শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:- ৩১
#আমিনা আফরোজ
মধ্যরাতে হঠাৎ নেহালের কল পেয়ে অবাক হয়ে গেছে রোদ। ও ভেবেছিল নেহাল হয়তো ওকে আজ আর কল করবে না। কিন্তু রোদের ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত করে নেহাল ওকে কল দেয়। তাই তুলি আর প্রিয়ন্তীর থেকে দূরে বারান্দায় চলে যায় রোদ।
বারান্দায় এসে এককোণে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ফোনটিতে আসা নেহালের কল রিসিভ করে রোদ । এর আগে কোনদিন নেহালেরর সাথে ফোনে কথা হয়নি ওর তাই আজ হঠাৎ নেহালের সাথে ফোনে কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে রোদের । কাঁপুনি কন্ঠে কোন রকমে বলল,
–“হ্যালো।”
–” এতক্ষণ কোথায় ছিলে বলো তো? সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি তোমায় কিন্তু তুমি রিসিভ করছো না কেন?”
–” আমি আসলে প্রিয়ন্তি আর তুলির সাথে কথা বলছিলাম তাই বুঝতে পারি নি।”
–“তোমাকে কে কি কিছু বলেছে নাকি?”
–“না আমাকে না বললেও ভাইয়া বলেছে আপনার ব্যাপারে খোঁজখবর নিবে।”
–“এইটা আগেই অনুমান করেছিলাম। ঠিক আছে এই নিয়ে চিন্তা করো না তুমি।এদিকটা আমি সামলিয়ে নিবো।”
–” তা না হয় নিবেন কিন্তু আমি একটা কথা এখনো বুঝতে পারছি না ।”
–“কি এমন কথা যে তুমি এখনো বুঝতে পারছো না শুনি। এমনিতেই তো সবসময় এক লাইন বেশিই বুঝো।”
নেহালের কথা শুনে রোদ রেগে বলল,
–“আপনি কি এই মাঝরাতে আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য কল দিয়েছেন?”
–” না আজ তো রীতি অনুযায়ী আমাদের বাসর রাত।এমন রাতে কি ঝগড়া করার জন্য কেউ কল দেয় নাকি। অন্তত আমি এতটাও নিরামিষ নই ।”
–“ছি ছি কি সব অশ্লিল কথা বলছেন আপনি ?”
–“বউয়ের কাছে সব ছেলেরাই এমন কথা বলে। একে অশ্লিল বলতে হয় না বউ।”
–“আপনি মানুষটা আসলেই খারাপ।”
কথাটা বলেই রোদ নেহালকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আচমকা কল কেটে দিল। নেহালের এমন কথা শুনে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে রোদকে। বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নেহালের কথা ভাবছে ও।নেহালের বউ বলে কথাটা এখনো ওর কানে বাজছে।তাহলে কি নেহাল ও ওকে ভালোবাসে। রোদের এখন মনে হচ্ছে নেহালকে বিয়ে করে কোন ভুল করে নি ও। আসলেই কি ভুল করে নি রোদ ?
এদিকে রোদকে এমন আচমকা ফোন কাটতে দেখেই রাগ হলো নেহালের। ও কি ইচ্ছে করে কল দিয়েছে নাকি রোদকে। ও তো সন্ধ্যার কথা আর ঐ বাড়িতে ওর অনুপস্থিতিতে আর কি ঘটেছে তা জানতেই কল করেছিল।এমনিতেও ওর বলা ঘটনাটা যে করেই হোক সত্য বলে দেখাতে হবে তাছাড়াও ওর বাবা – মা কেউ গ্রাম থেকে এনে রাজি করাতে হবে এগুলো নিয়ে ভাবতেই সময় যাচ্ছে নেহালের। এদিকে তার ওপর এই মেয়ের অতিরিক্ত নেকামি অসহ্য লাগছে ওর কাছে। তবুও নিজেকে অতি কষ্টে শান্ত করল ও। রোদকে এখন কোন ভাবেই রাগিয়ে দেওয়া যাবে না। রোদকে এখন খুব প্রয়োজন ওর। রোদই যে একমাত্র সন্ধ্যার কাছে যাওয়ার মাধ্যম। তাই নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করে রোদের ফোনে আবারো কল দিল নেহাল। কিন্তু বার তিনেক কল দিয়েও রোদ রিসিভ না করায় এবার একটা মেসেজ দিল রোদকে। মেসেজ পাঠিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বলল,
–” আমি জানি আমি যা করছি ঠিক করছি না তবে এছাড়া আমার আর করার কিছুই নেই।তবে তুমি চিন্তা করো না রোদ তোমার জীবনটা যখন আমিই নষ্ট করেছি তখন আমিই না হয় তোমার জীবন আবার নতুন করে সাজিয়ে দিব। সন্ধ্যাকে পাওয়ায় পর থেকে তুমি আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবে এর আগে তোমার মুক্তি নেই।সেদিন পারলে আমাকে মাফ করে দিও।”
বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে বাহিরের টিমটিম জ্বলতে থাকা বাতির দিকে তাকিয়ে ছিল রোদ। আকাশে চাঁদ না থাকায় অন্ধকার হয়ে আছে চারিদিক। ঘরে খুব একটা ঠান্ডা না লাগলেও এখানে বেশ ঠান্ডা লাগছে ওর। তবুও এই শীতের মাঝেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল ও। আসলে বাহিরে এই আলো-আধারির খেলা বেশ ভালোই লাগছে ওর। রোদ যখন আলো-আধারির খেলায় বিভর ঠিক তখনি রোদ ওর ফোনে হতে মেসেজের শব্দ পেলো। এর আগে নেহাল বার তিনেক কল করেছিল কিন্তু রোদ লজ্জাতেই রিসিভ করে নি তখন। ফোনে মেসেজ আসার শব্দ পেতেই বাহিরে থেকে মুখ ফিরিয়ে ফোনের দিকে কৌতহলী দৃষ্টিতে তাকালো রোদ। ও শতভাগ নিশ্চিত নেহালই মেসেজ পাঠিয়েছে । ফোনের লক খুলে কিছুক্ষণ আগে আসা মেসেজটা দেখে অবাক হয়ে গেল রোদ। নেহাল ওকে হুমকি দিয়েছে।বিয়ের রাতে কোন ছেলে বউকে হুমকি দেয় বলে জানা ছিল না রোদের। নেহালের কথা ভাবতে ভাবতেই আবারো বাহিরের দিকে তাকালো রোদ। এসব নিয়ে পরে ভাববে ও। বাকি রাতটুকু না হয় আলো আধারির সাথেই কাটাবে ও।
রাতের আঁধার কেটে সূচনা ঘটল নতুন একটি দিনের। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বাদ গেল আরেকটি দিন। নতুন দিনের সূচনা ঘটলো পাঁচ পাঁচটি জীবনে । সকালের আলোর ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার। শ্রাবণের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে গেল ফ্রেশ হতে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর লাল রঙের শাড়ি পড়ে ঘরে ফিরে আসল ও। তারপর চলে গেল রান্না ঘরে। সকালে সঠিক সময়ে নাস্তা না পেলে মনোয়ারা বেগম হয়ত আবারো চেঁচামেচি করবেন।সন্ধ্যা এখনো বুঝতে পারল না মনোয়ারা বেগম কেন এতো ওকে অপছন্দ করেন। মনোয়ার বেগমকে খুশি করার জন্য কত কিছুই না এই কয়দিনে করেছে ও কিন্তু কোন কাজে আসে নি। বরং দিনকে দিনকে মনোয়ারা বেগমের ঘেন্নার মাত্রা যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে আর কতদিন চলবে কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতেই রান্না ঘরে চলে এলো ও। তারপর ঝটপট সবার জন্য চা করে নিয়ে গেল ও। যাবার আগে অবশ্য খালাকে সকালে কি খাবে সবাই তার উপকরণ রেডি করতে বলে গেছে। সবাইকে একে একে চা দিয়ে মনোয়ারা বেগমের ঘরে এলো সন্ধ্যা। মনোয়ারা বেগম তখন তজবি পাঠ করছিলেন।সন্ধ্যা মনোয়ারা বেগমকে বিরক্ত না করে পাশের ছোট টেবিলে চা রেখে ধীর কন্ঠে বলল,
–” ফুপি চা রেখে গেলাম এখানে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিবেন তা নাহলে আবার চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
সন্ধ্যার কথা শুনেই মনোয়ারা বেগম মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
–” আমাকে নিয়ে তোমার এত না ভাবলেও চলবে। সকালের নাস্তা দ্রুত তৈরীর করো গিয়ে।আজ কিন্তু তুলির প্রথম দিন কলেজের।তাই আমি চাই না আজ তুলির কলেজ যেতে দেরি হোক। বুঝেছো তো আমি কি বলেছি। ”
সন্ধ্যা ফুপির কথার পরিপ্রেক্ষিতে কেবল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
–“জি ফুপি বুঝেছি আপনি কোন চিন্তা করবেন না সব কাজ ঠিক সময়ে হয়ে যাবে।”
–“বুঝলেই ভালো।”
তারপর আর কিছু না বলে সন্ধ্যা শ্রাবণের ঘরের দিকে চলে গেল। গিয়ে দেখল শ্রাবন তখনো ঘুমে বিভোর হয়ে রয়েছে। চায়ের কাপটা বিছানার পাশে ছোট টেবিলে রেখে শ্রাবণের দিকে এগিয়ে গেল সন্ধ্যা। শ্রাবণের মুখোমুখি বসে একটু ঝুঁকে শ্রাবণের কপালে চুমু দিয়ে শান্ত কন্ঠে ডাকতে লাগল ও। সন্ধ্যার মৃদু কন্ঠে শ্রাবনতো উঠলো না বরং সন্ধ্যাকেও নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। সন্ধ্যা যত দূরে সরে যেতে চাইছে শ্রাবণ ততই যেন সন্ধ্যাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শ্রাবণের সাথে না পেরে এক সময় সন্ধ্যাও শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরে শ্রাবণের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“অনেক হয়েছে ।এবার উঠুন তো। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমার।”
সন্ধার কথা শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল শ্রাবণ। সন্ধ্যায় মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
–“আগে আমার পাওনাটা বুঝে নেই তারপর না হয় তোমাকে ছুটি দেওয়া যাবে।”
–“দেখুন ……
–“আমি তো দেখার জন্যই অপেক্ষা করে আছি। কী দেখাবে দেখাও না বউ?”
–” ধ্যাত ছাড়ুন তো সব সময় শুধু উল্টাপাল্টা কথা।”
–“তোমাকে লজ্জা পেলে আরও বেশি আবেদনময়ী লাগে মায়াবতী। মনে হয় নিজের সাথে মিশিয়ে রাখি সবসময় যেনো আমার থেকে দূরে যেতে না পারো।”
শ্রাবণের কথা শুনে সন্ধ্যা আরো বেশি লজ্জা পেল সন্ধ্যাকে লজ্জা পেলে দেখে শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল,
–“তোমাকে লজ্জা পেতে দেখলে আমার মনে হয় আমি বোধহয় গতকালকেই বিয়ে করেছি তোমায়। এত লজ্জা পাও কেন তুমি?আমি মনে হয় আজ প্রথম স্পর্শ করছি তোমায়। এর আগেও তো আমি তোমাকে…..
শ্রাবণের মুখে হাত রেখে সন্ধ্যা বলে উঠলো,
–“দোহাই লাগে আপনার আর কিছু বলবেন না প্লিজ।”
সন্ধ্যার হাতে আলতো চুমু দিয়ে শ্রাবণ বলল,
–“ঠিক আছে এখন আর বলবো না, তবে রাতে কিন্তু তোমাকে ছাড়ছি না।”
সন্ধ্যা কোনমতে শ্রাবনকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে উঠে দৌড়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। তবে যাওয়ার সময় শ্রাবনকে বলল,
–“পরেরটা পরে ভাবা যাবে আগে আপনি চা টা খেয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিচে আসুন।”
শ্রাবণ সন্ধ্যার প্রতি উত্তরে বলল,
–“যথা আজ্ঞা মহারানী। আপনার আদেশ শিরোধার্য।”
তারপর ঝটপট চা খেয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল শ্রাবণ।
এদিকে খুব ভোরের দিকে ঘুম ভাঙ্গে নেহার। সারারাত না ঘুমানোর ফলে চোখ ফুলে গিয়েছে ওর। তার উপর সারারাত কান্না করার ফলে মাথাটাও তীব্র ব্যথা করছে ঘুম থেকে উঠে টলমল পায়ে ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে এলো নেহা। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল সন্ধ্যাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে বের হবার আগে অবশ্য বাবাকে বলে এসেছে ও। আজ হয়ত শ্রাবনকে ফিরে পাবার কোন না কোন পথ খুঁজে পাবে ও। যে করেই হোক শ্রাবণ কে ওর চাই ই চাই। শ্রাবণ ওর ছিল,ওর আছে আর সারাজীবন ওরই থাকবে। কেউ শ্রাবণকে ওর থেকে আলাদা করতে পারবে না ।আর এই দুদিনের মেয়ে সন্ধ্যা তো নয়ই।
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। 5 টার পরে গল্প দিতে চেয়েও না দিতে পারায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি। কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আশা করি এখন থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ। ভালো থাকবেন। আর সবাই মাহে রমজানের রোজা রাখবেন।)