শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩৭

0
1110

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩৭
#আমিনা আফরোজ

টিফিনের বিরতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে বেড়েছে লোক সমাগম। ক্যান্টিনের পাশে সবাই ভীড় জমিয়েছে। তাই এই লোকসমাগম এড়িয়ে অনির্বাণ রোদকে নিয়ে মাঠের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে এসে দাঁড়ালো। এখানে আশে-পাশে তেমন কলাহল নেই বললেই চলে। শুধু গুটিকতক শিক্ষার্থী বসে নিজের মধ্যে গল্প করছে। মাঝে মাঝে অবশ্য তাদের হাসির ঝংকার শুনতে পাচ্ছে অনির্বাণ। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে রোদের দিকে তাকালো ও। কিন্তু কিভাবে রোদকে ওর মনের কথাগুলো বলবে বুঝতে পারছে না ও। অনির্বাণ বুঝতে পারছে ও নার্ভাস ফিল করছে এখন । নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে ওর।

এদিকে অনির্বাণকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল রোদের। অনির্বাণের সাথে এর আগে অবশ্য দু একবার কথা হয়েছিল ওর তা নেহাতই পড়ার বিষয়ে। ক্লাসের মেধাবী ছাত্রের তালিকায় অনির্বাণ একজন। তাই শুরুর দিকে নোট নেওয়ার জন্যই পরিচয় হয়েছিল অনির্বাণের সাথে। সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা । তবে আজ এত ঘটা করে এখানে নিয়ে আসার কারণ রোদের অজানা। নিরবতার রেশ কাটিয়ে রোদ নিজেই বলে উঠলো,

–“কি যেন বলবে বলেছিলে?”

রোদের কথা শুনে চমকে উঠলো অনির্বাণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ,

–“অনেক কিছুই তো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিজের কাছেই সব তালগোল পেকে গেছে এখন। তোমাকে কি বলবো বলো তো ?”

–“দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করো দেখবে সব কথা আপনা আপনি মনে পড়বে ।”

রোদের কথা মত অনির্বাণ মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগল,

–” জানিনা কথাটা কি ভাবে নিবে তুমি? তবুও আজ বলবো তোমায়। কলেজের প্রথমদিন তুমি যখন তোমার বান্ধবীর সাথে ক্লাসে হেসে হেসে প্রবেশ করছিল ঠিক তখনই তোমার হাসি দেখে ভালো লেগে যায় তোমায়। তারপর নোট নেওয়ার সুবাদে তোমার সাথে পরিচিত হয়ে তোমার ব্যবহার আর মুগ্ধতা দেখে আরেকদফা ভালো লেগে যায় তোমায়। ধীরে ধীরে ভালোলাগাটা পরিবর্তিত হয়ে যায় ভালোবাসায়। ক্রমশ তোমাতে আসক্ত হয়ে পড়ি আমি। তাই আজ নিজের অনুভূতিগুলোর সাথে তোমায় পরিচয় করাতেই নিয়ে এসেছি।”

অনির্বাণের কথাগুলোর রোদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে আছে রোদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল,

–” এসব তুমি কি বলছে অনির্বাণ? তুমি কি সব ভুলে বসে আছো?”

–“এত বিচলিত হবার কিছু হয়নি রোদ। আমি তোমার কাছ থেকে আজকেই আমার প্রস্তাবের উত্তর চাচ্ছি না। দিন কতেক ভেবে তারপরে না হয় উত্তর জানিও আমায়।”

–“তুমি কি আমার আর তোমার মাঝে ধর্মের যে বিশাল দেয়াল আছে তা ভুলে গেছো? তাছাড়া আমি শতভাগ নিশ্চিত আমার প্রতি তোমার শুধু মোহ পড়েছে যা কাটিয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগবে না তোমার।”

রোদের কথা শুনে অনির্বাণের মুখে হাসি মিলিয়ে গিয়ে গম্ভিরতা ফুটে উঠল। কিছু সময় পর ও রোদের কাছে এসে রোদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

–” তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো যদি শুধু ভালোলাগা থেকে হতো তবে তোমাকে আমি সে কথা বলতাম না । ভালোলাগাটা মনেই রেখে দিতাম । আর রইল ধর্মের কথা , আমি হিন্দু বলে কি তোমাকে ভালবাসতে পারব না? ভালোবাসতে গেলে বুঝি ধর্ম দেখে ভালবাসতে হয় ?”

–“দেখো……..

রোদের কথা শেষ না হতেই পিছন থেকে নেহালের কথা শুনতে পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো রোদ। তখনো রোদের হাত অনিবার্নের হাতের মুঠোয় বন্দি ছিল ।

অনির্বাণ আর রোদের পিছু পিছু নেহালও চলে এসেছিল কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে। তবে দুজনের থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব দাঁড়িয়েছিল ও। দুজনের কথোপকথন শুনতে না পেলেও অনির্বাণের হাতের মুঠোয় রোদের হাতের অস্তিত্ব দেখে রেগে গেল ও । তাই ওদের উদ্দেশ্যে ধমক দিল পেছন থেকে । তারপর এগিয়ে গেল ওদের দিকে।

–” কি হচ্ছে এখানে?”

নেহালের উপস্থিতি এ মুহূর্তে রোদ ও অনির্বাণ দুজনের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।নেহালের কন্ঠ শুনে অনির্বাণ দ্রুত রোদের হাত ছেড়ে দিয়ে রোদের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। তারপর মাথা নিচু করে নিচুস্বরে বলল,

–“কিছু না স্যার।”

অনির্বাণের কথা শুনে নেহাল ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

–” কি হচ্ছিলো তা তো নিজের চোখেই দেখলাম ।”

নেহালের কথা শুনে অনির্বাণ আবারো বলে উঠলো,

–“স্যার, আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়।”

নেহাল গম্ভীর করে বলল,

–” অনির্বাণ তুমি আপাতত ক্লাসে চলে যাও আমার রোদের সাথে কিছু কথা আছে।”

অনির্বাণ নিহালের কথা শুনে ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে গেল ক্লাস রুমের দিকে । অনির্বাণের চলে যাওয়ার পর নেহাল রাগী দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকালো। তারপর বলে উঠলো,

–“কি হচ্ছিলো এখানে?”

–“তেমন কিছু নয় আপনি হঠাৎ এখানে এলেন যে?”

–“সেই কৈফিয়ৎ কি আমি তোমাকে দিব? তার আগে বলো অনির্বাণের সাথে তুমি এখানে এলে কেন?”

–“অনির্বাণই ডেকে নিয়ে আসলো আমাকে।”

–“একজন তোমাকে ডেকে নিয়ে আসলো আর তুমি ধেই ধেই করতে করতে চলে এলে তার সাথে তাই তো?”

–“তো কেউ ডাকলে তার কথা শুনবো না?”

–“না শুনতে হবে না তোমাকে।”

–“কেন শুনতে হবে না?”

রোদের কথা শুনে নেহালের রাগ যেন আরো বেড়ে গেল। রেগে বলল,

–“এই যে তুমি অনির্বাণের কথা শুনে ধেই ধেই করতে করতে ওর সাথে চলে এসেছো তার ওপর আমার আমার মুখে তর্ক করছো এইজন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।”

–“কিন্তু আমি তো কোনো ভুল করেছি বলে আমার মনে হয় না।”

–“চুপ আমি যা বলেছি তাই করতে হবে তোমাকে।”

কথাগুলো শেষ করে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে আবারও হ রোদের উদ্দেশ্যে নেহাল বলে উঠলো,

–“টিফিনের সময় শেষ হতে এখনও মিনিট ত্রিশেক বাকি আছে। এই 30 মিনিট তুমি কাঠ ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

নেহালের কথা শুনে রোদ অবাক হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

–“আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন । যদি আমি এই রোদে ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে মনে হয় না আমি আর বেঁচে থাকব।”

–“কোনো অজুহাত শুনবো না তোমার। আজকে শাস্তি তোমায় পেতেই হবে তোমাকে। আজকে শাস্তি দিলে পরে কোনদিন অন্য কারো ডাকে এভাবে ধেই ধেই করে আসবে না ।”

–“আপনি কি জানেন আপনি একটা বদ লোক।”

–“ধন্যবাদ আমাকে এমন উপাধি দেওয়ার জন্য কিন্তু এখন যদি তুমি আমার শাস্তি না মেনে নাও তবে শাস্তি কিন্তু আমি আরো দ্বিগুন করে দেবো এখন তুমি ভেবে দেখো কি করবে?”

রোদ নেহালের দিকে তাকিয়ে বুঝল আজ আর কোন কথা শুনবে না নেহাল তাই গুটি গুটি পায়ে দুপুরের এই রোদে গিয়ে দাঁড়াল। এদিকে রোদকে রোদে দাঁড়াতে দেখে নেহাল আবারো বলে উঠলো,

–“এখান থেকে একদম নড়বেবে না । আমি আবার কেবিন থেকে তোমার উপর লক্ষ্য রাখবো 30 মিনিট।”

কথাগুলো বলে রোদের দিকে পৈশাচিক হাসি দিয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেল এদিকে রোদ মেয়েদের উদ্দেশ্যে মনে মনে হাজারো গালি দিতে লাগলো।

এদিকে সন্ধ্যা শ্রাবনের অফিসে ঢুকে রিসেপসনিস্টের কাছে গিয়ে দাঁড়লছ রিসেপসনিস্ট মেয়েটি বলল,

–“হ্যালো ম্যাডাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

–“আপনাদের শ্রাবণ স্যার আছেন কি?”

–“জি স্যার তো অফিসেই আছেন তবে স্যার একটু মিটিংয়ের কাজে ব্যস্ত আছেন।”

–“মিটিং কখন শেষ হবে বলতে পারবেন?”

–“এইতো আর একটু পর স্যারের মিটিং শেষ হবে। আপাদত আপনি এখানে একটু বসুন ।স্যারের মিটিং শেষ হলে আমি আপনাকে ডেকে দেবো।”

–“ঠিক আছে ধন্যবাদ।”

–“ওয়েলকাম ম্যাডাম কিন্তু আপনার নামটা তো জানা হলো না?”

–“আমার নাম সন্ধ্যা ।আপনার সাথে আমার নাম বললেই চিনবে।”

–“ঠিক আছে আপনি এখানে বসুন স্যারের মিটিং শেষ হলে আমি স্যারকে আপনার কথা বলব।

সন্ধ্যা অগত্যা খাবারের বক্স নিয়ে সেখানে বসল। টেবিলের উপর খবরের কাগজ চোখে পড়তেই কাগজ দিয়ে হাতে নিলো সন্ধ্যা। সময় কাটানোর জন্য এখন খবরের কাগজে উত্তম পন্থা। বেশ কিছুক্ষণ পর রিসেপশনিস্ট মেয়েকে শ্রাবনকে কল করে বলল,

–“হ্যালো স্যার সন্ধ্যা নামের একজন ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”

সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–” কখন এসেছে?”

–” বেশ কিছুক্ষণ হবে স্যার।”

–“আর তুমি আমাকে এখন বলছ? যাই হোক ওনাকে পাঠিয়ে দাও আর শোনো এরপর যদি কখনো উনি আমার অফিসে আসেন তাহলে ওনাকে বসিয়ে রাখবে না। উনার জন্য আমার কেবিনের দরজা সব সময় খোলা । ইনি তোমাদের ম্যাডাম। বুঝতে পেরেছো আমার কথা।”

–“জি স্যার ঠিক আছে। আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি ম্যাডামকে।”

শ্রাবণের সাথে কথা শেষ করে রিসেপসনিস্ট মেয়েটি সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–“আমি আপনাকে চিনতে পারিনি ম্যাডাম এ জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

–“সন্ধ্যা মেয়েটির কথা শুনে হেসে বলল,

–‘ ইটস ওকে।”

তারপর মেয়েটির দেখানো পথ দিয়ে শ্রাবণের কেবিনে চলে গেল সন্ধ্যা। সন্ধ্যা কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে চলে গেল। শ্রাবণ তখন কেবিনেই ছিল। সন্ধ্যা লক্ষ্য করলো শ্রাবন ওকে দেখার পরও চুপচাপ রয়েছে এর অর্থ জনাবের এখনো রাগ ভাঙ্গেনি। আচ্ছা ও যে শ্রাবনের জন্য এত কষ্ট করে শাড়ী পড়ে এলো তা কি শ্রাবণের চোখে পড়ছে না?

সন্ধ্যা হেসে শ্রাবণকে বলল,

–“আজ আমি আপনার জন্য বাড়ি থেকে দুপুরে খাবার নিয়ে এসেছি।”

শ্রাবন সন্ধ্যার দিকে না তাকিয়ে বলল,

–“টেবিলে রেখে যাও। আমি পরে খেয়ে নেব।”

শ্রাবণের এমন কথা শুনে সন্ধ্যার দু-চোখ পানিতে ভরে উঠলো। তাহলে কি শ্রাবণের রাগ কমবে না?

তবুও কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,

–“আমি নিজ হাতে আপনাকে খাইয়ে দিলে আপনার কি খুব অসুবিধা হবে?”

–“নিজের হাতে খাইয়ে দিতে হবে কেন আল্লাহ আমাকে হাত দিয়েছেন আমি আমার হাত দিয়ে খেতে পারি।”

–“তাহলে কি আমি চলে যাব?”

–“সে তোমার ইচ্ছা। আমার কোন কথাই বা শুনেছো যে এখন আমার অনুমতি চাইছো।”

–“আপনি কি এখনো রেগে আছেন আমার উপর?”

–“তোমার ওপর রাগ করার অধিকার আছে নাকি আমার?”

–“এমন করে কথা বলছেন কেন আমার সাথে?”

–“তো কি করব?”

সন্ধ্যা অভিমানী গলায় বলল,

–“আমি থাকাতে আপনার বোধহয় কাজে অসুবিধা হচ্ছে আমি বরং খাবারটা রেখে যাচ্ছি আপনি সময় মতো খেয়ে নিবেন।”

শ্রাবন সন্ধ্যার কথাল কোনো প্রতি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। আপাতত ও সন্ধ্যার সাথে রেগে আছে। কোন কথা বলবেনা ও সন্ধ্যার সাথে।

চলবে

(আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো থাকবেন।হ্যাপি রিডিং ???)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here