শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩৬
#আমিনা আফরোজ
ঘড়িতে তখন একটা বাজে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে পুরো শহর যেন ঝলসে যাচ্ছে। অসহ্য এই সূর্যের তাপে ঘেমে গেছে সন্ধ্যা। শ্রাবনের জন্য আজ ও নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে পিঠ বরাবর। চোখে ঘন কাজল আর ঠোঁট হালকা গোলাপি রঙে রাঙিয়েছে ও। এক কথায় আজ নিজেকে সম্পূর্ণ সাজিয়েছে শ্রাবনের পছন্দে।
উত্তপ্ত গরমে অতিষ্ঠ সন্ধ্যা। কাঠফাঁটা এই গরমে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ হলে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু গাড়ির কোন নাম নিশানা দেখতে পাচ্ছে না ও। সন্ধ্যার শাশুড়ি অর্থাৎ মিসেস রাবেয়া বেগম সন্ধ্যাকে অনেকবার নিজেদের গাড়ি নেওয়ার কথা বলেছেন কিছু মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সন্ধ্যার বাড়ি থেকে গাড়ি নেওয়ার ইচ্ছেটা আপাতত মরে গেছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা শ্রাবনের পছন্দের খাবার ভাত আর কোষা মাংস রেঁধে রান্নাঘর থেকে বেরোতেই মনোয়ারা বেগমের সাথে দেখা হয়েছিল সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকে এই সময়ে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–“কি ব্যপার এতো হন্তোদন্ত হয়ে কোথায় ছুটে চলেছো?”
মনোয়ারা বেগমকে দেখে এমনিতেই ভয়ে তটস্থ থাকে সন্ধ্যা।তার ওপর এমন ধমকানিতে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল ও। নিজেকে কোন রকমে সামলিয়ে বলল,
–“ফ্রেশ হতে যাচ্ছি ফুপি।”
–” ফ্রেশ হতে যাচ্ছ ভালো কথা তবে এমন ছুটাছুটি করছো কেন? বলি এত বড় বাড়িটা কি খেলার মাঠ পেয়েছো নাকি?”
–“আসলে একটু তাড়াহূড়োতে ছিলাম তো তাই ….
সন্ধ্যাকে কথা থামিয়ে দিয়ে মনোয়ারা বেগম আবারো বলতে লাগলেন,
–“তাই তুমি সারা বাড়ি ধেই ধেই করে নেচে বেড়াচ্ছো। তা কিসের এতো তাড়াহুড়ো তোমার শুনি?”
–“ফুপি আজ একটু ওনার অফিসে খাবার নিয়ে যাব তাই দ্রুত রান্না শেষ করে ফ্রেশ হতে যাচ্ছিলাম।”
সন্ধ্যার কথা শেষ হতেই মিসেস রাবেয়া বেগম ছুটে এলেন সেখানে। সবেমাত্র নামাজ শেষে দাঁড়িয়েছেন তিনি এমন সময় মনোয়ারা বেগমের চেঁচামেচি শুনে এদিকে ছুটে এসেছেন । মনোয়ারারা বেগমের সাথে সন্ধ্যাকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন,
–“কি ব্যাপার সন্ধ্যা তুমি এখনো ফ্রেশ হও নি। সময় তো গড়িয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণের জন্য দুপুরে খাবার নিয়ে যাবে কখন তুমি?”
–“আমি ফ্রেশ হতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু ফুপি…
সন্ধ্যার কথা শুনেই রেগে গেলেন মনোয়ার বেগমক । সন্ধ্যার থেকেও ওনার এখন ভাইয়ের বউয়ের প্রতি রাগ ওঠছে বেশি। বউয়ের প্রতি এতো আদর আসে কই থেকে তার? কই তার মেয়েকে তো এমন আদর করে না?আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। তাই কপট রাগ নিয়ে বললেন,
–“আমি কি?কি করেছি আমি তোমায়? আর ভাবি তোমাকেও বলি হাঁড়ি ছেলের বউকে এতো প্রশয় দিচ্ছো কেন?”
–“প্রশয় কেন দিবো মনু? তুমি যে কি হলো না মনু।”
–“তো কি করছো তুমি?ওকে এমন লাই দিচ্ছো কেন? ওর শ্রাবনের অফিসে খাবার নিয়ে যাবারই বা কি দরকার বলো তো? শ্রাবণ তো সব সময় বাহিরেই দুপুরের খাবার খায়।”
–“আহা ওদের সবে বিয়ে হয়েছে ওদের। দু-দুজনকে না চিনলে বাকি জীবন একসাথে কাটাবে কি করে বলো তো?”
–“তাই বলে….
মনোয়ারা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে মিসেস রাবেয়া বেগম বলে উঠলেন,
–“তুমি আর এ নিয়ে কথা বাড়িয়ো না মনু। সন্ধ্যা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে শ্রাবনের জন্য খাবার নিয়ে ওর অফিসে যাও। আর শুনো যাওয়ার সময় বাসার গাড়ি নিয়ে যেও। আমি ডাইভারকে আগেই বলে রেখেছি তোমার কথা।”
সন্ধ্যাকে গাড়ি নিয়ে যাবার কথা শুনেই মনে মনে ফন্দি আটলেন মনোয়ারা বেগম। তিনি ভাবলেন সন্ধ্যা যেহেতু গ্রামের মেয়ে তাই সন্ধ্যা হয়তো গাড়ি ছাড়া শ্রাবনের অফিস অবদি যেতে পারবে না । আর সন্ধ্যা শ্রাবণের অফিসে না যায় তাহলে ওরা দুজনে কাছাকাছি আসতে পারবে না। তাহলে ওদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আর পাঁচ-দশটা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মতো হবে না। এতে করে তুলিকে শ্রাবনের সাথে বিয়ে দেওয়াটা আরো সহজ হয়ে যাবে মনোয়ারা বেগমের কাছে। তাই তিনি বলে উঠলেন,
–“আমি তো আজ অনাত আশ্রম এ যেতে চাইলাম ভাবি। তাই গাড়িটা যদি আমাকে দিতে ভালো হতো।”
–“কিন্তু…
–“ভাবি তুমি জানো তো ঢাকা শহরের সবকিছুতে আমন আমি চিনি না। গাড়ি নিয়ে গেলে আমার জন্য ভালো হতো । কিন্তু তুমি যদি এখন তোমার ছেলের বউকে ঝাড়ি দিতে চাও তাহলে আর কি করার আছে বলো?”
মনোয়ারা বেগমের কথা শোনা সন্ধ্যা বলে উঠলো,
–“ফুপু আপনি বরং গাড়ি নিয়ে যান। আমি অন্য গাড়ি করে ওনার অফিসে চলে যাব।”
সন্ধ্যার কথা শুনে মিসেস রাবেয়া বেগম আর মনোয়ারা বেগমকে তেমন কিছু বললেন না। তখনকার মত যে যার কাজে চলে যায়। সন্ধ্যা নিজের মত দ্রুত ফ্রেশ হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা ট্যাক্সির দেখা পেল সন্ধ্যা। সন্ধ্যা শ্রাবণের অফিসের ঠিকানা বলে বিসমিল্লাহ বলে গাড়িতে উঠে পড়ল। প্রায় 45 মিনিটের মাথায় গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো ও। তারপর ভাড়া মিটিয়ে হাতে রাখা টিফিন বক্স নিয়ে চলে গেল শ্রাবণের কেবিনের উদ্দেশ্য।
এদিকে টিফিন আওয়ারে ক্যান্টিনে তুলি আর প্রিয়ন্তীর সাথে চুপচাপ বসে আছে রোদ। তুলি আর প্রিয়ন্তির মুখে কথার ফুলঝুরি থাকলেও রোদ কখনো চুপচাপ বসেছিল। রোদদের থেকে কিছু দূরে নেহাল বসেছিল। আসলে নেহালের আজকে কেবিনে বসে খেতে ভালো লাগছিল না তাই ক্যান্টিনে এসেছে ও। ক্যান্টিনে ঢোকার সময়ই রোদের দিকে নজর পড়ে ওর। তাই রোদের সামনের টেবিলে বসে পড়ে নেহাল। আজ কেন যেনো রোদকে দেখার প্রবল তৃষ্ণা জেগেছে নেহালের মনে। এ যেন অন্য রকম এক তৃষ্ণা। ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকেও রোদের মায়াবী মুখের দিকে হাজারবার তাকিয়েছে ও। নিজের এহেন কান্ডে নিজের মনকেই শাসিয়েছে বারংবার তবুও অবাধ্য মনটাকে কিছুতেই বাধ্য করতে পারছে না নেহাল। অবাধ্য মনটার সাথে সাথে চোখ দুটো যেন অবাধ্য হয়ে উঠেছে ওর। নেহাল যখন ওর ভাবোনাতে মত্ত ঠিক তখনই রোদের ক্লাসের এক ছেলে রোদদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলেটি শ্যামবর্ণ হলেও চোখে মুখে ছিল মায়ার আবরন। আকস্মিকভাবে ছেলেটিকে রোদদের টেবিলে দেখে ভ্রূ-কুঁচকে গেল নেহালের। ছেলেটির পরবর্তী কি করতে চলছে তা বুঝতে চেষ্টা করল নেহাল।
ছেলেটির নাম অর্নিবান। রোদের সাথে একই ক্লাসেই পড়ে। মেধাবী ছাত্র। দেখতে শ্যামবর্ন তবে ছেলেটির দুচোখে রয়েছে গভীর মায়া।অর্নিবানের কলেজের প্রথম দিনই রোদকে দেখে ভালো লেগে যায়।তা পরবর্তীতে রূপ নেয় ভালোবাসায়। আজ নিজের লুকানো অনুভূতিই প্রকাশ করতে এসেছে রোদের কাছে। তাই সাহস সঞ্চয় করে রোদকে বলে,
–“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল রোদ। একটু ক্যান্টিনের বাহিরে যাবে ?”
রোদ অবাক হয়ে বলল,
–“যা বলার এখানেই বল না অনির্বাণ।”
–“কথাটা খুবই ব্যক্তিগত রোদ। একটু বোঝার চেষ্টা করো। কথাটা যদি এখানে বলা যেত তাহলে এখানেই বলতাম আমি।”
অনির্বাণের কথা শুনে প্রিয়ন্তী হেসে বলল,
–“কি এমন লুকানো কথা বলবে রোদকে তা আমাদের সামনে বলা যাবে না। তা আমাদেরও একটু বলো আমরাও শুনি তোমার সিক্রেট কথা।”
অনির্বাণ প্রিয়ন্তীর কথা শুনে মাথা চুলকে মুচকি হেসে বলল,
–“সিক্রেট কথাটা না হয় রোদের থেকেই শুনে নিও।”
তারপর আবারো রোদকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
–“কি ব্যাপার এখনো বসে থাকলে যে চলো।”
–“ঠিক আছে চলো তবে।”
এদিকে নেহাল রোদ আর অনির্বাণের কথাগুলো স্পষ্টই শুনতে পেলো। অনির্বাণের সাথে রোদকে যেতে দেখেই রেগে গেল নেহাল। অনির্বাণের সাথে যাওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল রোদের?হাত মুঠো করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার শত চেষ্টা করেও তা বিফল হলো নেহাল। নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে রোদ আর অনির্বাণের পিছু পিছু চলে গেল ও। আজ এই অপরাধের শাস্তি রোদকে ও দিবেই।
চলবে
(আসলামু আলাইকুম। আজকের পর্ব টি কেমন হয়েছে জানাবে আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গল্পের আপডেড পেতে আমার নতুন পেজটিকে লাইক দিয়ে রাখবেন।গল্প নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলে তা কমেন্ট এ জানাবেন। ভালো থাকবেন সবাই।)