শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-৩৪

0
1110

শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-৩৪
#আমিনা আফরোজ

সকাল তখন নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। রূপগঞ্জের বাস স্ট্যাডের পাশেই ডানদিকে বসেছে গ্রামের ছোট বাজার।অনেক গৃহস্থই সেখানে তাদের ক্ষেত থেকে তুলে আনা শাকসবজি আর নদী থেকে সদ্য ধরে আনা ছোট-বড় হরেক রকমের মাছ নিয়ে বসেছে। ছোট্ট এ বাজারে খুব একটা লোকের সমাগম না থাকলেও মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক দেখা যাচ্ছে সেখানে। কেউবা তখন ব্যস্ত শাক-সবজীর দরদামে আবার কেউবা ব্যস্ত এ-দোকান থেকে সে -দোকান ঘুরে ঘুরে শাক-সবজি আর মাছ দেখতে। তাদের হই-হট্টগোল আর হৈচৈ এ মুখরিত রূপগঞ্জের ছোট্ট বাজারটি।

বাজারের বাম পাশে রয়েছে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। গ্রামের হরেক পেশার লোক সে দোকানে বসে গল্পগজব করতে করতে চা খায়। মিন্টু চায়ের দোকানের সামনে এসে দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চটিতে বসে দোকানীর উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলল,

–” ঐ রাজু আমারে এক কাপ কড়া লিকারের চা দে তো।”

মিন্টুর হাঁক শুনে বিরক্ত হলো দোকানের মধ্য অবস্থানরত মাঝবয়সি ছেলেটি।ছেলেটির ডাক নাম রাজু।বয়স বছর ছাব্বিশ হবে। রূপগঞ্জের ই বাসিন্দা ও। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল না।চায়ের এই ছোট্ট দোকানের ওপর নির্ভর করে চলে ওর পরিবার। তবে ধানের মৌসুমে ধান কাটে অনেক গৃহস্থের বাড়িতে। তখন একটু বাড়তি টাকার যোগান হয়। আজ সকাল থেকে রাজুর চায়ের দোকানে খদ্দেরে দেখা নেই তার উপর মিন্টু মিয়ার মতো উটকো ঝামেলা আসায় একটু বিরক্ত আজ রাজু। মিন্টুকে ঝামেলা বলার পিছনে অনেক কারন রয়েছে রাজুর কাছে। রাজুর দোকানে দিনের পর দিন মিন্টুর বাকি খাতার পরিমান বেড়েই চলেছে কিন্তু মিন্টু মিয়ার সেই টাকা পরিশোধ করার খবর নেই। রোজ সকালে এসে চা খেয়ে দামটা বাকির খাতায় লিখে রাখতে বলে আবারো গ্রামের পথের দিকে চলে যায় সে। কিন্তু বছরের পর বছর বকেয়া টাকা জমা হলেও মিন্টু তা পরিশোধ করে না। তাই মিন্টুর মিয়ার বাকি খাতাটাও অযত্নে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার কাজের লোক বলে মিন্টুকে কেউ বেশি ঘাটায় না। এতে অবশ্য মিন্টুরই লাভ হয়েছে ঢের।

রাজু চা নিয়ে না আসায় আবারো হাঁক ছাড়ল মিন্টু।

–“কিরে রাজু এহনো চা দিলি নারে?”

মিন্টুর ডাকে রাজু দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

–” একটুখানি অপেক্ষা করন লাগতো মিয়া। পানি কেবল চুলায় বসাইছি। চা হইতে দেরি হইব।”

মিন্টু বিরক্তি মাখা মুখে বলল,

–” ঠিক আছে। কি আর করনের আছে। হামি বইসা আছি। তুই চা কইরে হামাক দে।”

রাজুর বিরক্তি নিয়ে চলে গেল দোকানের ভিতর। ও ভেবেছিল দেরি হওয়ার কথা শুনে মিন্টু হয়তো চলে যাবে কিন্তু এই ছেচরা লোকটা তো উল্টো আরো জেকে বসলো ওর দোকানে । রাজু রাগে গজরাতে গজরাতে পানি ভর্তি কেটলিতা চুলায় বসিয়ে দিল।

এমন সময় রূপগঞ্জের ছোট বাসস্ট্যান্ডে এসে থামল গতকালের ঢাকা থেকে রওনা দেওয়া বাসটি। বাসটি থেকে নামল সাদা রংয়ের শার্ট-প্যান্ট পরিহিত একটি মেয়ে। চোখে মুখে তার শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া। হাতে রাখা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল রাজুর সেই ছোট্ট চায়ের দোকানের দিকে।

এদিকে রোদ কলেজ এসেই প্রিয়ন্তী আর তুলির কাছে নিজের ব্যাগ রেখে নেহালের কেবিনের দিকে ছুটে এসেছে। মিনিট পাঁচেকের পথটুকু পেরোতেই আজ যেনো রোদ হাঁপিয়ে উঠেছে । কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে হাপাতে লাগল রোদ। নেহাল তখন ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । রোদকে এভাবে দেখে অবাক হয়ে বলল,

–” কি ব্যাপার এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন? কারো কোন জিনিস চুরি করে পালিয়ে এসেছে নাকি? নেপালের কথা শুনে রোদ চোখ রাঙিয়ে বলল,

–“আমাকে দেখে কি আপনার চোর মনে হয় ?”

নেহাল ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,

–” মনে না হওয়ার কি আছে? তোমাকে ভরসা হয় না আমার। কি থেকে যে কি করে বসবে তা আল্লাই জানে । ”

রোদ কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই মনে পড়লো শ্রাবণের বলা কথাগুলো। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে নেহালকে বলল,

–“আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল?”

–“কি কথা ?”

নেহালের প্রশ্নের জবাবে রোদ সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনা নেহালকে বলতে লাগল । রোদের কথা শুনে নেহাল মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে রইল । মনোয়ারা বেগমের কথাগুলো শুনে আচমকাই রাগ উঠেছে নেহালের। রোদকে বলা কথাগুলো কিছুতেই মানতে পারছি না ও। আজ হঠাৎ রোদের প্রতি এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ কি? নাকি বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের টানেই এমন অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নেহালের মন ও মস্তিষ্কে। তাহলে কি নেহাল ভুলে যাবে ওর শ্যামলতাকে?

নেহালকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে এসে রোদ বলল,

–“কি হলো আপনি এমন চুপ করে বসে আছেন কেন? কিছু একটা ভাবুন না হলে আমি আমার পরিবারকে হারাবো।”

রোদের ডাকে নেহাল ওর ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” কাউকে হারাতে হবে না তোমায়। আমি গত রাতে আমার বাবার সাথে কথা বলেছি। ওনারা খুব শীঘ্রই তোমাদের বাসায় যাবেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তুমি আর এই নিয়ে কোন চিন্তা করো না।

–” কিন্তু ভাইয়া…..

রোদকে আর বলতে না দিয়ে নেহাল বলল,

–“ভাইয়ার চিন্তা আমাকে করতে দাও। তুমি এখন ক্লাসে চলে যাও। এই সময় আমার কেবিনে তোমাকে কেউ দেখলে হয়তো অন্য কিছু বানিয়ে ফেলবো। আর জানতো মানুষের কথা বাড়াতে খুব একটা সময় লাগে না। মেয়েদেরও গায়ে কলঙ্ক লাগতেও সময় লাগে না।”

নেহালের কথা শুনে রোদ আর না বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত রোদ।নেহাল যখন বলেছে তখন সবকিছু নিজেই সামলে নিব। নিশ্চুপ বারান্দায দিয়ে গুটি গুটি পায়ে রোদ চলে গেল ক্লাসের দিকে।

এদিকে রোদ চলে যাওয়ার পরেও নেহাল তখনো ভেবে চলেছে অনেক কিছু। নিজের অজান্তেই রোদের জন্য অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়েছে নেহালের মনে।তার ওপর গতকাল রাতে ওর বাবার বলা কথাগুলোও ভাবাচ্ছে ওকে।

গতকাল রাত আনুমানিক দশটার দিকে নেহাল কল দিয়েছিল ওর বাবাকে। সামাদ মিয়া তখনো জেগে ছিলেন কাজ করছিলেন। নেহাল চলে যাওয়ার পর সব কাজই এখন একা করতে হয় ওনাকে। নেহাল বুদ্ধি খাটিয়ে সেই সময় ই কল দেয় বাবাকে। নেহাল জানে এখন একলা পাওয়া যাবে ওর বাবাকে। সামাদ মিয়া কল রিসিভ করেন তখনি।

–“হ্যালো আব্বা কেমন আছেন আপনে?”

–“ভালো আছি বাবা। আপনারা কেমন আছেন?”

–“হামরা আর কেমন থাহি।আফনেরে ছাড়া ভালা নাই হামরা।”

–” বাবা আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো আমার।”

–“কি কথা আব্বা?”

–“আপনাকে আর আম্মাকে তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসতে হবে।”

ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে চেয়ারম্যান সামাদ মিয়া অবাক হয়ে বলল,

–“ঢাকা যাওন লাগবো ক্যান আব্বা? আপনার কোন সমস্যা হইছে নি আব্বা?”

–“না বাবা সমস্যা হয় নি । আপনি ঢাকায় আসেন তখন নাহয় সব বলবো।”

–“ঠিক আহে আব্বা। হামি বাসায় গিয়া আপনের আম্মারে বলব নি ঢাকা যাওনের কথা।”

–“ঠিক আছে ভালো থাকবেন আব্বা। আম্মাকেও আমার সালাম জানাবেন।”

–“ঠিক আছে আব্বা আফনিও ভালো থাকবেন।”

গতকাল বাবার সাথে কথা বলবে নেহাল ভেবেছিলো আগে বাবা-মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে ও তারপর ওনাদের বুঝিয়ে রোদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবে তবে সন্ধ্যার কথাটা কিছুতেই বুঝতে দিবে না ও। হঠ্যাৎ ক্লাসের ঘন্টা পড়ায় গতকালের ভাবনা থেকে বেরিয়ে কেবিন থেকে ক্লাসের দিকে চলে গেল রোদ। এসব ভাবনাগুলো আপাতত দূরে থাকুক।

চলবে

(আসসালামু আলাইকুম।জানি রেগে আছেন আপনারা কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। গতকাল রাতে কারেন্ট চলে যাওয়ার পর ফোনে চার্জ না থাকায় লিখতে পারি নি। তাই সকালে ওঠে লিখলাম। অপেক্ষা করানোর জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী আমি। আজকের পর্বটা কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু।আপনাদের মন্তব্য জানলে আমার লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়।ভালো থাকবেন সবাই।গল্প হয়তো ঈদের আগের দিন পাবেন আবার। ভালো থাকবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here