বলছে? সে বলল,”চল তোকে না নিয়ে গেলে আবার জোর করে পাঠাবে।” দিশা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আসছি বলে আলমারি থেকে একটা হলুদ ড্রেস বের করলো। ওয়াসরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এসে মাথায় হালকা চিরনি করে বেরিয়ে আসলো সে। শাওন ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। দিশা আসতেই উঠে দাঁড়ায়। দিশা কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। শাওন দরজা লক করে গাড়িতে গিয়ে উঠে। দিশা পিছনে বসেছে। শাওন বলল,”সামনে আয়।” দিশা কিছু বলল না বাইরে তাকিয়ে থাকলো। শাওন গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিসোর্টে পৌঁছে গাড়ি থামালে শাওন নামার আগেই দিশা গাড়ি থেকে নেমে হলের ভেতর চলে যায়। দিশার এই নিরবতা যেন শাওন মেনে নিতে পারছে না। কেন জানি সেই ঝগড়াটে দিশাকে খুব মিস করছে সে। আচ্ছা! যদি এখন সব স্বাভাবিক থাকতো। শাওন দিশাকে কাল ওই কঠিন কথাগুলা না বলতো। তাহলে কি পুরোটা রাস্তা এভাবে চুপচাপ আসতো দুজন? নাকি দিশা পুরো রাস্তা পকপক করে ঝগড়া করে আসতো? শাওনের গলা ব্যথা করিছে। কষ্টগুলো সব গলায় এসে আটকে আছে। সে তো চায় দিশা দূরে থাকুক ঝগড়া না করুক। তাহলে খারাপ লাগছে কেন? কেন এতো খারাপ লাগছে? দিশার সাথে ঝগড়া করা কি তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে নাকি অন্যকিছু?

সুমনা চৌধুরীর খুব রাগ হচ্ছে উনার মেয়ের উপর। লারার পরিবারের সবাই চলে এসেছে অথচ দিশা এখনো রেডিই হচ্ছে না। বার বার বলছে সে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। ইশি হাত টেনে দু-তিনবার ওয়াসরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে। বলেছে সাজগোজ না কর লেহেঙ্গাটা অন্তত পর। কিছুক্ষণ পরে ওয়াসরুমে গিয়ে দেখে দিশা দাঁড়িয়ে আছে লেহেঙ্গা পরেনি। সুমনা চৌধুরী অসয্য হয়ে দিহানকে ডাকতে গেলেন। দিহান শাওন নীল সেলফি তুলছে। সুমনা গিয়ে বললেন,”দিহান তুই কি দিশাকে কিছু বলেছিস?
_নাতো কি বলবো?
_তাহলে ও রেগে আছে কেন? দেখনা ও লেহেঙ্গা পড়ছে না। কি একটা ফকিন্নি মার্কা ড্রেস পরে এসেছে। সে নাকি এটাই পড়ে থাকবে। মানুষ কি বলবে বলতো।” দিহান শাওনকে আর নীলকে বলল,”তোরা থাক আমি আসছি।” দিহান দিশার কাছে চলে যায়। রুমে ঢুকে দেখে দিশা খাটে বসে আছে। অরিন ও ইশি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এমন একটা দৃশ্য মনে হচ্ছে যেন দিশার আজ বিয়ে সে বিয়ে করবে না আর তাকে জোর করে বিয়ের বেনারসি পড়াতে চায় সবাই। দিহান দিয়ার পাশে বসে বলল,”কি হয়েছে তোর? সবাই রেডি হয়ে গেছে আর তুই এখনো বসে আছিস?” দিশা বলল,”আমি রেডি হয়ে গেছি ভাইয়া। আমি লেহেঙ্গা পরবো না।
_পরবি না তো কিনলি কেন?” দিশা চুপচাপ বসে থাকলো। দিহান লেহেঙ্গাটা দিশার হাতে তুলে দিয়ে বলল,”পড়ে নে প্লিজ। সবাই একরকম পড়লে ভালো লাগবে। ভাইয়ের কথা ফেলে দিবি?” দিশা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে লেহেঙ্গা নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো। দিহান ইশিকে বলল,”ইশি তুই একটু যা তো তোকে মনে হয় বড়মা ডাকছে।” ইশি বলল,”সোজা ভাবে বললেই পারিস বউয়ের সাথে রোমান্স করবি। এতো মিথ্যে বলার কি আছে।
_বুঝতে পারছিস তো যাচ্ছিস না কেন?” ইশি ভেংচি কেটে চলে গেলো। অরিনও চলে যেতে লাগে। দিহান অরিনের হাতে হেঁচকা টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। অরিন নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করতে করতে বলে,”ছাড়েন। লজ্জা সরম কিছুই নাই। এভাবে ছোট বোনদের কেউ বলে?
_আমি বলি।
_ছাড়েন তো। দিশা আপু ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসবে।
_রাখো তোমার দিশা আপু। আসার আগে একটা গুড বাই কিস দিয়ে আসবা বলেছিলাম না। আসার সময় তো আমাকে বলেই আসলা না।
_বলে তো আসলাম। আপনারা ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। তখন না বললাম যাচ্ছি।
_যাচ্ছি। এটাকে বিদায় নেওয়া বলে? আর কেমন বউ তুমি? স্বামীর থেকে যে আলাদা ভাবে বিদায় নিতে হয় এটা জানা নেই তোমার।
_তো আমি কি করতাম সবাই সাথে ছিলো।
_আমি তো তোমায় একবার বলেছিলাম কাজ আছে উপরে চলো। তখন গেলা না কেন?”” অরিন কিছু বলল না। কি বলবে? তখন তো শান্তি চৌধুরী তাঁর হাত ধরে রাখছিলেন। দিহান অরিনকে ওয়াসরুমের দরজার সাথে ঠেকে ধরলো। অরিনের কপালে চুমু এঁকে তাঁর মুখের খুব কাছে মুখটা নিয়ে দাঁড়ালো। অরিন চোখ বন্ধ করে দেয়। অনুভব করতে পারছে দিহান তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। দিহানের গরম নিশ্বাসগুলো সব তাঁর ঠোঁট মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।দিহান ডাক দেয়,”বউপাখি।”অরিন চোখ খুলে তাকায়। দিহানের নেশাভরা চোখ তাকে ঘায়েল করে দিচ্ছে। কি আছে এই দুটো চোখে? এতো নেশা কেন এই দুটো চোখে। এই চোখের দিকে তাকালে অরিন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দিহান মৃদু গলায় বলল,লেহেঙ্গাটায় তোমায় যা লাগছে না। আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উফফফ। সো হট।” অরিন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। দিহান অরিনের ঠোঁটের দিকে এগুয়। দিশা ওয়াসরুম থেকে দরজা ধাক্কিয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলো,”ওইইইইইই ইশির বাচ্চা দরজায় ঠেসে আছিস কেন?।” দিহান চট করে অরিনকে ছেড়ে চলে যায়। অরিন হাসতে হাসতে দরজা খুলে দিলো। হলুদ লেহেঙ্গায় দিশাকে একদম হলুদ পরী লাগছে। অরিন বলল,”তুমি তোমার ভাইয়ের মতো সুন্দর।” দিশা বলল,”আমি তাঁর মতো সুন্দর নয়। সে আমার মতো সুন্দর।” অরিন হেসে উঠে। দিশাকে নিয়ে বাইরে আসে।

শান্তি চৌধুরী অরিনকে কার কার সাথে পরিচিত করাতে ডেকে নিয়ে যান। দিশা হলরুমে যায়। শাওন ইশির সাথে বসে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। শাওনকে দেখে দিশা অন্যদিকে যাওয়া ধরে। ইশি দিশাকে ডেকে আনে। বলে,”দিশা দেখ এই কুত্তা কি বলে। আমাকে নাকি রানু মন্ডলের মতো লাগছে। তার নিজের চেহারা দেখনা। কিরকম কুত্তার মতো লাগছে।” দিশা একবার শাওনের দিকে তাকালো। তখন শাওন ও মাত্র তাকিয়ে ছিলো। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলে দুজনই চোখ সরিয়ে নেয়। দিশা জোরপূর্বক হেসে বলল,”হয়তো ভাইয়া তোর সাথে মজা করছে। আমি আসছি তুই বস।” দিশা চলে যায়। শাওন ইশির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে সামনে তাকাতেই দেখলো অরিন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। হলুদ রংয়ের লেহেঙ্গা হলুদ চুড়ি। কোমর সমান চুলগুলো খুলা। শাওনের চোখ আটকে গেলো অরিনের উপর। এতো ভালো কেন বাসে সে এই মেয়েটাকে? এক তরফা ভালোবাসা কেন সে ভুলতে পারছে না? ইচ্ছে করছে অরিনকে নিয়ে দূর কোথাও চলে যাক। যেখানে গেলে দিহান কেন কেউ তাদের খোঁজে পাবেন না। তারপর অরিনকে নিয়ে সুখে থাকবে সে। দিহান এসে অরিনকে কোলে তুলে সিঁড়ি নামাতে লাগলো। দৃশ্যটা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো শাওন। তাঁর ঘোর লাগা চোখে নেমে আসলো এক রাশ বিষন্নতা।

হলুদ লাগানো শুরু হলে একে একে সবাই হলুদ লাগাতে যায়। নীল লুপাকে ইশারায় বলছে লুপা যেন একটু আড়ালে যায়। লুপা ইশারায় উপরে বুঝিয়ে সে উপরে চলে গেলো। নীল চারদিকে তাকিয়ে চুপিচুপি সেও উপরে চলে গেলো। উপরে এসে নীল লুপাকে নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। লুপা চাপা গলায় বলল,”কি বলবে তারাতাড়ি বলো।
_বাসা থআকতে থেকে শুধু ইশারা দিচ্ছি আড়ালে যেতে শুনছিস না কেন?
_দেখো কি বলবে তারাতাড়ি বলো আমার ভয় লাগছে।” নীল লুপার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শিসসসস। কিচ্ছু বলবি না। না আমি তোকে কিচ্ছু বলব। শুধু দু-চোখ ভরে তোকে দেখবো।” লুপা নীলের আঙুল সরিয়ে বলল,”রাখো তোমার উছলানো প্রেম। আগে সবাইকে মানিয়ে আসো। তারপর বউ বানিয়ে নিয়ে চোখ মন সব ভরে দেখো।” বলেই লুপা চলে যেতে লাগে। নীল লুপাকে দেয়ালে চেপে ধরে বলল, “একটা ছোট আদর দে তারপর যা।
_ছাড়ো তো পাগলামি করোনা।
_মাত্র একটা। প্লিইইইইইজ।” লুপা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফোঁস করে একটা দম ছাড়লো।

অরিনকে হলুদ লাগানোর জন্য ডাকছে। কিন্তু দিহানকে পাচ্ছে না বলে অরিন যেতে পারছে না। দিহানকে খুঁজে অরিন উপরে আসলো। একটা জায়গায় এসে অরিন আহহহহহ বলে চিৎকার করে উঠলো। লুপা নীল চট করে একজন আরেকজনকে ছেড়ে দেয়। অরিন চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায়। নীল আর লুপা প্রেম করে? আর সেটা সে জানতোই না? অরিন অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে। এরকম একটা অবস্থায় এসে দুজনকে দেখবে জানলে উপরেই আসতো না। নীল শুধু মাথা চুলকাচ্ছে। লুপা মুখে হাত রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায়,অস্বস্তিতে অরিন অন্যদিকে ঘুরে চলে যায়। চুড়ির ঝনঝন শব্দ আসছে। অরিন পিছনে না তাকালেও বুঝতে পারলো লুপা চলে যেতে চাইছে নীল জোর করে আটকাচ্ছে।

অরিন দিহানকে খুঁজতে একটা রুমের দিকে যাচ্ছিলো,যে রুমে কিছুক্ষণ আগে দিহানকে দেখেছিল। অরিন রুমের পাশে আসতেই একটা হাত অরিনকে হেঁচকা টানে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আচমকা ঘটনায় অরিনের আত্মা কেঁপে ওঠে। মূহুর্তেই থরথর করে কাঁপ্তে লাগলো। ভয়ে চিৎকারও আসছে না গলা দিয়ে। ঘরটা একদম অন্ধকার। অরিনের ঘাড়ে চুমু খেয়ে অরিনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। অরিনের কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, “সো হট।” অরিনের মনে পরলো একটু আগে দিহানের বলা সেইম কথাটা। অরিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তার পাগল বরটা সত্যিই লুচু। অরিনের পেট জড়িয়ে রাখা দুটো হাতের উপর হাত রেখে বলে,”জানেন কবে থেকে খুঁজতেছি, কই ছিলেন আপনি?” অরিনের কথায় কোনো জবাব আসেনা। তাঁর ঘাড়ে একটা কামড় বসিয়ে দেয়। অরিন আর্তনাদে আহহহ বলে কুঁকিয়ে উঠে বলে,”কি করছেন এগুলা?” এবারও কোনো জবাব নেই। অরিনের ঘাড়ে চুলে নাক ডুবিয়ে শুধু তাঁর গায়ের স্মেল নিয়ে যাচ্ছে। অরিন বিরক্তি নিয়ে বলে,”কি করছেন এগুলা ছাড়েন।” বরাবরের মতো এবারও কোনো জবাব নেই। দিহান প্রতিদিন এরকমটা করে কিন্তু আজ কেন জানি অন্যদিনের মতো অরিনের ভালো লাগছে না। অরিনের কানে খুব ভারি নিশ্বাসের শব্দ আসছে। তাঁর গায়ে এসে পড়ছে তাকে ছুঁয়ে দেওয়া মানুষটার নিঃশ্বাস। কেন জানি এই নিঃশ্বাসের শব্দ এই নিঃশ্বাসের ছুঁয়া অরিনের রক্তে শীতল স্রোত বইছে না। মনেও জাগছে না কোনো ইচ্ছে,শিহরণ। অরিনের ঘাড়ে একফোঁটা জল পড়লো। দিহান কি কাঁদছে? অরিনের বুকটা ধুক করে উঠলো। তাকে জড়িয়ে রাখা অদৃষ্ট ব্যক্তির হাত ছাড়িয়ে পিছন ঘুরে তাকালো সে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অরিন হাতড়ে তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মুখে হাত দিলো। দুগাল চোখের জলে ভিজে আছে। অরিন বলল,”কা কা কাঁদছেন কেন?” অদৃষ্ট ব্যক্তি অরিনের জবাব না দিয়ে চট করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অরিন দুহাতে জড়িয়ে বলল,”প্লিজ কাঁদবেন না। আপনার বউপাখি যে কষ্ট পাবে। কি হয়েছে আপনার বলুন?” অদৃষ্ট ব্যক্তি কোনো জবাব দিলোনা। শুধু ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে গেলো। অনেক্ষণ এভাবে জড়িয়ে থাকলো। অরিন বার বার জিজ্ঞেস করলো কেন কাঁদছেন কোনো উত্তর দিলো না। একসময় অরিন রেগে গিয়ে বলল,”থাকেন আপনি। কথা বলতে হবেনা আপনাকে। আমি যাচ্ছি।” বলেই অরিন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রুম থেকে বের হয়েই সে ৪৪০ ভোল্টের শকড খেলো। তাঁর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। মাথায় আকাশ ভাঙা বাজ পড়ে। এ কাকে দেখছে সে? হলুদ রংয়ের পাঞ্জাবী পরা দিহান তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তাহলে এতোক্ষণ কার সাথে ছিলো?

চলবে,,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here