#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু
পর্ব : ৪৯
আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। আপনার আর একমাস কি দেশে থাকা যায় না?
কেমন যেন ধরে আসা গলায় কথাটা বললো সাচী। আর মোটামুটি হাঁফাতে লাগলো সে। যেন ছুটে এসেছে,আরাদের সাথে দেখা করার জন্য। হ্যাঁ,হয়তো ছুটেই এসেছে। কিন্তু সেটাতো ভালোবাসার টানে নয়,হয়তো ভদ্রতার খাতিরে। হয়তো আরাদকে তাদের বিয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি ভেবে, নিমন্ত্রণ করতে এসেছে। আরাদ এসব আকাশ-পাতাল ভেবে ফেললো মুহুর্তেই। সামনে তাকিয়ে দেখে, সাচী মাথা নিচু করে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে রেখে, কি যেন ভাবছে। সেই সুযোগে আরাদ সাচীকে একনজর দেখে নেয়ার লোভটা সামলাতে পারলনা। শেষবারের জন্য নিজের মত করে দেখে, মনের চিত্রপটে এঁকে নিয়ে যাক তার থাপ্পড় রাণীকে। আর তো এভাবে দেখতে পাবেনা সে!
আরাদ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
আমিই মনে হয় একমাত্র প্রেমিক,যে তার প্রেমিকাকে, তার প্রেমিকের কাছে তুলে দিতে গিয়ে, নিজে ভালোবেসে ফেলেছি।
ভীষণ অপরাধী আমি,ভীষণ। এ অপরাধের ক্ষমা নেই,কোন ক্ষমা নেই। আচ্ছা, আমি তাকে প্রেমিকা সম্বোধন করছি কেন?
সে তো আমাকে ভালোবাসেনা।
তাহলে একতরফা ভালোবাসলে কি কাউকে, প্রেমিকা বলা যায়?
একটু ভালোবাসবে? হৃদয়টা তপ্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে,ভালোবাসাহীনতার খরায় ভুগে। সেই মরুভূমিতে একপশলা ভালোবাসা ঢালবে?
আরাদের মনে তখন ঝড় বয়ে চলেছে। সে ঝড় যেকোন মুহুর্তে সব তছনছ করে দিতে পারে।
কি আছে এই মেয়েটার মাঝে?
রাগ,ইগো,অভিমানের একটা ফুল প্যাকেজ। আর কোনদিনও প্রেমে পড়বে না, ভালোবাসবে না বলেও,আরাদ এই ফায়ার প্যাকেজটার প্রেমেই পড়ে গেলো! হাউ পিকুলিয়ার!
সাচী মনে হয় এখন রেগুলার চুল স্ট্রেইট করে,কালার করে বিভিন্ন। দেখতে যে খারাপ লাগে,তা নয়। তবে সেই যে তার কোঁকড়ানো সুন্দর চুলগুলো প্রথম দেখেছিলো, সেটা ভীষণ মিস করে আরাদ। ঐ চুলগুলোতে সাচীর চেহারায় একটা ভিন্নতার ছাপ ছিলো। একটা নিজস্বতা ছিলো। যাকগে,যার যার লাইফ,তার তার রুচি। অবশ্য আরাদ জানে,এটা তুহিনের পছন্দে করা। এবং সে এটাও জানে,এতে দোষের কিছু নেই। কেউ কারো প্রেমিকাকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী দেখতে চাইতেই পারে। এতে অন্য কারো কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।
আরাদকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে, সাচী মাথা তুলে তাকালো। মুহুর্তেই আরাদ চোখে কিছু পড়েছে,এমন একটা ভান করে চোখ কঁচলাতে লাগলো। যেন ওর চোখের বিষাদ,সাচীর চোখে ধরা না পড়ে। আরাদকে চোখ কঁচলাতে দেখে,সাচী এগিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলো। কিন্তু আরাদ তেমন কিছুনা বলে,পিছিয়ে যেতে চাইলো। তখন সহসা সাচী একটা ধমক দিয়ে, আরাদকে দাঁড় করালো। পাবলিক প্লেসে এভাবে সাচীর আচমকা ধমকে,আরাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সাচী এমনভাবে ধমকটা দিলো,যেন আরাদের উপর ওর কত অধিকার।
অধিকার!
হ্যাঁ, সত্যিই তো অধিকার আছে। কিন্তু শুধু সাচীই সেটা জানেনা। জানবেও না।
গোপনে সবটা অধিকার যে দিয়ে বসে আছে,সেটা তো থাপ্পড় রাণী ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না!
সাচীকে আরাদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে,আরাদ পুরো পাথর হয়ে গেলো। একসময় সাচী ওর থেকে আধহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইলো। ওদের উচ্চতাটা এতোই কাছাকাছি যে,সাচী আরাদের নাক অবধি লম্বা। সহসা আরাদ দেখতে পেলো, সাচী তার ওড়নার কোণাটা দলার মতন করছে। তারপর সেটা প্রথমে নিজের মুখে নিতে গিয়ে,কি যেন ভেবে নিলোনা। আরাদের মুখের সামনে ধরে বললো,
‘ এটা মুখের ভেতর নিয়ে, চোখে গরম ভাপ দিন। আরাম লাগবে।’
আরাদ কিছু শুনতে পাই নি,এমনভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখন আবার সাচীর কথায় ওর ঘোর কাটে। তবে সে সাচীর ওড়না হাতে নেয় নি। নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে,চোখে মিছি মিছি ভাপ দিলো। চোখে তো কিছু হয়নি, ভাপ দিয়ে কি হবে?
হয়েছে তো মনে। সেখানের কোন পথ্য কি জানা আছে মিস থাপ্পড় রাণীর?
মনে মনে এই প্রশ্নটা সাচীকে করলো আরাদ। কিন্তু কোন উত্তর পেলো না। পাবে কি করে?
সাচীর অন্তর তো অন্য কারো জন্য কম্পিত হয়। সে অন্তরে যে আরাদের অস্তিত্ব নেই। এই কঠিনতম সত্যাটা মেনেই আরাদ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ আরাদ ওর মায়ের সাথে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। দেশে আর আসবেনা কখনো। দেশে আসলেই যে চাপা ব্যাথাটা সতেজ হয়ে উঠবে। যে আগুন একবার চাপা দিয়েছে,সেটা দ্বিতীয়বার জ্বালাতে চায় না সে। সব আগুন দাবানল হয়ে জ্বলতে নেই,কিছু কিছু ভূ-গর্ভেই বিলীন হয়ে যেতে হয়। তাহলে ধরিত্রীর ভারসাম্য থাকে বোধহয়।
আরাদের কাজটাতে সাচীর ভীষণ অপমানবোধ লাগলো। সে বহুকষ্ট রাগ সংবরণ করে, ওড়নাটা গুটিয়ে নিলো। আরাদ স্পষ্ট দেখতে পেলো, রাগে সাচীর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। হয়তো রাগটা বেরিয়ে আসতে চাইছে,কিন্তু পারছেনা। তাই ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। তবে সেই দৃশ্য একবারের বেশি দেখতে পারলনা আরাদ। সাচীকে অপমানিত করার ইচ্ছা বা সাহস কোনটায় আরাদের নেই। কিন্তু সাচীর একটু কেয়ার,একটু ভালোবাসা পেলেই তার মনের বরফ গলে যাবে। সেটা সাচী যা ভেবেই করুক। সেই ভয়েই সে সাচীকে আর কাছে আসতে দিলো না। ভালোবাসার মানুষের খুব কাছাকাছি গেলেই,মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ভুলচুক করে বসে। মনে হয় যেন,ভালোবাসা কাবু করে রাখে ততক্ষণ,যতক্ষণ কাছে থাকে। আর বাকী সব শূন্য। আর আরাদ সেটা হতে দিতে পারেনা। কোনভাবেই না।
তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে কি যেন একটা বক্স বের করলো। সাচী অবশ্য সেটা খেয়াল করলোনা। তবে পরক্ষণেই যখন আরাদ বক্সটা সাচীর সামনে ধরলো,তখন সাচী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
আরাদ বক্সটা হাতে নেয়ার জন্য ইশারা করলো। আরাদ কিছুক্ষণ আগেই জেনেছে যে,সাচী এখানে আসছে। রোহানী ফোন দিয়েছিলো। সাচী নাকি ওর কাছে ফোন দিয়েছিলো, কি কারনে। তখন আরাদ যে চলে যাচ্ছে, সেটা রোহানী বলে দেয়। কারন আরাদ সাচীকে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলেনি। কিন্তু রোহানী মুটকি যে কেন বলে দিলো,সেটা আরাদ বেশ ভালো জানে। কিন্তু তাতে আর কোন লাভ নেই এখন। ভালোবাসাকে, ভালোবেসে, ভালোবাসায় হৃদয়ে আবেশে জড়িয়ে রাখতে হয়। কোন স্বার্থপরতার জায়গা নেই সেখানে।
রোহানী এয়ারপোর্টে আসেনি,কারন মুটকি মা হতে চলেছে। তিনমাস চলে,তাই এসময় জার্নি করাটা বিপদজনক। তবে ওর বাচ্চা হওয়ার আগে,আরাদকে দেশে আসতে হবে। না হলে উপায় রাখবেনা এই রুই মাছ। আরাদও বললো, সে আসবে।
সাচী আসছে শুনেই আরাদ এই বক্সটা কিনলো। সাচী বক্সটা ব্যাগে ঢুকাতে নিলে,আরাদ এখানেই খোলার ইশারা করলো। সাচী বক্স খুলে হতভম্ব হয়ে গেলো!
বক্সভর্তি আমলকি!
সাচী করুণ চোখে আরাদের দিকে তাকালো। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলোনা। অন্যদিকে আরাদ একটা মলিন হাসি দিলো। আমলকীর মধ্যেখানে একটা ছোট্ট চিরকুটও ছিলো আবার। সেটা এখন খুলতে নিষেধ করলো আরাদ। যাওয়ার পর খুলতে বললো।
অগত্যা সাচী সেটা ওর ব্যাগে রেখে দিলো।
সাচী কি যেন বলতে চাইছে আরাদকে, কিন্তু সে গুলিয়ে ফেলছে সব। এমন অস্থিরতা কাজ করছে কেন ওর!
আরাদের চলে যাওয়াতে?
নাহ!
এতে অস্থির হওয়ার কি আছে। আরাদ কি করবে,না করবে সেটা ওর ব্যাপার। সেখানে সাচী কথা বলার কে?
তবুও কেন যেন সাচীর আরাদকে বলতে ইচ্ছে করছে,যেন দেশ না ছাড়ে। কিন্তু সেই কথাটা সাচীর গলায় কাঁটার মত আঁটকে আসছে। কোনভাবেই সে বলতে পারছেনা।
আরাদও বেশ বুঝতে পারছে,সাচী কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কি, সেটা ও নিজেও জানেনা।
কখনো কখনো এমন হয়,আমরা বিষয়টা বুঝি,আবার বুঝি না। বিষয়টা বলতে ইচ্ছে হয়,আবার বলতে পারিনা।
কোথায় যেন একটা অস্পষ্ট বাধা। আর সেই বাধা আমরা সহজে কাঁটিয়ে উঠতে পারিনা।
সেদিন সাচী আরাদকে আর কিছুই বলতে পারলনা। তবে আরাদ নিজের একটা অদ্ভুত দাবী আদায় করে নিয়েছিলো সাচীর থেকে। একটা জিনিস চেয়েছিলো,সাচীর কাছে। যেটার রেশ নিয়েই সে দেশ ছেড়েছিলো।
তবে সেদিন অদ্ভুতভাবে তুহিনও এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো। সাচীকে দেখে না চমকালেও,তুহিনকে দেখে আরাদ ঠিকই বেশ চমকে গিয়েছিলো। আর তুহিন এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো, আরাদকে ওদের বিয়ের কার্ড দেয়ার জন্য। আরাদ ভেবে পেলো না,কেবল কার্ডটা দেয়ার জন্য এয়ারপোর্টে আসার কি মানে থাকতে পারে?
যেখানে ও বিয়ের সময় দেশেই থাকবেনা!
তবে আরাদ এতোটুকু বুঝতে পারলো,তুহিন সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এই কাজটা করেছে। যেন আরাদের মনে সাচীর জন্য কোন অনুভূতি থেকে থাকলেও,সেটা চিরতরে নিভে যায়।
কারন তুহিন তখনো আরাদকে সন্দেহ করছিলো। এবং আরাদ জানে,তুহিনের সন্দেহটা অযৌক্তিক নয়। তবে সে তুহিনের কাছে ধরা দিবে না। কারন এতে সাচীর প্রতি তুহিন বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে পারে। তাই সেদিন তুহিনের সব প্রশ্ন সে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তা স্বত্তেও তুহিন সেদিন কেমন যেন অদ্ভুত রহস্যের হাসি হেসেছিলো। যার মানে,আরাদের বোধগম্য হলো না।
সে তো সব অনুভূতি পেছনে ফেলে,চলেই যাচ্ছে। তাহলে এতো বুঝে কি লাভ?
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে সাচীর তুহিনের সাথে দেখা হয়ে যায়। সাচী কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তুহিন এদিকে কেন এসেছিলো?
ওকে ফলো করছিলো নাকি?
এটা ভেবে সাচীর বেশ বিরক্তিবোধ হচ্ছিলো। তবে তুহিন ওকে কিছুই বলেনি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো,বাসায় যাবে, নাকি কোথাও ঘুরতে যাবে?
তখন সাচী বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিলো। ব্যাস, তুহিন কোন কথা না বলে,সাচীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলো। তুহিনের আচরণ সাচীর সুবিধার ঠেকলো না। কেমন যেন থম মেরে রয়েছে সে। তবে কেন,সেটা সাচী ধরতে পারলনা।
তবে রাতে তুহিনের একটা টেক্সট পেয়ে,সাচী হতবুদ্ধি হয়ে গেলো!
তুহিন কি মজা করছে ওর সাথে?
কিন্তু এমুহূর্তে এরকম মজা করার কি মানে?
বিয়ে হবে না মানে!
#চলবে…