সমাপ্তির_শেষটা #পর্ব_৪

0
1189

#সমাপ্তির_শেষটা
#পর্ব_৪
______________________________________
নিয়নের চেম্বারে ওর সামনের চেয়ারটায় বসে আছি আমি । প্রায় পনেরো বিশ মিনিটের মতো হয়ে যাচ্ছে ওর চেম্বারে এসেছি । তখন থেকেই নিয়ন চুপ মেরে বসে আছে । কেমন স্থির দৃষ্টি । কিছু যেন বলছে ওর সেই স্থির নয়নজোড়া । আমি একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসেই রইলাম । এক হাত দিয়ে অন্য হাতের আঙ্গুল মোড়াচ্ছিলাম । এভাবে বসে থাকতে খুব অস্বস্থি লাগছিল । তাই নীরবতা ভাঙ্গতে আমিই বললাম,
“তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে? বললে না যে?”
নিয়ন ওর চেয়ারটায় পিছনের দিকে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ফেলল । সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । মিনিটখানেক সময় নিয়ে বলল,
“কিভাবে কি দিয়ে শুরু করবো বুঝতে পারছি না ।”

নিয়নের একথা আমাকে আরো অস্বস্তিতে ফেলে দিল । চুপ করে বসে রইলাম আমি । আমাকে নীরব দেখে নিয়ন আবার বলল,
“জানি না নিজেকে সামলাতে পারবে কিনা ।”

ওর এবারের কথার ইঙ্গিতটা যেন অন্যদিকে । কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম । সেই সাথে একটা অজানা ভয় আমাকে জালের মতো পেঁচিয়ে বসে । নিয়ন কি বাবাকে নিয়ে কিছু বলবে? দাভাইয়ের থেকে তো শুনেছি বাবা নিয়নের চিকিৎসাধীন ছিলেন । তাহলে কি…..।
ভাবনার সুতো কাটে নিয়নের কথায় ।
“নূহা…তুমি তো জানতে যে তোমার বাবা ক্যান্সারের লাস্ট পর্যায়ে ছিল । জানতে না?”

আমি মাথা হেলিয়ে উত্তর দিলাম যে জানতাম । হাত পা কেমন জানি ঠান্ডা হয়ে আসছিল আমার । দুরু দুরু করে কাপছিল বুকের ভেতর । কি বলবে নিয়ন? সোজাসাপ্টা না বলে এত সময় কেন নিচ্ছে? ধৈর্য্য ধরে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
“কি হয়েছে সোজাসাপ্টা ভাবে বলে ফেলো । এতসময় নিচ্ছো কেন?”

“হুম…বলবো । চলো আমার সাথে ।”
_______________________________
নিয়ন আমাকে নিয়ে বাবার কেবিনের সামনে আসে । কেন যেন চারপাশের পরিবেশটা ভারী মনে হচ্ছিল আমার । বাতাসে যেন কিসের হাহাকার । আমার মনটাও কোনো কারণে যেন বলছে কিছু একটা ঠিক নেই । এলোমেলো হয়ে গেছে । কেবিনের ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম বেডের উপর সাদা কাপড়ে একজনের মুখ ঢেকে রাখা । পাশে স্থির হয়ে বসে আছে দাভাই । বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছু । তবে মন যে মানছে না । মন বলছে যা হচ্ছে, চোখের সামনে যা দেখছি সব…সবটা মিথ্যা । নয়তো আমার দেখা কোনো দুঃস্বপ্ন । যেটা ঘুম থেকে জেগে উঠার সাথে সাথেই মিথ্যে হয়ে যাবে ।
এক’পা দু’পা করে এগিয়ে গেলাম বেডের কাছ পর্যন্ত । হাত কাঁপছে আমার । তবুও নিজের মনকে প্রবাদ দিয়ে সাহস সঞ্চার করে সাদা কাপড়টা সরালাম । একটা মুখ…. খুব চিরচেনা । আমার জীবনের প্রথম পুরুষ এই মুখের মালিকটি । আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটার মুখ । খুব যতনে আলতো স্পর্শে মুখখানা ছুঁয়ে দিলাম আমি । হঠাৎ চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এলো….
_______________________________
চোখ খোলার পর বুঝতে পারলাম না যে কোথায় আছি । ধীরে ধীরে উঠে বসলাম । মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ । কতক্ষণ জ্ঞানহীন ছিলাম তাও জানি না । আস্তে আস্তে মনে পড়লো হাসপাতালের সব কাহিনী । তখন একলাফে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়ি । ছুটে বের হই রুম থেকে । রুম থেকে বের হতেই ড্রয়িংরুম সামনে পড়লো । সেখানে সবাই বসে আছে । তার মাঝে অনেককেই চিনি না । চাপা কান্নার আওয়াজ । সেই কান্নার গুঞ্জনই বলে দিচ্ছে আমার বাবা নেই আর । চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে ।
আমার চোখ চারপাশে কিছু একটা খুঁজে চলছে । সেটা কি জানি না। হঠাৎ কেউ জাপ্টে ধরায় চমকে উঠে তাকাতেই দেখি আদর আমায় জড়িয়ে ধরেছে । ওর চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে । অদ্ভুত কথা হলো আমার চোখ দিয়ে কোনো পানি আসছে না । কেমন জানি অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে । মুখ দিয়ে কোনো শব্দও বের হচ্ছে না । এই যে আমার ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমি ওকেও স্পর্শ করছি না । ঠাঁই দাড়িয়ে আছি শুধু । ঘরে উপস্থিতদের মধ্যে অনেকে আবার আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে । তারা নিশ্চয়ই জানে যে আমি কে । তারা হয়তো ভাবছে বাবা মারা গিয়েছে অথচ মেয়ের চোখে কোনো জল নেই । কি অদ্ভুত! আবার অন্য কিছুও ভাবতে পারে ।

কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকাতেই দেখি আমার স্ট্রোং দাভাই এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম । দাভাই নিজে থেকেই বলল,
“তুই আসার আধঘন্টা আগেই বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন । তাই তোকে তখন বাবার সাথে দেখা করতে দিইনি ।”
কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে রইলাম আমি । দাভাই ফের বলল,
“বাবাকে মাটি দেওয়া হয়েছে । তুই তখন অজ্ঞান ছিলি ।”
মুখ ফুটে তখন আর কিছু বলতে মন চাইলো না । অভিযোগ ছিল অনেক । কিন্তু কিছুই বললাম না । আর বলে কি হবে? সব কিছুর সমাপ্তি তো হয়েই গেছে ।
______________________________
আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দিকে এগিয়ে চলেছি আমি । বাবার সমাধির কাছে কাছে গিয়ে চুপটি করে দাড়ালাম । মনে মনে কত কি বললাম বাবাকে তার হিসেব নেই ।
জীবনের প্রথম এই মানুষটার খুশির জন্যই নিজের স্বপ্নকে স্বপ্নই রেখে অজানা এক মানুষের হাত ধরেছিলাম । এই মানুষটার জন্যই সূদুর কুয়েত থেকে পালিয়ে এসেছিলাম । আমার এক জনমে এই মানুষটার খুশিই ছিল আমার সব । আমার বাবা….। কিন্তু আজ আমাকে এই পৃথিবীতে একা ফেলে নিষ্ঠুরের মতো চলে গেল । এটাই নাকি বাস্তবতা । এমন বাস্তবতা, এমন নিয়ম কেন ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া যায় না??? তাহলে হয়তো আজ এমন নিমর্ম হতো না আমার জীবনটা ৷ দেখতে পারলাম না… শেষ দেখাটাও । চোখ জুড়ালো না…বাবা ডাকটা শেষবার ডাকতে পারলাম না । শুনতে পারলাম না বাবার “রূপকথার মেঘের রাণী” ডাকটা । এ কেমন ভাগ্য আমার?? বিধাতা কেন এত নিষ্ঠুর হলেন আমার প্রতি??
চোখ জ্বলছে প্রচুর । মন পুড়ছে কষ্টের অনলে । চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো অশ্রুরা । আমার সাথে পাল্লা দিয়ে গুরুগুরু চিৎকারে কেঁদে উঠলো আকাশটাও । পাল্লা দিয়ে ঝরাতে লাগলো বৃষ্টি । ভালোই হলো আমার চোখের পানি কেউ দেখবে না । জানবে না । আজ আমি পৃথিবীতে একা । খুব একা…

নাহ্… একটু ভুল বললাম । কারণ আমার বাম হাতকে আঁকড়ে ধরলো ছোট্ট দুটি হাত । আদর…
আর ডান পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম । ফিরে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করিনি । কারণ আমি জানি পাশে দাড়িয়ে আছে নিয়ন…

বৃষ্টি বাড়ছে ৷ সেই সাথে কাঁদছি আমিও । এ কান্নার সমাপ্তি আছে কিনা জানা নেই আমার । তবে আমার সুখের সমাপ্তির শেষটা বোধহয় এটাই……
.
.
.
.
_____________সমাপ্ত__________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here