শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৯
#আমিনা আফরোজ
দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ধরনীর বুকে নেমে এসেছে নিকষ কালো অন্ধকার। সূর্যমামাও ততক্ষনে পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমাকাশের কোলে। ধীরে ধীরে কমছে ব্যস্ততম শহরে মানুষের আনাগোনা। দিনশেষে সবাই ছুটে চলছে নিজ গন্তব্যের দিকে।
বারান্দার এক কোণে এসে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ না থাকলেও মৃদু বাতাস আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যাকে। সেই সাথে গায়ে জেকে বসেছে হালকা শীত। হেমন্তেরর শেষের দিকে আবির্ভাব ঘটেছে হালকা শীতের। বাহিরে পড়েছে হালকা কুয়াশার আস্তরণ । তবে এ কুয়াশায় সামনের সবকিছুই দৃশ্যমান। সন্ধ্যা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গেটের দিকে । দুশ্চিন্তায় এই মুহূর্তে ওর মাথা কাজ করছে না। যতসব আজে – বাজে ভাবনা ওর মাথায় আসছে। প্রার্থনা করছে মেয়েটি যেন সহিসালামতে বাসায় ফিরে আসে।রাত বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে সকলের দুশ্চিন্তা। অনেকক্ষন দাড়িয়ে থাকার পরেও আশাতীত মানুষটিকে ফিরতে না দেখে হতাশ হয়ে নিচে চলে গেল সন্ধ্যা। আপাতত শ্বশুর-শাশুড়িকে সামলাতে হবে ওকে।
বিকেলে প্রিয়ন্তী যখন একাই বাড়িতে এলো তখন সন্ধ্যা প্রিয়ন্তীকে একা দেখে বেশ অবাক হয়। সন্ধ্যার সাথে অবাক হয় বাড়ির বাকি সদস্য গুলোও। সাধারণত রোদ আর প্রিয়ন্তি সব সময় এক সাথেই বাড়ি ফিরে। বাড়ির সবাই প্রিয়ন্তিকে রোদের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রিয়ন্তী বলে রোদ বলেছে ওর কাজ আছে তাই ও পরে আসবে। প্রিয়ন্তি এই নিয়ে জোর করলেও রোদ জেদ করে প্রিয়ন্তিকে একাই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মনোয়ারা বেগম এ নিয়ে অনেক চেচামেচি শুরু করেন। মনোয়ারা বেগমের রাগারাগী দেখে ভয়ে ঢোক গিলতে থাকে প্রিয়ন্তি। ইতিমধ্যেই ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে ও। প্রিয়ন্তি মনে মনে ভাবতে লাগল এই মহিলা হয়তো ওর বলা মিথ্যে কথাগুলো এখনই ধরে ফেলবে। কিন্তু প্রিয়ন্তীর এই মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না ওর কাছে কেননা রোদকে ও কথা দিয়েছিল বাড়িতে ও রোদের ব্যপারে কিছুই বলবে না। কলেজ ছুটির পর রোদ প্রিয়ন্তীকে রোদের বলা কথাগুলো শিখিয়ে দিয়েছিল তবে প্রিয়ন্তিও রোদকে শর্ত দিয়েছিল ও বাড়ির সবাইকে মিথ্যে কথা বলবে কিন্তু তার বিনিময়ে রোদকে ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। রোদও কোন উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল প্রিয়ন্তির শর্তে।
মনোয়ারা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রিয়ন্তীর দিকে। তিনি যে প্রিয়ন্তির বলা কথাগুলো বিশ্বাস করেন নি এইটা ওনার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখেই বুঝতে পেরেছে প্রিয়ন্তি। মনোয়ারা বেগম প্রিয়ন্তির দিকে দু-কদম এগিয়ে আসতেই রশিদ সাহেব বলে উঠলেন,
–“তুই শুধু শুধু এতো চিন্তা করছিস মনু। রোদ যখন বলেছে ওর কাজ শেষে বাসায় আসবে তখন আর কোন চিন্তা নেই বুঝলি। এর আগেও রোদ বহুবার সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরেছে।”
রশিদ সাহেবের কথা শুনে প্রিয়ন্তির মনে অপরাধ বোধ জেগে উঠেছিল। মিথ্যা কথা বলার কারণে অপরাধে মাথা নিচু করে রেখেছিল ও।
–“কিন্তু ভাই আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না. আমি আবার আজ-কালকার ছেলে- মেয়েদের ওপর খুব একটা ভরসা পায় না বুঝলে ভাই।”
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে মুচকি হাসলেন রশিদ সাহেব, সেই সাথে হেসে উঠলেনম মিসেস রাবেয়া বেগম। রশিদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন, তার বোনটা সেই আগের মতোই রয়ে গেল আজীবন । সবকিছুতেই ওর সন্দেহ। ছোটবেলা থেকেই মনোয়ারা বেগম এমন ছিলেন। ছোট ছোট সাধারণ বিষয় গুলো নিয়েও উনার মনে ছিল সন্দেহ নামক শব্দ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো তবুও সবাই স্বাভাবিকই ছিলেন কিন্তু যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে ধরণীর বুকে নেমে এলো রাতের প্রহর তখন থেকেই শুরু হলো সবার দুশ্চিন্তা। সবাই ভাবলেন রোদ হয়তো কোন বিপদে পড়েছে। মেয়ের বিপদের কথা মনে হতেই অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠল রশিদ সাহেবের। মিসেস রাবেয়া বেগম ততক্ষণে কেঁদে ফেলে দিয়েছেন। মনোয়ারা বেগম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। রশিদ সাহেব দ্রুত কল করে শ্রাবনকে সব কথা খুলে বললেন। শ্রাবন রোদের কথা শুনে তখনই বেড়িয়ে পরলো অফিস থেকে।
এই ঘটনায় একজন শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় সন্ধ্যা নিজে। সন্ধ্যা তখন হাজার ভাবনায় মত্ত। সন্ধ্যা শতভাগ নিশ্চিত প্রিয়ন্তি মিথ্যা বলেছে ওদের কিন্তু প্রিয়ন্তির মিথ্যা বলার পেছনে কারণটা বুঝতে পারছে না সন্ধ্যা। রোদের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কোন ভাবে নেহালের হাত নেই তো? না এসব কি ভাবছে ও? সন্ধ্যার কি তবে নেহালের কথাটা শ্রাবণকে জানানো উচিত ছিল? না আর কিছুই ভাবতে পারছে না ও । এসব ভাবনা চিন্তায় মাথাটা হয়তো ফেটে যাবে এখন । হঠাৎ দূর থেকে গাড়ির শব্দ পেতেই সন্ধ্যার দৌড়ে চলে গেল বারান্দায় কিন্তু কোন গাড়ির নিশানা দেখতে পেল না । সন্ধ্যার মনের কোণে উঁকি দেওয়া আশার আলোটুকুও নিভে গেল সেই সাথে।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ড্রইংরুমে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোদ আর নেহাল। অপরাধী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। কিছুক্ষণ আগে অপরিচিত একটি ছেলের হাত ধরে বাড়ির ভেতরের আসে রোদ। রোদকে বাড়ি ফিরতে দেখে দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল সবার। সকলের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার আঁধার কাটিয়ে ফুটে উঠল আনন্দের দীপ্ততা। তবে সে আনন্দের রেশ খুব বেশি সময় রইল না। কলেজ ড্রেস পরা মেয়ের গলায় মালা ঝুলতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল সবার। রোদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দিকে সবার দৃষ্টি পড়লো এবার। অপরিচিত ছেলেকে রোদের পাশে দেখে বেশ অবাক হলো সবাই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সবাই বোঝার চেষ্টা করছে আসলে কি ঘটেছে রোদের সাথে?
এদিকে সবার এমন দৃষ্টিতে তাকানো দেখে নেহালের অস্বস্তি হচ্ছিল। এভাবে সবাই মিলে একজনের তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি হবারই কথা। সবার এমন তাকানো দেখে অসহায় দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকালো নেহাল। নেহালের এমন দৃষ্টি দেখে রোদ আশ্বস্ত করলো ওকে।
এদিকে রোদের সাথে নেহালকে দেখে অবাক হয়ে গেল সন্ধ্যা।এমনটা তো হবার কথা নয়। তাহলে কি সেদিন রেস্টুরেন্টে নেহাল সন্ধ্যাকে রোদের কথা বলেছিল। এর মানে নেহাল এই বিয়ে মন থেকে করে নি। শুধুমাত্র সন্ধ্যার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই রোদকে বিয়ে করেছে ও। আজ ওর জন্য রোদের জীবনটা নষ্ট হতে দেখে দু-চোখ পানিতে ভরে ওঠল সন্ধ্যার।
এদিকে প্রিয়ন্তি রোদ আর নিহালকে একসাথে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বেচারি এখনো বুঝছে না আসলে এখানে হচ্ছেটা কি? আর নেহাল স্যারই বা রোদদের বাড়িতে এসেছেন কেন? রোদের সাথে চোখা-চোখি হতেই ইশারায় জিজ্ঞেস করল, এসবের অর্থ কি? কিন্তু রোদ ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।
ড্রয়িংরুমে এখন নিরবতার প্রহর চলছে। নীরবতার রেশ কাটিয়ে রশিদ সাহেব নিজেই বলে উঠলেন,
–“এসবের মানে কি রোদ? এই ছেলেটিই বা কে? আর তুই বা এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
রশিদ সাহেবের প্রশ্নের উত্তর রোদ দেওয়ার আগে নেহাল নিজে বলে উঠলো,
–“আমার নাম নেহাল মাহমুদ অভ্র। আমি রোদের কলেজের শিক্ষক।”
নেহাল ওদের বিয়ের কথাটা না বলায় রোদ রেগে গেল নেহালের ওপর । নেহালের দিকে রেগে তাকাতেই নেহাল ওকে ইশরায় কোন কথা বলতে না করলে আরো অবাক হয়ে গেল রোদ। এই মুহূর্তে নেহাল কি চাচ্ছে বুঝতে পারছে না ও।
নেহালের পরিচয় পেতেই সবার দুশ্চিন্তা ঘুচল এতক্ষণে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রশিদ সাহেব বললেন,
–“দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা বসো এখানে। তুমি আমার ছেলের বয়সি হবে তাই তুমি করেই বললাম কিছু মনে করো না। আসলে রোদ তো কখনো এত দেরিতে বাসায় আসে না তাই ওকে নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম । বোঝোই তো মেয়ে বড় হলে বাবা-মার চিন্তা কত বাড়ে।”
রশিদ সাহেবের কথা শুনে সামনে এগিয়ে এসে রশিদ সাহেবের পাশের সোফায় বসে পড়লো নেহাল। তারপর বলতে লাগল,
–“জি বুঝতে পেরেছি আমি আর আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আসলে একটা জরুরী কথা ছিল আপনাদের সাথে।”
–“কি কথা বলো?”
–“আসলে আজ সন্ধ্যায় একটা দুর্ঘটনায় পড়ে আপনাদের কে না জানিয়েই আমার আর রোদের বিয়ে করতে হয়েছে।”
বিয়ের কথা শুনেই আরেক দফা চমকে উঠল সবাই। রশিদ সাহেব কে বলতে না দিয়ে শ্রাবণ নিজেই বলে উঠলো,
–“কি হয়েছিল তা যদি একটু খুলে বলতেন তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো।”
–“আসলে রোদ একাকি ঘুরতে ঘুরতে শহর থেকে একটু দূরেই চলে গিয়েছিল। সেখানে কিছু বখাটে ছেলে ওর সাথে অসভ্যতামি করছিল।ভাগ্যক্রমে আমিও সেই একই জায়গায় গিয়েছিলাম ঘুরতে।আসলে জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। তাই মাঝে- মধ্যেই সেখানে ঘুরতে যাই আমি। রোদের সাথে ছেলেগুলো অসভ্যতামি দেখে ওকে সাহায্য করতে গিয়ে বখাটে ছেলে গুলোর সাথে আমার হাতাহাতি হলে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয় সেখানে। স্থানীয় লোকেরা তখন আমাদের দুজনকে দেখে বলে রোদের যে অবস্থা এতে রোদকে বিয়ে করাই ভালো হবে। ছেলে-মেয়ে দুজনকে এভাবে একা দেখলেই ওনাদের ওখানে এমন বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ নাকি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। এই কথা শোনা মাত্রই বখাটে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন রোদের দিকে এগিয়ে আসার আগেই আমি নিজেই রোদকে বিয়ে করব বলে রাজি হয়ে যাই।”
নেহালের কথাগুলো শোনার পর সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। যেন আজ ওনাদের সব কথা ফুরিয়ে গেছে। তবে সবথেকে বেশি অবাক হয়েছে রোদ নিজেই । নেহাল যে ব্যাপারটাকে এভাবে সামলিয়ে নিবে তা বুঝতে পারে নি ও। তবে নেহাল সবাইকে মিথ্যা কথা বলল কেন?
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে নেহাল নিজেই আবার বলে উঠলো,
–“আসলে আমি নিজেও এভাবে রোদকে বিয়ে করতে চাই নি তাই আমি ভেবেছি আমি আমার বাবা মাকে কয়েকদিনের মধ্যেই আপনাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবো । তারপর সামাজিক স্বীকৃতিতেই রোদকে আবারো বিয়ে করব। আমি আমার মতামত টা আপনাদের জানিয়েছি,এখন আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। আজ আসি তবে।”
নেহাল কথাগুলো বলেই রোদের দিকে মুচকি হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেল নিজ গন্তব্যের পথে। তবে তার আগে বেশ কিছু কাজ করতে হবে ওকে। রোদ তখনো তাকিয়ে রইল নেহালের দিকে।এখনো সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর কাছে। কি ঘটতে চলেছে নেহাল আর রোদের জীবনে?নেহালের আগমনে কি তবে সন্ধ্যা আর শ্রাবণের সম্পর্কে ফাটল ধরবে ?
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বটি কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর তারা নিরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই।)