#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু
পর্ব : ৪৬।
সাচীদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে আরাদ। সাচীকে কোনকিছু না জানিয়েই এসেছে সে। যার কারনে সাচীকে বাসায়ই পেলো না। হয়তো তুহিনের সাথে ঘুরতে গেছে। এটা মনে হতেই,সাথে সাথে ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে ফেললো সে। একদম এসব নিয়ে ভাববেনা সে।
বিরুনিকা চা,নাস্তা রেখে গেলো। তখন শফিকুর এসে আরাদের পাশে বসলেন। হঠাৎ কি যেন ভেবে শফিকুর বলে উঠলেন,
তোমাকে ঐদিন টিভিতে নিউজে দেখলাম মনে হলো। কিন্তু কিসের নিউজ ছিলো, সেটা মনে করতে পারছিনা। শফিকুর কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবনায় ডুবে রইলেন। সহসা মনে হয়েছে এমন ভাব করে বলতে লাগলেন,
তোমার মা টিভি অভিনেত্রী আরফা খান?
শফিকুরের প্রশ্নে আরাদ মাথা নাড়ালো। তখন শফিকুর বলতে লাগলেন,
একসময় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন তোমার মা। আমার সাথে মোটামুটি পরিচয়ও ছিলো। একটা মঞ্চনাটকে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম। তারপর কয়েকবছর আগে উনি হুঁট করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন,সাথে অভিনয়ও। ঐদিন এয়ারপোর্টে উনার সাথে তোমাকে দেখলাম। কিন্তু সেখানে তো ঐ ইন্ডিয়াতে বিমান বিধ্বস্তের নিউজটা দেখাচ্ছিলো। তোমাদের কেউ ছিলো নাকি ঐখানে?
শফিকুর উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
তখন আরাদ শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
‘ আমার বাবা।’
শফিকুর যেন স্তব্দ হয়ে গেলেন। এরকম কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই এখন কি বলবেন,বুঝতে পারছেন না। এমনটা বুঝতে পারলে,এভাবে জিজ্ঞেস করতেন না তিনি। উনি কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইলেন।
তখনি সহসা সাচী সেখানে প্রবেশ করলো। তবে ওর মুখটা কেমন জানি থমথমে হয়ে আছে। সাচীর দিকে একনজর তাকিয়েই, দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আরাদ। সাচীর মুখ যেমনই থাক,সেটা দেখার জন্য ওর নিজের মানুষ আছে। তোকে এতো ভাবতে হবে না। নিজেকে নিজে শাসালো আরাদ।
তখন মেয়েকে বসতে বলে,শফিকুর নিজের রুমে চলে গেলেন। তার আগে আরাদকে একটু শান্তনা-টান্তনা দিয়ে গেলেন। যদিএ তিনি জানেন,এখানে শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা নেই। তবুও মানবতার খাতিরেই আমরা দেই।
আরাদ কিছুই খাচ্ছে না। চুপচাপ বসে আছে। আরাদের আচমকা কিছু না বলে আসার কারনটা অবশ্য সাচী বুঝতে পারলনা। সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামালো না অবশ্য। সেদিকে না গিয়ে, সে আচমকা আরাদকে সরি বললো।
যদিও আরাদ বুঝতে পারলনা,সাচীর সরি বলার কি কারন থাকতে পারে?
তবে পরে বুঝতে পারলো। সাচী রুমে ঢুকেই হয়তো আরাদ আর সাচীর বাবার কথোপকথন শুনেছিলো। কিন্তু এতে সরি বলার কি আছে? এমনতো না যে, সাচী ঐ প্লেনের পাইলট ছিলো। আর থাকলেই বা কি,পাইলট নিজেও তো আর বেঁচে নেই। আরাদ ওর উদ্ভট ভাবনা পাশে রেখে, সাচীর কথায় মনোযোগ দিলো।
সাচী বলছিলো,
‘ আসলে আপনার বাবার নাম যে ঐটা, তা তো জানতাম না। নিউজটা আমি দেখেছিলাম,তবে উনি যে আপনার বাবা সেটা জানতাম না। জানলে অন্তত দেখতে যেতাম। মুখটা ছোট বাচ্চাদের মত ভার করে রেখেছে সাচী। সেটা দেখে আরাদের বেশ হাসি পেলো। তবে হাসলনা। সাচীকে বললো,
‘ইটস ওকে। এতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার না জানাটা স্বাভাবিক। আমি কখনো বলিনি আপনাকে।’
এরপর সাচী আর কি বলবে,ভেবে পাচ্ছে না। আরাদ কেন এসেছে,সেটাও জিজ্ঞেস করতে আনইজি লাগছে। তাই চুপ করে বসে রইলো। দুজনের কেউই কোন কথা বলছেনা।
একসময় আরাদই জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনার কাজটা কি এখন আর করার কোন সুযোগ নেই?’
আরাদের কথায় সাচী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। কিসের কথা বলছে আরাদ? তখন আরাদ শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,
আসলে তখন একটু মানসিকভাবে ডিস্টার্বড ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি,কাজটা এভাবে মাঝপথে ঝুলিয়ে রেখে চলে গিয়ে ভুল করেছি। ইনফ্যাক্ট এটা অন্যায়। তাই গিল্টি ফিল হচ্ছে এখন। তাই সেটা শেষ করতে চাইছি। এজন্যই আমার এখন এখানে আসা। যদিও জানি,আমি আপনার অনেক বড় ক্ষতি করেছি। আর তার জন্য আমি সত্যিই অনুতপ্ত।’
আরাদের কথা শুনে সাচী বিস্মিত না হয়ে পারলনা। কিছুদিন আগে যার বাবা মারা গেছে,সে কিভাবে ওতো শক্তভাবে কথা বলছে? তাও কাজ শুরু করতে চাইছে।
তাহলে আগে কি এমন হয়েছিলো যে,ওমন অদ্ভুত আচরণ করেছিলো?
বিষয়টা সাচীর মাথায় ধরলোনা। এই ছেলেকে বুঝতে পারা,সাচীর ভাবনাতীত।
কিন্তু এখন আর শর্টফিল্ম করে কি করবে সাচী?
প্রতিযোগিতায় জমা দেয়ার তারিখ তো শেষ!
সেটা আরাদও জানে। কিন্তু তবুও সে কাজটা শেষ করতে চাইছে। এই প্রতিযোগিতায় না হলেও,অন্য কোথাও দিবে, অন্য কোন সময়ে। কাজটা শেষ করা থাকলে, যেকোন সময় সেটা, যেকোন জায়গায় দিতে পারবে। এটায় সে সাচীকে বুঝালো।
সাচী কি যেন ভাবলো কতক্ষণ। কিন্তু পরক্ষনেই আবার বললো,
আচ্ছা, সব বুঝলাম। কিন্তু তার জন্য আপনার এখনি কাজ করতে হবে না। আরো সময় নিয়ে পরে করা যাবে। আর আমিও এখন বেশ বিজি থাকবো।
আরাদ জানে,সাচী কেন এমনটা বলছে। হয়তো ভাবছে,আরাদ মানসিকভাবে ভেঙে আছে এখন। হ্যাঁ তা আছে বটে। কিন্তু তার কারনে জীবন থেমে থাকে না। মানুষ শোক কাঁটিয়ে উঠে,উঠতে হয়। এটাই ধ্রুব সত্য।
আর অসমাপ্ত কাজটা শেষতো করতেই হবে। আরাদের হাতে সময়ও অনেক কম। এরমধ্যেই শেষ করতে হবে। কিন্তু সেটা সাচীকে জানানো যাবে না। অন্য কোন ভাবে,সাচীকে ম্যানেজ করতে হবে।
আরাদকে চুপ থাকতে দেখে,সাচী জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি ভাবছেন?’
আরাদ সাচীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে,একটা খাম সাচীর দিকে এগিয়ে দিলো। সাচী অদ্ভুত চাহনিতে আরাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। খামটা হাতে নিয়ে খুলতেই,সাচীর বুঝতে অসুবিধা হলো না, এগুলো কিসের টাকা। আরাদ কি তবে টাকাগুলো ফেরত দেয়ার জন্যই এসেছে?
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ বসে রইলো সাচী।
তারপর ঠান্ডা মাথায় আরাদকে বললো,
ঐদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আসলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। আপনি এভাবে আচমকা নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। কোন খোঁজ পাচ্ছিলাম না আমি। তারপর ঐদিনও আমার সাথে ঠিকঠাক কথাও বলছিলেন না আপনি। সবমিলিয়ে আমি ওমন রাফ বিহেভ করতে বাধ্য হয়েছি। হ্যাঁ,আমি জানি আমার ওমন আচরণ করা উচিত হয় নি। কিন্তু মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি আসলে। সাচী চোখমুখ করুণ করে রাখলো। যার মানে সে ভীষণ অনুতপ্ত।
সাচী একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো,
তবে এটা ঠিক,আপনার কাজের পারিশ্রমিক তো অবশ্যই আপনাকে নিতে হবে। হয়তো ঐভাবে দেয়াটা আমার অন্যায় ছিলো।
আর তার জন্য আমি আবারও ক্ষমা চাইছি।
সাচী এতোটা কেন অনুতপ্ত হচ্ছে, আরাদ বুঝতে পারছেনা। সে যেমন অদ্ভুত আচরণ করেছিলো,তাতে সাচীর জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলে আরো বাজে ব্যবহার করতো। সে তুলনায় সাচী কমই করেছে। নিজের একটা ড্রিম প্রজেক্ট শেষ মুহুর্তে এসে কেউ পন্ড করে দিলে,যে কারো মাথায় ঠিক থাকবেনা। সাচীর প্রতি আরাদের কোন অভিযোগ নেই।
কারন সত্যিই ওর কোন দোষ নেই।
দোষ যদি কিছু থেকে থাকে,তবে সেটা আরাদের অবাধ্য মনের। যার সাথে সবরকম জোর খাঁটিয়েও, আরাদ হেরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু এটা হতে পারে না। সে কাউকে কিছু টের পেতে দিবে না। কাউকে না। এবার নিজেকে চিরতরে গুটিয়ে নিবে। মনের দরজায় শক্ত পেরেক মেরে, অনুভূতিগুলোকে বন্দি করে দিবে। যেন আর কোন অনুভূতি ওকে না ছুঁতে পারে। যেন দ্বিতীয় কেউ মনের গহীনে ঝড় না তুলতে পারে। ক্ষতবিক্ষত না করতে পারে অন্তর। সীলমোহরে আবদ্ধ করে দিবে অন্তর।
সেদিন অনেক কথা কাটাকটির পর অবশেষে সাচীকে ম্যানেজ করতে পেরেছিলো আরাদ। তবে সাচী কেমন অদ্ভুত চাহনি নিয়ে বারবার আরাদের দিকে তাকাচ্ছিলো। আরাদ সেটা খেয়াল করেছে,সরাসরি সাচীর চোখের দিকে না তাকিয়েও। আচ্ছা,সাচী কি দিনদিন আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে?
নাকি এটা আরাদের মনের ভ্রম!
চলে আসার আগে স্মরণিকা,সাফুয়ানের সাথে দেখা করে এলো। শুক্রবার হওয়াতে কোমলকেও বাসায় পেয়ে গেলো।
সবাই আরাদের প্রতি ভীষণ রাগ করেছে। কিন্তু যখন শুনলো আরাদের বাবা ঐ বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে,তখন সবাই চুপ হয়ে গেলো।
আরাদের খবর না নেয়াতে,তাদের নিজেরও অপরাধবোধ হতে লাগলো। তবে সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া করে তারপর বাসায় আসতে হয়েছিলো আরাদকে।
হঠাৎ পরিচয়ে মানুষ কত আপন করে নেয় মানুষকে। সেটা এদের না দেখলে আরাদ জানতোনা।
অথচ অনেকদিনের সম্পর্কও এভাবে হঠাৎ করেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রকৃতির কি অদ্ভুত সেই খেল। ভাঙেও সহসা,গড়েও তুলে সহসায়। এটাই মানব জীবনের রহস্য।
বাসায় ফেরার পথে,রোহানীর ফোন। ফোন দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। রিতি চৌধুরী এক্সিডেন্ট করতে করতে বেঁচে গেছেন। একা একা বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় উদভ্রান্তের মত নাকি হাঁটছিলেন। প্রায় প্রায়ই উনি একেক ঘটনা ঘটাচ্ছেন। সবাই ভীষণ আতঙ্কে থাকে, উনাকে নিয়ে। কি মহিলা ছিলেন,আর কি হয়ে গেলেন। মানুষ কিসের এতো বড়াই করে? এই পৃথিবীতে কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। চেহারা,সম্পদ,যশ সবই তো ক্ষণস্থায়ী। তবুও আমরা সেসবের মোহে পড়ে যায়।
#চলবে…