যখন_তুমি_এলে পর্ব : ৪৩।

0
612

#যখন_তুমি_এলে
লেখা : জাহান লিমু
পর্ব : ৪৩।

বিরুনিকা, সায়াহ্নর বিয়ে হয়েছে একমাস হয়ে গেলো। বিয়ের পর আরাদ ঐ বাসায় আর যায় নি। ঐদিন স্মরণিকা ফোন দিয়ে,বেশ ইমোশনাল কথাবার্তা বললো আরাদকে। যে সে জানতো,আরাদ ওদের ভুলে যাবে। রক্তের সম্পর্ক নয়তো,তাই। আরো একগাধা লেকচার শোনালো সে। আরাদ চুপচাপ শুনে গেলো। কোন জবাব দিলো না। কারন জবাব নেই তার কাছে। স্মরণিকা রাগে,কেঁদে ফোন রেখে দিলো।
মেয়েটা ভীষণ ইমোশনাল। তবে আরাদ আশ্বস্ত করলো যে,সে যাবে। কিন্তু স্মরণিকা জানে,আরাদ এই মিথ্যাটা গত একমাস যাবত বলে আসছে।
বিরুনিকা,সায়াহ্নর বিয়ের পর থেকেই আরাদ কেমন জানি বদলে গেছে। সাচীর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আগের সিম পাল্টে ফেলেছে সে। তাই সাচী ফোন দিলেই,বন্ধ পাচ্ছে।
আরাদের এহেন অদ্ভুত আচরণে সাচী বেশ অবাক হলো। ফোন বন্ধ করে রাখবে কেন?
বিয়ের পরেও কয়দিন সাচী বেশ বিজি ছিলো। তাই আরাদের সাথে ওরও যোগাযোগ হয়নি। কিংবা সে সময় পায় নি। কিন্তু যখন ফোন দিলো,তখন ওর ফোন বন্ধ। অগত্যা সাচী নিজেই আরাদের বাসায় উপস্থিত। কিন্তু বাসায় এসেও,আরাদকে পেলো না। এবার সাচী চূড়ান্ত অবাক হলো। হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরন করার কি মানে থাকতে পারে?
সাচী কিছু ভেবে পেলো না। বাসার কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করাতে বললো,স্যারতো অনেক রাতে বাসায় ফিরে। সারাদিন বাসায় থাকে না। সাচী হতাশ হলো বেশ। আরাদের এমন পরিবর্তন, তাকে বেশ আহত করছে। কি এমন হলো ঐদিন?যে এতোটা বদলে গেছে?
কিংবা সাচীকে স্পষ্ট এড়িয়ে চলছে,এতে কোন সন্দেহ নেই।
তারমানে এখন ওর সাথে দেখা করতে হলে,রাতে আসতে হবে?
কিন্তু সেটাতো কেমন দেখায়। তুহিন জানতে পারলে,ভীষণ ক্ষেপে যাবে। এমনিতেই তুহিন কেন জানি আরাদের নামটায় শুনতে পারেনা। সাচী যখনি আরাদের প্রসঙ্গ আনে,তুহিন সেটা অত্যন্ত সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন,আরাদের নামটা শুনলেই তুহিনের মনে তুফান চলে।
তুহিনের এমন ওভার রিয়েক্ট করার হেতুও,সাচী বুঝতে পারেনা। তুহিন একটু বেশিই পজেসিভ। যেটা সাচীর বিরক্তিকর লাগে।
কিন্তু আরাদ কেন এমন করছে,সেটাই এখন ভাববার বিষয়।
সেদিনের গায়ে হলুদের পর,বিয়ের দিন সহসাই আরাদ চলে যায়। কেউ বলতে পারেনা। ফোন দিলে ফোন বন্ধ পায়। পরে বিরুনিকাকে ফোন দিয়ে সরি বলেছিলো,এভাবে চলে আসার জন্য। আর বলেছিলো,ওর কি জরুরী কাজ ছিলো,তাই চলে গেছে।
সবাই সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো।
কিন্তু কেউ বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ওর ভেতরে কি চলছিলো তখন,সেটা টের পায় নি। তবে একজন বোধহয় পেয়েছিলো।
বিয়ের পুরোটা সময়,সাচীকে তুহিনের সাথে দেখে আরাদের কেমন অদ্ভুত ব্যাথা হচ্ছিলো বুকে। সে জানেনা,এই অস্বাভাবিক ব্যাথার কারন। সে জানতে চাইও না। কিছু কিছু ব্যাথার মানে,জানতে নেই। জানলে ব্যাথা দ্বিগুণ বাড়ে।
বিয়ের পুরো সময়টা যতক্ষণ ছিলো, সে দমবদ্ধকর অবস্থায় অতিবাহিত করলো। একসময় না পেরে সে চলে আসলে।
সবকিছু অসহনীয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো বুঝি নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে।
সেখান থেকে সে সোজা রোহানীর কাছে গেলো। ঐ মুহুর্তে মনে হচ্ছিলো, কারো সাথে কথা বলা দরকার খুব করে। তবে একটু স্বস্থি পেতে পারে। আর সেটা রোহানী ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
সেদিন আরাদের সেই বিধ্বস্ত মুখটা দেখে,রোহানী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো পুরো। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলো সে। এতোটা বিধ্বস্ত আরাদ শেষবার হয়েছিলো,যখন ওর মা ওর বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু আজকের এই বিধ্বস্ততার কি এমন কঠিন কারন রয়েছে?
রোহানীর চোখমুখ কালো হয়ে গেলো। এক অজানা আতঙ্ক ওর মনকে গ্রাস করে ফেলছিলো। মনেপ্রাণে চাইছিলো,যেন তেমন কিছু না হয়। তবে যে জীবন্মৃত দশায় বেঁচে রইবে এই রুক্ষ,কঠিন ছেলেটা।
.

অনেক ভেবে চিন্তে, একদিন রাতেই সাচী আরাদের সাথে দেখা করতে গেলো। তবে একা নয়। তুহিনকে সাথে নিয়েই। যদিও তুহিন যারপরনাই বিরক্ত হচ্ছিলো, সাচীর এখানে আসতে চাওয়ার কারনে। তখন সাচী তুহিনকে বিষয়টা বুঝালো। যে আর একসপ্তাহ সময় আছে হাতে। এরমধ্যে শর্টফিল্মের বাকী কাজ শেষ করতে না পারলে,সে প্রতিযোগিতায় জমা দিতে পারবেনা। কিন্তু এটা ওর জন্য খুব স্পেশাল ছিলো। সাচীর জোরাজুরিতে তুহিন অবশেষে রাজি হলো বটে। তবে ওর চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি।
শুধু সাচীর মনে কষ্ট দিতে চায় না বলেই,সে আসতে রাজি হলো। ওরা দশটার দিকে আরাদের বাসায় গেলো। কিন্তু তখনো আরাদ বাসায় আসেনি। সাচী বেশ অবাক হলো। এতোরাত পর্যন্ত আরাদ বাইরে কি করে?
ঘড়ির কাঁটা যখন এগারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই, তখন আরাদ ফিরলো। তবে এসেই ড্রয়িংরুমে সাচীকে দেখে ভূত দেখার মতো, বেশ চমকে গেলো।

এতোরাতে সাচী এখানে করছে?

লোকে কি বলবে?

মেয়েটার কি মাথা খারাপ হলো নাকি!

আরাদ সব ভুলে তড়িঘড়ি করে, সাচীর সামনে গেলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করেই বললো,

” আপনি, এতোরাতে এখানে,একা? আর ইউ লস্ট অফ ইউর মাইন্ড? আরাদ প্রায় জোরে জোরেই কথাগুলো বলছিলো। তখনি আচমকা তুহিন সাচীর পিছনে এসে দাঁড়ায়। এতোক্ষণ আরাদ তুহিনকে দেখতে পায় নি,কারন এখানে ছিলো না সে। কোথায় গিয়েছিলো কে জানে।
তুহিনকে দেখে এবার আরাদ চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ সুনশান নীরবতা।
পরক্ষণেই সাচীই প্রথম কথা বললো। আরাদ তখনো দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই সাচীও সোফা থেকে উঠে,আরাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরাদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাচীর চোখের দিকে একবারের জন্যও তাকাচ্ছেনা সে। সাচী বেশ অবাক হলো তাতে।
সে নিজের বিস্ময় দমন করে,ক্ষোভ নিয়ে বললো,

” আপনার সমস্যাটা কি?
ফোন বন্ধ,খুঁজলে পাওয়া যায় না। ঐদিন বিয়ে থেকে হুঁট করে চলে আসলেন। আমার সাথে দেখা পর্যন্ত করলেন না। এসবের মানে কি?”

আরাদ তখনো নিশ্চুপ,আর মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখে সাচীর মেজাজ বিগড়ে গেলো। এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন ওর সাথে?
সাচী এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো,

” এডভান্স দেয়নি দেখে কি, কাজ শেষ না করেই কেঁটে পড়তে চাইছেন?”

কথাটা আরাদের কানে প্রবেশ করা মাত্রই,চোখগুলো জ্বলে উঠলো। আর সাচী ঠিক এ কারনেই ইচ্ছাকৃতভাবে এই কথাটা বলেছে। কিন্তু তারপরও আরাদ ওর দিকে তাকালো না। মাথা নিচু করেই বললো,সে কাজ শেষ করবে।

এতে সাচী চূড়ান্ত বিরক্ত হলো। আরাদ এমন আচরণ করছে যেন ক্লাস নাইন-টেনের পোলাপান সে,আর সাচী ভার্সিটির সিনিয়র। সে কোন অপরাধ করে ফেলেছে,আর সাচী তাকে শাসন করছে। ডিসগাস্টিং!

সাচী আর একমুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। বিড়বিড় করে বললো,ভেস্তে যাক শর্টফিল্ম। দরকার নেই এসবের। আর মুখে জোরে বলে গেলো,আরাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তাকে আর অভিনয় করতে হবে না। সহসা সাচী তুহিনের কাছে টাকা চাইলো। তুহিন বেশ অবাক হলেও,মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করলো। সে টাকাগুলো আর সাচী ওর পার্স থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে,আরাদের সামনে ধরলো। আরাদ সাচীর কাজ দেখে হতভম্ব সেজে গেলো।
কি করতে চাইছে সে?
আরাদকে সটান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,সাচী টাকাগুলো ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,

আপনার পেমেন্ট। কাজ শেষ না করলেও,পুরোটাই দিয়েছি। আমি কখনো ঋণ রাখি না। এটা বলে আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ালো না সে। আরাদ তুহিনের মুখের দিকে তাকালো,কিন্তু সেও কিছু না বলে প্রস্থান করলো।
আরাদ ওর হাতে গুঁজা টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে, বোকার মতন হাসতে লাগলো। সে হাসি না সুখের,না দুঃখের। সে হাসি ছাঁইছাপা আগুনের ন্যায় যন্ত্রণাদায়ক।

আরাদ সাচীকে বিদ্রুপ করে বললো,

যদি জানতে আমার এই অদ্ভুত বদলে যাওয়ার কারন,তবে দুনিয়ার সমস্ত অর্থ দিয়েও কি পারতে, করতে সেই শূণ্যতা পূরণ? যে শূণ্যতা হৃদয়ে বিরাজ করছে,সে যে অমূল্য সম্পদেও পূরণ হবার নয়। সে যে গোস্তাকি। আর আমি জেনেশুনেই সে গোস্তাকি করে ফেলেছি। সেই গোস্তাকি জানলে যে কবেই আরো দুই-চার ঘা দুইগালে বসাতে।

এবার একটা উদ্ভট পাগলামী করলো সে। হাতের টাকাগুলো সহ নিজেই নিজের গালে থাপ্পড় দিতে লাগলো সে। টাকাটাতেও যে তার থাপ্পড়রানীর স্পর্শ আছে। মনে হবে সেই দিচ্ছে থাপ্পড়। প্রেমে পড়লে, কত উদ্ভট ভাবনায় না ভর করে মস্তিষ্কে। মানুষ যেটা না চাই, সেটাই বোধহয় তেড়ে আসে তার কাছে। কিংবা তেড়ে আসবে দেখেই,মানুষ সেটা চায় না। জীবনের সমীকরণ গুলো অদ্ভুত!
ভীষণরকম অদ্ভুত।
যার সমাধান, আমাদের হাতে নেই।
এই পৃথিবীতে যারা কখনোই ভালোবাসবে না,প্রেমে পড়বেনা বলে পণ করে বসে থাকে,তারাই আরো উল্কার ন্যায় দ্রুতগতিতে প্রেমে পড়ে।একেবারে ভেঙেচুরে সর্বনাশা প্রেমে পতিত হয় তারা। বিধ্বস্ত হয়ে যায় ভালোবাসার আঘাতে। ক্ষতবিক্ষত হয় ভেতর-বাহির। অথচ তারা ভালোবাসা থেকে অযুত লক্ষ,নিযুত কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে থাকতে চায়তো সবসময়। যেমনটা আরাদ চেয়েছিলো।
কিন্তু এখন!

.
তবে এর মধ্যে যে আরো বড় একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিলো আরাদের জীবনে,সেটা বোধহয় আরাদ কল্পনাও করতে পারেনি। এরপর আরাদের জীবন কোনদিকে মোড় নিবে,জানেনা সে। আরাদের কাঁদার কথা,কিন্তু সে কাঁদতে পারছেনা। কেমন জানি বুকটা ব্যাথা করছে। মুহুর্তেই যেন ওর পৃথিবীটাই পাল্টে গেলো। মানুষ ঠিকই বলে,বিপদ যখন আসে,তখন সবদিক থেকে আসে। আর অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here